সোমবার, ১২ আগস্ট, ২০১৯

কাশ্মীর নিয়ে বামেদের অবস্থান ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

বর্তমানে কাশ্মীর নিয়ে বামেদের অবস্থান নানান বিতর্ক তৈরি হয়েছে,বিশেষ করে হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীগুলি বামেদের দেশদ্রোহী পর্যন্ত আখ্যা দিয়েছে।কিন্তু একটু ইতিহাসের পাতা ঘাটলেই বামেদের অবস্থান পরিষ্কার হবে যা অখন্ড ভারতের পক্ষ নিয়েই জোর সওয়াল ও কর্মসূচি নিয়েছে লাগাতার।তৎকালীন কাশ্মীর সংকটের সময় কমিউনিস্ট পার্টির অবস্থান কতটা বাস্তব ধর্মী তা সেই সময়ের লেখনী থেকেই স্পষ্ট হয়।

শেখ আবদুল্লার পদচ্যুতির পর কাশ্মীর পরিস্থিতি সম্পর্কে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির
পলিট ব্যুরাের বিবৃতি (১৬ই আগষ্ট, ১৯৫৩ সালে 'ক্রসরােড সে' মুদ্রিত ):-

"এডলাই স্টিভেনসনের পরিদর্শনের পর কাশ্মীরের সাম্প্রতিক ঘটনাচক্রের চরম পরিণতি হল সর্দার-ই-রিয়াসৎ কর্তৃক শেখ আবদুল্লার পদচ্যুতি ও কাশ্মীরে নতুন সরকার গঠন,মার্কিন চক্রান্তকারীদের সুরে সুর মিলিয়ে শেখ আবদুল্লা জাতিসংঘ অর্থাৎ আমেরিকার গ্যারান্টিপ্রাপ্ত স্বাধীন কাশ্মীর রাষ্ট্রের আওয়াজ তুলেছিলেন। মন্ত্রিসভা এবং ন্যাশনাল কনফারেন্সের ওয়ার্কিং কমিটির বেশির ভাগ সদস্য এই নীতিকে কাশ্মীরের জনসাধারণের পক্ষে ক্ষতিকারক বলে বিরুদ্ধতা করেছেন। স্বতন্ত্র মর্যাদা এবং ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সহায়তায়
কাশ্মীরকে গণতন্ত্রে রূপায়িত করবার সব চাইতে বড় গ্যারান্টি 'সীমাবদ্ধ অন্তভুক্তি ও দিল্লী-চুক্তির শর্তানুসারে তারা ভারতের সঙ্গে অব্যাহত ঐক্য- সম্পর্ক রক্ষা করতে চান।কাশ্মীরের জনসাধারণের মধ্যে যথেষ্ট বিভ্রান্তি দেখা দেবে। পাকিস্তান-পক্ষীগণ এবং মার্কিন গুপ্তচরেরা, প্রয়ােজন হলে এমন কি সাম্প্রদায়িক মনােভাব জাগিয়ে তুলেও ভারতের বিরুদ্ধে কাশ্মীরী জনসাধারণকে উত্তেজিত
করবার সুযােগ গ্রহণ করবে। এই উদ্দেশ্যে প্রতিটি দুর্বলতা, সরকারের প্রতিটি দুর্নীতি এবং জনগণের প্রতিটি আর্থিক অসন্তোষের সুযােগ গ্রহণ করবে তারা।গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের দায়িত্ব হল সতর্ক হয়ে সরকারের জনস্বার্থ-বিরােধী প্রতিটি নীতি ও কর্মের বিরুদ্ধে উদ্যোগ নিয়ে জনগণের স্বার্থের সংরক্ষক হওয়া এবং মার্কিনপন্থী সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখােস খুলে দেওয়া।

তাদের বিশেষ ভাবে অবহিত থাকতে হবে যাতে কৃষিসংস্কারগুলি ব্যর্থ হয় এবং গণতান্ত্রিক অধিকারগুলি ছিনিয়ে না নেওয়া হয়। আরও বেশি সংস্কারের জন্য তাদের দাবি তুলতে হবে।
কাশ্মীরে যে কঠিন পরিস্থিতির সম্মুখীন তারা হয়েছে তার গুরুত্ব ভারত সরকারকে বুঝতে হবে। তারা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের কৌশলে পড়ে জাতিসংঘে কাশ্মীর সমস্যা উপস্থাপিত করে ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীদের কাশ্মীর সমস্যায় হস্তক্ষেপ করবার সুযােগ করে দিয়েছেন।

জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকের নামে তারা বিপুল সংখ্যক আমেরিকানকে কাশ্মীর থেকে দীর্ঘ ছয় বৎসর ধরে জঘন্য কাজ কারবার চালিয়ে যেতে দিয়েছেন।কাশ্মীর থেকে মার্কিন গুপ্তচরদের হঠিয়ে দেবার কঠিন কর্মনীতি গ্রহণ করবার মত সাহস কি ভারত সরকারের হবে ? ভারত সরকার কি ঘােষণা করবেন যে কাশ্মীরের জনগণই কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণের একমাত্র অধিকারী–তাই জাতিসংঘের মুখােস পরে কোন রকম বৃটিশ অথবা মার্কিন হস্তক্ষেপই
তারা সহ্য করবেন না ?

রাজপ্রমুখ, নিজাম অথবা সর্দার-ই-রিয়াসং ইত্যাদি নামে যে স্বেচ্ছাচার চলে তাকে খতম করে ভারত সরকার কি কৃষক এবং শ্রমজীবী জনসাধারণকে গণতান্ত্রিক সরকার, জমি ও খাদ্যের প্রতিশ্রুতি দেবেন?

কাশ্মীরের জনগণ যদি দেখেন যে ভারত সরকার এবং ভারতের গণ-আন্দোলন তাদের দুঃসহ অর্থনৈতিক অসুবিধা দূর করতে চেষ্টার ত্রুটি করছেন এবং তাদের স্বতন্ত্র মর্যাদাকে শ্রদ্ধা করছেন তবেই তারা ভারতের সঙ্গে অব্যাহত সম্পর্ক রাখবেন।ইতিমধ্যেই হিন্দুমহাসভা এবং জনসংঘের মত সাম্প্রদায়িক কায়েমী স্বার্থসম্পন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলি জম্মু ও ভারতে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা
ছড়িয়ে এবং ভারতে কাশ্মীরের পুর্ণ অন্তভুক্তির দাবি তুলে কাশ্মীর উপত্যকায় সাম্প্রদায়িকতাবাদী এবং পাকিস্তান-পন্থীদের হাত শক্তিশালী করে তুলেছে।
তারা দাবি করছে যে শেখ আবদুলা সরকারের পদচ্যুতি তাদের জয়লাভ ,কাশ্মীরের পূর্ণ ভারতভুক্তি নিয়ে তারা হৈচৈ শুরু করে দিয়েছে।

এর চাইতে বড় আত্মঘাতী আওয়াজ আর নেই। কাশ্মীরে পাকিস্তান-পন্থীদের এবং মার্কিন অনুচরদের পরাজিত করবার জন্য এবং বিশেষ করে ভারতের গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে বাঁচাবার জন্য ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তি-সমূহকে জাগ্রত হয়ে শতগুণ বেশি শক্তি নিয়ে লড়াই করে সাম্প্রদায়িক প্রতি- ক্রিয়াপন্থী এবং তাদের আওয়াজ ও কাজকে উৎখাত করতে হবে।

জম্মু ও কাশ্মীরের গণতান্ত্রিক জনগণ, বিশেষ করে ন্যাশনাল কনফারেন্সের কর্মীদের প্রতি কমিউনিস্ট পার্টি আবেদন করছে "স্বাধীন কাশ্মীর উপত্যকা" আওয়াজের আড়ালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ আপনাদের প্রিয় কাশ্মীর উপত্যকার উপর যে থাবা বিস্তার করেছে তার গুরুত্ব আপনারা অনুভব করুন। গত দুই যুগ ধরে মহারাজার স্বেচ্ছাচারী শাসন এবং সামন্ততন্ত্রকে খতম করে নতুন গণতান্ত্রিক কাশ্মীরের জন্য আপনারা যে গৌরবময় সংগ্রাম করেছেন তার কথা আপনার স্মরণ রাখবেন।

১৯৪৭ সালে যে হানাদারেরা কাশ্মীর অধিকার করতে চেয়েছিল তাদের বিরুদ্ধে আপনাদের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধের ইতিহাস আপনারা ভুলবেন না।যারা আপনাদের মার্কিন আধিপত্যের কবলে নিতে চায় আর যারা পূর্ণ অন্তর্ভুক্তির দাবি তুলে যে-স্বাতন্ত্র্য আপনারা পেয়েছেন তাকে ধ্বংস করতে চায় তাদের উভয়ের বিরুদ্ধে দৃঢ় হয়ে দাড়িয়ে আপনারা সংগ্রাম করুন।এই সংগ্রাম সফল করবার জন্য ব্যাপক ঐক্যবদ্ধ গণতান্ত্রিক এক আন্দোলন ও সংগঠন গড়ে তুলুন আপনারা।"

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন