বৃহস্পতিবার, ৩১ জুলাই, ২০২৫

প্রশাসন ও স্বাস্থ্য ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

ওপরওয়ালারা মাঝেমধ্যেই বলেন, মানে উপদেশ দেন, "ঘরে বসে প্রশাসন চালাবেন না, বাইরে যান, নজরদারি চালান, লোকজনের সাথে কথাবার্তা বলুন, তাদের জানা বোঝার চেষ্টা করুন।" বিশ্বাস করুন চেষ্টা করি। এসির ঠান্ডা ঘর ছেড়ে বেরিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। "দুয়ারে প্রশাসন"। তারই এক ঝলক রইল সুধী পাঠকদের জন্য। 

সরকারি হাসপাতালের একটা টিপিক্যাল দিন। একটা বেঞ্চে ধরুন পাশাপাশি বসে আছে ওরা। পেশেন্ট নম্বর এক। মহিলা মাঝবয়সী, মাছের বাজারে প্রতি সপ্তাহেই এঁকে দেখতে পান  আপনি। সামান্য পয়সার বিনিময়ে আপনার মাছগুলো কেটে কুটে দেন। সেটাই পেশা। মাছ কাটতে গিয়ে হাত কেটে ফেলে ফিনকি দিয়ে রক্ত। জল দিয়ে ধোয়ার পরে রুমাল বের করে বেঁধে দিলেন। মাছের বাজারে ফার্স্ট এইড আর কি বা হবে। হাসপাতালে যেতে বললেন। সেলাই লাগবে। মহিলার দু চোখ দিয়ে অঝোরে জলের ধারা। কেন মাসি কাঁদছো কেন। খুব ব্যথা ? ব্যাথা নয় বাবু। সেলাই মানেই তো সাত দিন কাজ বন্ধ। রোজগার বন্ধ। খাবো কি ?

পেশেন্ট নম্বর দুই। বছর দশেক এর একটি বালিকা। বেআইনি বাজি কারখানায় ততোধিক বেআইনি বাজি বানাতে গিয়ে মুখের ওপরেই ফেটেছে। চোখ মুখ আগুনে ঝলসে গেছে। পরিত্রাহি চেঁচাচ্ছে। চোখটা বোধ হয় বাঁচবে না। সঙ্গে আসা স্বামী পরিত্যক্ত মায়ের আরো বড় চিন্তা, পরিবারে রোজগারের একটা লোক কমে গেল।

বেঞ্চে বসে থাকা তিন নম্বর। সতেরো আঠেরো বছরের কিশোর। গ্যারেজে কাজ করে, আপনার গাড়িটা এর হাতেই ঠিক হয়। হেড মিস্ত্রির হেল্পার। কালি ঝুলি মাখা কিশোরটিকে সেই নিয়ে এসেছে। গাড়ির তলায় শুয়ে কাজ করছিল। জ্যাক উল্টে গিয়ে গোটা গাড়িটা তার সমস্ত ওজন নিয়ে পায়ের ওপরে পড়েছে। দুটো পা'ই বিশ্রী রকম থেঁতলে গেছে। একটা পা সম্ভবতঃ এমপুট করতে হবে। হেড মিস্ত্রির আকুল জিজ্ঞাসা, পা টা কোনভাবেই বাঁচানো যাবে না ডাক্তারবাবু ? পা চলে যাওয়া মানে তো বেকার হয়ে যাবে আবার।

পেশেন্ট নম্বর চার। চব্বিশ পঁচিশ এর যুবক। এ কাঁদছে না। ক্লান্ত দেহটা নিয়ে চুপচাপ বসে আছে। জন্ডিস হয়েছে, আমাদের ভাষায় ইনফেক্টিভ হেপাটাইটিস। অন্ততঃ একমাস বিশ্রাম নিতে হবে এই পরার্মশ শুনে একটু বাদেই ছেলেটার মুখ থমথমে হয়ে যাবে। কেনরে ছেলে ?  বিএ পরীক্ষা দেব ডাক্তারবাবু। অভাবের সংসারে একটা সাইকেল নিয়ে সকাল বেলায় খবরের কাগজ বিলি করে আপনার ফ্ল্যাটে। বিশ্রাম মানে কাজটাই চলে যাবে। শুধু রোজগার না। পড়বো কি করে ? 

বেঞ্চের পাঁচ নম্বর ব্যক্তি মাঝবয়সী লোক। চিন্তা ভাবনায় বয়সের থেকে বেশি বুড়ো লাগছে। টিবি রোগ ধরা পরতে শপিং মলের সেলস ক্লার্ক এর চাকরিটা গেছে। দুদিন আগে এই মানুষটাই আপনার ক্রেডিট কার্ড ঘষে টাকা নিয়েছিল। দু মাস তো ওষুধ খেলাম ডাক্তারবাবু।  আমার অসুখটা কি এখনো ছোঁয়াচে ? একবারটি লিখে দেবেন আমি সেরে গেছি। যদি চাকরিটা আবার ফিরে পাই ?

হাসপাতালের আউটডোর/এমার্জেন্সির বেঞ্চে বসা কয়েকটা লোক। মানুষ। পেশেন্ট আমাদের কাছে। আসলে এক টুকরো ভারতবর্ষ। ডাক্তারের অপেক্ষায় আছে। কখন সেই ধন্বন্তরীর দেখা পাওয়া যাবে। যিনি দেখা দিলেই সব ভালো হয়ে যাবে। ঠিক হয়ে যাবে। 

অপেক্ষমান এই মানুষগুলোর সামনে আমি, ক্ষুদে প্রশাসক, রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষুদে প্রতিভূ। মানুষগুলোর একটাই জিজ্ঞাসা। সব ঠিক হয়ে যাবে তো ? প্রশ্নের উত্তরের অপেক্ষায় কাটা হাত, পোড়া মুখ, ভাঙা পা, বেড়ে যাওয়া লিভার, ফোপরা ফুসফুস নিয়ে ওরা বসে আছে পাশাপাশি। আমার আপনার সহনাগরিক। ক্ষুদে একটা পশ্চিমবঙ্গ, ক্ষুদে একটা ভারতবর্ষ। ওরা বসে আছে কাছাকাছি ঘেঁষাঘেষি করে। অপেক্ষায় আছে। প্রশাসনের কাছ থেকে, সরকারের কাছ থেকে, রাষ্ট্রের কাছ থেকে সদুত্তর এর আশায়। ওরা বসে আছে পরম ধৈর্য নিয়ে, সহিষ্ণুতা নিয়ে, অনেক আশা নিয়ে, সমস্যার সমাধানের অপেক্ষায়, আচ্ছে  দিন এর অপেক্ষায়। ওদের দুয়ারে প্রশাসন, দুয়ারে সরকার, দুয়ারে রাষ্ট্র সবকা সাথ সবকা বিকাশ পারবে দিতে সমাধান?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন