একদা বিশ্বকবি, বাঙালি জাতির অতি সাবধানী,ভীতু আর নির্বিবাদী চরিত্রের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে এই উক্তিটি করেছিলেন। এখানে অন্যায় যে করে'র থেকে অন্যায় যে সহে'র প্রতি কবির বিদ্বেষ বেশী প্রকাশ পেয়েছিল।
এই অন্যায় সহার ব্যাপারে বাঙালির চিরকালই এক অদ্ভুত গুরুচন্ডালি দোষ আছে। এরা রোজ সকালে খবরের কাগজে প্রকাশিত সমগ্র নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষ দের প্রতি সমব্যথায় ,ক্ষোভে ,আবেগে ভেঙ্গে পড়বে অথচ নিজের বাড়ির ভাড়াটে বৌটিকে তার স্বামীর রোজ রাতে মদ খেয়ে পেটানোর প্রতিবাদ করবেনা ।
ফুটপাথের বাসিন্দা মানুষের মর্যাদা পাবে তখন ই যখন তারা মাঝরাতে কোনো বলিউডি হিরোর গাড়ির তলায় এসে মারা যাবে ।অন্য সময় ফুটপাথ বাসী আর গার্বেজ বিন এর মধ্যে পার্থক্য কোথায়?
৩১ শে ডিসেমবর রাতে কোনো ট্রাফিক সার্জেন্ট ইভ টিজিং এর প্রতিবাদ করতে গিয়ে মার খেয়ে মারা গেলে প্রায় সব বাঙালিই চায়ের কাপে ঝড় তুলে পারলে সমগ্র ইভ টিজার কুলের টুটি টিপে মেরে ফেলে, কিন্তু পাড়ার রকের মার্কা মারা, সোনালী রং করা চুলের লোফার গুলো যখন কোনো অষ্টাদশী তন্বী কে দেখে হিন্দি গানের বুলি আউড়ে যায় তখন 'পৃথিবীর সব মেয়েই তো আর আমার বোন নয়' ভেবে তড়িঘড়ি রিক্সায় উঠে পালায়।
একাধারে ঘোর প্রতিবাদী এবং নির্বিবাদী চরিত্র বাঙালি ব্যতিত অন্য কোনো সমাজে বড়ই বিরল বলে আমার বিশ্বাস। এরই মধ্যে যদি বা দু একজন বাঙালি যৌবনের তেজে বা বিবেকের তাড়নায় কালে ভদ্রে একটু আধটু অন্যায় এর প্রতিবাদ করতে যায় তবে তাকে হয় মাঝরাতে পুলিশ তুলে নিয়ে গিয়ে এমন পেটায় যে সে অন্যায় তে কোন 'ন' তাই ভুলে যায় আর নয় তো কোনো এক নেতার পাড়াতুতো ভাইরা মাথার পেছনে আইস্যা রড এর বাড়ি মারে যে প্রতিবাদী ভাই টি কযেক সপ্তাহেই পাড়ার মোড়ে শহীদ মঞ্চে স্থান পায় ।
আরো এক প্রকার বাঙালি আছে ,যারা আবার প্রতিবাদীর প্রতিবাদ করে আনন্দ পায়। এবার এদের সাথে পরিচিত হন।এই ধরনের বাঙালি আবার দুই প্রকার ।সাধারণ ও অ -সাধারণ ।উপরে উল্লিখিত উদাহরণ টিতে যারা প্রতিবাদী ভাইটির ইহলীলা সাঙ্গ করে তাদের সাহস এবং সাধ্য (রাজনৈতিক নেতার মদত ) দুই ই আছে।অর্থাত এরা সাধারণ মানুষের মত অসহায় নয়, এক কথায় অ-সাধারণ।
আর যে সব বাঙালির সাহস আর সাধ্য দুই এর ই অভাব তারা নিতান্তই সাধারণ।উদাহরন? দিচ্ছি।
এই ধরুন বাজারে এক সব্জিওয়ালা এক খরিদ্দার কে ওজনে কম দিচ্ছে দেখে খরিদ্দার রেগে দু এক কথা শুনিয়ে দিলে আপনি তৎক্ষনাত সেই সব্জিওয়ালার বাবার আমলের খরিদ্দার হয়ে যান আর সে যে কোনদিন ওজনে বেশি বই কম দিতেই পারেনা সে বিষয়ে দু চার কথা শুনিয়ে দু তিন জনকে টপকে নিজের কাজ টা সেরে নিয়ে মুচকি হেসে পালালেন।
আবার ধরুন খুচরো দিতে না পারায় আপনার এক সহযাত্রী কে যখন অটোওয়ালা সেই যাত্রীর গুষ্টির তুষ্টি উদ্ধার করে চলেছে তখন কিভাবে যেন অটোওয়ালার ময়লা হয়ে যাওয়া ছেঁড়া জামা আর সহযাত্রীর ঝাঁ চকচকে জামাকাপড়ের মধ্যে একটা অর্থনৈতিক বৈষম্যের গন্ধ আপনার মন কে পীড়িত করে তোলে আর সব যাত্রীরই কোনো এক অলীক এটিএম থেকে পকেট ভর্তি করে খুচরো জোগাড় করে অটোতে বসা উচিত এই বিষয়ে আপনি একটি সংক্ষিপ্ত তাৎক্ষণিক বক্তৃতা দিয়ে ফেলেন ।
এই ধরনের বাঙালিরা কখনো দিল্লির নির্ভয়া কান্ডে অভিযুক্ত নাবালক এর শাস্তির বিরুদ্ধে ,কখনো ধর্ষক ও খুনীদের ফাঁসির বিরুদ্ধে আবার কখনো খামখেয়ালী নেতা নেত্রীর অসংলগ্ন মন্তব্যের সপক্ষে ফেসবুক ,টুইটার এ গলা ফাটান। এরূপ অসহায় ঢাল তরোয়াল হীন সাধারণ বাঙালির প্রতিবাদী সম্প্রদায়টির প্রতি বিশেষ আলার্জি আছে। অবশ্য তার পেছনে কযেকটি নিদারুন সত্য ও লুকিয়ে আছে ।
প্রথমত - আশেপাশে প্রতিবাদী চরিত্র দেখলে বিবেক নামের প্রায় অকেজো হয়ে যাওয়া যন্ত্রটা খুব বিরক্ত করতে থাকে ।
দ্বিতীয়ত - এসব প্রতিবাদী লোকজন কে বেশি ঘেঁষতে দিলে নিজের জীবনে ও একটা সংযম এর প্রয়োজন হয়ে পরে ।কারণ এরা কখনো কারোর ভাই বোন বা বন্ধু হয়না ।এরা যখন তখন যেখানে সেখানে যে কোনো কারোর হাটে হাঁড়ি ভাঙ্গতে পারে।তাই এদের থেকে শত হাত দুরে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ ।
তৃতীয়ত - প্রতিবাদী লোকজনকে তোল্লাই দিলে যখন তখন রাস্তা ঘাটে মার খেতে হতে পারে ।কিম্বা নেহাত গলা মেলানোর অভিযোগে থানায় রাত্রি যাপন ও হয়ে যেতে পারে।কি দরকার সুখে থাকতে ভূতে কিলোনোর ।
চতুর্থত ও সর্বশেষ - প্রতিবাদী লোকেদের সাথে থাকার আরো একটা হ্যাপা আছে ।এদের সাথে থাকলে চারপাশের কিঞ্চিত চারিত্রিক দোষ সম্পন্ন,অল্প বিস্তর ঘুষখোর বা বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে লিপ্ত লোকগুলো আপনার পাশ মাড়াবেনা ।আর এসব লোকের হাঁড়ির খবর ছাড়া আপনার মদ সহযোগে সান্ধ্য আড্ডাটাই বা জমবে কিভাবে আর বাড়ির বৌদিদের পি.এন.পি.সি. গুলোই বা হবে কাদের নিয়ে ?
তার চেয়ে প্রতিবাদ থাকুক প্রতিবাদ এর জায়গায় আর বাঙালি থাকুক বাঙালির জায়গায়।
আর রবি ঠাকুরের সেই উক্তি? তা না হয় জানা রইলো ছেলের বাংলা খাতায় ভাব সম্প্রসারণ লিখে দেওয়ার জন্যই ।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন