ডিটক্স ওয়াটার নামে এক বস্তুর হালে খুব সমাদর হয়েছে। জলের মধ্যে চাকা চাকা করে কাটা লেবু, শশা, পুদিনা-পাতা আর কীসব ঘাস-ফুস ডুবিয়ে রেখে মাঝেমধ্যে চুকচুক করে খেলে নাকি শরীর থেকে যাবতীয় টক্সিন বেরিয়ে যায়।
কথা হচ্ছে, বড়লোকদের অনেক রকম ব্যামো থাকে। বড়লোক হওয়াটাই একটা ব্যামো ছাড়া আর কী? সুতরাং তাদের ব্যাপার স্যাপার আলাদা। তারা আকুপ্রেশার হাওয়াই চপ্পল পরছে বলেই আপনাকে পাঁচগুণ দাম দিয়ে ঐ ছাতা কিনতে হবে, বিকল্পে নিজের চটিতে পিরিতি-কাঁঠালের আঠা দিয়ে সমভাবাপন্ন এঁচোড়ের ছাল লাগাতে হবে – এসব করতে যাবেন না। তেষ্টা পেলে শুধু জল খান, বিশুদ্ধ জল। ওর মধ্যে শশা-ফশা ডুবিয়ে খেলে এক্সট্রা কিছু লাভবান হবেন না। আমাদের শরীরের মধ্যে যে সব যন্ত্রপাতি আছে – লিভার, কিডনি থেকে শুরু করে রক্তের শ্বেতকণিকা, অণুচক্রিকা ও বিশেষ ধরনের কোষসমূহ – এদের কাজই শরীর থেকে অব্যবহার্য বস্তু দূরীকরণ। শশা-লেবু-পুদিনার সাহায্য ছাড়াই। এবং শশা-লেবু-পুদিনার অস্ত্রে সজ্জিত না হলে তাদের কর্মকাণ্ডে যে বিন্দুমাত্র অসুবিধা হয়, তেমন কোনো বদনাম তাদের নেই।
এর মানে এই নয় যে শশা-লেবু-পুদিনা বাজে জিনিস। এগুলো খান যত খুশি। সুষম খাদ্যের অঙ্গ হিসাবে খান। ডিটক্স ওয়াটারের অঙ্গ হিসাবে নয়। কেননা ডিটক্স জিনিসটা ইমিউনিটি বাড়ানোর মতই এক প্রবল ঢপ। এবং তার কারণ টক্সিন জিনিসটা আসলে কী, তা না-জানা বা ভুল জানা। মনে করুন কোনো বিষধর সাপে আপনাকে ছোবল মারল। এর ফলে আপনি মারা যেতে পারেন। এ রকম বিষাক্ত মাকড়সাও আছে, যা কামড়ালে নিয়তি ঘনিয়ে আসে ফটাফট। বা ধরুন ভিমরুলে হুল ফোটাল। বা আপনি এমন কোনো মাশরুম খেয়ে ফেললেন, যা 'বিষাক্ত'। এই যে 'বিষ', আদতে এক ধরনের প্রোটিন যা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়া করে, সেগুলোকে বলা হয় টক্সিন। সাইটোটক্সিন, নিউরোটক্সিন, হিমোটক্সিন, সায়ানোটক্সিন ইত্যাদি নানাবিধ টক্সিন আছে, যা বিভিন্ন প্রত্যঙ্গকে বিভিন্ন ক্ষতিকর পদার্থ দিয়ে অকার্যকর করে দেয়। সাইটোটক্সিন কোষের ক্রিয়াকর্মকে, নিউরোটক্সিন নিউরাল নেটওয়ার্ককে, এটসেট্রা।
এই সমস্ত কথা এখন বলতে যাচ্ছি কেন? সেই গল্পে এবার আসি।
ইউজিন গারফিল্ডের নাম আপনাদের অনেকেই শোনেননি হয়ত। না, না, এর সঙ্গে কোনো কমিক স্ট্রিপের বিন্দুমাত্র সম্পর্ক নেই। ভদ্রলোক একজন আমেরিকান ভাষাবিদ, কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট ও ব্যবসায়ী, যিনি বিব্লিওমেট্রি ও সায়েন্টোমেট্রি নামে দুই বিষয়ের প্রবক্তা, যার সূত্র ধরে তিনি 'সায়েন্স সাইটেশন ইন্ডেক্স' নামে এক সূচক প্রবর্তন করেছিলেন। গত শতকের মাঝামাঝি এক সময় তিনি 'ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্টিফিক ইনফর্মেশন' নামে এক সংস্থা চালু করেন, যার পোশাকি নাম আইএসআই। এটা পাকিস্তানের গুপ্তচর শাখা নয়, এর কাজ হচ্ছে ঐ সাইটেশন ইন্ডেক্স জিনিসটাকে প্রতিষ্ঠিত করা। যাঁরা বিজ্ঞানে গবেষণার লাইনে আছেন, তাঁরা তো জানবেনই, যাঁরা নন, তাঁদের জন্যে খুব অল্প কথায় বলি – গবেষকরা যে 'পেপার' লেখে, সেই পেপারের গুরুত্ব কেমন, তার এক বিচার হয় সেই লেখা পড়ে কেউ তাদের-লেখা পেপারে এই পেপারের কাজের কথা উল্লেখ (রেফার) করেছে কিনা। আমি যদি একটা পেপার লিখি, যা কেউ পড়ে না, বা পড়লেও গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে না, তার মানে আমার পেপারটা একটা জাঙ্ক, ওর কোনো ভ্যালু নেই। পক্ষান্তরে যদি শ' খানেক বিজ্ঞানী সেই লেখা পড়ে তাকে গুরুত্বপূর্ণ জেনে তাঁদের নিজের পেপারে রেফার করেন (মানে কোনো উল্লেখযোগ্য তথ্য বা সিদ্ধান্ত আমার ঐ পেপার থেকে তিনি পেয়েছেন), তবে আমার পেপারের শ'-খানেক সাইটেশন হল। এই সাইটেশন অনুযায়ী জার্নালগুলোর আবার র্যাঙ্কিং হয়, তাকে বলা হয় 'ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর'। যে জার্নালের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর বেশি, সে তত বেশি কুলীন, তাতে পেপার পাবলিশ করা তত বেশি টাফ। 'নেচার' আর 'সায়েন্স' নামে দুটো ম্যাগাজিন আছে, তারা হচ্ছে কুলীনস্য কুলীন। সেখানে কারও পেপার বেরোলে সে কদিন কলার উঁচু করে ক্যাম্পাসে ঘুরে বেড়ায়।
সাধারণ প্রবন্ধে যে তথ্যসূত্র লেখা হয়, যাকে ইংরাজিতে বলা হয় বিব্লিওগ্রাফি, তার বিজ্ঞানভিত্তিক বিশেষ পর্যালোচনাই বিব্লিওমেট্রি। একজন সারা জীবনে কোথায় কতগুলো পেপার পাবলিশ করেছেন, তাদের ইমপ্যাক্ট ফ্যাক্টর ও সাইটেশন কত, ইত্যাদি নিয়ে তেমনি সায়েন্টোমেন্ট্রি। ইউজিন গারফিল্ড এই জিনিসটা প্রথম চালু করেছিলেন, তাঁর পরে আরও অনেকে নতুন নতুন ইকুয়েশন বানিয়ে জিনিসটা ক্রমে ক্রমে বেশ কঠিন এক খিচুড়ি বানিয়ে ফেলেছেন।
রিল্যাক্স। আমার এই নগণ্য প্রতিবেদন এ সব জিনিস নিয়ে ততটা নয়।
ইউজিন গারফিল্ড আরও একটা কাজ করেছিলেন। তিনি 'কারেন্ট কনটেন্টস' নামে এক জার্নাল বের করেছিলেন। ঐ যে নেচার, সায়েন্স নামের ম্যাগাজিনের কথা বললাম, সায়েন্স জার্নাল তো আর দু-একটা না, বেশ কয়েক হাজার। শুধু কেমিস্ট্রির জার্নালই কয়েক শো। লোকে জানবে কী করে কোথায় কী পাবলিশ হচ্ছে? তার জন্যে প্রতিটি জার্নাল আলাদা আলাদা করে তো পড়তে হবে। সে এক মস্ত হ্যাপা। উনি যেটা করেছিলেন, তা হচ্ছে, এক জার্নাল বের করলেন, যাতে প্রথম সারির বেশ কিছু জার্নালের লেটেস্ট ইস্যুর কন্টেন্ট পেজ একসঙ্গে করে ছাপিয়ে দিতেন। শুধুমাত্র সূচিপত্র। সেটাতে চোখ বুলিয়ে নিলে নজরে পড়ে যাবে কোন জার্নালে কী বিষয়ে লেখা ছাপা হয়েছে। তার সবগুলো তো নিজের কাজে গুরুত্বপূর্ণ হয় না। যেটা হয়, এবার সেই জার্নাল বের করে পড়ে নাও।
এই নীরস জিনিসের সঙ্গে তিনি নিজের লেখা কিছু কিছু প্রবন্ধ ছাপতেন। সাইটেশন জিনিসটার গুরুত্ব প্রতিষ্ঠিত করতে তিনি ১৯৮৬ সালের কারেন্ট কনটেন্টসের এক ইস্যুতে এমন এক প্রবন্ধ ছাপলেন, যা পড়ে অবাক হয়ে গেল পৃথিবীর এক শ্রেণির গবেষকরা।
সে সময় কলেরা রোগের ভীষণ প্রাদুর্ভাব হয়েছিল পৃথিবীর কিছু অঞ্চলে, মহামারীর মতো। গারফিল্ড দেখালেন গত প্রায় দুশো বছরে সেটা হচ্ছে কলেরা সংক্রান্ত সপ্তম মহামারী। কলেরা নিয়ে উল্লেখযোগ্য গবেষণা যাঁরা করেছেন, আইএসআই সাইটেশনে তাঁদের কাজের এক ডেটাবেস তৈরি করে সেই কাজকর্মের সাইটেশন পিছন ফিরে দেখতে দেখতে তিনি আবিষ্কার করলেন – 'সব পথ শেষে মিলে গেল এসে' এমন একজনের গবেষণালব্ধ পেপারে, যাঁর তেমন কোনো নামই শোনেনি বৃহৎ বিজ্ঞানজগত।
সেই মানুষটির নাম শম্ভুনাথ দে! একজন বঙ্গসন্তান!
শম্ভুনাথ দে-র যে পেপারটা নিয়ে এই মন্তব্য, সেটা ছাপা হয়েছিল নেচার পত্রিকায়। তার বিষয় ছিল কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরি-নিঃসৃত এক এন্টারোটক্সিনের কথা। শম্ভুনাথ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, এই টক্সিন তথা প্রোটিন নিঃসৃত হয় ভিব্রিও কলেরি জীবাণু থেকে, যা অন্ত্রের আভ্যন্তরীণ ঝিল্লিতে সেঁটে যাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় শরীর প্রচুর জল ঐ ঝিল্লি মারফত ঢেলে দেয় অন্ত্রের মধ্যে। এর ফলেই পাৎলা পায়খানা ও দ্রুত ডিহাইড্রেশন। নির্গত জল প্রতিস্থাপনের উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ না করলে অবধারিত মৃত্যু।
শম্ভুনাথের এই গবেষণালব্ধ ফলই জন্ম দেয় ওরাল রিহাইড্রেশন সলিউশন তথা ওআরএসের, তার আবিষ্কারকদের অন্যতম আর এক বঙ্গসন্তান কলকাতার চিত্তরঞ্জন হাসপাতালের ডাক্তার হেমেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায়। এবং জীবন্ত ব্যাক্টেরিয়া নয়, বরং তার দেহনিঃসৃত এই টক্সিনই যে কলেরার কারণ, শম্ভুনাথ এই সত্য প্রতিষ্ঠিত করায় সেই টক্সিনের প্রতিষেধক টিকা প্রস্তুতির লক্ষ্যও স্থির করে দেয় তাঁর গবেষণা।
শম্ভুনাথের জন্ম চুঁচড়োর বুড়োশিবতলার কাছে গড়বাটিতে, ১৯১৫ সালে, এক অভাবী পরিবারে। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ঠাকুরদার অকালমৃত্যুতে বাবা দাশরথিকে অনেকগুলো ভাইবোনদের মধ্যে বড় বলে ছোটবেলা থেকেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল, তিনি এক মুদিখানার দোকানে কাজ করতেন। পরে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলেন, যদিও তা তেমন চলেনি। কাকা পড়াশুনা শিখেছিলেন, তিনিই ছিলেন শম্ভুনাথের অনুপ্রেরণা। গড়বাটি হাই স্কুল থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি হুগলি মহসীন কলেজে স্কলারশিপ নিয়ে ভর্তি হন। সেখানেও ভালো রেজাল্টের সুবাদে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ আসে। পরিবারের আর্থিক অনটনের দিনে তাঁকে সাহায্য করেছিলেন কলকাতার ধনী ব্যবসায়ী কেষ্টধন শেঠ। মেধাবী ও ধীরস্থির প্রকৃতির শম্ভুনাথ অধ্যাপকদের প্রিয়পাত্র ছিলেন। ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দে শম্ভুনাথ এমবি এবং ১৯৪২ সালে ট্রপিক্যাল মেডিসিনে ডিপ্লোমা অর্জন করেন। ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড মাইক্রোবায়োলজির অধ্যাপক মণীন্দ্রনাথ দে তাঁকে বিশেষ স্নেহ করতেন। নিজের মেয়ে তরুবালার সঙ্গে শম্ভুনাথের বিয়ে দেন তিনি।
১৯৪২ সালে শম্ভুনাথ কলকাতা মেডিকেল কলেজে প্যাথলজির ডেমনস্ট্রেটর পদে নিযুক্ত হন ও অধ্যাপক বিপি ত্রিবেদীর অধীনে গবেষণা শুরু করেন। কয়েকটা পেপারও পাব্লিশ করেছিলেন তাঁরা। দেশ স্বাধীন হল যে বছর, সে বছর শ্বশুরমশাই তাঁকে পাঠালেন লন্ডনের ইউনিভার্সিটি কলেজ হাসপাতালে গবেষণার জন্যে। প্রফেসর জি আর ক্যামেরনের অধীনে হাইড্রোসেফালাস নিয়ে তিনি গবেষণা করে পিএইচডি পেলেন ১৯৪৯ সালে। দেশে ফিরে তিনি নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের প্যাথলজি ও ব্যাক্টিরিয়লজি বিভাগে যোগ দেন। কলেরা নিয়ে তাঁর গবেষণা শুরু তখনই। ১৯৫৫ সালে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে প্যাথলজি ও ব্যাক্টিরিয়লজি বিভাগের প্রধান হিসাবে যোগ দেন ও অবসর নেওয়ার আগে পর্যন্ত সেই কাজেই ব্যস্ত ছিলেন। অবসরের পর বোস ইনস্টিটিউটেও তিনি কিছুদিন গবেষণা করেছিলেন।
স্মরণ থাকতে পারে, এই কলকাতায় এসেই রবার্ট কখ কলেরার জীবাণু ভিব্রিও কলেরি আবিষ্কার করেছিলেন ১৮৮৩-৮৪ সালে। কিন্তু তিনি এই জীবাণুর প্রভাবে কীভাবে কলেরা হয়, তা বের করতে পারেননি, যে জন্যে এর প্রতিষেধক বা ওষুধ কিছুই তৈরি করা সম্ভব হচ্ছিল না। পঞ্চাশের দশকে তিনখানা যুগান্তকারী পেপারে শম্ভুনাথ সেই সমস্যার সমাধান করলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি পাবলিশ করলেন জার্নাল অফ প্যাথলজি অ্যান্ড ব্যাক্টিরিওলজিতে একটা পেপার বের করে দেখালেন একটা খরগোশের ক্ষুদ্রান্ত্রের কিছুটা কেটে নিয়ে দুপাশে সুতো দিয়ে বেঁধে তার মধ্যে কলেরার জীবাণু ভরে দিলে এক দিনের মধ্যেই ওই ক্ষুদ্রান্ত্র কলেরার পাৎলা পায়খানার মত চালধোয়া রঙের তরলে ভরে যায়। জীবাণুর বদলে তাদের কালচার করে ছেঁকে ফেলে শুধু জলটা ভরে দিলেও একই রেজাল্ট পাওয়া যায়। অর্থাৎ জীবাণু নিশ্চয় এমন কিছু নিঃসরণ করছে, যার ফলে কলেরার উপসর্গ দেখা দিচ্ছে।
১৯৫৬ সালে কলেরার বদলে প্যাথজেনিক ইসচিরিচিয়া কোলাই নিয়ে একই জার্নালে এবং ১৯৫৯ সালে পুরো ব্যাপারটার ব্যাখ্যা দিতে নেচার পত্রিকায় তিনি আরও দুটো পেপার পাবলিশ করেন। নেচার পত্রিকার প্রবন্ধটার শিরোনাম ছিল – এন্টারোটক্সিসিটি অভ ব্যাক্টেরিয়া-ফ্রি কালচার-ফিলট্রেট অভ ভিব্রিও কলেরি। সেই প্রথম কলেরার ক্ষেত্রে এন্টারোটক্সিসিটি শব্দটার ব্যবহার। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োকেমিস্ট্রির স্বনামধন্য এমিরিটাস প্রফেসর হাইনিঙ্গেনের মতে - De's paper deserves to go down as a classic in the history of cholera, and indeed, as later developments have shown, in the history of cellular physiology and biochemistry.
পৃথিবীর যত দেশে বিজ্ঞান চর্চা হয়, প্রায় সকলেরই একটা করে সায়েন্স অ্যাকাডেমি থাকে। ইন্ডিয়ার একটা না, দু-দুখানা এই রকম অ্যাকাডেমি আছে। একটার নাম ইনসা বা ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স অ্যাকাডেমি, যা শুরু হয়েছিল স্বাধীনতার আগেই। এর কেষ্টবিষ্টুদের সঙ্গে মতের মিল না হওয়ায় নোবেলজয়ী সিভি রামন দাক্ষিণাত্যে নিজের দল বানিয়ে প্রতিষ্ঠা করেন আইএএস বা ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অফ সায়েন্সেজ-এর। ইনসা দিল্লি চালায়, আইএএস চালায় ব্যাঙ্গালোর। দেশের অধিকাংশ নামী বিজ্ঞানীরা দুটো অ্যাকাডেমিরই সদস্য।
শম্ভুনাথ দে একটারও সদস্য ছিলেন না। তিনি যে এই এলিট সংস্থার উপযুক্ত, তা কারও মাথায় আসেনি। ইউজিন গারফিল্ডের 'ম্যাপিং কলেরা রিসার্চ অ্যান্ড দি ইমপ্যাক্ট অফ শম্ভুনাথ দে অভ ক্যালকাটা'-শীর্ষক সেই প্রবন্ধ ছাপা হওয়ার পর যখন দেশের কেষ্টবিষ্টুদের নজরে পড়ল, আরে, তাই তো, আমাদের মধ্যে তো একজন মহান ব্যক্তি আছেন, যাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ একজন বিদেশীও, তার এক বছর আগেই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন শম্ভুনাথ।
গারফিল্ড লিখছেন, একটা ব্যাপারে শম্ভুনাথের সঙ্গে তুলনা করা যায় বারবারা ম্যাকক্লিনটকের। দুজনেই ছিলেন প্রচারবিমুখ এবং নিজস্ব গণ্ডিতে আবদ্ধ। কিন্তু বারবারা আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যাকাডেমির সদস্য হয়েছিলেন, ফলে ১৯৮৩ সালের মেডিসিন নোবেল পেতে সুবিধে হয়েছিল। শম্ভুনাথ কোনো অ্যাকাডেমির সদস্য ছিলেন না। ফলে তাঁর কিছুই জোটেনি। ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে নোবেল ফাউন্ডেশনের আমন্ত্রণে তিনি কলেরা ও ডায়রিয়ার উপর অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে তাঁর যুগান্তকারী আবিষ্কারের ওপর বক্তৃতা দিতে গেছিলেন মাত্র।
সায়েন্স পত্রিকা প্রকাশ করে যে সংস্থা, যার নাম আমেরিকান অ্যাসোসিয়েশন ফর দি অ্যাডভান্সমেন্ট অভ সায়েন্স (এএএএস), তার এক সভায় ইন্ডিয়ান জার্নাল অভ টেকনোলজির এডিটর সুব্বাইয়া অরুণাচলম ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন – তৃতীয় বিশ্বের দেশ থেকে হাই-ইমপ্যাক্ট-ফ্যাক্টর জার্নালে পেপার ছাপানো অতি দুঃসাধ্য কাজ। কিন্তু তা যদি সম্ভব হয়ও, সেই পেপারকে সাধারণভাবে অবজ্ঞা করেন প্রথম বিশ্বের বিজ্ঞানীরা। হাই-ইমপ্যাক্ট-ফ্যাক্টর জার্নালে পরে ছাপা-হওয়া প্রথম বিশ্বের অন্য কারও পেপার সাধারণভাবে অগ্রাধিকার পেয়ে যায়, তাঁরই নামডাক হয়। শম্ভুনাথের ক্ষেত্রেও সেই ব্যাপার ঘটেছিল।
১৯৯০ সালে কারেন্ট সায়েন্স জার্নালের এক গোটা ইস্যু নিবেদিত হয় শম্ভুনাথের প্রতি শ্রদ্ধায়। তাতে প্রবন্ধ পাবলিশ করেন দেশ-বিদেশের বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব। তাঁদের মধ্যে ছিলেন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী জশুয়া লিডেরবার্গও। তিনি জানান, তিনি একাধিকবার শম্ভুনাথের নাম নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন করেছিলেন। তাঁর মতে - our appreciation of De must extend beyond the humanitarian consequences of his discovery. . . he is also an examplar and inspiration for a boldness of challenge to the established wisdom, a style of thought that should be more aggressively taught by example as well as precept.
ইন্ডিয়ান ইনস্টিট্যুটের (তখনকার ভাবী, এখনকার প্রাক্তন) ডিরেক্টর অধ্যাপক বলরাম লিখলেন, শম্ভুনাথের মৃত্যু হয়েছে সম্মানহীনভাবে, অগীতভাবে। তিনি যে জীবনে বিশেষ কোনো সম্মান বা পুরস্কার পাননি, এটা আমাদের বিজ্ঞানী-সমাজের এক বিশাল ত্রুটি। যে বিষয় নিয়ে তিনি গবেষণা করেছিলেন, দেশের পক্ষে তা ছিল অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। সাহসী চিন্তাধারা, দৃঢ় অধ্যবসায় ও গভীর মনোনিবেশে তিনি এক ব্রেক-থ্রু সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পেরেছিলেন। তাঁর দৃষ্টান্ত নিঃসন্দেহে উদ্বুদ্ধ করবে সেই সমস্ত তরুণ গবেষকদের যাদের সামনে ঝুলছে গবেষণার নামে বড় বড় প্রোজেক্ট, প্রচুর টাকা-পয়সা-ডলার এবং ঢক্কানিনাদ-সর্বস্ব এক অন্তঃসারশূন্য প্রচার।
আশ্চর্য এই, আমেরিকান কম্পিউটার সায়েন্টিস্ট ইউজিন গারফিল্ড সায়েন্স সাইটেশনের খড়ের গাদায় সূঁচের মতন তাঁর খোঁজ না পেলে এতসব হয়ত আমরা জানতেও পারতাম না।
অমিতাভ প্রামাণিক / ২৩ জুন ২০২১
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন