চারটি শ্রম কোড কেন বাতিল করতে হবে
বিজেপি-পরিচালিত এনডিএ সরকার ২৯টি শ্রম আইনকে চারটি লেবার কোডে পরিণত করে সংসদে পাশ করেছে। এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তার কারণ বিধি (rules) তৈরি হয়নি। বিধি তৈরি না হলে কোনো আইন লাগু করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের তিনটি রাজ্য বাদ দিয়ে সব রাজ্যই ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করেছে। এ বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তর ঘোষণা করেছিল, পয়লা এপ্রিল ২০২৫ থেকে সারা দেশে শ্রম কোড লাগু করা হবে। শেষ অবধি তা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সারা ভারতে যখন শ্রম কোড চালু হবে, তখন পশ্চিমবঙ্গেও কি আইন লাগু হবে? হ্যাঁ হবে, কারণ শ্রম যে হেতু যুগ্ম তালিকাভুক্ত, তাই কেন্দ্রীয় সরকার নোটিফিকেশন জারি করতে পারে যে, যে রাজ্যগুলি বিধি তৈরি করেনি, সেগুলিতেও কেন্দ্রীয় বিধি লাগু হবে।
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন ও চারটি শ্রম কোড লোক সভায় বিল আকারে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বার কৃষক আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শ্রম কোডের বিরুদ্ধে গোটা দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন যে প্রতিবাদ করেনি, এমনটা নয়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধার অনেক কম ছিল। শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার জন্যই আজ গোটা দেশে শ্রম কোড লাগু হতে চলেছে।
প্রশ্ন আসে, বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে যে শ্রম আইন এসেছিল, তার সাথে এই চারটি শ্রম কোডের পার্থক্যটা কী? এ যাবৎ কালে যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শ্রম আইন এসেছিল, তার প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই চারটি শ্রম কোড ভিন্ন ভিন্ন আইনকে একটা সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাই প্রতিটা আইনের যে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যগুলি ছিল, সেগুলি তুলে নেওয়া হয়েছে। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ১৯৭০ সালে যখন 'কন্ট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন)' আইন আসে, তার উদ্দেশ্য ছিল ঠিকা শ্রমিকদের কাজের নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করা, ও ঠিকা প্রথার অবসান ঘটানো। যদিও ঐ আইনে ঠিকা শ্রম নির্মূল করা বা 'অ্যাবোলিশন'-এর কোনো কথা লেখা হয়নি, তবু এই উদ্দেশ্যে আইনটি তৈরি হয়েছিল। এ বারে 'অক্যুপেশনাল সেফটি, হেল্থ এবং ওয়ার্কিং কনডিশন' ২০২০ নামক শ্রম কোডটিতে ঠিকা শ্রমিকের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হোলো। ফলে ঠিকা শ্রমিকদের জন্য ১৯৭০ সালে প্রণীত মূল আইনটির তাৎপর্যই হারিয়ে গেল। আমরা দেখি, এই কোডের বিষয়টির 'উদ্দেশ্য' হিসেবে লেখা রয়েছে, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঠিকা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যার জন্য আইনে ঠিকাদারদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, প্রধান নিয়োগকারীকে সময়মতো মজুরি মেটাতে, এবং অন্যান্য সুবিধা ঠিকা শ্রমিকদের দিতে বাধ্য করা হয়েছিল — সে সব কিছুই আর নতুন আইনে নেই।
আমরা যদি চারটি শ্রম কোড খুঁটিয়ে পড়ি, তা হলে দেখব যে এই কোডগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে টুকরো টুকরো মানুষে পরিবর্তিত করা। পুঁজিবাদের শুরুর পর্যায়ে শ্রমিক ছিল 'ক্লাস ইন ইটসেল্ফ' — 'শ্রমিক' একটি শ্রেণি-পরিচয়। কিন্তু ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা 'ক্লাস ফর ইট সেল্ফ' (নিজেদের জন্য নির্মিত শ্রেণি, স্বরচিত পরিচয়) অবস্থানে পৌঁছয়। লেবার কোডে এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকরা সেই 'শ্রেণি' সত্বা হারিয়ে ফেলবে, কেবল 'ব্যক্তি' সত্বায় পরিণত হবে। অর্থাৎ পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না।
দ্বিতীয়ত, শ্রম কোড এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক- ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন) অ্যাক্টে ২০জন শ্রমিক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করলে আইনি অধিকার পেতো। শ্রম কোডে সংখ্যাটা ৫০ করে দেওয়া হয়েছে।ফলে একজন কন্ট্রাকটর ৪৯জন শ্রমিককে নিয়ে কাজ করলে আইন তাকে ছুঁতেও পারবে না। আর বিভিন্ন কোম্পানিতে ঠিকা শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত হয় এবং কাজ করে, সেই সংখ্যাটা মাত্রাতিরিক্ত হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নানান ধরনের ঠিকাদারকে নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একজনই ঠিকাদার সব ধরনের কাজ করেন, এমন নয়। কাজ এমন টুকরো টুকরো করে দেওয়ার ফলে, একজন ঠিকাদার ৫০জনের বেশি ঠিকা শ্রমিককে নিয়োগ করবেন, সে সম্ভাবনা কতটুকু? সুতরাং নতুন লেবার কোডে বেশির ভাগ ঠিকা কর্মীকে শ্রম আইনের বাইরেও নিয়ে আসা হলো। ফলত কন্ট্রাকটর কিংবা মূল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর যথেষ্ট আক্রমণের চেষ্টা করবে।
এই শ্রম কোডগুলিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার, অর্থাৎ ধর্মঘট করার অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহালের বিষয়টিও। কারখানায় স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার যে অধিকার শ্রমিকের ছিল, তা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু ঠিকা শ্রমিক নয়, অন্য একটা বিরাট অংশের শ্রমিককেও লেবার আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই শ্রমকোডে 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞাও পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এত দিন আইনি সংজ্ঞা ছিল, 'যে প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলে অন্তত ১০জন শ্রমিক কাজ করে, অথবা বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করে, তা 'ফ্যাক্টরি' বা কারখানার মর্যাদা পাবে। এবং এই আইনের সুবিধা পাবে। কিন্তু শ্রম কোডে শ্রমিক সংখ্যা পূর্বের আইনের দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করলে তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে। আর বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৪০জন শ্রমিক কাজ করতে হবে। যে হেতু ভারতে অধিকাংশ কারখানা খুব কম শ্রমিক নিয়ে কাজ করে, তাই আইনে পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের কোনো আইনি সুবিধা থাকবে না। তাদের শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাবে শ্রম কোড। এই কোড শ্রমিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রেণির পরিবর্তে অগুনতি টুকরো টুকরো মানুষে পরিণত করবে। এ হল সংগ্রাম ও সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই কোড বাতিলের লড়াই ছাড়া, অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
যে চারটি শ্রমিক কোড আইনে রূপান্তরিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০' — শিল্পে শ্রমিক নিযুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন, নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে বিবাদ সম্পর্কিত আইন। এ বিষয়ে তিনটি পূর্বতন আইন ছিল 'দ্য ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬', 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার্স' অ্যাক্ট, ১৯৪৬', এবং 'দ্য ইন্ডায়স্ট্রিয়াল ডিসপিউটস, ১৯৪৭।' এই কোডে একটি শব্দ সংযোজিত হয়েছে, 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট।' এতে লেখা হয়েছে, একজন শ্রমিক তার মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের পরে (সেটা কয়েক মাস বা কয়েক বছর হতে পারে) তাকে আবার চুক্তি করতে হবে। অর্থাৎ ধারাবাহিক ভাবে কাজের সুযোগকে খর্ব করা হল, চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদী নিয়োগকে আইনত বৈধ করা হল।
নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মরসুমি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ঢোকায়, সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ২০১৮ সালে বস্ত্রশিল্পের জন্য এর 'গেজেট নোটিফিকেশন' জারি হয়। লেবার কোডে শিল্পের সমস্ত বিভাগে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এটা করতে এই সরকার এতটাই বদ্ধপরিকর যে গ্র্যাচুয়িটি আইনেরও পরিবর্তন করেছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টের চুক্তি করলে এক বছরে গ্র্যাচুইটি পাবেন শ্রমিক। সরকারি ভাবে গ্র্যাচুইটি পাবার নিয়ম হল, অন্তত পাঁচ বছর কাজ করলে গ্র্যাচুইটি পাওয়া যায়। কিন্তু সময়সীমা কমিয়ে এক বছর করা হল। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল গ্র্যাচুইটি আইনের সংশোধন করে পাঁচ বছরের জায়গায় এক বছর কাজ করলেই গ্র্যাচুইটি দেওয়া হোক। সরকার মানেনি। এখন শ্রম কোডে এই সুবিধা দেওয়া হল কেন? এটা শ্রমিককে প্রলোভিত করার জন্য, যাতে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর নিয়মে শ্রমিক মালিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী এই চুক্তি যদি মালিক পুনরায় নবীকরণ না করে, তা হলে তো গ্র্যাচুইটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব পাওনার শেষ হবে।
অর্থাৎ 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' চুক্তিতে একবার ঢুকলে স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার, সব বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি শ্রমিকের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন করার বিষয়টি আর থাকবে না। ফিক্সড টার্মে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহোরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তা লিখিত চুক্তির বিরুদ্ধে হবে৷ সুপরিকল্পিত ভাবে ফিক্সড টার্ম ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। কারণ, ফিক্সড টার্ম চুক্তিতে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে তা লিখিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করবে। সুপরিকল্পিত ভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে 'ফিক্সড টার্ম' চুক্তির ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। আর এখানে সরকার বা লেবার দপ্তরের কোনো দায়ও থাকবে না। কারণ মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করেই ব্যক্তি শ্রমিক কাজ পেয়েছে৷ সরকার বা শ্রম দপ্তরের এখানে কিছু করার নেই৷ এমনকি শ্রমিক কোনো আইনি সুরক্ষাও পাবে না। কারণ আদালতে যুক্তি আসবে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখিত চুক্তি করে স্বল্পমেয়াদী নিয়োগের শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' একটি আদ্যোপান্ত দানবীয় আইন।
একটা প্রশ্ন আসতে পারে— এ দেশে বিভিন্ন শিল্পে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকই বেশি। 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর সঙ্গে তা হলে তফাতটা কী হল? মূলগত ভাবে তফাত না থাকলেও একটি তফাত আছে৷ তা হল, চুক্তিভিত্তিক বা কনট্র্যাকচুয়াল শ্রমিকের ক্ষেত্রে সব সময় নিয়োগের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না, বা লিখিত চুক্তি করতে হয় না। কিন্তু 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে। আরও বড় সমস্যা হল, শ্রম কোডে এটা অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে একে আইনত বৈধ করা হল। আরও যে সমস্যা পরবর্তী কালে আসবে তা হল, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বা আদালতের যে একটা ভূমিকা থাকে, তা কার্যত নাকচ হয়ে যাবে।
এরপর এই কোডের আরও দুটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব — ধর্মঘট এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন বিষয়ে।
ধর্মঘট বিষয়ে আগে বলা ছিল, এক দল শ্রমিকের কাজ বন্ধ করা বা সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করতে না চাওয়াকে 'স্ট্রাইক' বা ধর্মঘট বলা হবে। এ বার তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে৷ পঞ্চাশ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক যদি ছুটি নেয়, তা হলে সেটাও ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে। শ্রমিক কাজ করতে চায় না, বা কাজ বন্ধ করে তার অধিকার আদায়ের জন্য। কিন্তু ছুটি তো একটা অধিকার৷ ৫০ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক ছুটি নিলে সেটা কেন ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে? এতে ছুটি বা Leave-কে ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটা একটা অধিকার জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, আগে জনপরিষেবার কোনও ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ধর্মঘট করতে চাইলে নোটিস দিতে হত। বাকি শিল্প, যা 'পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস'-এর মধ্যে পড়ে না সেখানে ধর্মঘটের জন্য আগাম নোটিস দিতে হত না। শ্রম কোডের নিয়ম অনুসারে ধর্মঘট করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত হয়ে যাবে — ইউনিয়ন ধর্মঘটের নোটিস দিল, মালিক মানল না, সেটা শ্রম দপ্তরে দু'তরফের বিবাদ বা 'ডিসপ্যুট' হিসেবে গেল। তারপর শুরু হল আলোচনা। আলোচনা চলাকালীন কোনো পক্ষ এক তরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বলছে কোড। অর্থাৎ কার্যত ধর্মঘটের বিষয়টা এক অন্তহীন প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেল। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কারখানায় মালিক বা কর্তৃপক্ষ একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দেয়। অথবা, দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে, বা গুরুতর আহত হলে শ্রমিকরা তক্ষুণি কাজ বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের এই সমবেত প্রত্যাঘাতে মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটেছে। এ যাবৎ এটা বে-আইনি কাজ হিসেবে গণ্য হত না। কিন্তু বর্তমানে কোনও পরিস্থিতিতেই তাৎক্ষণিক কাজ বন্ধ করা যাবে না। শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে, তারপর ধর্মঘট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ আইনের প্যাঁচে এই ধরনের সমস্ত লড়াই চলে যাবে বিশ বাঁও জলে। এই ভাবে ধর্মঘটের অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রম কোডে।
নতুন শ্রমকোডে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো কারখানায় একের অধিক ইউনিয়ন থাকলে, কোনও শ্রমিক সংগঠনকে আইনত স্বীকৃত বা 'রেকগনাইজড' ইউনিয়ন হতে গেলে মোট শ্রমিকদের ৫১% বা তার বেশি নাম মাস্টার রোলে থাকতে হবে। যদি ৫০%-এর বেশি শ্রমিকের সমর্থন কোনো ইউনিয়ন না পায়, তা হলে আনুপাতিক হারে কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। সেই কাউন্সিলই মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করবে। আপাত ভাবে মনে হয় ৫১% বেশি শ্রমিকের নাম মাস্টার রোলে থাকলে ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় — ৫১% শ্রমিকের নাম মাস্টাররোলে রাখার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়নি। ফলে ইউনিয়ন তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের, বা কারাখানা মালিকের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। তাদের পছন্দের ইউনিয়নের শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ বা তার বেশি সদস্যের নাম মাস্টাররোলে ওঠানোর চেষ্টা জারি থাকবে। আর ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যাই হোক,.... প্রধান এজেন্ট হিসেবে নির্বাচনের কোনো কথা এই আইনে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ইউনিয়নের উপর শাসকদলের বা মালিকের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকবে।
এর আগে আমরা দেখেছি, 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞা বদলে বহু কারখানা শ্রমিককে আইনের সুরক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় 'স্ট্যান্ডিং অর্ডার'— যার উল্লেখ 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০'-তে লেখা আছে। তিনশো বা তার বেশি শ্রমিক যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সেখানে স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে। এখন প্রশ্ন হল, স্ট্যান্ডিং অর্ডারের গুরুত্ব কোথায় ছিল? স্ট্যান্ডিং অর্ডারে কী থাকে? শ্রমিকদের বিভাগ নির্ণয় (ক্লাসিফিকেশন) অর্থাৎ শ্রমিকটি স্থায়ী না ক্যাজুয়াল, নাকি বদলি শ্রমিক, ইত্যাদি। এ ছাড়া কাজের সময় থেকে শুরু করে শিফট কী ভাবে চলবে, টিফিনের সময়, বেতন কখন, কবে দেওয়া হবে, ছাঁটাইয়ের শর্ত, খারাপ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা— অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কর ব্যাপারটি নীতিভুক্ত হয়। দু'ভাবে স্ট্যান্ডিং অর্ডার হয়। একটা থাকে মডেল স্ট্যান্ডিং অর্ডার, আরেকটা মালিক-শ্রমিক চুক্তি হয় লেবার দপ্তরের উপস্থিতিতে। এখন কিন্তু ৩০০-র চেয়ে কম শ্রমিক কাজ করলে সেখানে কোনো স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে না। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি চলার অভ্যন্তরীণ রীতি তুলে দেওয়া হল।
অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন আইনে নানা সংজ্ঞা এবং বিধি বদল করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনের বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প-শ্রমিকদের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ কাড়া হয়েছে সংগঠন ও সংগ্রামের অধিকার।
অপর দিকে যে সব শ্রমিকেরা আজ শ্রম আইনের আওতায় নেই, সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের বিষয়ে চারটি শ্রম কোড কী অবস্থান নিয়েছে? বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, কিছু উদাহরণই যথেষ্ট। লাখ লাখ গৃহপরিচারিকাদের সম্পর্কে কোডে কোনো কথা বলা নেই। আর আজকের শ্রম-বাজারে যে শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়, সেই গিগ শ্রমিকদের ব্যাপারে লেখা আছে, 'gig workers means a person who performs work or participates in a work arrangement and earn from such activities outside of traditional employer-employee relationship.' মানে প্রথাগত মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাইরে থাকবে গিগ শ্রমিকরা। তাদের কোনো আইনি অধিকার থাকবে না। শুধু কিছু প্রকল্পের সুযোগ পাবে। এ সব থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে চারটি শ্রম কোড সমস্ত ধরনের শ্রমিকের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার। এই চারটি শ্রম কোডকেই বাতিল করার দাবিতে সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন হল, আজ ভারতে কেন এই শ্রম কোড আনা হল? বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা কি? এর পিছনের রাজনীতিটা আমরা বুঝব কী ভাবে? রাজনীতি বুঝতে না পারলে সঠিক প্রতিরোধও গড়া যাবে না।
কয়েকটা প্রশ্নে ভাগ করে এর উত্তর খুঁজব।
১) শ্রমকোড বা শ্রম আইন আনার প্রেক্ষিতটা কী?
বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আসার পর শ্রমিক শ্রেণি পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। 'মেশিন-ভাঙা' আন্দোলন থেকে বিভিন্ন বিভাগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারখানায় কিংবা শিল্প-ভিত্তিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মে দিবসের লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের শ্রেণিগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ। ইতিমধ্যে ১৮৭১ সালে প্যারি-কমিউন ঘটে। ১৯১৭ সালে শ্রমিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাশিয়ার। রাশিয়ার বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন জোয়ার আনে। ঐ সময় বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আইনি অধিকার পাবার লড়াই জোরদার করে। অপর দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়েও অংশগ্রহণ করে। অন্য দিকে বুর্জোয়ারাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শ্রমিকদের কিছু আইনি অধিকার দিতে বাধ্য হয়। এবং নানান ধরনের শ্রম আইন তৈরি হয় নানান দেশে। মানে রাষ্ট্র একটা নিয়ম প্রবর্তন করে যা শ্রমিক, মালিক, রাষ্ট্র সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই সব আইনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি কিছু আইনি অধিকার পায়। শ্রমিক বিপ্লব যাতে না হয়, তার জন্য বুর্জোয়ারা এই অধিকার দিতে কিছুটা বাধ্যও হয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন না থাকলে শ্রমিকদের এই আইনি অধিকার অর্জন হতো না। শ্রমিকরা যা কিছু আদায় করেছে, সংগঠনের জোরে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জোরেই করেছে।
আমাদের দেশের সংগঠিত শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শ্রমিকরা আন্দোলনের জোরে বেশ কিছু আইনী অধিকার অর্জন করেছে। ভারত রাষ্ট্রে দেশী-বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শাসন থাকা সত্ত্বেও অনেক লড়াই করে শ্রমিকরা এই অধিকার অর্জন করেছিল। শ্রমিক আন্দোলন যত দুর্বল হতে থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণি ততই শ্রমিকের আইনি অধিকারকে খর্ব করতে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। ফলে বহু ক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রবর্তন করতে শুরু করে। কাজের ঘন্টা বাড়ানো, স্থায়ী শ্রমিক প্রথা রদ, বেতন সংকোচন, চুক্তি শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যায় বৃদ্ধি, ইচ্ছেমতো ছাঁটাই, যখন-তখন কাজ বন্ধ করা, ইত্যাদি চলতে থাকে। এক কথায় শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনে।
২) আর এস এস পরিচালিত বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দু'টো বিষয় নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে :
(ক) গত শতাব্দীর ন'য়ের দশক থেকে এই দেশে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আগমন ঘটে, কংগ্রেসের নরসীমা রাও ও মনমোহন সিংহের আমলে যার প্রবর্তন হয়। এটি গোটা দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিপুল বদল আনে।
(খ) এই পর্যায়েই এ দেশের ফ্যাসিস্ট দল বিজেপির বিপুল শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী কালে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, হিংস্র পুঁজিপতি গোষ্ঠী বিজেপি-কে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। ফ্যাসিবাদ সব সময় প্রধান প্রতিপক্ষ করে শ্রমিকশ্রেণিকে। শ্রমিক শ্রেণি যাতে শ্রেণিবদ্ধ ভাবে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, শ্রমিকদের শ্রেণিগত ঐক্য ভেঙে যাতে শ্রমিকরা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়, মতাদর্শের দিক দিয়েই ফ্যাসিস্টরা তা নিশ্চিত করতে চায়। ফ্যাসিবাদী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে তফাৎ হলো, ফ্যাসিবাদী শাসনে স্বৈরাচার থাকবে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনে ফ্যাসিবাদ থাকবেই— এমনটা নয়। একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭০-১৯৭৬ যখন ইন্দিরা গান্ধীর চরম স্বৈরাচারী শাসন চলছে, সেই সময়েই তিনটি শ্রম আইন তৈরি হয় : ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট প্রথা (রেগুলেশন ও এ্যবুলেশন) আইন, ১৯৭২ সালে গ্র্যাচুইটি আইন, ১৯৭৬ সালে সমকাজে সমবেতনের আইন। দেশে স্বৈরশাসন চলাকালীনই এই আইনগুলি পাশ হয়েছিলো, যেগুলি শ্রমিক-স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিলো। কিন্তু ২০১৪-২০২৫, এই এগারো বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রমিক স্বার্থে একটাও আইন তৈরি করেনি। উপরন্তু ২৯টি শ্রম আইনকে চারটে শ্রম কোডে পরিবর্তিত করে শ্রমিকদের আইনি অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যে চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কার্যত এই সরকার বেশির ভাগ শ্রমিককে শ্রম-আইনের বাইরে নিয়ে এসে গেছে। অপর দিকে যেটুকু আইন থাকবে, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষা করবে। যেমন ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়ন করা, মজুরির প্রশ্ন, গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক-সহ অজস্র শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনকে দাঁড় করানো, ইত্যাদি। এক কথায় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ফ্যাসিস্ট শক্তি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে। কোনো মতেই যেন শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। এটা আরো ভালো ভাবে লক্ষ করা যাবে গুজরাটে। এই পর্যায়ে দুটি রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তুলনামূলক ভাবে সক্রিয়, গুজরাট ও তামিলনাডু। এ দেশে চারটি শ্রম কোড আইনে রূপ পাওয়ার পরও দেশব্যাপী শ্রমিকদের নানান প্রতিবাদের জন্য আজো শ্রমবিধি তৈরি হয়নি। ফলে চারটি শ্রম কোডকে প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্তত একটি ক্ষেত্রে আট ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজের জন্য অর্ডিন্যান্স গুজরাট সরকার লাগু করেছে। অথচ সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টায় কাজের কথাও লেখা আছে। তার মানে এক দিকে দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজকে আইনত বৈধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অপর দিকে সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে হবে। এখন, একটা শিল্প তো তিন দিন বন্ধ রাখা যাবে না! ফলে এই অর্ডিন্যান্সের ফলে বাকি দু'দিন বেআইনি প্রক্রিয়াকে আইনি প্রক্রিয়া করে দেওয়া হলো। ফ্যাসিস্ট শক্তির আঁতুড়ঘর গুজরাট। তাই গুজরাটে অর্ডিন্যান্স করে তারা দেখে নিতে চায় ১২ ঘন্টার কাজকে আইনত বৈধ করলে সমাজ জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়। আর সেই জন্যই এই অর্ডিন্যান্স। এক কথায়, শ্রম কোড আনার পিছনে এটাই বিজেপি-র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এক দিকে যেমন বেশির ভাগ শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, অপর দিকে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে আরো জোরের সাথে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, এর বিরুদ্ধে লড়াইটা কিভাবে গড়ে উঠবে? প্রতিরোধ কিভাবে করবে শ্রমিক শ্রেণি? এই আলোচনায় যাবার আগে আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন একটা ভাটার পর্বের মধ্য দিয়ে চলছে। এক দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির নিত্যনতুন, একচেটিয়া হামলা চলছে, সেই সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে, অপর দিকে দীর্ঘ লড়াই করে শ্রমিকশ্রেণি যে অধিকার অর্জন করেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে হাতছাড়া হচ্ছে। আজকের শ্রম কোডে যে সব অধিকার ধরে রাখার জন্য লড়াই করা হচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো হারানোর প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সমাজ জুড়ে চলছে। যেমন স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ প্রথা রদ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ ও ঠিকা শ্রমিক বৃদ্ধি, কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অবাধ ছাঁটাই-সাসপেন্ড, মজুরি কমানো, ধর্মঘট-সহ যে কোনও শ্রমিকদের লড়াইয়ের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে যে কোন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পরিষেবা শিল্প সর্বত্র অস্থায়ী শ্রমিক ও কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রমিক, যেমন গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি অধিকার দেওয়া হয়নি। গৃহশ্রমিক থেকে মিড ডে মিল কর্মচারী, এদের জন্য কোনো আইন নেই। এক কথায়, কোটি কোটি মানুষ শ্রম দিচ্ছেন, সম্পদ তৈরি করছেন অথচ তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। শ্রমিক আন্দোলনের এই ভাঁটার সময়ে এক দিকে দীর্ঘ দিন আগে অর্জিত অধিকারগুলি হারাচ্ছেন, অপর দিকে অজস্র যে নতুন 'শ্রমিক' যোগ দিচ্ছেন নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে, নানা ধরনের শর্তে, তাঁদের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা। কোথাও যে লড়াই বা প্রতিরোধ হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে স্পর্শ করতে পারছে না। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি। একটা প্রশ্ন আসবেই— এই তো কিছু দিন আগে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হয়ে গেল। সেখানেও তো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কিছু ছবি পাওয়া গেছে। তা হলে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে বিজেপি বাদে প্রায় সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত ইউনিয়ন, অজস্র ছোট ছোট ট্রেড ইউনিয়ন, নকশালপন্থীদের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নানা ধরনের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাতে একটা রাজনৈতি
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন