মাছের বাজারে গিয়ে দেখলাম, একটা বড় হাঁড়িতে হরেক কিসিমের চুনো মাছ খলবল করছে। কী নেই তাতে? খোলসে, পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা, বেলে মাছ...। আরও কত কী! বহুদিন খোলসে (বাঙালরা বলে, খোইলসা) খাইনি। এমনকী চোখেও দেখিনি। কত মাছ যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। কিংবা হয়তো আছে। আমি জানি না।
বিদেশি দ্রব্যে বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু মাছের ভুবনায়ন কি হয়েছে? মানে, ত্রিনিদাদের মাছ তেঘরিয়ায় বিক্কিরি হচ্ছে, এমন তো শোনা যায়নি। তা হলে এই চুনো মাছগুলো গেল কোথায়? কোন আঘাটায়? জলা বুজিয়ে যে অসংখ্য ফ্ল্যাট মাথা তুলেছে, তার ধারেকাছে গেলে হয়তো চুনোমাছের আত্মার ফিসফিসানি শোনা যাবে।
তা সেই বড় চুনো মাছের হাঁড়ির সামনে ভনভন করছে লোকজন। হেমন্তের ভোর। মাছের বাজারের জলে পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে। সবাই ওই মাছ কিনতে চায়। ভিড় ঠেলে আমিও নিলাম সেরটাক। নানা জাতের মাছ আমার ঝোলায়। আজ মাছের বিয়ে। ওরা বরযাত্রী যাচ্ছে। গায়ক-অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় মঞ্চে উঠে একদা মাছের বিয়ে গানটি খুব গাইতেন। এখনও গান কি না, জানি না। তবে গানটি আমার কানে লেগে আছে। গানটা শুরু হচ্ছে এই ভাবে----চ্যাং মাছে বলে মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও...। কেন চ্যাং মাছের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এই কাতর আবেদন? শোনা যাক গায়ক কী গাইছেন----আরে কাইল দারিকার হইব বিয়ারে/ আমি বইরযাত্রী যামু/ আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, ঠ্যাংদিগিলা, জটাবোগিলা...আলুকশালুক শালুক ননদি...মা হইব মৌরলা, কাইল দারিকার হইব বিয়া, আজও চান্দা না আইল রে...।
এমন অদ্ভুত দুলে দুলে গাইতেন অরিন্দম যে, দর্শকরাও দুলে উঠত। বিয়েতে মা সাজবে মৌরলা, কিন্তু বাউন্ডুলে চান্দা মাছ গেল কোথায়? সে তো এখনও এল না। সাইকেলে ঝোলাটা আটকে আমিও মন খুলে গাইতে শুরু করলাম---আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, জটাবগিলা...(ভুল লিখলে ক্ষমা প্রার্থনীয়)। দুরন্ত ছন্দের গানটি গেয়ে শিরা-ধমনি এমন চলকে উঠল, মনে হল, বাল্যকাল ফিরে পেয়েছি। আমার এই এক দুরারোগ্য রোগ। যেখানে ছিটেফোঁটা বাল্যকালের সন্ধান পাই, সেখানেই থানা গেড়ে বসে পড়ি। হেমন্তের শিরশিরে হাওয়াও কোন সুদূর থেকে বাল্যকাল ডেকে আনে। কার্তিকের জ্যোৎস্না, হিমমাখা ভোর আমাকে আছড়ে ফেলে ফসলের খেতে।
তা যাই হোক, আমরা রোজ খাল, বিল, পুকুর বুজিয়ে ফেলছি। আসলে ঠিক খাল-বিল বুজিয়ে ফেলছি না। আত্মাকে গলা টিপে খুন করছি। আমার বাড়ির অদূরে একটি ইটখোলা ছিল। তাতে ছিল খানতিনেক গভীর পুকুর। সেই পুকুরে মাছ ধরার টিকিট বিক্কিরি হতো। টিকিট কেটে লোকজন মাছ ধরত। মাছের চারের যে কত সম্মোহনী গন্ধ থাকতে পারে, তা পুকুর ধারে না-গেলে বোঝা যেত না। কেউ কেউ উৎকৃষ্ট মানের সুরা মাছের টোপে মাখিয়ে দিতেন। মাছও যে মদ্যপ হয়, সেটা ওই পুকুর ধারে বসে জেনেছি। কয়েক হাত অন্তর ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে মৎস্যশিকারিরা। উপরে সুনীল আকাশ। অদ্ভুত এক নীরব মেলা। এত মানুষ বসে আছে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছে না। পাছে মাছ পালিয়ে যায়। মাছ যে গোলযোগ সইতে পারে না। তা সেই পুকুরগুলো আর নেই। সেখানে ফ্ল্যাট উঠেছে। একটি পুকুরকে সুইমিং পুল বানানো হয়েছে। কিন্তু পুকুর আর সুইমিং পুল এক জিনিস নয়। পুকুরে শালুক ফোটে, পুকুরের গভীরে ডুব দিয়ে ছেলেরা মাটি তুলে আনে, পুকুরে ঝিনুক থাকে, পুকুরের জলে সর পড়ে, পুকুরে কার্তিকের চাঁদ জ্যোৎস্না ঢেলে নিজের বাসা খোঁজে। এই পুকুরেই ছিল খোলসে, চাঁদা, পুঁটি মাছের বসত। আমরাই ওদের বাসা কেড়ে নিয়েছি। এখন কেঁদে কী হবে? মাছের বিয়ের গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে মাছের ঝোলাটা রাখলাম নীচে। দু-একটা মুক্তিকামী মাছের মুখ উঁকি মারছে আমার দিকে। ওগুলো কি সত্যিই মাছের মুখ? নাহ। ওরা বাংলার মুখ। হেমন্তের ভোরে মাছের ঝোলায় খলবল করছে আমার বাংলা।
পৃথিবীর রূপ খোঁজার আর দরকার কী?
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন