সোমবার, ৮ মে, ২০২৩

রবীন্দ্রনাথ , বুর্জোয়া কবি ; এবং... ~ রাজদীপ বিশ্বাস রুদ্র

ফি বছর ২৫ শে বৈশাখ এলেই একটি অভিযোগ খুব উঠতে দেখি ইদানীং ― " কমিউনিস্টরা তো রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া কবি বলেছিলো "! অভিযোগটি মূলত আসে তাদের দিক থেকে যারা স্কুল সিলেবাস থেকে রবীন্দ্রনাথ এবং ডারউইনকে ছেঁটে ফেলেছে। অভিযোগের উত্তরে বামপন্থীরা যুক্তি দেন - ওই মূল্যায়ন সিপিআই নেতা, প্রাবন্ধিক ভবানী সেনের ব্যক্তি মূল্যায়ন। ভবানী সেনের ব্যক্তি মূল্যায়ন কমিউনিস্ট পার্টির দলগত মূল্যায়ন ছিল না। মজা হলো, পক্ষ এবং বিপক্ষের লোকজন যদি একটু তথ্যনিষ্ঠ হতেন, যদি তারা জানতে চেষ্টা করতেন নিজের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের আত্ম মতামতটি ঠিক কি ছিল, তাহলে তারা একটি আশ্চর্য তথ্যের খোঁজ পেতে পারতেন। তারা দেখতে পেতেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ নিজেই নিজেকে বলতেন - " জাত - বুর্জোয়া "!  

সাহিত্যকে শ্রেণী দৃষ্টিতে বিচার করার বিষয়টি রবীন্দ্রনাথের পছন্দ ছিল না। সাহিত্য বিচারে ভাব এবং অন্তরের সম্পদকেই রবীন্দ্রনাথ বিবেচ্য মনে করতেন। সেই প্রসঙ্গেই ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন - ময়মনসিংহগীতিকা পড়ে তিনি খুবই আনন্দ পেয়েছেন। শ্রেণী বিচারে ময়মনসিংহগীতিকা হয়ত প্রলেতারিয়েত। আর তিনি নিজে জাত - বুর্জোয়া। তাতে গ্রন্থটির রসাস্বাদনে তার কোন অসুবিধা হয়নি। স্পষ্টতই বোঝা যায়, নিজের শ্রেণী অবস্থান সম্পর্কে কতটা অকপট ছিলেন, কতটা স্বচ্ছ ধারণা রাখতেন রবীন্দ্রনাথ। 

বুর্জোয়া শব্দটি যে গালাগালি নয়, ওইটি যে একটি শ্রেণীগত অবস্থানবাচক শব্দ, তা তথাকথিত রবীন্দ্র অনুরাগী দক্ষিনপন্থীরা না বুঝলেও, রবীন্দ্রনাথ বুঝতেন। নিজের সম্পর্কে " জাত বুর্জোয়া " বিশেষণ ব্যবহারে তাই কোনও কুন্ঠা ছিল না তার। নিজের শ্রেণীগত অবস্থান সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলেই হয়ত তার পক্ষে শ্রেণীগত অবস্থানের উর্ধ্বে ওঠার প্রচেষ্টা সম্ভব হয়েছিল। তার কৃষি সমবায় গঠনের প্রচেষ্টা, সোভিয়েত প্রীতি, সোভিয়েত ব্যবস্থার প্রতি তার অকুন্ঠ সমর্থন মোটেই কাকতালীয় নয়।

রবীন্দ্রনাথকে " বুর্জোয়া কবি " বললে কি তার সৃষ্টিকে অপমান করা হয়? মোটেই না। বরং উল্টো। লেনিন প্রলেতারিয় সংস্কৃতি প্রসঙ্গে লিখেছেন - প্রলেতারিয় সংস্কৃতি আকাশ থেকে পড়বে না, বাতাস থেকেও তৈরী হবে না। বুর্জোয়া সংস্কৃতির যা কিছু বৈপ্লবিক,যা কিছু মহান, তার প্রকৃত উত্তরসূরি হয়ে উঠতে হবে প্রলেতারিয়েতকে। একমাত্র এভাবেই প্রলেতারিয়েতের পক্ষে নিজস্ব সংস্কৃতির নির্মান সম্ভব। 

সোভিয়েতে  পুশকিন, গোগোল, টলস্টয়, চেকভ বর্জিত হননি। তারাও সামন্ত অথবা বুর্জোয়াই ছিলেন। কেউই প্রলেতারিয়েত বা কমিউনিস্ট ছিলেন না। তাদের শ্রেণীগত অবস্থান গোপন না করেই সোভিয়েত কমিউনিস্টরা তাদের সৃষ্টিকে ধারণ করেছেন। তাদের সাহিত্যগত ঐতিহ্যের উত্তরসূরি হয়েই তারপর নির্মিত হয়েছে - সোভিয়েত সাহিত্য।

ছবি : অমিয় চক্রবর্তীকে লেখা রবীন্দ্রনাথের চিঠিটি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন