বৃহস্পতিবার, ২২ আগস্ট, ২০১৯

প্রসঙ্গ চিদাম্বরম, গণতন্ত্রের কালো দিন ~ বাসব রায়

এফআইআর-এ নাম ছিল না, প্রাথমিকভাবে তিনি অভিযুক্তও ছিলেন না, তবু জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যেভাবে অভিযান করে সেনাবাহিনী কতকটা সেই ঢঙেই চিদাম্বরমকে নিজেদের হেফাজতে নিয়েছে সিবিআই। আইএনএক্স মিডিয়া মামলায়।
গতকাল দিল্লি হাইকোর্টে চিদাম্বরমের পূর্ববর্তী জামিনের আবেদন খারিজ হয়ে যায়। এর প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে জামিনের আবেদন করলে, শুক্রবার সেই শুনানি হবে জানিয়েছে শীর্ষ আদালত। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা পরই সুপ্রিম কোর্টে শুনানির ফলাফল এসে যেত। তবু চিদাম্বরমকে গ্রেফতার করতে সিবিআই এত তাড়াহুড়ো করল কেন?
এমন তো নয়, যে মামলায় চিদাম্বরমকে সিবিআই হেফাজতে নিল, স্বাধীন থাকলে চিদাম্বরম তাতে কোনো প্রভাব ফেলতে পারতেন। কেননা ঘটনাটা অনেক পুরনো। তিনি এখন আর মন্ত্রী নন যে সরকারের কোনো সিদ্ধান্তে প্রভাব খাটাতে পারবেন। ৪৮ ঘণ্টা পর তাঁকে হেফাজতে নিলে কী অসুবিধে হত সিবিআইয়ের?
এবং এই প্রশ্নের মধ্যেই চিদাম্বরমকে হেফাজতে নেওয়ার রহস্য লুকিয়ে আছে। আইএনএক্স মিডিয়া মামলার এফআইআর-এ চিদাম্বরমের নাম ছিল না, সেই মামলার কোনো চার্জশিট এখন পর্যন্ত সিবিআই দিতে পারেনি, তারপরও তাঁকে গ্রেফতারের দাবি হয়তো সুপ্রিম কোর্টে খারিজ হয়ে যেত। আর এটাই হতে দিল না সিবিআই। 
ঘটনা হল, সিবিআইয়ের আইএনএক্স মিডিয়া মামলার পাশাপাশি ইডিও একটি মামলায় চিদাম্বরমকে জড়িয়েছে। সেটা হল এয়ারবাস কেনার মামলা। তাই একবার সিবিআই একবার ইডি, এই চক্কর কাটতে হবে চিদাম্বরমকে। তারপর কিছুদিন থাকতে হবে জেলে। জামিন পাওয়া এত সহজ হবে না তাঁর, বেশ কিছুদিন তাঁর কথাবার্তা আমরা শুনতে পারব না।  
আইএনএক্স মিডিয়া মামলায় ইন্দ্রাণী মুখোপাধ্যায় নাম করেছেন চিদাম্বরমের। সম্ভবত তিনি ওই মামলায় অ্যাপ্রুভার বা রাজসাক্ষী হবেন। মজার ব্যাপার হল, চিদাম্বরমকে যাঁর কথার ভিত্তিতে আজ সিবিআই হেফাজতে নিয়েছে, তিনি হলেন সহ-অভিযুক্ত, যাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ নিজের কন্যাকে হত্যা করার। এখন তাঁকেই সিবিআই বিশ্বাস করছে। শুধু একটা কথা, চিদাম্বরম ছিলেন ভারতের প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী-স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। বর্তমান সরকারের কোনো চুক্তি যদি পরে প্রমাণ হয় অনৈতিক ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলে, আমরা কি এমন দেখব যে এই সরকারের বড় বড় মন্ত্রীকে আজকের মতোই সিবিআই গ্রেফতার করছে!
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি সবচেয়ে বেশি সরব ছিলেন চিদাম্বরম, সে ৩৭০ ধারা বিলোপ কিংবা দেশের বেহাল অর্থনীতি, প্রসঙ্গ যাই হোক না কেন। 
তাৎক্ষণিক তিন তালাক নিষিদ্ধকরণ, ৩৭০ ধারা বিলোপ, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা, পরমাণু অস্ত্র ব্যবহারের বিধিভঙ্গের হুমকি, গরু-রক্ষা, মুসলমান-ত্রাস, এনআরসি, নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল... এই সব ঢেউ একদিন থেমে যাবে, রাজনীতি হবে নিস্তরঙ্গ। তখন উঠে আসবে জগতের আদি ও অনন্ত চাহিদা – খিদে। আর তখন মানুষ প্রশ্ন করবে... 
বিশ্বাস করুন, মোদী-শাহ-নির্মলা সীতারামন তিনজনেই জানেন, সরকারের হাতে টাকা নেই। আজই স্টেট ব্যাংক বলেছে, এটিএম কার্ড বন্ধ করে দেবে। নতুন অ্যাপ নিয়ে আসবে। কেন? আসল কারণ, লোকজনের ব্যাংক থেকে টাকা তোলা বন্ধ করতে। অবস্থা কতটা খারাপ একটা উদাহরণ দিই। আপনার হকের প্রভিডেন্ট ফান্ডের টাকা সরকারের কাছে থাকে। প্রতি বছর 1 এপ্রিল সুদের টাকা জমা হয়। এ বছর হয়নি। নাকি সার্ভার খারাপ। আরে ডিজিটাল ইন্ডিয়ায় 6 মাসে সার্ভার ঠিক হলো না? গত বছরও একই যুক্তি ছিল। পিএফের টাকা সরকার ধার নেয়। বিভিন্ন খাতে খাটায়। তারপর সুদ সমেত ফেরত দেয়। এটাই নিয়ম। এই বছর আজও গত বছরের টাকা ফেরত দেয়নি। দিলে খাতা কলমে এক লাখ কোটি টাকা শুধু সুদ দিতে হবে। সরকারের কাছে সেই টাকা নেই। জিএসটি থেকে আয় হলে দেবে।
আপনারা ভাসা ভাসা জানেন বিএসএনএল এর অবস্থা খারাপ। জানেন কি, শুধু কলকাতায় যাঁরা লাইন-ম্যান হিসেবে কাজ করেন, সেই 4800 কর্মচারী গত জানুয়ারির পর কোনো বেতন বা টাকা পায়নি। সাত মাস ধরে কী করে তাঁদের পরিবার চলছে তাঁরাই জানেন। অনাহারে অসুস্থ হয়ে ইতিমধ্যে 7 জন মারা গেছেন। কলকাতায় এই মুহূর্তে 25 হাজার ল্যান্ড লাইন খারাপ। দিন দিন সংখ্যা বাড়ছে। কাজ করার লোক নেই। ভাবছেন জিও তো ব্রড ব্যান্ড নিয়ে আসছে। চিন্তা কী! এই মুহূর্তে বিএসএনএল এর জন্য সরকারকে দিতে হবে মাত্র 14 হাজার কোটি টাকা। তাহলেই 1 লাখ 75 হাজার কর্মী সেইসঙ্গে ঠিকাদার ও শ্রমিক মিলে 5 লাখ পরিবার বাঁচবে। মাত্র 14 হাজার কোটি কেন বললাম? রিলায়েন্স এর ব্যাংকের কাছে ধার প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা! সিংহভাগ জি ওর জন্য। বুঝছেন ব্যাপার টা? এয়ারটেল এর ধার এক লাখ কোটির ওপর।
লোকের হাতে টাকা নেই। ফ্ল্যাট বিক্রি হচ্ছে না। এই মুহূর্তে দেশের 30 টি বড় শহরে 12 লাখ 80 হাজার তৈরি ফ্ল্যাট পড়ে আছে। কেনার লোক নেই। শুধু কলকাতায় 20 হাজারের উপর ফ্ল্যাট অবিক্রীত।
গাড়ি বিক্রি এতই কমে গেছে নয়ডার মারুতি গাড়ির কারখানা থেকে শুরু করে জামসেদপুরের টাটা মোটরের উৎপাদন ক'দিনের জন্য বন্ধ রাখতে হচ্ছে। কর্মী ছাঁটাই শুরু হচ্ছে। একই অবস্থা বাজাজ এবং হিরো কোম্পানির। কয়েকশো গাড়ির শোরুম ঝাঁপ ফেলে ব্যাংকে জানিয়ে দিয়েছে, আমরা আর এখন টাকা শোধ করতে পারব না। কম্পিউটার এর জন্য অনুসঙ্গ বানানো কোম্পানি mosar বিয়ার এর মালিক আজই দেনার দায়ে গ্রেফতার হয়েছে। ভিডিওকন আগেই বন্ধ। মালিক বেনুগোপাল ধুত আগেই জানিয়ে দিয়েছেন, হাজার কোটি টাকা ব্যাংকের দেনা তার পক্ষে শোধ করা সম্ভব নয়। বেশ কিছু সিমেন্ট কারখানা বন্ধ। ঝাড়খণ্ডের জয় বালাজি স্টিল কোম্পানি দু দিন হল উৎপাদন বন্ধ করেছে। কারণ ইস্পাত এর বাজার নেই। টাটা স্টিল ও ওই পথ নিতে পারে। গত দুই মাসে শুধু ঝাড়খণ্ড এ বেকার হয়েছে 3 লাখ শ্রমিক। লোকের হাতে টাকা না থাকায় বা থাকলেও খরচ করতে ভয় পাওয়ার ফলে হোটেলে খাওয়া কমেছে। সাবান থেকে বিস্কুট সব কিছুর বিক্রি কমছে। অর্থাৎ কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের আয়ের যে অন্যতম উৎস GST সেখানেই বিপুল ঘাটতি দেখা দিতে চলেছে। কী ভাবে এই অবস্থা সামাল দেবে মোদী অ্যাল্ড কোং তা জানেন না।
আজই কাপড় কলের মালিকরা কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়ে জানিয়েছেন, বস্ত্র শিল্পের অবস্থা খুব খারাপ। বাজার নেই। কাপড় কলের মধ্যে তিনভাগের একভাগ এই বছরই বন্ধ হয়ে যেতে পারে। লোকসান করায় মিল মালিকরা ব্যাংকের টাকা শোধ করতে পারছে না। ওদের হিসেবেই তুলো চাষিদের নিয়ে কয়েক কোটি মানুষ এই শিল্পের সঙ্গে খেয়ে পরে বাঁচে। তাঁদের ভবিষ্যৎ কী কেউ জানে না। বিদেশে রফতানিও কমেছে দ্রুত। তার থেকেও বড় কথা ক মাস বাদেই নতুন তুলো উঠবে। তার বাজার মূল্য 80 হাজার কোটি টাকা। বিক্রির বাজার না থাকলে মিল মালিকরা তা কিনবে কেন? কিংবা আরও সস্তায় কিনবে। ফলে তুলো চাষিদের আত্মহত্যা আরও বাড়বে। এই বছরই আবার ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, হরিয়ানার ভোট। রাজনৈতিক দল গুলো তার জন্যে টাকা তুলবে!
গোদের উপর বিষ ফোঁড়ার মতো কাশ্মীর। সেখানে কাশ্মীরি জনগণের মৌলিক অধিকার বন্দুকের বেয়নেট এর জোরে কেড়ে নিতে প্রায় 6 লাখ সেনা নিয়োগ করতে হয়েছে। তার বিপুল খরচ। কোনো যুদ্ধের থেকে খুব কম নয়। তা কিন্তু জোগাতে হবে। কারণ কাশ্মীর আগ্নেয়গিরির মত ফুটছে। ফ্যাসিস্টদের পরিয়ে দেওয়া কাজলে আমরা এতটাই অন্ধ, তা দেখতে পাচ্ছি না। আর মোদী-ভক্ত দালাল মিডিয়া দেখাচ্ছে, সব স্বাভাবিক।
পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে একটাই পথ সরকারি সম্পত্তি বিক্রি। লাভের মুখ দেখা বেঙ্গল কেমিক্যাল থেকে অর্ডিন্যান্স ফ্যাক্টরি সব বিক্রি করে দাও। রেলের টিকেট বিক্রি থেকে IRCTC সব বেসরকারি হাতে তুলে দাও। আরে কিনবে কে? পরিষেবা দেবে কে ? তা জানি না। তিনবার দরপত্র হাঁকার পর আজ অব্দি কেউ air India কিনলো না!
প্রতিবাদ করলেই UAPA আছে। আপনাকে দেশদ্রোহী বলে দেগে দেওয়া হবে। কংগ্রেস কার্যত ভোকাট্টা। দুর্নীতিগ্রস্ত বিরোধীদের জন্যে ED, CBI, IT আছে। তারাও মুখ বুজে আছে। অন্য ধান্দা করছে।
চিদাম্বরমরা এইসব প্রশ্ন করেছেন, করতে চেয়েছেন, করে চলেছেন। আর তাই, তাঁকে এবং তাঁদের যেভাবেই হোক লোহার শিকের ওপারে রাখতেই হবে। 

(সাংবাদিক ও সমাজকর্মী প্রসূন আচার্যের লেখা থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন