১২ ই মার্চ, ১৯৭১। বর্ধমান টাউন হলে কংগ্রেসের জেলা জমায়েত ছিল। চাঁদু চৌধুরী নামে এক যুবক বাসে চেপে সেহারা, কাঁটাপুকুর থেকে আসছিল। সেই বাসেই ছিল জমায়েতে যোগদানকারী বিরোধী পক্ষের পান্ডারা। বাসে ওরা চাঁদুকে দেখতে পেয়েই পকেটমার, পকেটমার চিৎকার করে ওঠে। বাস তখন সগড়াই মোড়ে। ক্ষোভে লজ্জায়, নিজের প্রাণ বাঁচাতে চাঁদু সগড়াই মোড়ে নেমে ধানক্ষেতের উপর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করে। সগড়াই মোড় থেকে উদিত গ্রাম পেরিয়ে আহ্লাদিপুর। সেখানে ছিল তাঁর পিসির বাড়ি। গ্রামের মানুষ খেয়ে তখন ভাতঘুম দিচ্ছিল। এমন সময় ইশু চৌধুরীর নেতৃত্বে কংগ্রেসী গুন্ডারা চাঁদুর খোঁজে গ্রাম আক্রমণ করলো। চাঁদু তার পিসির বাড়িতে খবর দিয়েই পাশের গ্রাম উগ্রতিতে খবর দিতে চলে গেল। কংগ্রেসী গুন্ডাদের হাতে বন্দুক অন্যদিকে নিরীহ গ্রামবাসীরা। গ্রামবাসীদের সম্বল বলতে তীর ধনুক, টাঙ্গি। আহ্লাদিপুর গ্রামের পাশাপাশি উগ্রতি গ্রাম থেকে লালচাঁদ বাগদী সহ অন্যরা এসে গেছে। বিকেল চারটে সাড়ে চারটের সময় বন্দুক হাতে নব সাঁই এসে হাজির। ৭৫ বছরের আনসার মির্জাকে বলা হল গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে। আনসার মির্জা বললো আমরা তো বুড়ো মানুষ, কোথায় যাবো? টাঙ্গির এক কোপে পাশের ডোবায় আনসার মির্জার মুন্ডু পাঠিয়ে দেওয়া হলো। সৈয়দ মির্জা প্রথমে পালিয়ে গেছিলো, পরে পরিবারের খবর নেওয়ার জন্য গ্রামে ফিরতেই খুন করা হল। ৬৫ বছরের শরৎ দলুই মাঠের উপর দিয়ে পালানোর সময় খুন হন। খুন হলেন কমঃ শিবু রাম। মোট ৪ জন শহীদ হলেন আহ্লাদিপুরে। গোটা গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ধানের মড়াই, গমের মড়াই সব পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। গ্রামের সবাই তখন পালিয়ে মাঠে বসবাস করছে।
ওমর আলির বয়স্ক বাবাকে মারধর করলো নব সাঁই এর নেতৃত্বে কংগ্রেসী গুন্ডারা। লালচাঁদের পায়ে গুলি করা হয়েছিল। লালচাঁদের পা ভেঙে যায়। ওই অবস্থায় ও নব সাঁই, ইশুকে আঁকড়ে ধরে মাটিতে ফেলে গলায় টাঙ্গির এক কোপ। মাথাটা ওদের ছিটকে গেল। রক্ত, রক্ত, রক্তে ভেসে গেল গোটা আহ্লাদিপুর গ্রাম।
সাঁই রা ছিল অর্থ, ক্ষমতা আর বন্দুকের জোরে বর্ধমান জেলার অত্যাচার, সন্ত্রাস ও নৃশংসতার প্রতীক। 'ওই মলয়-প্রণব আসছে' গোটা বর্ধমানে আতঙ্কের প্রতীক হয়ে উঠেছিল সাঁইরা। মলয় সাঁই ও প্রণব সাঁই দু দফার পিভি অ্যাক্টে বন্দী ছিল। বহু খুন, জখম মামলার আসামী ছিল সাঁইরা। হরিসভার হিন্দু বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা রাজলক্ষ্মী মুখার্জির বাড়িতে মলয় সাঁই এর নেতৃত্বে হামলা করা হয়েছিল। তাঁর মাকেও প্রহার করা হয়েছিল। আদালত থেকে জামিনের শর্তই ছিল বর্ধমান শহরের বাইরে থাকতে হবে। ওদের ভগ্নিপতিও পিভি অ্যাক্টে বন্দী ছিল।
১৬ ই মার্চ মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জি ইস্তফা দিলে যুক্তফ্রন্ট সরকার পরে যায়। অনৈতিকভাবে সরকার ভাঙার প্রতিবাদে বামফ্রন্ট ধর্মঘট ও মিছিলের ডাক দেয়। সারা রাজ্যের মত বর্ধমান শহরেও মিছিল হয়েছিল। মিছিল যখন এস বসু রোডে, প্রতাপেশ্বর শিবতলায় এসে উপস্থিত তখন সাঁইরা হাতবোমা, পাইপগান নিয়ে হামলা চালায়।সাঁইদের ছোঁড়া বোমার আঘাতে জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন গৌর সরকার। পরে এই গৌর সরকারকেই পুলিশ গ্রেফতার করে। বোমার ঘটনায় উত্তেজিত হয়ে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা সাঁইবাড়িতে হামলা চালায়। মলয় সাঁই, প্রণব সাঁই ও জিতেন রাই মারা যান। সেদিন কিন্তু বাড়ির জামাই কিংবা নব সাঁই এর কিছু হয়নি। সাঁইদের বড়ভাই এর চোখে নাকি অ্যাসিড ঢেলে দিয়েছিল। রাজ্যপাল ধরমবীরের সামনে চোখে ব্যান্ডেজ বেঁধে মিডিয়ায় তাই বলেছিল। অথচ ১৫ দিন পর জনসভায় ভাষণ দেন তখন চোখে ব্যান্ডেজ ছিল না। ভাবা যায় অ্যাসিড ঢালার পর মাত্র কয়েকদিনে সুস্থ হয়ে গেছিলো নব সাঁই। এই নব সাঁই খুন হলেন ১২ ই জুন, রায়নার আহ্লাদিপুর গ্রামে আক্রমণ করতে গিয়ে।
সাঁই মামলায় একদিনে ৭০ জন গ্রেপ্তার হলেন। এলাকার হেডমাস্টার থেকে বহিরাগত সবাই গ্রেপ্তার হলেন। সাঁইদের সহানুভূতি দেখাতে তৎকালীন রাজ্যপাল ধরমবীর থেকে সিদ্ধার্থ শংকর রায় সবাই সাঁইবাড়ি গেছিলেন। রাজ্যপালের এই যাওয়াকে ব্যঙ্গ করে মিছিল সংগঠিত করলেন বিনয় কোঙার। এবার বিনয় কোঙার টার্গেট হয়ে গেলেন। এপ্রিলের ২/৩ তারিখে মেমারির বিধায়ক বিনয় কোঙার গ্রেপ্তার হলেন। এমনকি স্বাধীনতা সংগ্রামী বর্ধমান জেলা পার্টির সম্পাদক সুবোধ চৌধুরী পর্যন্ত গ্রেপ্তার হলেন।
২৩ শে মে খুন হলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী শিবশঙ্কর চৌধুরী ওরফে কালো চৌধুরী। এহেন প্রবীণ নেতাকে ছাড় দেয়নি নব সাঁই এর নেতৃত্বে কংগ্রেসের গুন্ডাবাহিনী। মামলা লড়ার জন্য কোনও উকিল দাঁড়ায়নি। সবারই তো প্রাণের ভয় আছে। কালো চৌধুরীর এক কথাতে রাজী হয়ে গেলেন উকিল ভবদীশ রায়। বিনা অর্থে বিনয় কোঙার সহ অন্যান্য বন্দীদের হয়ে সাঁই মামলায় সওয়াল করার জন্য। ৬ ই এপ্রিল বর্ধমান শহরে খুন হলেন লক্ষ্মী নায়েক। তার কয়েকদিন পরে খুন হয়ে গেলেন উকিল ভবদীশ রায়। সকাল সাড়ে দশটায়, যখন রিকশায় চেপে মুহুরির সাথে কোর্টে যাচ্ছিলেন তখন বর্ধমান থানার পাশেই খোসবাগানে গুলি করা হল। পুলিশ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হয়েও কোনও ব্যবস্থা নেয়নি। বার্তা পৌছে দেওয়া হল হত্যার সপক্ষে পুলিশ আছে। আর মে মাসে খুন হলেন কালো চৌধুরী। পার্টির কাজ সেরে ভাইপো অমিতাভের বাড়ি থেকে খেয়ে বর্ধমান শহরের নিজের ভাড়া বাড়িতে সাইকেলে করে যখন ফিরছিলেন সেই সময় রাতের অন্ধকারে গুলি করে খুন করলো কংগ্রেসী গুন্ডারা। দিনটা ছিল ২৩ শে মে, ১৯৭১। না ভবদীশ রায় না শিবশঙ্কর চৌধুরী ওরফে কালো চৌধুরীর খুনের ঘটনায় কেউ গ্রেপ্তার হলেন। সারা বর্ধমান জুড়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব চললো।
১৯৭০ সালের ২৮শে এপ্রিল গঠিত হয় তারাপদ মুখার্জি কমিশন। তখন কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সব জেলে। টাউনহলে সেই কমিশনের সামনে সাক্ষ্য দেবার মতো পরিবেশ ছিল না। শুধুমাত্র কংগ্রেসের কর্মী ও নেতারা কমিশনের কাছে সাক্ষী দেয়। সেই রিপোর্ট পেশ হয় ২৫শে এপ্রিল ১৯৭১সালে। সেখানে কমিশনের রিপোর্টে প্রকাশ- এটা কোন ষড়যন্ত্র বা সুপরিকল্পিত ঘটনা নয়। ১৯৭২সালের ১০ই মার্চ নির্বাচনে রিগিং-এর মাধ্যমে জিতে সিদ্ধার্থ শঙ্কর রায় মুখ্যমন্ত্রী হন। তখন তারাপদ মুখার্জি কমিশনের রিপোর্ট বিধানসভাতে কেন পেশ করা হলো না? রাষ্ট্রপতি শাসন চলাকালীন তারাপদ মুখার্জি রিপোর্ট জমা করলেও লোকসভাতে সেই কমিশনের রিপোর্ট পেশ করা হয়নি।
১৯৭০ সালের ১৭ ই মার্চ সাঁই বাড়ির ঘটনায় যারা নিহত হন তাঁদের বর্ধমান শহরে ঢোকা নিষেধ ছিল আদালতের নির্দেশে। তারা শর্তাধীনে জামিন পেয়ে বাইরে ছিলেন। কমিশন বিষ্ময় প্রকাশ করে এরা বর্ধমান শহরে ঢুকলেন কিভাবে? তারাপদ মুখার্জি কমিশন কোথাও উল্লেখ করেননি নিরুপম সেন, বিনয় কোঙারের নাম। শুধুমাত্র পুলিস ও প্রশাসনের অপদার্থতার কথায় উল্লেখ ছিল। মহকুমা শাসককে সাসপেন্ডও করা হয়। বদলি করা হয় থানার আইসি ও অতিরিক্ত জেলাশাসককে।
সাঁই কান্ডের কয়েক মাস পরেই রাষ্ট্রপতি শাসনের মধ্যে ভোট হয়েছিল। যথারীতি সেই ভোটেও জিতেছিল বাম প্রার্থী বিনয় চৌধুরী।
আগামী ১২ ই জুন অন্যান্য বছরের মতো এবছরও আহ্লাদিপুর গ্রামে নব সাঁই এর গুন্ডাবাহিনীর হাতে নিহতদের স্মরণ করা হবে সামাজিক দূরত্ব মেনে। চাইলে আপনিও উপস্থিত থাকতে পারেন।
আহ্লাদিপুর গ্রামের ঠিকানা -
গ্রাম - আহ্লাদিপুর, পোস্টঃ শ্যামসুন্দর, পি এস - রায়না, জেলা - পূর্ব বর্ধমান, পিন কোড - ৭১৩৪২৪
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন