বিজ্ঞান নামের জিনিসটা তো একদিনে তৈরি হয়নি। সেই সুদূর অতীতে মানুষ হাঁ-করে তাকিয়ে থাকত আকাশের দিকে, দেখত সূর্য-চাঁদ-তারাদের গতিপথ। দেখত কেমন তাদের অবস্থান বদলে বদলে যায় সময়ের সঙ্গে। সূর্য রোজ পুব আকাশেই ওঠে বটে, কিন্তু ঠিক এক জায়গায় ওঠে না। সরে সরে যায়। সরতে সরতে এক জায়গায় এসে আবার উল্টোদিকে সরতে থাকে। শীত পড়তে শুরু করলে যেমন দক্ষিণ দিকে সরতে থাকে। অনেক শীতে এমন এক দক্ষিণে পৌঁছে যায়, যেখান থেকে আবার শুরু হয় উত্তরমুখী চলা। সেই দিনটাকে বলা হতে লাগল মকর-সংক্রান্তি। উত্তর আকাশে একপিস তারা আবার সরে-টরে না বললেই চলে। তাকে বলা হল ধ্রুবতারা, ইত্যাদি।
মার কাছে মাসির গল্প আর কী শোনাবো, আপনারা তো জানেনই, এর নাম অ্যাস্ট্রোনমি। অ্যাস্ট্রোনমি হচ্ছে বিজ্ঞান, অ্যাস্ট্রলজি হচ্ছে ঢপবাজি। যারা পড়াশুনা করে, যাদের অঙ্কে খুব মাথা, তারা পড়াশুনা করে অ্যাস্ট্রনমার হয়; যারা পড়াশুনা করে না, ফেলুড়ে, তারা চাকদা রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্মে ডুগডুগি বাজিয়ে মাদুলি বিক্কিরি করে, নিজেদের বলে অ্যাস্ট্রলজার। প্রথমটা বিজ্ঞান, দ্বিতীয়টা কাইন্ড অফ ধর্ম।
বিজ্ঞান আর ধর্ম জানা হয়ে গেল। এবার খানিকটা ভূগোল আর ইতিহাস জানা যাক।
বনগাঁ-র নাম নিশ্চয় সবাই জানেন। শিয়ালদা থেকে বনগাঁ লোকাল বোধহয় চার বা চারের-এ প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়ে। তো সেই বনগাঁর কাছে হচ্ছে গিয়ে আপনার পেট্রাপোল সীমান্ত। এদিকে পেট্রাপোল, ওদিকে বেনাপোল। এদিকের রাস্তাটার নাম যশোর রোড বা ন্যাশনাল হাইওয়ে ১১২, ওদিকের রাস্তাটার নাম এন-৭০৬ জাতীয় সড়ক। এদিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা, ওদিকে যশোর। তো সীমান্ত পেরিয়ে ওই জাতীয় সড়ক ধরে নাক বরাবর চোদ্দ কিলোমিটার চলে যান, পেয়ে যাবেন নাভারন নামে একটা জায়গা। সেখান থেকে ডানদিকে ঘুরে যান আর-৭৮০ জাতীয় সড়ক ধরে, সোজা চলুন আরও চোদ্দ কিলোমিটার। দেখবেন রাস্তার ডানদিকে আসবে বাঘ-আঁচড়া গ্রাম।
ওখানে দাঁড়িয়ে যান, আমাদের কাহিনি ওখানেই শুরু। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির কিশোর ছোট ছেলেটা যখন পকেট-খাতায় লুকিয়ে লুকিয়ে 'গহন কুসুমকুঞ্জমাঝে মৃদুল মধুর বংশী বাজে' ধরনের অ্যাডাল্ট গান লিখছে, সেই সময় ঐ বাঘ-আঁচড়া গ্রামে পদ্মমুখীর গর্ভে জন্ম হল রাধাগোবিন্দ-র। বাবা গোরাচাঁদ ওখানকার এক ডাক্তারের কম্পাউন্ডার, ডাক্তারবাবুর ফরমাশ মতন তিনি শিশির গায়ে খাঁজকাটা খাঁজকাটা কাগজ আঠা দিয়ে সেঁটে শিশিতে মিকচার ঢেলে দেন, বলে দেন কখন কত দাগ করে খেতে হবে। পদ্মমুখী জমিদারবাড়ির মেয়ে, ফলে রাধাগোবিন্দর যত মজা মামার বাড়িতেই, সেখানে তো কিল-চড় নাই।
গ্রামের স্কুলে প্রাইমারির পাঠ শেষ হলে রাধাগোবিন্দকে ভর্তি করে দেওয়া হল যশোর জিলা স্কুলে। কিন্তু বাবুর পড়াশুনায় মন নেই। মামাবাড়ির দুধ-ঘি আম-জাম-কাঁঠাল নিয়মিত সাপ্লাই পেলে কারই বা থাকে! সে ছাদে শুয়ে থাকে আর আকাশের তারা দেখে। মাঝরাতে আকাশ কত নীচে নেমে আসে, সে অবাক হয়ে দেখে আকাশে কত কত তারা। ইস্কুলের পাঠ্যবইতে অক্ষয় কুমার দত্তের একটা গদ্য পড়েছে সে, সেটার নাম 'ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড'! সত্যিই তো, এ যে অগুন্তি তারা। কোনোটা খুব উজ্জ্বল, কোনোটা মাঝারি, কোনোটা অতিকষ্টে দেখা যায়। রাধাগোবিন্দ সব লিখে রাখে, কোন আকাশে কেমন ধরনের উজ্জ্বল তারা দেখছে। এই করতে করতে স্কুলের লেখাপড়া ডকে উঠে যায়। গাঁয়ের উকিল কালীনাথ মুখুজ্জে দেখেন, ছোকরা আকাশের তারা নিয়ে মেতে আছে। তিনিও তারা-টারা নিয়ে উৎসাহী, 'স্টার অ্যাটলাস' নামে একটা বই এডিট করছেন। তাঁর পড়াশুনা কৃষ্ণনগরের স্কুলে, সেখানে তিনি কৃষ্ণনগর কোর্টের বিচারক হার্শেলের সংস্পর্শে এসেছিলেন। এই হার্শেল আবার বিখ্যাত আস্ট্রনমার উইলিয়াম আর জেমস হার্শেলের বংশধর। তাঁর কাছে অ্যাস্ট্রনমির প্রাথমিক পাঠ তাঁর হয়েছিল। রাধাগোবিন্দকে তিনি চিনিয়ে দিলেন আকাশের বড় বড় তারা আর রাশিগুলোকে। ফলে রাধাগোবিন্দ সেখান থেকেও প্রশ্রয় পেতে শুরু করল।
সুকুমার রায় যখন ব্যাগ দুলিয়ে স্কুলে যাওয়া শুরু করছেন, তখন রাধাগোবিন্দর এন্ট্রান্স পরীক্ষা এসে গেল। এবং সে ফেল করল। ও রকম ফেল ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। মামারা তাকে আরও আম-কাঁঠাল খাওয়ালো এবং সে পরের বছরও এন্ট্রান্সে ফেল করল। বিরক্ত রাধাগোবিন্দ দুচ্ছাই করে আকাশ দেখতে লাগল আরও নিবিড়ভাবে এবং তৃতীয়বারও ধেড়িয়ে এন্ট্রান্সে ফেল করে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে ফেলল।
ফলে মেঘনাদ-সত্যেন্দ্র-প্রশান্তচন্দ্রের মতো বড় বড় ভবিষ্যৎ-বিজ্ঞানীরা যখন জন্মে গেছেন, জন্মে গেছেন এমনকি সুভাষ এবং নজরুলও, আমাদের রাধাগোবিন্দ তখনও ফেলুড়ে!
এদিকে গোঁফদাড়ি গজিয়ে যাচ্ছে! মানে ছেলে সেয়ানা হচ্ছে। সেয়ানা হলে ছেলেকে কী করে বাপ-মায়? বিয়ে দেয়। তাই এক শুভলগ্নে একুশ বছরের রাধাগোবিন্দর বিয়ে হয়ে গেল। পাত্রী মুর্শিদাবাদের ন-বছরের মেয়ে গোবিন্দমোহিনী। পাত্রের নামেও গোবিন্দ, পাত্রীর নামেও গোবিন্দ, পুরো মাখো মাখো ব্যাপার। খই উড়িয়ে নমো-টমো করে বিয়ে হয়ে গেল। শতাব্দী ঘুরে গেল।
বিয়ের কনে একদিন তার কানে কানে বলল, এ মা, তুমি ফেলুড়ে! শুনে ক্ষেপে গেল রাধাগোবিন্দ। সে ততদিনে আকাশের তারা-ফারা সব মুখস্থ করে ফেলেছে, সামান্য বই মুখস্থ করতে পারবে না? তেড়েফুঁড়ে উঠে সে আবার এন্ট্রান্স পরীক্ষা দিল। এবং আবারও ফেল করল।
গঙ্গারামের মতো উনিশবার টানতে পারল না রাধাগোবিন্দ। এখন সে রীতিমত এক গৃহস্থ, ঘরে তার গৃহিণী আছে। তাকে তো খাওয়াতে পরাতে হবে। চাকরি খুঁজতে লাগল সে। ফেলুড়ে ছেলেকে কে চাকরি দেবে? খুঁজতে খুঁজতে জুতোর শুকতলা ক্ষয়ে গেলে বছর দুয়েক পরে যশোর কালেক্টরেট আপিসে তার চাকরি হল। কাজ খাজাঞ্চিগিরির। ট্যাক্স কালেক্ট করা, সে টাকার হিসেব রাখা। গঙ্গারামের কনিষ্ঠ ভাই তিনরাত্তির যাত্রাদলে তবলা বাজিয়ে যা পেত, তার বেতন মাসান্তে সেই পনেরটি টাকা।
এর মধ্যে বঙ্গভঙ্গ-টঙ্গ চলে এল। রাখি-টাখি পরানো হল কলকেতায়। ক্ষুদিরাম-প্রফুল্ল বোম ছুঁড়লেন। ফাঁসি-টাসি হল। গোবিন্দমোহিনীর কোল আলো করে এক সময় এল এক পুত্রসন্তান, তার নাম রাখা হল কাল। আর কিছুকাল পরে এক ঘোর বরিষণে এক কন্যাসন্তান, তার নাম রাখা হল বর্ষা। কাল-বর্ষা শশিকলার ন্যায় বেড়ে উঠতে লাগল। ততদিনে আকাশের দিকে হাঁ-করা তাকিয়ে থাকা রাধাগোবিন্দ একটা সস্তার দূরবিন কিনে নিয়েছে। খাজাঞ্চিখানার কাজ শেষ হলেই সে বাড়ি এসে সেটা নিয়ে তাক করে থাকে আকাশের দিকে। যাবতীয় তারার হিসেব তার মোটামুটি নখদর্পণে। জাবেদা খাতায় সে প্রতিদিন তাদের হিসেব লিখে রাখে।
১৯১০ সালে হ্যালির ধূমকেতু নামে এক বস্তু আকাশে উদিত হল। পঁচাত্তর বছর পর পর তিনি পৃথিবীর মানুষকে দর্শন দিয়ে ধন্য করেন। রাধাগোবিন্দ তার দূরবিন তাক করল সেই ধূমকেতুর দিকে। লেজ-ফেজওলা সেই অদ্ভুত জিনিস দেখে তার নেশা ধরে গেল। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তার চেহারা দেখে সে, কী দেখে সব লিখে রাখে। কখন সেটা কোন তারার পাশ দিয়ে কোন দিকে যাচ্ছে, কতটা উজ্জ্বল সেটা, তার ধারাবিবরণী জমে ওঠে তার খাতায়। কালীনাথবাবুর পরামর্শে সে এই নিয়ে প্রবন্ধও লিখে ফেলল, সেই প্রবন্ধ ছাপা হয়ে গেল রায়বাহাদুর যদুনাথ মজুমদার প্রকাশিত যশোরের 'হিন্দু' নামে এক পত্রিকাতেও।
সেই প্রবন্ধ চোখে পড়ে গেল রবি ঠাকুরের শান্তিনিকেতন ব্রহ্মচর্যাশ্রমের বিজ্ঞান-শিক্ষক জগদানন্দ রায়ের। তাঁর মতন অমন সুন্দর করে বিজ্ঞান আর কেই বা বোঝাতে পারত তখন! জগদানন্দ চিঠি লিখলেন রাধাগোবিন্দকে – বাপু হে, খালি চোখে বা ঐ সস্তার দূরবিন দিয়ে কি আর তারা দেখে কিছু শেখা যায়! ভালো কিছু করতে হলে একটা টেলিস্কোপ যে জোগাড় করতে হবে!
নিম্নবিত্ত রাধাগোবিন্দের ওই একটিই নেশা – তারা দেখা। টেলিস্কোপ সে পাবে কোথায়? তার দাম কত, কোথায় পাওয়া যায়, কিছুই জানে না। খোঁজখবর নিয়ে জানতে পারল, সে জিনিস এ দেশে পাওয়া যায় না, কিনতে গেলে আনাতে হবে বিলেত থেকে, তার খরচা কম না। সবচেয়ে কমদামী এক টেলিস্কোপের দাম তেরো পাউন্ড! কত টাকা কে জানে! আনাতেই বা কত খরচা! সারা বছরের বেতন চলে যাবে একটা সস্তার টেলিস্কোপ কিনতেই।
অল্প কিছু সঞ্চয় হয়েছিল ততদিনে। বাকিটা ম্যানেজ করতে কিছু জমি বিক্রি করে দিতে হল, এ ছাড়া উপায় কী! ১৯১২ সালের পুজোর আগে সেই টেলিস্কোপ এলো রাধাগোবিন্দর বাড়ি। ইংল্যান্ডের এফ বার্নার্ড কোম্পানি মেসার্স কক্স শিপিং এজেন্সির মাধ্যমে সেই টেলিস্কোপ পাঠিয়েছে, এর জন্যে রাধাগোবিন্দর খরচা পড়েছে ১৬০ টাকা ১০ আনা ৬ পাই। তিন-ইঞ্চি ব্যাসের লেন্সওয়ালা টেলিস্কোপ, তার টিউব মোটা কার্ডবোর্ডের। নিজের জাবদা খাতায় প্রথম পুরুষে নিজের সম্বন্ধে লিখলেন – সন ১৩১৯ সালের আশ্বিন মাসে দূরবিন আসার পরে রাধাগোবিন্দ চন্দ্রের নক্ষত্রবিদ্যা অনুশীলনের চতুর্থ পর্ব আরম্ভ। এই সময় তিনি কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের 'ভূগোলচিত্রম' ও 'তারা' পুস্তকের সাহায্যে এটা-ওটা করিয়া যুগল নক্ষত্র, নক্ষত্র-পুঞ্জ নীহারিকা, শনি, মঙ্গল প্রভৃতি গ্রহ দেখিতেন। পরে জগদানন্দ রায়ের উপদেশ মত 'স্টার অ্যাটলাস' এবং 'সেলেসসিয়াল অবজেক্ট' ক্রয় করিয়া যথারীতি গগন পর্যবেক্ষণ করিতে আরম্ভ করেন। কিন্তু ইহাতেও তাঁহার কার্য বেশীদূর অগ্রসর হয় নাই। তবে তিনি এই সময় গগনের সমস্ত রাশি-নক্ষত্র ও যাবতীয় তারা চিনিয়া লইয়াছিলেন এবং কোন নির্দিষ্ট তারায় দূরবিন স্থাপনা করিতে পারিতেন।
রোদ-জলের পক্ষে নিতান্তই অনুপযুক্ত টেলিস্কোপের কার্ডবোর্ডের ব্যারেল। ফলে আরও টাকা জোগাড় করতে হল রাধাগোবিন্দকে। এবং নিজের উদ্যোগেই আরও কড়কড়ে ৯৬ টাকা ১০ আনা খরচা করে ইংল্যান্ডের ব্রডহার্স্ট ক্লার্কসন অ্যান্ড কোম্পানি থেকে আনিয়ে নিলেন পিতলের ব্যারেল, তাতে নিজেই ফিক্স করে নিলেন লেন্স-টেন্স।
এর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ নোবেল পুরস্কার পেলেন, তারপর একটা গোটা বিশ্বযুদ্ধ হয়ে গেল। স্প্যানিশ ফ্লু নামে মারণব্যাধি ভারতে ঢোকার ঠিক আগের বছর, ১৯১৮ সালের জুনমাসের প্রথম সপ্তাহে তিনি আকাশে হঠাৎ এক উজ্জ্বল তারা দেখলেন, যা তার আগের ছবির সঙ্গে মিলল না। এ রকম ছিল না আকাশের ওখানে, হঠাৎ করে একটা তারা উজ্জ্বল হয়ে গেল কী করে! এই অভূতপূর্ব ব্যাপার চেপে রাখার মানেই হয় না। তিনি ছবি-টবি এঁকে এ খবর চিঠি লিখে জানালেন হার্ভার্ডের মানমন্দিরে। হার্ভার্ড স্পেস অবজার্ভেটরি রাধাগোবিন্দর চিঠি পড়েই বুঝতে পারল, এ হচ্ছে এক নোভা। নোভা মানে এমন এক তারা যার অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন হওয়ার জন্যে সে খুব দ্রুত কয়েকদিনের মধ্যে তার ঔজ্জ্বল্য বাড়িয়ে ফেলে বহুগুণ, যা ধীরে ধীরে পরে কমে যায়। নতুন এক নোভা আবিষ্কার করে ফেলেছে রাধাগোবিন্দ! এবং এই আবিষ্কার শুধু যশোরে বা বাংলায় নয়, নয় এমনকি ভারতবর্ষেও, সমগ্র এশিয়ার সেই প্রথম পর্যবেক্ষক যে নতুন নোভা আবিষ্কার করেছে। সেটার নাম দেওয়া হল নোভা অ্যাকুইলিয়া ৩।
হার্ভার্ড মানমন্দিরের ডিরেক্টর এডওয়ার্ড চার্লস পিকারিং রাধাগোবিন্দকে উৎসাহিত করতে কিছু বইপত্র পাঠালেন। আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন অফ ভেরিয়েবল স্টার অবজার্ভার্স বা আভসো-র সদস্যপদ গ্রহণের নিমন্ত্রণও এসে গেল রাধাগোবিন্দর কাছে। ঠিক হল, আভসোর অন্যান্য নিমন্ত্রিত সদস্যদের মতো তিনি তাঁর যাবতীয় পর্যবেক্ষণ ওদের কাছে পাঠাবেন। এবং তারই স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯২৬ সালে আভসো থেকেই আমেরিকায় তৈরি ছয়-ইঞ্চি ব্যাসের এক টেলিস্কোপ পাঠানো হল রাধাগোবিন্দকে। সঙ্গে হার্ভার্ড স্পেস অবজার্ভেটরির প্রধান হ্যারলো শেপলি-র চিঠি – বিদেশ থেকে পরিবর্তনশীল নক্ষত্র সংক্রান্ত আমরা যে সব পর্যবেক্ষণমূলক তথ্য পাই, তারমধ্যে আপনার দান অন্যতম। আপনাকে আমার আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।
এর দু-বছর পরে চারবারের এন্ট্রান্স-ফেল রাধাগোবিন্দকে ফরাসী সরকার পাঠাল তাদের দেশের সম্মান - Officer d'Academic Republic Francaise.
আরও অনেক পরিবর্তনশীল নক্ষত্র, ধূমকেতু, ক্যালেন্ডার ফর্মেশন ইত্যাদি মহাজাগতিক কাজকারবার পর্যবেক্ষণ করে চললেন রাধাগোবিন্দ। এই সব করতে করতে ভারত স্বাধীন এবং দু-ভাগ হয়ে গেল। রাধাগোবিন্দর গ্রাম গিয়ে পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে। যশোরের জিলা কমিশনার এম আর কুদ্দুস সাহেব রাধাগোবিন্দকে বললেন – চন্দরবাবু, আফনে ইন্ডিয়ায় চইলা যান। ওদিকে এ সবের কদর বেশি, আফনার সুবিধা অইব।
নিজের পুরনো তিন-ইঞ্চি আর আমেরিকার দানের ছ-ইঞ্চির টেলিস্কোপ নিয়ে বেনাপোল সীমান্ত দিয়ে বনগাঁয় ঢুকতে গেলে সীমান্তের কাস্টমস তাঁর টেলিস্কোপ দুটো বাজেয়াপ্ত করল। ক্ষুব্ধ রাধাগোবিন্দ প্রাণের ধন ছেড়ে ভারতে ঢুকে আস্তানা গাড়লেন পানিহাটিতে। টেলিস্কোপ খোয়া গেছে জানিয়ে চিঠি লিখলেন আমেরিকার হার্ভার্ডে আর ফ্রান্সের প্যারিসে, যাদের সাম্মানিক পদ তিনি গ্রহণ করেছেন।
সেই চিঠির জেরে কিনা কে জানে, ক-দিন পরে যশোরের জিলা কালেক্টর নিজে সেই টেলিস্কোপ দুটো বগলদাবা করে তাঁর বাড়িতে দিয়ে গেল।
পানিহাটিতেও একই উৎসাহে কাজকর্ম চলতে লাগল, আকাশ দেখতে ছেলে-ছোকরাদের উৎসাহিত করতে তিনি তৈরি করলেন একটা ক্লাবও। ছিয়াত্তর বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে তিনি বুঝতে পারলেন, তাঁর চোখের দৃষ্টি অতি ক্ষীণ হয়ে এসেছে। এই চোখ নিয়ে আর দূর আকাশের তারা দেখা সম্ভব না। ততদিনে তিনি আভসোর শ্রেষ্ঠ সদস্যদের মধ্যেও সর্বোচ্চ স্তরের একজন হিসাবে সাঁইত্রিশ হাজার আড়াইশোর কাছাকাছি ট্রেইন্ড-আই পর্যবেক্ষণ কমিউনিকেট করে ফেলেছেন, তাঁর সারা জীবনের পর্যবেক্ষণ উনপঞ্চাশ হাজার সাতশো! পূর্ব গোলার্ধে তখন তাঁর সমকক্ষ কোনো পর্যবেক্ষক নেই।
আভসোর প্রধানকে চিঠি লিখলেন তিনি – আমাকে আপনারা আকাশ-দেখার একটা টেলিস্কোপ দান করেছিলেন। সেই যন্ত্র ব্যবহার করে আমি গত আঠাশ বছর ধরে নিরবচ্ছিন্ন ভাবে আকাশ দেখে গেছি, আমার সেই আনন্দ আমি ভাগ করে নিয়েছি আপনাদের সঙ্গে। আমার বয়স হয়েছে, চোখের জ্যোতি চলে গেছে, আমার আর আকাশ দেখার ক্ষমতা নেই। যন্ত্রটা আপনাদের কাছে ফেরত দেওয়া উচিত ছিল আমারই, কিন্তু ফেরত পাঠানোর মতো আর্থিক সঙ্গতি আমার নেই। আপনারা নিজে ব্যবস্থা করে যদি যন্ত্রটা আমার কাছে থেকে ফেরত নেওয়ার ব্যবস্থা করেন, তবে আমি বাধিত হব।
আভসো আপ্লুত হয়ে তার উত্তরে লিখল, যন্ত্রটা আপনাকে দান করা হয়েছিল ফেরত নেওয়ার বাসনাতে নয়। আকাশ পর্যবেক্ষণে আপনার অবদান অসামান্য। আপনি নিজে ব্যবহার করতে না পারলে যোগ্য কাউকে সেটা দান করতে পারেন, আমাদের এতে বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই।
রাধাগোবিন্দ সেই ছয়-ইঞ্চির আমেরিকান টেলিস্কোপ দান করে দিলেন নৈনিতালের জনৈক ভাইনু বাপ্পুকে।
জীবনসায়াহ্নে পৌঁছে তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেছিলেন – ক্লাস সিক্সে সেই যে পড়েছিলাম অক্ষয় দত্তের চারুপাঠ, তাতে যে লেখা ছিল ব্রহ্মাণ্ড কী প্রকাণ্ড, সেটা পড়ে কতজনের ব্রহ্মাণ্ড দেখার বাসনা জেগেছিল, সে তো বাপু আমি জানি না, আমার জেগেছিল। সেই অদম্য ইচ্ছা প্রশমিত করার কোনো চেষ্টাই আমি করিনি। পড়াশুনা হয়নি আমার। সারাটা জীবন ঐ করেই কাটিয়ে দিলাম। এখন মনে হয়, ঠিকই করেছিলাম।
দারিদ্র্য তাঁর পিছন ছাড়েনি। আমেরিকা, ব্রিটেন, ফ্রান্স থেকে সম্মান-পাওয়া রাধাগোবিন্দ স্বাধীন ভারতে কানাকড়ি বা স্বীকৃতি কিছুই পাননি। পাঠ্যবই দূরে থাক, তাঁর নাম কোনোদিন কাগজেও ওঠেনি। পানিহাটি থেকে পরে তিনি পাততাড়ি গুটিয়ে বাসা বেঁধেছিলেন বারাসাতের দুর্গাপল্লীতে। ১৯৭৫ সালে শীতের শেষে গরম পড়তে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। অনুজ্জ্বল চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই এপ্রিলের তিন তারিখে প্রায় বিনা চিকিৎসায় আকাশের তারা হয়ে যান সাতানব্বই বছর বয়সী চন্দ্রবংশীয় রাধাগোবিন্দ।
১৯ জুন ২০২১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন