বাঙালনামা - ১ প্রথম উপলব্ধি "আমি বাঙাল"। ৭ জুলাই, ১৯৭৭ মাঠে যাওয়া বাবার সাথে গিয়ে ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখা। এর আগে ভরসা ছিল রেডিও। বাবার সাথে অজয় বসু, পুস্পেন সরকার এর গলায় ধারাবিবরণী শুনতে শুনতে মানসিক ভাবে মাঠে থাকলেও, ইস্টবেঙ্গল মোহনবাগান এর ম্যাচ মাঠে বসে দেখার প্রথম অভিজ্ঞতা। সে বছরেই লীগের ইস্টবেঙ্গল আর পুলিশ টীম এর খেলা দেখতে গিয়ে টিকিট পাই নি, বাবার কাঁধে বসে রাম্পার্ট এ দাঁড়িয়ে খেলা দেখা হযেছিল মনে আছে। সঙ্গে বাবার প্রতিশ্রুতি 'দুঃখ কোরো না সেজদা (বাবা আমায় ওই নামেই ডাকেন, একান্নবর্তী বাড়ির সেজ ছেলে বলে), তোমায় ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান ম্যাচ দেখাতে নিয়ে আসব। উফফ , এত্ত লোক। মাঠে এসে দেখি গ্যালারি তে প্রচুর লোক, যারা আমার ঠাম্মার মতো করে কথা বলে, বাঙাল ভাষায়। বাবার কিঞ্চিত অস্বস্তি। চারপাশে বাচিক শিল্পীর দল। অবশ্য তখন সেটা appreciate করার মতো বয়স হয় নি। শিহরণ জাগানো অনুভূতি ৭ বছর বয়সের এক বালকের। খেলা শুরু, মিহির বসুর দুরন্ত শট বিশ্বজিৎ দাসের হাত এড়িয়ে মোহনবাগানের জালে আছড়ে পড়তেই ঘর ফেটে পড়ল ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের চিৎকারে। হাবিব নাচে, উল্গা নাচে, পি কে বাজায় ঢোল / দেখবি যদি আয়রে তোরা মিহির বোসের গোল। এরপর আবার পিন্টু চৌধুরীর ফ্রিকিক মোহনবাগানের জালে , বাবার সাথে মাঠে চিত্কার। কেমন যেন একটা ঘোর। জন্ম এই বাঙাল এর।
"বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু/ লম্ফ দিয়া গাছে ওঠে ল্যাজ নাই কিন্তু"… অনেকবার শুনেছি, বন্ধুদের কাছে। সত্যি কথা বলতে কি এটাকে মজা হিসেবে নিতে শিখেছি। জন্ম এদেশে হলেও বাঙাল গন্ধটা গা থেকে ঘোচে নি। তার ওপর ইস্টবেঙ্গল এর সাপোর্টার ! আর মজাটা হলো এই যে, ওই ছড়াটা লেখাও আবার এক বাঙালের , সুকুমার রায় , যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জের লোক। ভারী মজার … বাঙাল নিয়ে ছড়া লিখল আরেক বাঙাল, আর তাই নিয়ে বাঙাল খেপায় ঘটিরা। আর আমার মতো বাঙাল রাও ছেড়ে কথা কয় না, ফলে চলতে থাকে কথার লড়াই .... বাঙাল-ঘটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ইলিশ-চিংড়ি …. (চুপিচুপি বলি, চিংড়ি কিন্তু বেজায় খেতে লাগে আমার ) … নীহাররঞ্জন রায় "বাঙালির ইতিহাস" এ লিখেছিলেন প্রাচীন বঙ্গদেশের একটি বিভাগের নাম ছিল বঙ্গাল , সেখানকার অধিবাসীরাই কি প্রথম বাঙাল? তবে বাঙাল কথাটার চল ছিল না তখনও। মনে হয় এই কথাটা আসে আরো কিছুদিন বাদে। মোটামুটি বাংলার নবজাগরণের পরেপরেই। নব্যশিক্ষিত জমিদার সম্প্রদায়, যারা সেসময় বাংলার সংস্কৃতির ধারক-বাহক মনে করতেন নিজেদের, তারাই বোধহয় ওনাদের ততাকথিত শিক্ষিত শ্রেনীর বাইরের সকলকে 'বাঙাল' ভাবতেন। আমি ভুলও হতে পারি। যদিও হুতুম প্যাঁচার নকশা'য় বাঙাল জমিদারের বিবরণ থেকে স্পষ্ট, 'বাঙালের ভূত' নাগরিক জীবনে নেহাতই বেমানান।
তাহলে বাঙাল ব্যাপারটা কি সংস্কৃতিক, নাকি ভৌগলিক? অভিধান দেখছিলাম, সেখানে বলছে বাঙাল (বিদ্রুপে) [bāṅāla (bidrupē)] 1 পূর্ববঙ্গবাসী; 2 (বিরল) গ্রাম্য লোক। মানে কালীপ্রসন্ন বাবু ঠিক আভিধানিক অর্থেই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। আসলে, খুঁজছিলাম বাঙাল কথাটার উত্স। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'ভীমে ডাকাতের বট' গল্পে দুই বন্ধু ঝগড়া করতে করতে একে অপরকে 'বাঙাল' ও 'ঘটিচোর' বলে সম্বোধন করে। ঘটিচোর থেকে ঘটি? বাংলা অভিধানে 'ঘটি' শব্দের মানে খুঁজলে "লোটা, জলের পাত্র…" পেলেও 'পশ্চিমবঙ্গবাসী' পাওয়া যায় না। ঘটির পাল্টা হলো লোটা। আসলে ওই আর কি "ইসে" আর "কচু"র পাল্টা হিসেবে "নেবু, নুচি, নংকা, এলুম, গেলুম" নিয়ে মজা করা। যেমন যখন বলতে শুনি, "শালা সত্যযুগের পাবলিক মাইরি, হাতের লেগে থাকা ঘি পচে যাওয়ার পর-ও সেই পচা গন্ধ শুঁকে চলেছে, ছ্যাঁ ছ্যাঁ ;-))... উত্তরের দেরী নাই "সইত্যযুগ? গন্ধ কি হে, এখনও তো হাতের চট্চটে ভাবটাও যায় নাই! :-)))"
মাঝে মাঝে যদিও আমার মজাটা ঠিক মজা লাগে না। আসলে মজা করা আর হ্যাটা করার মধ্যে একটা সূক্ষ লাইন আছে, যেটা অনেকেই অতিক্রম করে যাই। যেমন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এর সেই বিখ্যাত ডায়লগ। মনে পড়ে? "বাঙাল পুংলিঙ্গ আর বাঙালি স্ত্রীলিঙ্গ।" 'বাঙালি' অর্থে পশ্চিমবঙ্গের লোক। পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্যটি গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্ব দাখিলে ব্যবহৃত হয়ে সমবেত বাঙালের হাততালি কুড়োল, ঠিক হলো কি? ফিরে আসি আবার ফুটবলের কোথায়। আজ বাঙাল-ঘটি র লড়াই কেবল ফুটবল মাঠে। বাড়িয়ে লাল পার্টি বলুন, গেরুয়া পার্টি বলুন আর সবুজ পার্টি বলুন, সেখানে তো বাঙাল-ঘটি মিলে মিশে একাকার। বাঙালের ছেলে মোহনবাগানের সাপোর্টার হলে সে "ঘটি" (যেমন বাবলু ভটচাজ্জি না চুনীবাবু), আর ঘটির ছেলে/মেয়ে ইস্টবেঙ্গলের প্রতি সদয় হলে সে "লোটা" (যেমন মিহির বসু)। আমার অবাঙালি বন্ধুরাও এই লোটা-ঘটির বেড়াজালে বন্দী। আর সেকারণেই ভেঙ্কটেশ, আপ্পারাও, ধনরাজ, আমেদ আর সালে এই পঞ্চপান্ডব, বঙ্গদেশের অধিবাসী না হয়েও পারফেক্ট বাঙাল।
কমলকুমার মজুমদার একবার বলেছিলেন, "বাঙালদের হিস্ট্রি আছে, জিওগ্রাফি নেই।" বাড়িতে গপ্পো শুনেছি ঠাম্মার কাছে। ফরিদপুর এর ভাঙ্গা থানা, সদরদিহি গ্রাম, নদী , পুকুর, মাছ , সেখানকার মানুষজন। সবটাই হিস্ট্রি, ভূগোল টা আমার দেখা হয় নি। কে যেন বলছিলেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব টা বোধহয় সেই হারিয়ে যাওয়া ভূগোল বই !
"বাঙাল মনুষ্য নয়, উড়ে এক জন্তু/ লম্ফ দিয়া গাছে ওঠে ল্যাজ নাই কিন্তু"… অনেকবার শুনেছি, বন্ধুদের কাছে। সত্যি কথা বলতে কি এটাকে মজা হিসেবে নিতে শিখেছি। জন্ম এদেশে হলেও বাঙাল গন্ধটা গা থেকে ঘোচে নি। তার ওপর ইস্টবেঙ্গল এর সাপোর্টার ! আর মজাটা হলো এই যে, ওই ছড়াটা লেখাও আবার এক বাঙালের , সুকুমার রায় , যিনি জন্মসূত্রে ছিলেন পূর্ববঙ্গের কিশোরগঞ্জের লোক। ভারী মজার … বাঙাল নিয়ে ছড়া লিখল আরেক বাঙাল, আর তাই নিয়ে বাঙাল খেপায় ঘটিরা। আর আমার মতো বাঙাল রাও ছেড়ে কথা কয় না, ফলে চলতে থাকে কথার লড়াই .... বাঙাল-ঘটি, ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান, ইলিশ-চিংড়ি …. (চুপিচুপি বলি, চিংড়ি কিন্তু বেজায় খেতে লাগে আমার ) … নীহাররঞ্জন রায় "বাঙালির ইতিহাস" এ লিখেছিলেন প্রাচীন বঙ্গদেশের একটি বিভাগের নাম ছিল বঙ্গাল , সেখানকার অধিবাসীরাই কি প্রথম বাঙাল? তবে বাঙাল কথাটার চল ছিল না তখনও। মনে হয় এই কথাটা আসে আরো কিছুদিন বাদে। মোটামুটি বাংলার নবজাগরণের পরেপরেই। নব্যশিক্ষিত জমিদার সম্প্রদায়, যারা সেসময় বাংলার সংস্কৃতির ধারক-বাহক মনে করতেন নিজেদের, তারাই বোধহয় ওনাদের ততাকথিত শিক্ষিত শ্রেনীর বাইরের সকলকে 'বাঙাল' ভাবতেন। আমি ভুলও হতে পারি। যদিও হুতুম প্যাঁচার নকশা'য় বাঙাল জমিদারের বিবরণ থেকে স্পষ্ট, 'বাঙালের ভূত' নাগরিক জীবনে নেহাতই বেমানান।
তাহলে বাঙাল ব্যাপারটা কি সংস্কৃতিক, নাকি ভৌগলিক? অভিধান দেখছিলাম, সেখানে বলছে বাঙাল (বিদ্রুপে) [bāṅāla (bidrupē)] 1 পূর্ববঙ্গবাসী; 2 (বিরল) গ্রাম্য লোক। মানে কালীপ্রসন্ন বাবু ঠিক আভিধানিক অর্থেই শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। আসলে, খুঁজছিলাম বাঙাল কথাটার উত্স। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের 'ভীমে ডাকাতের বট' গল্পে দুই বন্ধু ঝগড়া করতে করতে একে অপরকে 'বাঙাল' ও 'ঘটিচোর' বলে সম্বোধন করে। ঘটিচোর থেকে ঘটি? বাংলা অভিধানে 'ঘটি' শব্দের মানে খুঁজলে "লোটা, জলের পাত্র…" পেলেও 'পশ্চিমবঙ্গবাসী' পাওয়া যায় না। ঘটির পাল্টা হলো লোটা। আসলে ওই আর কি "ইসে" আর "কচু"র পাল্টা হিসেবে "নেবু, নুচি, নংকা, এলুম, গেলুম" নিয়ে মজা করা। যেমন যখন বলতে শুনি, "শালা সত্যযুগের পাবলিক মাইরি, হাতের লেগে থাকা ঘি পচে যাওয়ার পর-ও সেই পচা গন্ধ শুঁকে চলেছে, ছ্যাঁ ছ্যাঁ ;-))... উত্তরের দেরী নাই "সইত্যযুগ? গন্ধ কি হে, এখনও তো হাতের চট্চটে ভাবটাও যায় নাই! :-)))"
মাঝে মাঝে যদিও আমার মজাটা ঠিক মজা লাগে না। আসলে মজা করা আর হ্যাটা করার মধ্যে একটা সূক্ষ লাইন আছে, যেটা অনেকেই অতিক্রম করে যাই। যেমন ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় এর সেই বিখ্যাত ডায়লগ। মনে পড়ে? "বাঙাল পুংলিঙ্গ আর বাঙালি স্ত্রীলিঙ্গ।" 'বাঙালি' অর্থে পশ্চিমবঙ্গের লোক। পিতৃতান্ত্রিক ভাষ্যটি গোষ্ঠীগত শ্রেষ্ঠত্ব দাখিলে ব্যবহৃত হয়ে সমবেত বাঙালের হাততালি কুড়োল, ঠিক হলো কি? ফিরে আসি আবার ফুটবলের কোথায়। আজ বাঙাল-ঘটি র লড়াই কেবল ফুটবল মাঠে। বাড়িয়ে লাল পার্টি বলুন, গেরুয়া পার্টি বলুন আর সবুজ পার্টি বলুন, সেখানে তো বাঙাল-ঘটি মিলে মিশে একাকার। বাঙালের ছেলে মোহনবাগানের সাপোর্টার হলে সে "ঘটি" (যেমন বাবলু ভটচাজ্জি না চুনীবাবু), আর ঘটির ছেলে/মেয়ে ইস্টবেঙ্গলের প্রতি সদয় হলে সে "লোটা" (যেমন মিহির বসু)। আমার অবাঙালি বন্ধুরাও এই লোটা-ঘটির বেড়াজালে বন্দী। আর সেকারণেই ভেঙ্কটেশ, আপ্পারাও, ধনরাজ, আমেদ আর সালে এই পঞ্চপান্ডব, বঙ্গদেশের অধিবাসী না হয়েও পারফেক্ট বাঙাল।
কমলকুমার মজুমদার একবার বলেছিলেন, "বাঙালদের হিস্ট্রি আছে, জিওগ্রাফি নেই।" বাড়িতে গপ্পো শুনেছি ঠাম্মার কাছে। ফরিদপুর এর ভাঙ্গা থানা, সদরদিহি গ্রাম, নদী , পুকুর, মাছ , সেখানকার মানুষজন। সবটাই হিস্ট্রি, ভূগোল টা আমার দেখা হয় নি। কে যেন বলছিলেন, ইস্টবেঙ্গল ক্লাব টা বোধহয় সেই হারিয়ে যাওয়া ভূগোল বই !
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন