শুক্রবার, ৯ আগস্ট, ২০১৯

ছিলো গরু ~ সুজাত্ৰ ব্যানার্জী

বেজায় দুর্গন্ধ। গাছতলায় দিব্যি ছায়ার মধ্যে চুপচাপ শুয়ে আছি, তবু গোবরের গন্ধে অস্থির। ঘাসের উপর গরুটা হাগছিল, তাড়ানোর জন্য যেই হ্যাট করতে গিয়েছি, অমনি গরুটা বলল, 'জ্যায় শ্রীরাম!' কি আপদ! গরুটা রামনাম করে কেন?
চেয়ে দেখি গরু তো আর গরু নেই, দিব্যি মোটা সোটা গেরুয়া পরা একটা লোক গোঁফ ফুলিয়ে প্যাট্‌ প্যাট্‌ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

আমি বললাম, 'কি মুশকিল! ছিল গরু, হয়ে গেল একটা চাড্ডি।'
অমনি লোকটা বলে উঠল, 'মুশকিল আবার কী? ছিল একটা রাজ্য, হয়ে গেল দিব্যি একটা বিধানসভা-বিহীন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এ তো হামেশাই হচ্ছে।'

আমি খানিক ভেবে বললাম, 'তাহলে তোমায় এখন কী বলে ডাকব? তুমি তো সত্যিকারের মানুষ নও, আসলে তুমি হচ্ছ গরু।'
লোকটা বলল, 'মানুষও বলতে পার, গরুও বলতে পার, হনুমানও বলতে পার।' আমি বললাম, 'হনুমান কেন?'
লোকটা বলল, 'তাও জানো না?' ব'লে এক চোখ বুজে ফ্যাঁচ্‌ ফ্যাঁচ্‌ করে বিশ্রী রকম হাসতে লাগল। আমি ভারি অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। মনে হল, ঐ হনুমানের কথাটা নিশ্চই আমার বোঝা উচিৎ ছিল। তাই থতমত খেয়ে তাড়াতাড়ি বলে ফেললাম, 'ও হ্যাঁ হ্যাঁ, বুঝতে পেরেছি।'
লোকটা খুশি হয়ে বলল, 'হ্যাঁ, এ তো বোঝাই যাচ্ছে- হনুমানের আ, গরুর র, আর মানুষের দন্ত্য স- হল আরেসেস। কেমন, হল তো?'

আমি কিছুই বুঝতে পারলাম না, কিন্তু পাছে লোকটা আবার সেই রকম বিশ্রী করে হেসে ওঠে, তাই সঙ্গে সঙ্গে হুঁ হুঁ করে গেলাম। তারপর লোকটা খানিকক্ষণ গোবরের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বলে উঠল, 'দুর্গন্ধ লাগে তো পাকিস্তানে গেলেই পার।' আমি বললাম, কিন্তু বললেই তো আর যাওয়া যায় না?'
লোকটা বলল, 'কেন? সে আর মুশকিল কী?'
আমি বললাম, 'কী করে যেতে হয় তুমি জানো?'
লোকটা একগাল হেসে বলল, 'তা আর জানিনে? কলকেতা, ডায়মন্ড হারবার, রানাঘাট, পাকিস্তান- ব্যাস্‌! সিধে রাস্তা, সওয়াঘণ্টার পথ, গেলেই হল ।'
আমি বললাম, 'তাহলে রাস্তাটা আমায় বাতলে দিতে পার?'
শুনে লোকটা কেমন গম্ভীর হয়ে গেল । তারপর মাথা নেড়ে বলল, 'উহুঁ সে আমার কর্ম নয়। আমার নমোদাদা যদি থাকত, তাহলে সে ঠিক বলতে পারত।'
আমি বললাম, 'নমো দাদা কে? তিনি থাকেন কোথায়?'
লোকটা বলল, 'নমো দাদা আবার কোথায় থাকবে? এখানেই থাকে।'
আমি বললাম, 'কোথায় তাঁর সঙ্গে দেখা হয়?'
লোকটা খুব জোরে জোরে মাথা নেড়ে বলল, 'সেটি হচ্ছে না, সে হবার যো নেই।'
আমি বললাম, 'কী রকম ?'
লোকটা বলল, 'সে কী রকম জানো? মনে কর, তুমি যখন যাবে দিল্লীতে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে, তখন তিনি থাকবেন টোকিয়োতে। যদি টোকিয়ো যাও, তাহলে শুনবে তিনি আছেন বার্লিনে। আবার সেখানে গেলে দেখবে তিনি গেলেন জেরুসালেম। কিছুতেই দেখা হবার যো নেই।'
আমি বললাম, তাহলে তোমরা কী করে দেখা কর?'
লোকটা বলল, 'সে অনেক হাঙ্গামা। আগে হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় নেই; তারপর হিসেব করে দেখতে হবে, দাদা কোথায় কোথায় থাকতে পারে; তারপর দেখতে হবে, দাদা এখন কোথায় আছে। তারপর দেখতে হবে, সেই হিসেব মতো যখন সেখানে গিয়ে পৌঁছব, তখন দাদা কোথায় থাকবে। তারপর দেখতে হবে-'
আমি তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললাম, 'সে কী রকম হিসেব?'
লোকটা বলল, 'সে ভারি শক্ত। দেখবে কী রকম?' এই বলে সে একটা কাঠি দিয়ে ঘাসের উপর লম্বা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর নমোদাদা।' বলেই খানিকক্ষণ গম্ভীর হয়ে চুপ করে বসে রইল।
তারপর আবার ঠিক তেমনি আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর তুমি,' বলে ঘাড় বেঁকিয়ে চুপ করে রইল।
তারপর হঠাৎ আবার একটা আঁচড় কেটে বলল, 'এই মনে কর অমিত শাহ।' এমনি করে খানিকক্ষণ কি ভাবে আর একটা করে লম্বা আঁচড় কাটে, আর বলে, 'এই মনে কর পুলওয়ামা'- 'এই মনে কর গৌরী লঙ্কেশ গুলি খেল'- 'এই মনে কর দিলীপ ঘোষ বর্ণপরিচয় পড়ছে'
এই রকম শুনতে শুনতে শেষটায় আমার কেমন রাগ ধরে গেল । আমি বললাম, 'দূর ছাই! কী সব আবোল-তাবোল বকছ, একটুও ভালো লাগে না।'
লোকটা বলল, 'আচ্ছা তাহলে আর একটু সহজ করে বলছি। চোখ বোজ, আমি যা বলব, মনে মনে তার হিসেব কর।' আমি চোখ বুজলাম।
চোখ বুজেই আছি, বুজেই আছি, লোকটার আর কোন সাড়া-শব্দ নেই। হঠাৎ কেমন সন্দেহ হল, চোখ চেয়ে দেখি লোকটা 'পাঞ্জাব ন্যাশনাল ব্যাঙ্ক' লেখা একটা ইয়া বড় ব্যাগ নিয়ে বাগানের বেড়া টপকিয়ে পালাচ্ছে আর ক্রমাগত ফ্যাঁচ্‌ ফ্যাঁচ্‌ করে হাসছে।

কী আর করি, গাছ তলায় একটা পাথরের উপর বসে পড়লাম। বসতেই কে যেন ভাঙা মোটা গলায় বলে উঠল, 'এগারো হাজার চারশো কোটিতে মোট কতগুলো শূন্য?'

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন