সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯

অসম - কী ভাবছেন? এনআরসি, অবশ্যই - আর ডাঃ দেবেন দত্তের কথা? ~ বিষাণ বসু

অসম - কী ভাবছেন?
এনআরসি, অবশ্যই - আর ডাঃ দেবেন দত্তের কথা?

খবরটা সবাই জানেন। ঊনিশ লক্ষ, হ্যাঁ, ১৯,০০,০০০ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে গেলেন। অসমে। সব কাগজের প্রথম পাতায় পড়া গিয়েছে এই খবর - ইলেকট্রনিক মিডিয়াতেও সারাদিন ধরে দেখানো হয়েছে। এই রাজ্যেও এনআরসি করলে কেমন হয়, কথা হচ্ছে সেই নিয়েও। আপনি কি চিন্তিত? ভাবছেন?

একই সময়ে অসমেরই এক চা-বাগানে চিকিৎসা করছিলেন এক ডাক্তার। বয়স পঁচাত্তর। চাকরি থেকে অবসর নিয়েছিলেন আগেই - কিন্তু, চা-বাগানে ডাক্তার পাওয়া যায় না। তাই, সেই চিকিৎসক, ডাঃ দেবেন দত্ত, দায়বদ্ধতার কারণেই, রয়ে গিয়েছেন - চা-বাগানের মজুর-কামিন-শিশুগুলোর চিকিৎসা করতে।

না, রয়ে গিয়েছেন নয় - রয়ে গিয়েছিলেন। ডাঃ দেবেন দত্ত আর নেই।

পরশু বিকেলে কোনো রোগী মারা গিয়েছেন বলে তাঁর ডাক পড়ে। স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পৌঁছালে, তিনি ক্ষুব্ধ, উন্মত্ত পরিজনের সামনে পড়ে যান। ঘিরে ধরে কয়েকশো মানুষ। হ্যাঁ, পোষাক পরে দুপায়ের উপর তো অন্য প্রজাতি দাঁড়ায় না সচরাচর। প্লাস, মুখে খিস্তি আর হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়েও সাধারণত মনুষ্যেতর প্রাণীরা সঙ্ঘবদ্ধ হয় না। কাজেই, সেই "মানুষেরা" ঝাঁপিয়ে পড়ে ডাঃ দেবেন দত্তের ওপরে।

পুলিশ ছিল - থুড়ি, ছিলেন। তাঁরা পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছিলেন। দেবেনবাবুকে বাঁচানোর কথা সেভাবে মাথায় ছিল না।

আক্রান্ত, রক্তাক্ত দেবেনবাবু পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় নেন স্বাস্থ্যকেন্দ্রের একটি কোণায় - সেই স্বাস্থ্যকেন্দ্র, যেখানে তাঁরই হাতে শুশ্রূষা পেয়েছেন নাম-না-জানা কতজন - জন্ম নিয়েছে কত শিশু - তাদের কেউ কেউ ওই উন্মত্ত মানুষগুলোর মধ্যে ছিলেন কি? দেবেনবাবু অত ভাবছিলেন না, সম্ভবত - তিনি রক্তক্ষরণ বন্ধ করতে চাইছিলেন - তিনি রক্ত দেখে ঘাবড়ান না, শুধু জানেন, রক্ত বন্ধ না হলে কী হতে পারে।

না,,স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কোনো গোপন কুঠুরি ছিল না। জনতা দেবেনবাবুর খোঁজ পেয়েই যায়। বন্ধ দরজার ওপার থেকে ভেসে আসতে থাকে খিস্তি-হুমকি - কাচের জানলা ভেঙে যায় এলোপাথাড়ি ইঁটে - দেবেনবাবুর শরীরে বিঁধে যায় কাচ - রক্তক্ষরণ বাড়তেই থাকে। দেবেনবাবু ডাক্তার - তিনি রক্ত দেখে ঘাবড়ান না - তিনি শুধু জানেন, ঠিক কতক্ষণ রক্তপাত চললে - তিনি ঘড়ি দেখেন।

উন্মত্ত মানুষগুলোকে থামানোর চেষ্টা হয়নি এমন নয় - পুলিশ বাদ দিয়েও তো বাকি অনেকেই ছিলেন - থামানো যায় নি - আর জোর খাটানোর ক্ষমতা তাঁদের ছিল না - জোর খাটাতে পারতেন যাঁরা, তাঁরা তখনও পরিস্থিতির উপর কড়া নজর রাখছেন। জনতা জানান, দেবেনবাবুকে একেবারে শেষ করতে পারলেই তাঁরা থেমে যাবেন।

অনেক, অনেকক্ষণ পরে ম্যাজিস্ট্রেট আসেন - সাথে বিশেষ বাহিনী। দেবেনবাবুর ঘড়ি ততক্ষণে ভেঙেচুরে গিয়েছে সম্ভবত - চালু থাকলেও তিনি আর দেখছিলেন না। অচৈতন্য ডাঃ দেবেন দত্তকে নিয়ে যাওয়া হয় জোড়হাট মেডিকেল কলেজে। দেবেনবাবুর অত ধৈর্য ছিল না আর - তিনি, অনেকক্ষণই, চিকিৎসার উর্দ্ধে।

আপনি কি চিন্তিত? ভাবছেন কিছু?

ভাববেন না? দরকার নেই কোনো? সত্যি, ঊনিশ লাখের পাশে এক - হাস্যকর। কিন্তু, সেই এক যখন চিকিৎসক - তখন আক্রান্তের সংখ্যা কত?

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেন, হাজার নাগরিকপিছু কমপক্ষে একজন ডাক্তার থাকা জরুরী। দেশে এই অনুপাত ঠিক কত, সেই নিয়ে চাপানউতোর প্রচুর। তবে, কেউই অস্বীকার করেন না, যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে ডাক্তার পাওয়া কঠিন। প্রান্তিক অঞ্চলে ডাক্তারের অনুপাত - সম্ভবত ওই কুড়ি হাজারে এক। চা-বাগানে, পরিস্থিতি আরো খারাপ। সেই এক যদি নিহত হন - আক্রান্তের সংখ্যা দাঁড়ায় কুড়ি হাজার এক। এই আতঙ্কে পাশের বাগান থেকেও ডাক্তার চলে গেলে - আক্রান্ত, চল্লিশ হাজার এক। সংখ্যাটা বাড়তে থাকে, বাড়তেই থাকে।

এনআরসি নিয়ে ভাবা জরুরী - ঊনিশ লক্ষ মানুষ রাষ্ট্রহীন হয়ে যাচ্ছেন, সেই নিয়ে ভাববেন না!!

কিন্তু, ডাঃ দেবেন দত্তকে নিয়েও ভাবুন। না হয় দেবেনবাবুর কথা না-ই ভাবলেন - অন্তত ওই কুড়ি কি চল্লিশ কি ষাট কি আশি হাজার মানুষের কথা ভাবুন। এঁদের চিকিৎসাহীন হয়ে পড়ার কথা ভাবুন।

চা-বাগান কর্তৃপক্ষ নোটিশ জারি করেছেন - এই ঘটনার প্রেক্ষিতে, অনির্দিষ্টকালের জন্যে বাগান লক-আউট। নোটিশে অবশ্য উল্লেখ, কর্মীদের, তাঁদের পরিবারের জন্যে স্বাস্থ্যপরিষেবা চালু থাকবে। বিশ্বাস করুন, এতকিছুর পরে বড্ডো হাসি পেয়ে গেল। ওই স্বাস্থ্যপরিষেবা চালু থাকার কথাটুকু পড়ে। মৃত্যুর ওপারে জীবন আছে কিনা জানা নেই - কিন্তু, সেইখানে কলবুক পৌঁছায় না নিশ্চিত - স্যার, হাসপাতালে ইমার্জেন্সি পেশেন্ট এসেছে, খারাপ কন্ডিশনে লেবার পেশেন্ট স্যার, ডাঃ দত্ত তো ফোনই তুলছেন না।

  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন