সোমবার, ৭ জুন, ২০২১

আলো কি কণা না তরঙ্গ ~ সৌমিক দাশগুপ্ত


আলো বস্তুটা কী? সেই ছোটবেলা থেকে জেনে আসছি, আলো নিজে অদৃশ্য, অন্য বস্তুকে দৃশ্যমান করতে সাহায্য করে। এ বিষয়ে খোঁজ খবর নিতে শুরু করলেন তিনি। কিনি? আরে আদ্ধেক বৈজ্ঞানিকের নাম না মনে পড়লে, সিধে পরম পিতা নিউটনকে স্মরণ করে নিতে হয়। ভদ্রলোক জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ সব করে গেছেন। নিউটন না হলে আইনস্টাইন। অন্তত সেভেন্টি পার্সেন্ট কেসে এই ফর্মুলা কাজে লাগবেই লাগবে। অবশ্য আদিকাল থেকে ইউক্লিড, দেকার্তে, ডেমোক্রেটাসরা এই নিয়ে মাথা ঘামিয়েছেন। আমরা নিউটনের কাজ নিয়েই কথা বলি। 


তা নিউটন সায়েবের কাছে অত যন্ত্রপাতি ছিল না সেই সময়ে। যা ছিল, তাই দিয়ে খুটুর খাটুর করে বলে দিলেন, আলো হল এক ধরনের পার্টিকল। নিউটন বলে কথা। লোকে মেনেও নিল। কিন্তু পাবলিক অনুভব করলো, কোথায় যেন একটা লোচা থেকে যাচ্ছে। আলোর নেচার, পার্টিকল থিয়োরিকে সাপোর্ট করছে না। লোকে আপত্তি করতে শুরু করলো। 

এমনই এক ঢ্যাঁটা লোক ছিলেন হিউজেন। প্রমাণ করেই ছাড়বেন, আলো কোনো কণা নয়। তরঙ্গ মাত্র। প্রমাণ করেই দেবেন, নিউটনের কণা তত্ত্ব বা করপাসকুলার থিয়োরি আসলে ভুল। 

কিন্তু বললেই তো করা সম্ভব নয়। হুঁ হুঁ বাওয়া। ওর নাম নিউটন। হিউজেন অনেক চেষ্টা করলেন। গাদা গাদা আলফা বিটা গামা ল্যামডা লেখা থিয়োরিটিকাল থিসিসও নামালেন। কিন্তু ইহা বিজ্ঞান। হাতে কলমে প্রমাণিত না হলে উহা প্রমাণ নহে। অবশেষে ভগ্নহৃদয়ে আলোর তরঙ্গ খোঁজার কাজে ক্ষান্ত দিলেন। 

গুরুর অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করার প্রতিজ্ঞা নিয়ে এগিয়ে এলেন ইয়ং, হিউজেনের ছাত্র। অবশেষে এলো সেই দিন। প্রমাণিত হল, লাইট ইজ নট পার্টিকল। লাইট ইজ ওয়েভ। বিখ্যাত সেই এক্সপেরিমেন্টের নাম, ইয়ং'স ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্ট। 

খটোমটো লাগলেও, পরীক্ষাটি কিন্তু বেশ সহজ। একটা একরঙা আলো নিতে হবে। সাদা আলো চলবে না। কারণ সাদা মানে অনেক রঙের সমাহার। তাদের ওয়েভ লেংথ বা তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বিভিন্ন রকম। তা সেই একরঙা আলোকে একটা ধাতব পাত, যাতে দুটো ফাঁক (স্লিট) আছে, তার মধ্য দিয়ে পাঠানো হল। দেখা গেলো পেছনে রাখা পর্দায় আলোর দুটো ব্যান্ড নয়, ফুটে উঠেছে সারি সারি আলো আঁধারির ব্যান্ড। 

ধরা যাক, পুকুরে দুটো ঢিল ছোঁড়া হল। দুটো তরঙ্গ সৃষ্টি হল। দেখা যাবে, এই দুই তরঙ্গ মিলে গিয়ে কোথাও বড় তরঙ্গ সৃষ্টি হচ্ছে। কোথাও বা দুটো তরঙ্গই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে৷ একই সাথে কনস্ট্রাকশন আর ডেসট্রাকশন। দুটো ওয়েভ খাপে খাপে মিলে গেলে, অর্থাৎ ক্রেস্টের সাথে ক্রেস্ট, ট্রফের সাথে ট্রফ মিলে গেলে সৃষ্টি হয় আরো বড় ওয়েভ, কিন্তু কোথাও যদি একের ক্রেস্ট অন্যের ট্রফের সাথে ধাক্কা খায়, একে অন্যকে খতম করে দেয়।

একই ভাবে আলো বিহেভ করেছিল। যেখানে কনস্ট্রাকশন, তৈরী হয়েছিল আলোর ব্যান্ড। যেখানে ডেস্ট্রাকশন, নেমে এসেছিল আঁধার। (সাথে ছবি দিলাম একটা)। প্রমাণ হল আলো একটি তরঙ্গ। পিছনে হটলো নিউটনের করপাসকুলার থিয়োরি। 

এর পর এলেন প্ল্যাংক, রাদারফোর্ড, নীলস বোরেরা। তাঁদের হাতে তখন ডাবল স্লিট এক্সপেরিমেন্টের চাবিকাঠি এসে গেছে। ফের হল ডাবল স্লিটের পরীক্ষা। কিন্তু এবার আলোর বদলে নেওয়া হল ইলেক্ট্রন গান। যে আলোর মতোই ইলেক্ট্রনের স্রোত ছুঁড়ে দেবে ওই মেটাল পাতের মধ্য দিয়ে। ইলেক্ট্রন একটি দৃশ্যমান বস্তু। শক্তিশালী মাইক্রোস্কোপে দেখা যায়। অর্থাৎ এনার্জির বদলে ম্যাটার নিয়ে শুরু হল পরীক্ষা। 

সবিস্ময়ে তাঁরা দেখলেন, ইলেকট্রন আচরণ করছে আলোর মতোই। পেছনে তৈরী হচ্ছে সেই আলো আঁধারির খেলা। কীভাবে সম্ভব হচ্ছে এটা? বস্তু আচরণ করছে শক্তির মত। কণা আচরণ করছে তরঙ্গের মত। ব্যাপারটাকে আরো ভালোভাবে দেখার জন্য তাঁরা ওই স্লিটের আগে একটা অবসার্ভার লাগালেন। যে গোয়েন্দার নজরে দেখবে, কীভাবে ইলেকট্রন বদলে যাচ্ছে ওয়েভে। ঘটছে বস্তু থেকে শক্তির রূপান্তর।

চুড়ান্ত, চুড়ান্ত বেকুব বনে গেলেন তাঁরা। যেই মুহুর্তে অবসার্ভার রাখা হল, পলকে পেছনের পর্দার সেই আলো আঁধারির প্যাটার্ন পালটে গেল দুটো সমান্তরাল রেখায়। অর্থাৎ স্বাভাবিক কণার স্রোত দুটো জানলার মধ্য দিয়ে গেলে যেরকম আচরণ হওয়া উচিত, সেরকমই। নজর সরাতেই আবার সেই আলো আঁধারী। আলো আঁধারীর ব্যান্ড। নজর দিলেই স্বাভাবিক আচরণ। 

সেদিন ইতিহাস তৈরী হয়েছিল। খুলে গেছিল বিজ্ঞানের এক নতুন দুনিয়া, যার নাম কোয়ান্টাম জগৎ। এ এমন জগৎ, যা অনিশ্চয়তায় ভরপুর। প্রমাণিত হল, আমরা বাস্তবে যা যা জিনিস দেখছি, তা আসলে তরঙ্গ। একেবারে বেসিক লেভেলে পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুই তরঙ্গ। এই বস্তু সত্ত্বা আসলে এক ইল্যুশন মাত্র। আমরা দেখছি, আমরা অবসার্ভ করছি, তাই সে বস্তু। নয়ত সে আসলে ওয়েভ। এই মুহুর্তে যাকে আমি দেখছি না, তার আসলে কোনো অস্তিত্বই নেই। সে আছে তরঙ্গাকারে। আমি যখনই তাকে দেখবো, সে আমার জন্য নিজের আকার ধারণ করবে। তৈরী হল বিখ্যাত ওয়েভ পার্টিকল ডুয়ালিটি তত্ত্ব। কে তৈরী করলেন?  লেখার একদম শুরুতে নিউটনের সাথে যাঁর নাম নিয়েছিলাম, সেই ভদ্রলোক। নিউটন বিজ্ঞানের ব্রহ্মা হলে তিনি বিজ্ঞানের বিষ্ণু। আলবার্ট আইনস্টাইন। তিনি বললেন,
 "It seems as though we must use sometimes the one theory and sometimes the other, while at times we may use either. We are faced with a new kind of difficulty. We have two contradictory pictures of reality; separately neither of them fully explains the phenomena of light, but together they do."

 গোদা বাংলায় যার মানে দাঁড়ায় আলোর দুটো পরস্পর বিরোধী সত্ত্বা আছে। একই সাথে সে তরঙ্গ এবং কণা। মান রক্ষা হল নিউটনের করপাসকুলার থিয়োরির। আবিষ্কার হল আলোর কণা, 'ফোটন'।
লেখা শেষ করার আগে, মরফিউসের সেই দুর্দান্ত বক্তব্য মনে পড়ছে।
 "What is "real"? How do you define "real"? If you're talking about what you can feel, what you can smell, taste and see then "real" is simply electrical signals interpreted by your brain."

এবার শেষ করি রবীন্দ্রনাথ দিয়ে। কোয়ান্টাম পদার্থবিদ্যায় রবীন্দ্রনাথ???  হুঁ হুঁ বাওয়া। আছো কোথায়। এ নিয়েও কবিতা লিখে গেছেন উনি। আজও হয়ত কলম চালিয়ে যাচ্ছেন, কোনো কোয়ান্টাম সমান্তরাল জগতে। 

আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ,
চুনি উঠল রাঙা হয়ে।
আমি চোখ মেললুম আকাশে,
জ্বলে উঠল আলো
পুবে পশ্চিমে।
গোলাপের দিকে চেয়ে বললুম "সুন্দর',
সুন্দর হল সে।

সৃষ্টির গোড়ার কথাই এই 'আমি'। আমি আছি, তাই এই পৃথিবী আছে। আমি নেই, তো কিচ্ছু নেই। আছে এক সুবিশাল অন্তহীন তরঙ্গ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন