''আমার পুত্র বলিয়া পরিচিত শ্রীযুক্ত নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় যারপরনাই যথেচ্ছাচারী ও কুপথগামী এজন্য, ও অন্য অন্য গুরুতর কারণবশতঃ আমি তাহার সংশ্রব ও সম্পর্ক পরিত্যাগ করিয়াছি। এই হেতুবশতঃ বৃত্তিনির্বন্ধস্থলে তাঁহার নাম পরিত্যক্ত হইয়াছে এবং এই হেতুবশতঃ (তিনি)…. আমার উত্তরাধিকারী বলিয়া পরিগণিত অথবা... এই বিনিয়োগ পত্রের কার্যদর্শী নিযুক্ত হইতে পারিবেন না।''
নারায়ণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিদ্যাসাগরের প্রথম সন্তান ও একমাত্র পুত্র সন্তান।
উইলে রয়েছে পঁয়তাল্লিশ জন নরনারীকে নির্দিষ্ট হারে মাসিক বৃত্তি দেবার নির্দেশ। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন চিকিৎসালয় ও বালিকা বিদ্যালয়ের জন্য বিধিব্যবস্থা ।
এই উইল রচিত হয়েছে ১৮৭৫ সালে, আজ থেকে ১৪৪ বছর আগে।
এক নিরানন্দ কর্মবীর।
কলকাতার লোভী, সংকীর্ণমনা, প্রসাদলোভী বাবু ও জমিদার শ্রেণী, তাদের বিদূষকবৃন্দ, শ্রেণী স্বার্থরক্ষাকারী ইংরেজ শাসক, নিজ পরিবার - কেউ রেয়াৎ করেনি এই মানুষটিকে।
একটা তথ্য দিলে বোঝা যাবে কতদূর বিরুদ্ধ পরিবেশে এই মানুষটি লড়াই করে গেছেন।
বিধবা বিবাহের পক্ষে বিদ্যাসাগর স্বাক্ষর পেয়েছিলেন এক হাজারেরও কম, পক্ষান্তরে রাধাকান্ত দেব পেয়েছিলেন ছত্রিশ হাজার, সাতশ তেষট্টিটি স্বাক্ষর। বহুবিবাহ বন্ধের পক্ষে সই পেয়েছিলেন পঁচিশ হাজার। বিরুদ্ধে ছিল আপামর জনগণ।
তার সহায়তায় দাঁড়ায়নি তৎকালীন বুদ্ধিজীবীদের প্রথিতযশা, জনপ্রিয় অংশ।
ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত স্থূল কবিতা লিখে মজা লুটছেন।
"বাঁধিয়াছে দলাদলি লাগিয়াছে গোল
বিধবার বিয়ে হবে‚ বাজিয়াছে ঢোল।
শরীর পড়েছে ঝুলি, চুলগুলি পাকা
কে ধরাবে মাছ তারে, কে পরাবে শাঁখা।"
বঙ্কিমচন্দ্র বিষবৃক্ষে সূর্যমুখীর পত্রে লেখেন, "ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর নামে কলকাতায় কে না কি বড় পন্ডিত আছেন। তিনি আবার একখানি বিধবাবিবাহের বহি বাহির করিয়াছেন। যে বিধবার বিবাহের ব্যবস্থা দেয়, তিনি যদি পন্ডিত, তবে মূর্খ কে?"
আবার প্যারীচরণ সরকার, রাজনারায়ণ বসু, ভূদেব মুখোপাধ্যায়, মদনমোহন তর্কালঙ্কার, রাধানাথ শিকদার, দীনবন্ধু মিত্র প্রমুখ তুলনায় অনামারা বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেছেন ।
নিজে সংস্কৃত পন্ডিত হয়েও বুঝেছিলেন পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রয়োজন, শাস্ত্রীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে হয়েছিলেন খড়্গহস্ত। ধর্মশাস্ত্রে পাণ্ডিত্য ছিল অসামান্য। কিন্তু ধর্ম নিয়ে মাতামাতি ছিল তার চিন্তার পরিপন্থী।
বলেছিলেন, 'শাস্ত্রে যার বীজ আছে এমন কোনও বৈজ্ঞানিক সত্যের কথা শুনলে সেই সত্য সম্পর্কে শ্রদ্ধা ও অনুসন্ধিৎসা জাগা দূরে থাক, তার ফল হয় বিপরীত। শাস্ত্রীয় কুসংস্কার আরও বাড়তে থাকে, তারা মনে করেন যেন শেষ পর্যন্ত শাস্ত্রেরই জয় হয়েছে। বিজ্ঞানের জয় হয় নি।'
একদিন এই শহর কলকাতা থেকে শারীরিক ও মানসিক ভাবে আক্রান্ত মানুষটি চলে গিয়েছিলেন শহর ও সমাজ ছেড়ে দূরে, বাঙালীর সীমানার বাইরে। তার আগে আমাদের দিয়ে গেছেন বর্ণপরিচয়, ভাষা, শিক্ষা প্রসারে স্কুল ও কলেজ, নারীর ন্যূনতম মর্যাদা রক্ষার অধিকার, আর অপরিমেয় সমাজ সংস্কার।
প্রতিটি বাঙালি বিদ্যাসাগরের কাছে আকণ্ঠ ঋণী।
অনেক দুঃখে বলেছিলেন, ''আমাদের দেশের লোক এত অসার ও অপদার্থ বলিয়া পূর্বে জানিলে আমি কখনই বিধবাবিবাহ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করিতাম না।''
বাঙালি অসার ও অপদার্থ। সুপরিচিত বাঙালি বুদ্ধিজীবীর মুখ মুখোশে ঢাকা। তখন ও এখন।
আর এখন বিশেষভাবে বাঙালি চিন্তাহীন, ভাবনাহীন। তাদের হৃদয় আজ শকুন ও শেয়ালের খাদ্য ।
এখানে এসেছে অন্ধকারে দীর্ঘ শীত-রাত।
এই ম্লান সন্ধ্যায়, দোহাই, ওনার সম্পর্কে কথা যেন একটু কম বলি। নিজেদের চূড়ান্ত আহাম্মকি যেন বারেবারে উন্মুক্ত না করি। অথবা না হয়ে যাই পারিতোষিক প্রাপ্ত ঊনবিংশ শতাব্দীর বিদূষক।
বরং পড়ে ফেলি বিনয় ঘোষের 'বিদ্যাসাগর ও বাঙালি সমাজ' এবং ইন্দ্র মিত্রের 'করুণাসাগর বিদ্যাসাগর'।
আর পাঠ করি এক আপোসহীন কবির কবিতা-
মুখোশ ছিল না তার, তাই তাঁর মুখের উপর
দৃশ্যগুলি কুয়াশার, কান্না ছুঁয়ে অবশেষে ঝড়;
---------------------------------------------------
অথচ গভীরে তাঁর, শান্ত-স্থির করুণাসাগর।
----------------- কবি বীরেন চট্টোপাধ্যায়
Madhusree Bandyopadhyay
26/09/2019
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন