শনিবার, ১০ আগস্ট, ২০১৯

ক্রিমিয়া থেকে কলকাতা ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

সাত সকালে ঘুম ভেঙে গেল ফোনের আওয়াজে। স্ক্রিনে ভেসে উঠেছে একটা নাম আর আরেকটা শব্দ। নামটা না হয় নাই লিখলাম। ধরে নিন ফুলেশ্বরী, ফিরোজা বা ফ্রান্সেসকা। নামে কি বা এসে যায়। নামের পরের শব্দটাই আসল। ওটা দেখেই ফোনটা তুলে অভ্যস্ত ভঙ্গিতে বলে ফেললাম, "বলুন দিদি, কেমন আছেন?" 

রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি তরঙ্গ বেয়ে উত্তর আসার আগে মনের তরঙ্গে ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেছে। কোথায় শেষ দেখা হয়েছিল। পালস পোলিও করতে গিয়ে সেই যেই বার ধূলিয়ান এ ঘেরাও হয়ে গেছিলাম ? নাগড়াকাটার চা বাগানের টিলার ওপরে সেই হাতির পালের ভেঙে দেওয়া সাব সেন্টার এর ঘর দেখতে গিয়ে ? পাথরপ্রতিমায় গৃহ সমীক্ষায় খুঁজে পাওয়া কুষ্ঠ রোগী দেখতে গিয়ে নদীর ফেরিঘাটে অপেক্ষায় ? পাঁশকুড়ার ইটভাটায় ম্যালেরিয়া মৃত্যুর অডিট করতে গিয়ে ? কোথায় দেখা হয়েছিল ওই ANM দিদির সাথে ?

ANM শব্দটার সাথে অনেকেই পরিচিত নন। আসুন একটু পরিচয় হোক। অক্সিলিয়ারী নার্স কাম মিড ওয়াইফ। নার্স বলতে হাসপাতালে সাদা ইউনিফর্ম এ যাদের চিরকাল দেখে এসেছেন তাদের থেকে একটু আলাদা। এদের ইউনিফর্ম গোলাপি অথবা হলুদ।

এরা  দেড় বছরের প্রশিক্ষণ শেষে কাজে যোগ দেন। কাজটা মূলতঃ জনস্বাস্থ্যের। প্রতি ৫০০০ লোক পিছু একজন, সেটা বাড়তে বাড়তে কোথাও ১০,০০০ হয়ে গেছে। গ্রামীন এলাকায় এদের একটা সাব সেন্টার বা উপ স্বাস্থ্য কেন্দ্র থাকে। কোনোটা নিজস্ব পাকা বাড়িতে, কোনোটা আবার ভাড়া করা এক বা দু'কামরার চালা ঘরে।

সপ্তাহে পাঁচদিন সেখানে ক্লিনিক খোলা হয়। মূলতঃ মা ও বাচ্চারাই আসে ওই ক্লিনিকে। বাচ্চাদের বিভিন্ন রকম টিকা দেওয়া হয়। প্রসূতি মা'র গর্ভাবস্থার চেক আপ হয়, আয়রন ফলিফার বড়ি দেওয়া হয়। হয় রক্তচাপ মাপা থেকে শুরু করে ছোটখাটো পরীক্ষা যেমন হিমোগ্লোবিন, সুগার, এলবুমিন মাপা। একটু বড় বাচ্চাদের দেওয়া হয় ভিটামিন A সিরাপ, কৃমির ওষুধ। পরানো হয় কপার টি জাতীয় গর্ভ নিরোধক। 

নিয়মিত ওষুধ নিতে আসেন টিবি রুগী, কুষ্ঠ রুগীরা। সামনে বসে ওষুধ খাওয়ানো হয়। ম্যালেরিয়ার রোগ নির্ণয় আর ওষুধ বিতরণ ও হয়। দেশের ড্রাগ এন্ড কসমেটিক আইন অনুযায়ী ডাক্তার ছাড়া কেবলমাত্র এই এ এন এম দিদিরাই ওষুধ প্রেসক্রাইব করতে পারেন। বাচ্চাদের পেট খারাপ এ ও আর এস, সর্দি কাশি, নিউমোনিয়াতে এন্টিবায়োটিক, ম্যালেরিয়া তে ওষুধ।

ক্লিনিক এর বাইরে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঘুরেও নানা কাজ। জন্ম মৃত্যুর রেজিশট্রেশন, বিভিন্ন রোগের সমীক্ষা, সদ্যোজাত আর তার মায়ের স্বাস্থ্য পরীক্ষা, ছানি রুগী, জ্বরের রুগী খুঁজে বের করা, আর স্বাস্থ্য নিয়ে লাগাতার প্রচার। গর্ভনিরোধক বড়ি থেকে শুরু করে হ্যালাজন ট্যাবলেট বিতরণ। 

ক্লিনিক খোলা থাকে বছরভর। বছরে মাত্র আট দিন বন্ধ। গ্রামে ঘুরে বিরামহীন, লাগাতার কাজ। রোদ, জল, ঝড়, বৃষ্টি সব মাথায় নিয়ে। বন্যা হলেও ছুটি নেই। বরং কাজ বেড়ে যায়। 

গোটা চাকরি জীবন জুড়ে নিতে হয় অসংখ্য প্রশিক্ষণ। জমা দিতে হয় দিস্তা দিস্তা রিপোর্ট, প্রতি সপ্তাহে, প্রতি মাসে। এভাবেই চলে। পদোন্নতির সুযোগ সামান্য। চাকরি জীবনের শেষ দিকে এসে সুপারভাইজার। সেই মাঠে আর ক্লিনিকে। 

সরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার স্তম্ভ হিসেবে, ফ্রন্ট লাইন কর্মী হিসেবে এই দিদিরা সকলের কাছে দায়বদ্ধ। পঞ্চায়েত সদস্য থেকে শুরু করে ব্লক এর মেডিক্যাল অফিসার, সবার নজরদারি আর খবরদারি। কাজে গাফিলতি হলে বকুনি। এভাবেই দিন কেটে যায়।

কবির ভাষায়: "ওরা চিরকাল/ ধরে থাকে হাল/ওরা কাজ করে/ নগরে, প্রান্তরে"।

মুঠো ফোনের ও ধার থেকে দিদির গলার আওয়াজ এ সম্বিৎ ফেরে আমার। "স্যার খুব বিপদে পড়ে ফোন করছি। আপনি আমাদের ট্রেনিং দিয়েছিলেন। বলেছিলেন ওষুধ খেলে টিবি সেরে যায়। আমার স্যার নিজের টিবি হয়েছে। MDR টিবি। ভালো হয়ে যাবো তো স্যার ?"

দিনের পর দিন টিবি রুগীর পরিচর্যা করতে গিয়ে রোগ হয়ে যাওয়াটা কিছু অস্বাভাবিক নয়। যতই সতর্কতা নেওয়া হোক। কিন্তু MDR টিবি ? মানে ড্রাগ রেজিস্ট্যান্ট টিবি। প্রথম সারির ওষুধ আর কাজ করবে না। দ্বিতীয় সারির আরো কড়া ওষুধ দিতে হবে। হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে দিদি কে। 

পেশাগত ঝুঁকি। ফোনের এপার থেকে স্বান্তনা দেওয়া ছাড়া আর কি বা করতে পারি। "দিদি, ভয় পাবেন না। ঠিক ভালো হয়ে যাবেন, দেখবেন। আমরা তো আছি।"

সত্যিই কি আমরা আছি ? ওদের সাথে, ওদের পাশে ? এক শুভ্র বসনা মহিয়সী সেবিকার জন্মদিন উপলক্ষে কয়েকদিন আগেই সারা পৃথিবী জুড়ে পালন হয়েছে আন্তর্জাতিক সেবিকা দিবস, ইন্টারন্যাশনাল নার্সেস ডে। প্রজ্বলিত প্রদীপ হাতে এক নারী। ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।

নাই বা থাকলো সাদা শাড়ি, নাই বা থাকলো হাসপাতালে যন্ত্রণাকাতর রুগীর মাথায় সেবার হাতের চিরন্তন ছবি। আমার কাছে আমার ANM দিদি, নামটা যাই হোক, ফুলেশ্বরী, ফিরোজা কিংবা ফ্রান্সেসকা, সেই তো জ্বালিয়ে তুলেছে হাজার হাজার প্রদীপ। 

গতকাল থেকে এই দিদিরা তাদের পদোন্নতির সুযোগ সহ চাকুরিগত কিছু দাবি দাওয়া নিয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। এখনো অবধি কেবল লাঞ্ছনা আর ঘাড় ধাক্কা জুটেছে এটাই জানলাম। বেশি কয়েজনকে থানায় ধরেও নিয়ে গেছে।

দিন গড়িয়ে রাত। আবার আঁধার নামছে। আঁধার এর মোকাবিলায় দিদিরা নিজেরাই জ্বালিয়েছেন হাজার হাজার আলো খোলা আকাশের নীচে। সেই আকাশের থেকে এবার কি ফ্লোরেন্স এর আশীর্বাদ ঝরে পড়বে অস্নাত, অভুক্ত, নিদ্রাহীন এইসব গোলাপি শাড়ি পড়া দিদিমনিদের ওপর ?

তারাও তো "লেডি উইথ এ ল্যাম্প"। আমার, আমাদের ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন