শনিবার, ৬ মে, ২০২৩

নিসর্গনীতি ও মার্ক্স ~ অরূপরতন হালদার

আশির দশকের তখন শেষ পর্ব। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের অধ্যাপক জন বেলামি ফস্টার একটা সন্দর্ভ লিখে ফেললেন "A Vulnerable Planet : A Short Economic History of the Environment". বিশ্ব পরিবেশের সংকট ও তার সঙ্গে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকট কিভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পৃক্ত একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে, এবং কেন বিশ্বের পরিবেশের সামগ্রিক সংকট থেকে পুঁজিবাদী অর্থনীতির সংকটকে আলাদা করা যাবেনা সেই বিষয় নিয়ে অনেকদিন ধরে ভাবছিলেন ফস্টার। প্রায় একই সময়ে American Journal of Sociology তে তিনি কার্ল মার্ক্সের "Metabolic Rift" বা "বিপাকীয় বিভাজন" তত্ত্ব নিয়ে আলোচনা করেন যা পরিবেশের সংকট ও পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মধ্যে সম্পর্কের মাঝখানে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আলো ফেলতে সক্ষম হয়। 

এখন Metabolic Rift বা বিপাকীয় বিভাজন বলতে মার্ক্স ঠিক কি বুঝিয়েছিলেন সেটা দেখা নেওয়া যেতে পারে। মার্ক্স পরিবেশগত সংকট নিয়ে যখন চিন্তা শুরু করেন তখন তাঁর মনে হয়েছিল যে এই সংকটের মূল কারণ হল সামাজিক বিপাকীয় প্রক্রিয়াগুলোর মধ্যে যে পারস্পরিকভাবে নির্ভরশীল প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে তাদের মধ্যে এক বিভাজন যা নিরাময়েযোগ্য অবস্থায় নেই। মানবসম্পদ ও প্রকৃতির বাকি জৈব ও অজৈব উপাদানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্কীয় একটা
ফাটল যা প্রধানত পুঁজিবাদী কৃষি অর্থনীতি যেখানে কৃষিকে মুনাফাভিত্তিক একটা ব্যবস্থায় পরিণত করার জন্য পুঁজিবাদী প্রক্রিয়া মূলত দায়ী হয়ে ওঠে আর সেইসঙ্গে শহর ও গ্রামের ক্রমবর্ধমান বিভাজন একে সঙ্গত করে। Economic and Philosophical Manuscripts এ মার্ক্স তাঁর এই যুগান্তকারী চিন্তা লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এখানে মার্ক্স খুব স্পষ্টভাবে নির্দেশ করেছেন তাঁর সমকালীন যুগ থেকে বহু অগ্রবর্তী সেই ধারণা যেখানে তিনি উল্লেখ করছেন Metabolism বা বিপাক অর্থাৎ যেখানে মানুষ প্রকৃতিকে ব্যবহার করে নিজের পুষ্টিসাধন করছে তার প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই সে প্রকৃতি থেকে ক্রমশই বিচ্ছিন্ন হচ্ছে। মার্ক্সকে যাঁরা মূলত রাজনৈতিক অর্থনীতি ও বিপ্লবী মতবাদের প্রবক্তা ছাড়া আর কিছু ভাবতে পারেননি তাঁদের ভুল প্রমাণিত করে মার্ক্স তাঁর অন্তর্দৃষ্টির এক বিস্ময়কর বিস্তারে ধরে ফেলেছিলেন সেই সংকট যা এই মুহূর্তে পৃথিবীর সবচেয়ে বড়ো সংকট হিসাবে আমাদের অস্তিত্বকে প্রশ্নচিহ্নের সামনে ফেলে দিয়েছে। 

১৮১৫ থেকে ১৮৮০ সালের মধ্যে ঘটে যাওয়া ইংল্যান্ডের কৃষি বিপ্লবকে মার্ক্স গভীরভাবে অধ্যয়ন করেন। সেইসময় এই কৃষি বিপ্লবের সঙ্গে সঙ্গেই মাটির রসায়নতত্ত্বের বিস্তার হয় ও রাসায়নিক সার নিয়ে বিশেষজ্ঞদের মধ্যে চিন্তা শুরু হয়। ফসলের উৎপাদন বাড়াবার জন্য রাসায়নিক সারের প্রয়োগ কিভাবে মাটির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে দিচ্ছে সেই বিষয়ে মার্ক্স সবিশেষ অধ্যয়ন করেন ও পরিস্থিতি সম্বন্ধে সচেতন হয়ে ওঠেন। 
পরে জার্মান কৃষিবিজ্ঞানি ভন লিবিগের গবেষণা মার্ক্সকে গভীরভাবে আকর্ষণ করে যেখানে লিবিগ পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করে দেখিয়েছিলেন কিভাবে নগরায়ন এবং তার সংস্কৃতি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রকৃতিতে আপন ধারণক্ষমতা বজায় রাখা কৃষির ব্যবস্থাকে ক্রমশ ধ্বংস করে ফেলে এবং গ্রাম ও শহরের মধ্যে মূলত কৃষি উৎপাদনকে কেন্দ্র করে একটা পারস্পরিক বিভাজনরেখা ক্রমশ রূপ নিতে থাকে। ভন লিবিগ গবেষণা করে তথ্য দিয়ে দেখিছিলেন যে যদি কোনো একটা জনসংখ্যার সমগ্র জনসমুদয়ের জৈব বর্জ্য সঠিকভাবে সংরক্ষণ করে কৃষি জমিতে সার হিসাবে ব্যবহার করা যায় তাহলে বর্ধিত জনসংখ্যার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই জমি থেকে বর্ধিত উৎপাদন পাওয়া সম্ভব একটুও রাসায়নিক সার ব্যবহার না করে। এই তথ্যে মার্ক্স চমৎকৃত হন। 
এই সঙ্গে মার্ক্স তাঁর শ্রম সম্পর্কিত তত্ত্ব ব্যবহার করে বুঝতে পারলেন যে সমগ্র ইতিহাস জুড়ে মানুষ প্রকৃতিকে তার নিজের প্রয়োজনে ব্যবহার করেছে মূলত তার শ্রমের ক্রমিক বিবর্তনের মাধ্যমে। ইতিহাসের বস্তুবাদী ধারণার প্রয়োগ ঘটিয়ে মার্ক্স এই সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন যে মাটির উৎপাদনক্ষমতা কোনো প্রাকৃতিক বিষয় নয়। বরং সময়ের সঙ্গে সমাজের যে লম্বা জটিল সম্পর্ক তার দ্বারা এই বিষয় নির্ধারিত হয়। 

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ক্রমোত্থানের ও নগরায়নের অনিবার্য পরিণতি হয়ে দাঁড়ালো গ্রাম থেকে শিল্পোৎপাদনের অঞ্চলগুলোতে বিপুল পরিমাণ কাঁচামাল ও খাদ্যের সরবরাহ। এর ফলে মার্ক্সের ভাষায় গ্রামসম্পদ শহরের দিকে প্রবাহিত হল, এবং সেইসঙ্গে গ্রামের জমির উৎপাদনশীলতাকে  ধারণক্ষমতার প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে ব্যাহত করে ক্রমাগত ধ্বংস করা হল। সেইসঙ্গে শিল্পের বর্জ্যকে সঠিকভাবে ব্যবহার না করে তা মাটিতে ফেলে সেখান দিয়েও মাটির উৎপাদনশীলতা কমিয়ে ফেলা হল। মার্ক্স তাঁর "পুঁজি" গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে "বৃহৎ আকারের শিল্প ও কৃষি" অধ্যায়ে লিখছেন ঃ " পুঁজিবাদী উৎপাদন-প্রক্রিয়া বিরাট এক জনসমুদয়কে আরও বৃহত্তর উৎপাদন কেন্দ্রের দিকে আকর্ষিত করে নিয়ে যায়, যার ফলে শহরের অধিবাসীদের হাতেই পুরো ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ অধিকতর কেন্দ্রীভূত হয়। এর দুটি ফলাফল। প্রথমত এর ফলে ঐতিহাসিকভাবে সমাজের সঞ্চালক শক্তির এক ধরণের কেন্দ্রীভবন ঘটে, অন্যদিকে মনুষ্যপ্রজাতি ও পৃথিবীর মধ্যে পারস্পরিক যে বিপাকীয় (পৃথিবীর সম্পদ আপন প্রয়োজনে ব্যবহার) সম্পর্ক রয়েছে তাকে গভীরভাবে ব্যাহত করে। অর্থাৎ এই ঘটনা মাটিতে সেই মৌলিক উপাদানগুলো ফিরে আসতে বাধা দেয় যা মানুষ খাদ্য এবং বস্ত্র হিসাবে মাটি থেকে বিভিন্ন উৎপাদনের মধ্যে দিয়ে ব্যবহার করেছিল। এইভাবে এই ঘটনা মাটির প্রাকৃতিক উর্বরতা বজায় রাখার একটা অনন্ত প্রক্রিয়াকে বাধা দেয়... আর এটা ঘটে এই বিপাকীয় সম্পর্কগুলোর পারিপার্শ্বিক অবস্থাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে।...পুঁজিবাদী কৃষি ব্যবস্থার যাবতীয় প্রগতি সবই হয়েছে কেবল কৃৎকৌশলগত প্রগতি যা শুধু কৃষি-শ্রমিককেই লুঠ করেনা, লুঠ করে জমির উর্বরতাকেও। একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জমির উর্বরতা বৃদ্ধির যাবতীয় পদ্ধতি শেষ পর্যন্ত  সামগ্রিকভাবে জমির উর্বরতার সমস্ত উৎসকে নষ্ট করে ফেলে...পুঁজিবাদী উৎপাদন প্রক্রিয়া শেষ পর্যন্ত শুধুমাত্র প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন এবং উৎপাদনের সামাজিক পদ্ধতির উন্নতিসাধন করে, কিন্তু একই সঙ্গে মাটি এবং কৃষি-শ্রমিকের যা প্রধান সম্পদ অর্থাৎ উৎপাদনশীলতাকে ধ্বংস করে।"

কবে ভাবছেন মার্ক্স এইসব কথা? ১৮৬৭ সাল। তার "পুঁজি" গ্রন্থের প্রথম খণ্ড লেখার সময়। তারপর দেড় শতকেরও বেশি অতিক্রান্ত হয়ে গেছে। এই সংকট ক্রমাগত ঘনীভূত হয়েছে। সে আজ আরও জটিলতার আবর্তে। জটিলতর হয়েছে পুঁজির বহুমাত্রিক কেন্দ্রীভবন। আরও বেশি মুনাফার আশায় এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে "কৃষি বিপ্লব" করতে গিয়ে আরও গভীর সংকটের ভেতর ঘুরপাক খাচ্ছে গোটা দুনিয়া। সেইসঙ্গে বিশ্ব-উষ্ণায়ন এক সার্বিক ভয়াবহতার সামনে দাঁড় করিয়েছে আমাদের।

২০০০ সালে বেলামি ফস্টার মার্ক্সের নিসর্গনীতি নিয়ে প্রকাশ করেছেন তাঁর বিখ্যাত বই "Marx's Ecology".  এই বইতে তিনি সাম্প্রতিক পরিবেশগত সংকট নিয়ে আরও গভীরে গেছেন, এবং এপিকিউরাস, ডারউইন, ফয়েরবাখ ও আরও অন্যান্য দার্শনিকদের মতবাদের সঙ্গে মার্ক্সের নিসর্গতত্ত্ব আলোচনা করে সাম্প্রতিক পুঁজির বহুমাত্রিকতা ও বিস্তারের পরিপ্রেক্ষিতে আরও ধারণক্ষমতাসম্পন্ন একটা তত্ত্বে পৌঁছাতে চেয়েছেন।  

মার্ক্স তাঁর "বিপাকীয় বিভাজন" তত্ত্ব নিয়ে আলোচনায় সবশেষে যে সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন সেই সমাজব্যবস্থা ছাড়া যে এই শিকড়ব্যাপী সংকটের মূল ধরে নাড়া দেওয়া যাবেনা সেই বিশ্বাস ব্যক্ত করেছেন। তিনি সেই ঐতিহাসিক পরিবর্তনের কথা বলেছেন যেখানে তিনি মনে করেছেন প্রকৃতির সঙ্গে মানবজাতির বিপাকীয় সম্পর্কটিকে পুনরুদ্ধার করতে গেলে সেই সম্পর্কটিকে প্রকৃতির শক্তি ও স্বাভাবিকতা  দিয়েই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। অর্থাৎ মার্ক্স ফিরতে চাইছেন একেবারে গোড়ায়। সেটা মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সব সম্পর্কের মৌলিক উদ্ধার। তিনি পরিষ্কার বলছেন এই কাজ বর্তমান সমাজব্যবস্থায় সম্ভব নয়। তার জন্য চাই মুক্ত উৎপাদকদের এক সমাজ যেখানে সবাই পরস্পরের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে প্রাকৃতিক সম্পর্কের স্বাভাবিক নিরিখে। এই সমাজ নিয়ন্ত্রিত হবে একমাত্র সমষ্টিগত স্বার্থে, কোনো বাজারী সম্পর্কের অন্ধ ক্ষমতার স্বার্থে নয়। 
কিন্তু মার্ক্স কখনো মনে করেননি যে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলেই এই সমস্যার স্বাভাবিক সমাধান ঘটবে। তিনি স্পষ্ট করেছেন এই বলে যে গ্রাম ও শহরের মধ্যে বিভাজন কমিয়ে এনে ও শ্রমের যে বিভাজন চালু আছে তাকে বৈজ্ঞানিকভাবে ও মানবিকভাবে একটা সুষ্ঠু পরিকল্পনার মাধ্যমে সুস্থ পরিকাঠামোয় রূপান্তরিত করে শেষ পর্যন্ত মাটির উর্বরতাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব। 

তাঁর এই চিন্তার বিস্তার ঘটেছে পরবর্তীকালে নিসর্গনীতির আর এক শাখায় যেখানে সমাজতান্ত্রিক নিসর্গনীতি নামে জ্ঞানচর্চার নতুন শাখা নিয়ে কাজ করেছেন বহু নিসর্গবিদ ও সমাজতাত্ত্বিক। এঁদের মধ্যে জাপানি দার্শনিক ও নিসর্গবিদ কোহেই সাইতো উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন, এবং এখনো করে চলেছেন। 

০৫/০৫/২০২৩

কার্ল মার্ক্সের ২০৬ তম জন্মদিন আজ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন