শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

পুলিশের ডাক ~ অনিমেষ বৈশ্য

আমাদের পাড়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ফাঁড়ির উঠোনে একটি কাঁঠালগাছ। পাশে একটি ছোট শিবমন্দির। আমরা সেই মন্দিরের চাতালে বসে দিনরাত তাস পিটতাম। মাঝে-মাঝে দু-একজন পুলিশ উনুনে ভাত চাপিয়ে আমাদের সঙ্গে দু-হাত তাস খেলে নিতেন। এক বিশাল চেহারার পুলিশ থেবড়ে বসে কুটনো কুটতেন। আর একজন পুলিশের নাম মনে নেই। তাঁর বয়স ছিল কম। তিনি হেমন্তের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে নিশ্চিন্তে উল বুনতেন। কার জন্য বুনতেন জানি না। তখনও রেডিমেড সোয়েটারের যুগ আসেনি। মা-মাসি-পিসি-দিদিমণি সবার হাতে থাকত উলের কাঁটা। কিন্তু একজন তাগড়াই চেহারার পুলিশ তাঁর কর্মস্থলে উল বুনছেন, এ দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। শীর্ষেন্দু মুখুজ্জে জানতে পারলে ওঁকে নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখে ফেলতেন। আমি লিখতে পারি না বলে পাঠকরা বঞ্চিত হলেন। 
এই পুলিশ ফাঁড়ির পত্তন হয়েছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। জরুরি অবস্থার আশপাশে। আমরা তখন ইস্কুলে পড়ি। নেহাতই কচিকাঁচা।

তখন থেকেই ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের নিদারুণ সদ্ভাব। এক পুলিশের নাম ছিল রাখাল। বিশাল চেহারা। তাঁর ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ত। রাখালপুলিশকে আমার এক জেঠামশাই ছোট একটু জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে পর্ণকুটির তৈরি করে সপুত্র বসবাস করতেন। রাখালপুলিশকে উর্দি পরা অবস্থায় কমই দেখেছি। তিনি কাছে থাকলে চোরেরা স্বস্তি পেত। চোরের মনে হতো, ইনি পুলিশ হবেন কোন দুঃখে? যেন বাড়ির লোক লক-আপে ট্যাংরা মাছ রেঁধে এনেছেন। রাখালপুলিশকে আমরা কাকু বলে ডাকতাম। তাঁর শরীর ও মনে পুলিশের অংশ ছিল সামান্যই। তিনি ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। শিবরাত্তিরে ফাঁড়ির সামনের মাঠে হ্যাজাক জ্বেলে যাত্রা হতো। কোনও একটা পালায় দীর্ঘদেহী রাখালকাকুকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। বোধহয় সাবিত্রী-সত্যবান পালায়। তিনি কার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, মনে নেই। সাবিত্রী হওয়াও বিচিত্র নয়। বসন্তকালে বিরহের পালা দেখে আমাদের তনুমন শিরশির করত। চৌদিকে বাতাসের হু হু আর কোকিলের কুহু। পুলিশ যে বসন্তের দূত হতে পারে, এ কথা পাঁচকান হলে পুলিশেরই চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু গাঁ-গেরামের খবর পুলিশের বড় কর্তারা রাখতেন না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে পুলিশকর্মীরা কালাতিপাত করতেন। শিবরাত্রির বহু আগে যাত্রার মহড়ার হু হু হা হা শুনে তস্করেরও বুঝি বুক কেঁপে উঠত। ফাঁড়ির পিছনে ছিল আকন্দের ঝোপ। বনতুলসী, আসশেওড়া, নিসিন্দার ঝোপঝাড়ও ছিল ইতিউতি। সেই সব গহিন ঝোপঝাড়ে একটা লম্বা কালো পাখি রক্তকরবী-র রাজার মতো গম্ভীর গলায় ডেকে যেত। তাকে দেখা যেত কম। আমাদের জীবনে তখন নন্দিনী আসবে-আসবে করছে। একটু উতল হাওয়া দিলেই ঝিমধরা ভালোলাগা চৌদিকে। ফিসফিসিয়ে হাওয়াকে বলতে ইচ্ছে করত, ধীরে বও, ওগো ধীরে বও।

ফাঁড়িতে খান কতক রাইফেলও ছিল। শেষ কবে ওই রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেছে, তার কোনও হিসেবনিকেশ নেই। আমরা মাঝে-মাঝে সেই রাইফেলের হিমশীতল শরীর স্পর্শ করে নিজের জীবনযৌবন সার্থক করেছি। কিছুদিন পরে দেখলাম একটা রাইফেলও নেই। কালী পুলিশ বলে একজন রাগী পুলিশ ছিলেন। একদিন দিনমানে ফাঁড়ির ভিতর থেকেই তাঁর সাইকেল চুরি যায়। এই চুরির খবর বোধহয় বড় কর্তাদের কানে পৌঁছেছিল। তার পর থেকেই ফাঁড়িতে রাইফেল রাখার আর কোনও দরকার মনে করেননি কর্তারা। রাইফেলের বদলে বাঁশি আর বেহালা হলে পালা বোধহয় আরও জমে উঠত। 

একদিন রাখালকাকুর বাড়ির সামনের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে হাওয়া বইছে। শীতকাল। ধানের শীষে সোনালি রং লেগেছে। ফড়িং উড়ছে। সদ্য লাঙল দেওয়া মাটি থেকে গন্ধ আসছে ভুরভুর। কোন একটা গানের দু-লাইন গেয়ে উঠেছিলাম, মনে নেই। হঠাৎ দেখি রাখালকাকু একটা নিমের দাঁতন মুখে নিয়ে বললেন, 'কী রে কচি, পালায় গান গাইবি?' আমি তো চমকে উঠলাম। বলে কী? পালায় গান গাইব? বললাম, 'আমি তো গান গাইতে পারি না।' রাখালকাকু বললেন, 'এই যে গাইলি।' গান গাওয়া আর গান গাইতে পারা কি এককথা ? কিন্তু রাখালকাকুকে কে বোঝাবে সে-কথা। আমি দৌড় লাগালাম। রাখালকাকু বলে চলেছেন, 'আরে শোন, পালাচ্ছিস কেন? নিমাই সন্ন্যাস পালা হবে। ওই দেখো।'

আমি ছুটছি। পুলিশকাকুও ডেকে চলেছেন, 'আরে শোন। এই কচি।' আমি ছুটছি। এই প্রথম পুলিশ দেখে ভয় লাগছে। পায়ের নীচে শুকনো বাঁশপাতা। ধানগাছের হাওয়া লাগছে গায়ে। ওই তো সোনাডাঙ্গা মাঠ, ওই যে পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিল, ওই যে বীরু রায়ের বটতলা...।

মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি। চলে...চলে...এগিয়েই চলে। দূরে পুলিশের বীণ শোনা যায়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন