রোববার মানেই
সাফসাফাইয়ের দিন।সেই ছোটবেলার সহজপাঠে মনটা ফিরে যাওয়া... “আজ মঙ্গলবার, আজ জঙ্গল
সাফাইয়ের দিন।”।দিন বদলে এখন মঙ্গল হয় রবিতে।দার্জিলিং চায়ে
শেষ চুমুকটা দিয়ে ডাস্টার নিয়ে লেগে পড়লাম।মানুষ মোটে তিনটে, তবু ছ’ছটা কামরা যেন
কম পড়ে যায় গুনতিতে। চকচকে তকতকে ফ্ল্যাটটা আরও আধুনিক, আরও সুন্দরী হয়ে ওঠে। হালফ্যাশানের
আসবাবগুলোর ফাঁকে দু-একছিটে ময়লাও কেমন যেন চোখে লাগে (চোখ টানে)। অথচ হরলাল মিত্র
লেনের সেই ঘুপচি ঘরটায় কামরা ছিল মেরেকেটে আড়াইখান।শোবার ঘরের এক কোণায় খবরের
কাগজের পাহাড়ে নিশিন্তে ঘুমিয়ে থাকতো ময়লা।তবু চোখে লাগতো না।আঙুলের কড়ে ওই
সাকুল্যে আড়াইমাত্রাই ছিল এক পৃথিবীর মতো। যেন মায়ের ছিঁড়ে যাওয়া , পুরনো হয়ে
যাওয়া জংলা শাড়িটা ,আদতে রংচটা, তবু তার পরতে পরতে হলুদ স্নেহ মাখা গন্ধ।বেশ
লাগছিল, বয়সের ভার নেমে যাচ্ছিল আস্তে আস্তে।
“বাবা এগুলো কি বলোতো?”।ডোডো
ছুট্টে এলো ওঘর থেকে। হাতে একগাদা দোমড়ানো মোচড়ানো জঞ্জাল।
“একি তুই আবার
নোংরা ঘাঁটছিস?”। হালকা চোখরাঙ্গানি পেরিয়ে ডোডো নাছোড়বান্দা।
“বলো না বাবা,
এগুলো কি?”
হাতবদল হয়ে ছেঁড়াখোঁড়া
কাগজগুলোর জট খুলতে থাকে একটু একটু করে...
ফর্দ – ঐকতান
সংঘের সার্বজনীন দূর্গাপুজা
মূর্তি – একচালা,
ডাকের সাজ, টানাটানা চোখ তার নীচে আবার দাগটানা মানে ওটা আবশ্যিক।
প্যান্ডেলের কাপড়
– লাল হলুদ হাইফেন মেরুন সবুজ তারপর ব্র্যাকেটে বড় বড় করে লেখা সব বাদ শুধু বেগুনী-সাদার
কলকা।মনে পড়ে গেল নচেদা সেবার খুব রেগে গেছিলো। অম্বর ডাক্তারের চেম্বারে আগুন
লেগে যায় প্রায়। তপনটা পাক্কা ঘটি, হাত-পা নেড়ে ব্যাটার সে কি দাপট।আমরাও দমবার
পাত্র নাকি?লালু, বাপী সবাই মিলে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম।শেষে নচেদা রেগেমেগে
বলে উঠেছিল “পূজো ক্যানসেল”।ব্যাসস আর কি, অমনি সবাই ভিজে বেড়াল।“তুমি যা
বলবে সেটাই ফাইনাল, তুমি লিখে দাও গুরু...”।সেবার
প্যান্ডেলটা হয়েছিল খাসা।ডোবা পুকুরের পেছনের মাঠটায়, আসমানি রঙের টুকরোগুলো বাঁশের
খুঁটির গায়ে লেগে যখন উড়ছিল আলতো হাওয়ায়, মনে হচ্ছিলো আকাশে মাটিতে একাকার হয়ে
গেছে পেঁজা তুলো ।ঢাকে কাঠি পড়তেই বেয়াদব একটা ধুকপুকুনি দৌড়ে
বেড়াতো শিরায় শিরায়, নিখুঁত হওয়ার দ্বন্দে, আধুনিক হওয়ার দ্বন্দে সেই ধুকপুকুনিটাই
কেমন যেন লজ্জা পায়, লুকিয়ে পড়তে চায়। ভাবতে ভাবাতে পাতা উল্টে যাই অন্যমনে।
পূজোর উপকরণ- ব্যানার্জিদা।
কি অসাধারণ দেখতে ছিলেন, ছফুটের চেহারায় যখন ষষ্ঠীর বোধনে গমগম করতো ”...”, গিঁট
বাঁধা খড়ের মণ্ড, গঙ্গামাটি ,পাটের দড়ির চুল জুড়ে জুড়ে জেগে উঠত প্রাণ, ছুঁয়ে যেত
রক্তমাংসে।সেই শুরু, তারপরের কয়েকটা দিন তুমুল হইহই।মুদিখানার
বাচ্চুদা, রেল-কলোনির টুকাই আর তার ভাইগুলো, মুখার্জী বাড়ির টিপটপ সুমিত সকলের
আনন্দগুলো কেমন যেন মিলেমিশে এক হয়ে যেত।এখনকার মতো মাপা হাসি, হিসেবী হাতমেলানো
নয়। নকুলদার লড়ঝড়ে ঠেলায় বাসি তেলে ভাজা এগরোলটাও এমনিই ভালো লাগতো, কোন চকচকে
মোড়ক ছাড়াই।প্যান্ডেলের পেছনে জড় হওয়া সার সার জিলিপি-নিমকি-বাদামের অস্থায়ী
আস্তানায়,সদ্য পাট-ভাঙ্গা জামদানীটায়, খানিকটা বুঝেও না বোঝার অজুহাতে ছুঁয়ে যাওয়া
আঙ্গুলগুলোয়, সব জায়গায় কেমন একটা ঘোর।ঘোর এখনো লাগে, তবে সেটা জাঁকজমকের,চোখ
ধাঁধানো চমকের।মনে পড়ে গেল অষ্টমীর ভোগ যেত আমাদের বাড়ি থেকে।
মা সক্কাল সক্কাল স্নান সেরে লাল টিপে ঠিক (কেমন) যেন অন্নপূর্ণা।পাড়ার বড় বড়
দিদিরা, বৌদিরা সব জড় হয়ে বসত মায়ের পায়ের কাছটায়। হাতে হাতে রান্না হত ধোঁওয়া ওঠা
আনন্দ। তারপর বিলি হত সারা পাড়া জুড়ে আত্মীয়তা।নবমীর সন্ধ্যায় আবার শব্দদূষনটা
একটু বেশি। শুরু জগাদার হেঁড়ে গলায় রবীন্দ্রসংগীত দিয়ে,তারপর তোতলা পল্টুর সেই এক “পূজার
সাজ”। আমরাও এটা-ওটা এদিক-সেদিক ছন্দ মিলিয়ে দাঁড়িয়ে পড়তাম মাইকের সামনে, যদি কোন
বনলতা সেন জুটে যায় এই মওকায়। তখন মঞ্চসজ্জার আড়ম্বর ছিল না,ডলবি-ডিজিটাল প্রক্ষেপণ
ছিল না, ,তবুও ঘ্যাড়ঘ্যাড়ে চোঙ্গামুখ দিয়ে যে অবাঞ্ছিত শব্দগুলো বেরিয়ে পড়তো মাঝেসাজে,
তারাও কেমন একটা অনুরণন (সুর) বেঁধে দিতো, খুব অল্পে খুব সাধারণে বেঁচে থাকার সুর।
ভাবতে ভাবতে ল্যাপটপে রাখা পুজো ২০১৪ ফোল্ডারটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা মনে
হল।ইন্টারনেট ঘেঁটে বাছাই করে রাখা তাক লাগানো সব কনসেপ্ট আর থিমগুলো ভীষণ
ম্যাড়ম্যাড়ে একঘেয়ে আর সস্তা হয়ে হারিয়ে যেতে লাগলো। সময়ের সাথে সাথে পূজোর বাজেটে
বাড়তে থাকা শূন্যর সংখ্যাগুলোও কেমন অযথা হয়ে মুছতে লাগলো একটা একটা করে। পড়ে রইলো
মন্ডপের পাশে ভাঙ্গাচোরা সহজ-সরল বেঁচে থাকাটা, পাঁচ ছটাক সাদাকালো হইহুল্লোড় আর শালপাতায়
মোড়া ঝাপসা নস্ট্যালজিয়া।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন