শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

গ্যাপ ~ সুনৃতা মাইতি

অপর্ণার মন খুব খুব  খারাপ। শরীরও জুতের নেই। দুগ্গা পুজো হয়ে দীপাবলি, এত পরিশ্রম গেছে যে বলার নয়। উৎসবের দিনকাল মানেই বাড়ির মানুষদের বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পায়ে পা তুলে জেঁকে বসে থাকা তো শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনদের যাওয়া আসাও  লেগে থাকে। আনতাবড়ি খাটতে খাটতে  অবস্হা কেরোসিন! শরীর এসব সয়ে নেয়, তার অভ্যেস আছে। বাকি রইল মন। সেও অনেক কিছু সইতে সইতে আজকাল শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। নারকোলের মত। ভেতরের সারজলটুকুর সন্ধান পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু মনের ওই নরম জায়গাটাতে যদি আঘাত লাগে তবে কি আর সহ্য হয়! সে কি সত্যি খারাপ! খারাপ মা? তার মেয়ে তার পিঠপিছে সেটাই বলেছে! মানে ঠিক বলেনি, লিখেছে। সেইটা আবার অপর্ণার গোচরে এসেছে।

লে দে কে অপর্ণার একটিই তো সাফল্য। তার একমাত্র সবেধন নীলমণি মেয়ে শ্রীতমা। বিটস পিলানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনই দুর্দান্ত ফ্যাশানিস্তা। রাস্তায় বেরোলে লোকে হা করে তাকিয়ে থাকে। দীপাবলির ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এসেই এমন সব ধুন্ধুমার ড্রেস পড়েছে যে বাড়িতে তার বাবার  সাথে চুলোচুলি হতে বাকি ছিল। অপর্ণা অতি কষ্টে ওই রক্ষনশীল ভদ্রলোক ও মেয়েকে যুগপৎ সামলেছে। মেয়ে পোশাকের ব্যাপারে মঝঝিম পন্থা নিতে বাধ্য হয়েছে মায়ের মধ্যস্থতায়। কিন্তু তাও তার বাপ ব্যাটামানুষের কি রাগ! গজগজ করতে করতে শাশুড়ি মায়ের কাছে কাঁধ মানে পাতি বাংলায় কন্ধা খুঁজতে গিয়েছিল। এদিকে অপর্ণার শাশুড়ি মাও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজকাল হেভি সেয়ানা হয়ে গেছেন। কোন দিকে যাবেন বুঝতে না পারলে বুড়ি আজকাল কানে কম  শোনার একটিং শুরু করেন। সেটাতে কাজ না হলে বলতে থাকেন," হরি বোল! হরি বোল! " যখন ইয়ে বয়স ছিল,সাংঘাতিক সব গা জ্বালানি কমেন্ট করতেন, যাকে বাঙাল ভাষায় বলে, চিমটাইন্যা কথা। আর খুব আস্তে বলতেন ,এত আস্তে যে খুব কাছাকাছি থাকা মানুষরাই শুনতে পেত। অপর্ণার বড় জা মৃদুলা সেই মন্তব্য শুনলেই হাউ হাউ করে দাপাদাপি করে উঠত।  পাড়াশুদ্ধ মানুষ বলত ," আহা! শাশুড়ি মানুষটি কি শান্তিপ্রিয়! গলা পর্যন্ত শোনা যায়না! বড়  বৌ কি দজ্জাল দেখো! "

তারপর তো বড় ভাসুর ও জা আলাদা হয়ে যায় তাদের যৌথ সংসার থেকে। অপর্ণা বরাবরই শান্ত ও ধৈর্যশীল মেয়ে। সবাইকে খুশি করেই চলার চেষ্টা করেছে বরাবর। তাতে অবশ্য ভালই হয়েছে। সকলেরই বিষদাঁত সময়ের সাথে সাথে নড়বড়ে হয়েছে। সব ক্ষত ভুলে সেও একদিন নিজের মত করে জীবনটাকে দেখতে পেরেছে, সাজতে গুজতে পেরেছে, নিজের মত শান্তিনীড় তৈরি করার চেষ্টা করতে পেরেছে। 

কিন্তু মেয়ের ব্যাপারটা ভাবলেই তার চোখ জলে ভিজে উঠছে।রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে বার বার তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে, 

"হ্যাঁ গো, এটা কি সত্যি ? মেয়ে তার হোয়া স্ট্যাটাসে তাই লিখেছে! সারা দুনিয়াকে জানিয়েছে,তার মা খারাপ! হ্যাঁ গো,আমি এত খারাপ!"

তার স্বামী চোখ ছোট ছোট করে কূটনী ভঙ্গিমায় বলেছে,

" তবে আর বলছি কি! নিজের চোখে দেখেও তোমার বিশ্বাস হলনা! যাগ্গে, বাদ্দাও। কবে বিয়ে হবে, কবে জামাই হবে! ওই নিয়ে ভেবে কাজ নেই।"

আসলে কিনা তার  কলিজার টুকরো মেয়ে  হোয়া স্ট্যাটাসে তার সামাজিক বায়োডাটা দিয়েছে, তাতে নিজের প্রোস আর কোন্স দিয়েছে। মজা করেই দিয়েছে হবে। মানে তাকে যে বিয়ে করবে, কী কী ভাল - মন্দের সম্মুখীন হবে আর কি। ওই আগাম ঘোষণার মত। আজকালকার নতুন জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা মানে যাদের জেন জি বলা হয় তারা এইরকম খুল্লামখুল্লা। মেয়ের ভালর মধ্যে লিখেছে, বয়ফ্রেন্ড একটি ফ্যাশন সচেতন মেয়ে পাবে, ভাল মনের মেয়ে পাবে, আবার খারাপের মধ্যে সে খুব এক্সপেনসিভ, মাথা গরম পদী ইত্যাদি। ফেলু গোয়েন্দা বাপ ডজন খানেক ফেক একাউন্ট খুলে সারাক্ষণ মেয়েকে সোস্যাল মিডিয়ায় স্টক করে বেড়ায়। মেয়ে বিপথে যাচ্ছে কিনা তাই নিয়ে বেজায় ভয় লোকটার। ফেসবুক, ইনস্টা, লিংকডিন তো বটেই, হোয়াতেও নজরদারি বাদ নেই। তাই ওই বাপের চোখেই এই স্ট্যাটাস পড়েছে। ওই বায়োডাটার মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল, জামাই একজন খারাপ শাশুড়ি পাবে। ভালয় না মন্দয়? প্রোসে না কোনে? ঠিক মনে নেই! দেখতে দেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিনা!এইসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা পরিষ্কার বুঝতে পারে, তার উপচে পড়া দুই চোখ আর জল ধরে রাখতে পারছে না। চোখ মুছতে মুছতে সে মেয়ের ঘরের দিকে রওনা হয়। না না, রাত বারোটা হোক কিংবা একটা এখনই তার ক্লিয়ার পিকচার চাই। যাকে গোদা বাংলায় ক্ল্যারিটি বলে। কীসে ভুল হল তার! মেয়ের কাছে  খারাপ কেন হল সে! তার এতদিনকার সব শ্রম কি বৃথা!

কিছুক্ষণ পর একজন মেয়ের সামনে গিয়ে একজন মাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শোনা যায়,

"হ্যাঁ রে, আমি এত খারাপ! এত ব্যাড? তোর বর যে হবে, সে ব্যাড শাশুড়ি পাবে?  ছিঃ!"

"যাব্বাবা! আমি আবার তোমাকে ব্যাড কোথায় বললাম?"মেয়ে ঘুম চোখে আকাশ থেকে পড়ে।

"বলিসনি! ওই যে স্ট্যাটাসে লিখেছিস ,মনে নেই! ইউ ক্যান গেট আ ব্যাডি মাদার ইন ল!বাবা ভাগ্যিস দেখাল,তাই জানলাম!"

মেয়ে বিছানা থেকে অতি কষ্টে বডি তুলে বিরক্ত গলায় বলে, "ফাইন!এতই যখন দেখেছ, ব্যাডের পাশে ডি আর ওয়াই টা  আন্দেখা করছ কেন! ওটা ব্যাডি ছিল।"

"দেখেছি। ব্যাডি। তোর ঠাকুমা হলে বলত, ব্যাডের স্ত্রী লিঙ্গ হবে। আমি যদ্দুর জানি, ওর মানে ক্রিমিনাল গোছের কিছু। " মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।

"বেশ! অনেক বুঝেছ। তাহলে দয়া করো। আমাকে ঘুমোতে দাও। আর পারলে গুগল করে দেখে নিও মানেটা। "বলেই মেয়ে পাচন গেলা মুখে কী সব বিড়বিড় করতে করতে বালিশে মাথা রাখে।

অপর্না নাক টানে, ভাল ভাবে চোখ মোছে আর তড়িঘড়ি ঘরে এসে মোবাইল নিয়ে ভালভাবে গুগল করে বিস্ফারিত নেত্রে দেখে ব্যাডি আদতে স্ল্যাং এবং এর দুটো অর্থ। এর একটি, জেন জি এর ভাষায় ,কনফিডেন্ট, স্টাইলিশ আর অ্যাটরাকটিভ! কি কেলো! উপরে চোখ তুলে সে ভাবে,এ যে ইয়েদের ভাষায়, হ্যারি হে ডিনোবন্ডু কেস! সে কী বুঝতে কী বুঝেছে!

তার মেয়ে মা সম্পর্কে এই ভাবে! বুকে একরাশ প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে তার। এই ডানা ঝাপটানো হৃদয় নিয়ে সে মোবাইলে আবার চোখ রাখতেই দেখে পিরিং করে মেসেঞ্জারে গভীর রাতের মেসেজ ঢুকেছে, "বি টি ডাবলু, ইউ লুক গুড ইন শাড়ি।"

হাসি হাসি মুখে সে ভাবে,তাই না তাই! কিন্তু বি টি ডাবলু আবার কী কেস রে বাবা!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন