মায়ের সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে চাপতে বড় ভালো লাগত। চালকের আসনে বসা মাকে ঘিরে এক প্রবল বিস্ময়বোধ তৈরি হত। মায়ের অনায়াস ভঙ্গিতে যৌথ পরিবারের বিরাট হেসেলে রান্না করা, রান্না করতে করতে নির্ভুল সুরে গান করা, সারা দিনের শেষে রাতের বেলা পিঠে অসংখ্য মশার কামড় সহ্য করেও হঠাত হঠাত ছবি আঁকার ধুম, অথবা দম বন্ধ করা গরমে হঠাতই ফ্যান নিভিয়ে হ্যারিকেনের আলোয় বাটিক করা সবই মুগ্ধ করত। কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ করত ছুটিতে শান্তিনিকেতনে গিয়ে খোয়াই এর উঁচু নিচু অগ্রাহ্য করে সাইকেলের পিছনে আমাকে নিয়ে ঘোরা। মাকে মনে হত শিশু পুত্র পিঠে নিয়ে রনাঙ্গণে সাক্ষাত লক্ষ্মীবাঈ। আর যেতামও তো নানান অভিযানে। মা সাইকেল চালাতে চালাতে তার পুরো দস্তুর শহুরে মেয়েটাকে চেনাতো মুচকুন্দ ফুলের গন্ধ, বনপুলকের ঝোপ, চেনাত তক্ষকের ডাক, লালমাটির প্রান্তরে ছড়িয়ে থাকা তাল গাছের সারি আর নিয়ে যেত সব আজব লোকের বাড়িতে, যাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মায়ের মাস্টারমশাই। মনে আছে একবার গৌরীদি (গৌরী ভঞ্জ, নন্দলাল বসুর মেয়ে)র বাড়ি গিয়ে দেখি তিনি ব্যস্ত হয়ে হরতকি ফুটিয়ে রং বের করছেন, যেতাম সোমনাথ হোরের বাড়ি বা স্টুডিওতেও। সেখানে ছড়ানো কাগজে কত ছাগলের স্কেচ। এভাবেই যেতাম দিনকর কৌশিকের বাড়ি, অনেক কাল বাদে জেনেছিলাম তিনি বাঙালি নন। তবে মায়ের আরেক মাস্টারের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার সময়ে অনেকেই আপত্তি করতেন, বলতেন, বাচ্চাটাকে নিয়ে যাস না। কিন্তু আমি বুঝতাম না কেন এত আপত্তি। তাঁকে দেখতে ছিল ঘুব সাদামাটা, গালে না-কাটা দাড়ি, খালি গায়ে লুঙ্গি পরে থাকতেন। তিনি রামকিঙ্কর। মায়েরা ডাকতেন কিঙ্কর দা। তাঁর করা মুর্তি দেখতাম শান্তিনিকেতন জুড়ে, কলের ডাক, হাটুরে। আমার সব থেকে ভালো লাগত ইউক্যালিপ্টাসের ভিড়ে হারিয়ে যাওয়া দীর্ঘ দেহী সুজাতাকে।
তাঁর বাড়ি যখন যেতাম, তখন সন্দেহ হত, ইনিই কি সেই শিল্পী? ঘরটা মায়ের অন্যান্য মাস্টারমশাইদের বাড়ি থেকে যেন কিছুটা বেশি নোংরা থাকত। তার মাঝেই বসে থাকতেন বৃদ্ধ কিঙ্করদা। বাড়িতে অনেক বেড়াল ছিল। বেড়ালের গন্ধ উঠত আরো অনেক অপরিচিত গন্ধের সঙ্গে। মা এলেই খুব জোরে 'আয় আয়' বলে হাঁক ছাড়তেন। প্রণাম নিতেন না, জড়িয়ে ধরে বলতেন, 'বাইরে চল, গান গাইবি।' এদিক ওদিক ছড়ানো মাটি পাথরের দাওয়ায় মোড়া পেতে বসতাম আমরা। মা গাইত। যে গানই গাক না কেন মুগ্ধ হয়ে শুনতেন, শেষে বলতেন, 'আর সেইটা? সেইটা গাইবি না?' মা যেন জানত। হেসে গান ধরত, 'বহু যুগের ওপার হতে আষাঢ় এলো'। ঘোর শীত বা গরমেও এই গানটাই শুনতে চাইতেন বারবার। আর গান শেষ হলে আমার দিকে তাকিয়ে প্রতিবারই একটাই গল্প বলতেন- 'তোমার মা জানো, একবার একটা ছবি একেছিল, অগ্নিশিখা ফুলের। তুমি দেখেছ অগ্নিশিখা?' আমি মাথা নাড়তাম। শান্তিনিকেতনে মা এই ফুলটা আর খুঁজে পায়না, তাই আর দেখায়ও নি। কিন্তু যে গল্পটা বলতেন, সে গল্পটা আমার জানা। মা তখন কলাভবনে সবে মাত্র ঢুকেছে। নেচার স্টাডির ক্লাসে দেওয়া হয়েছে ফ্লাওয়ার স্টাডি। মার ফ্লাওয়ার স্টাডির জন্য কোনো ফুলই পছন্দ হয়না। হঠাত একদিন ঝোপঝাড়ের মাঝে আবিষ্কার করে এক অদ্ভূত দর্শন ফুল- অগ্নিশিখা। এঁকে ফেলে সেই অগ্নিশিখাকেই। অদ্ভুত তার আকার আর অপূর্ব তার রঙ। এর কদিন বাদেই বাড়িতে হঠাত সশরীরে উপস্থিত কিঙ্করদা, রাম কিঙ্কর বেইজ। মাকে বললেন, 'দেখা দেখি কী এঁকেছিস? সবাই এত বলছে কেন?' মা ভয়ে ভয়ে দেখিয়েছিলেন ছবিটা। সস্নেহে বলেছিলেন, 'এত ফুল থাকতে তোর এই ফুলটাই কেন ভাল লাগল রে বেটি?' মায়ের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যেত। মা কেন এঁকেছিল সেই অগ্নিশিখা তা যেন কোন দিন ভাল করে বোঝাতে পারেনি কিঙ্করদাকে। তাই সেই গল্পের শেষেও কিঙ্করদা একই প্রশ্ন করতেন, কেন এঁকেছিলি রে অগ্নিশিখা?
মা যখন আমাকে এই গল্পটা বলত, আমি জিজ্ঞেস করতাম,' কিঙ্করদা তোমাদের কী শেখাতেন মা?' মা হেসে বলত 'স্কাল্পচার, ভাস্কর্য। কিন্তু ক্লাসে আমাদের কিছু শেখাতেন না, আমরা স্টুডিওতে কাজ করলেও বাইরে ডেকে আনতেন, বলতেন দেখ, দেখ বাইরেটা দেখ… কী হবে মুর্তি গড়ে… ওই মুর্তিকারের কাছে আমরা সবাই …। বলে বুড়ো আঙ্গুল তুলে কলা দেখাতেন।' আকাশে মেঘ জমলেই ডাক পড়ত মায়ের। হেকে বলতেন,' আয়… গান ধর … বহু যুগের ওপার হতে…।' মালবিকা অনিমিখে এলেই উনিও গলা মেলাতেন। মা বলত, খুব আনন্দ করে গাইতাম ঠিকই কিন্তু কিঙ্করদার ক্লাসের শেষে সাবমিশনের সময়ে বুক ঢিপঢিপ করত। কাজ তো হয়নি কিছুই। ধরে বেধে নিয়ে আসতাম কিঙ্করদাকে। স্টুডিওতে । আমাদের কাজ দেখে হাহা করে হাসতেন, মাঝে মাঝে হাতের চাপড়ে ভেঙ্গে দিতেন আমাদের বহুদিন ধরে যত্নে গড়া মুর্তিগুলো। মায়ের একবার প্রায় শেষ একটা মুর্তি এভাবে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। মায়ের খুব রাগ হয়েছিল। মা বলে সেদিন সন্ধেবেলায় সেই বনপুলকের মাঝে কিঙ্করদার আড্ডায় সেদিন যখন সবাই গান ধরেছে, মা নাকি চুপ করেই বসেছিল ভারাক্রান্ত মনে। হঠাত কিঙ্করদার নজরে পড়ে মাকে। বলেন, কি রে, চুপ কেন? তোর মুর্তি ভেঙে দিলাম বলে? আমরা কি আর নিটোল মানুষ রে …। আমরা হলাম কাঁকরের দেশের মানুষ, তাদের কি ভেঙ্গে পড়লে চলে? মা বলেছিল, ঠিক সেই সময়েই আমার চোখ গেল চাঁদের আলোয় ভাসা প্রাঙ্গণে আমাদের কাঁকুড়ে মাটিতে পড়া এবড়ো খেবড়ো ছায়ার দিকে। মনে হল, সত্যি আমার মুর্তি ছিল অনেক নিটোল, এমন এবড়ো খেবড়ো মাটিতে বেমানান। পরদিন ফের শুরু করলাম কাজ। এবার যে মুর্তি হল, কিঙ্কর দা ভাংলেন না, সোমনাথদা কে ডেকে বললেন, দেখো, কেমন কাজ করে এই মেয়েটা।
কিঙ্করদার নানা গল্প শুনতাম শান্তিনিকেতনে মাদের বন্ধুদের কাছে। রিক্সোতে উঠেই নাকি রিক্সোওয়ালাকে দশ টাকা দিয়ে দিতেন। তারপর ছেলেমানুষের মত তাঁর বায়না শুরু হত, আমায় তেলেভাজা খাওয়া, আমায় ফুল কিনে দে, আমার ঐ টুপিটা চাই। এই ভাবেই যেতেন। যদি সে সওদার শেষে রিক্সোওয়ালার কিছু বাঁচত, তাহলে সে যাই বাঁচুক তার, আর লোকসান হলেও তার।
শুনেছিলাম, বাইরের রাজনীতির খবর কিঙ্করদা বড় একটা রাখতেন না। কংগ্রেসের ভোটের প্রতীক জোড়া বলদ থেকে যখন গাই-বাছুর হল, তখন নাকি তিনি বুথ থেকে ব্যালট হাতে বেরিয়ে এসে চেঁচামিচি জোড়েন, আমার জোড়া বলদ কোথায় গেল? আমি ভোট দেব না। অনেক বামপন্থীর মতে অবশ্য সেটা তিনি সজ্ঞানেই করেছিলেন, কারণ তিনি সেবার কংগ্রেসকে ভোট দিতে চাননি।
শুনতাম তা সত্তেও ইন্দিরা গান্ধী নাকি কিঙ্করদাকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতেন। মায়ের বন্ধু মইনূল মামার কাছে অবশ্য শুনেছিলাম এমারজেন্সির সময়ে বা একটু পরে কোনও একটা প্রদর্শনী উদ্ভোধনের সময়ে ইন্দিরা গান্ধীর পাশে দাঁড়ানো কিঙ্করদা হঠাতই প্রধানমন্ত্রীর নাক টিপে ধরেন। দেহরক্ষীরা ছুটে এলে কিঙ্করদা নির্বিকার চিত্তে বলেন, ভয় লাগছিল, ওর নাকে আগুন লেগে যেতে পারে। এ রকম সব ঘটনা কিঙ্করদাই পারতেন, তা তালে না বেতালে কেউ জানত না।
শেষ বার মা যখন পি জি হাসপাতালে দেখা করতে গেছে, আমি সঙ্গে ছিলাম। মা মাথায় হাত রাখাতে চোখ মেললেন। বোধহয় চেষ্টা করলেন নামটা মনে করতে। তারপর, এক অপার্থিব গলায় বললেন, গা … মালবিকা অনিমিখে / চেয়েছিল পথের দিকে…।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন