রবিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৫

চুনো মাছ ও বাল্যকাল ~ অনিমেষ বৈশ্য

মাছের বাজারে গিয়ে দেখলাম, একটা বড় হাঁড়িতে হরেক কিসিমের চুনো মাছ খলবল করছে। কী নেই তাতে? খোলসে, পুঁটি, মৌরলা, চাঁদা, বেলে মাছ...। আরও কত কী! বহুদিন খোলসে (বাঙালরা বলে, খোইলসা) খাইনি। এমনকী চোখেও দেখিনি। কত মাছ যে বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে, তার হিসেব নেই। কিংবা হয়তো আছে। আমি জানি না। 
বিদেশি দ্রব্যে বাজার ছেয়ে গেছে। কিন্তু মাছের ভুবনায়ন কি হয়েছে? মানে, ত্রিনিদাদের মাছ তেঘরিয়ায় বিক্কিরি হচ্ছে, এমন তো শোনা যায়নি। তা হলে এই চুনো মাছগুলো গেল কোথায়? কোন আঘাটায়?  জলা বুজিয়ে যে অসংখ্য ফ্ল্যাট মাথা তুলেছে, তার ধারেকাছে গেলে হয়তো  চুনোমাছের আত্মার ফিসফিসানি শোনা যাবে।
তা সেই বড় চুনো মাছের হাঁড়ির সামনে ভনভন করছে লোকজন। হেমন্তের ভোর। মাছের বাজারের জলে পায়ের পাতা ভিজে যাচ্ছে। সবাই ওই মাছ কিনতে চায়। ভিড় ঠেলে আমিও নিলাম সেরটাক। নানা জাতের মাছ আমার ঝোলায়। আজ মাছের বিয়ে। ওরা বরযাত্রী যাচ্ছে। গায়ক-অভিনেতা অরিন্দম গঙ্গোপাধ্যায় মঞ্চে উঠে একদা মাছের বিয়ে গানটি খুব গাইতেন। এখনও গান কি না, জানি না। তবে গানটি আমার কানে লেগে আছে। গানটা শুরু হচ্ছে এই ভাবে----চ্যাং মাছে বলে মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও মাঝিভাই/ আমাকে না মারিও...। কেন চ্যাং মাছের নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার এই কাতর আবেদন? শোনা যাক গায়ক কী গাইছেন----আরে কাইল  দারিকার হইব বিয়ারে/ আমি বইরযাত্রী যামু/ আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, ঠ্যাংদিগিলা, জটাবোগিলা...আলুকশালুক শালুক ননদি...মা হইব মৌরলা, কাইল দারিকার হইব বিয়া, আজও চান্দা না আইল রে...।
এমন অদ্ভুত দুলে দুলে গাইতেন অরিন্দম যে, দর্শকরাও দুলে উঠত। বিয়েতে মা সাজবে মৌরলা, কিন্তু বাউন্ডুলে চান্দা মাছ গেল কোথায়? সে তো এখনও এল না। সাইকেলে ঝোলাটা আটকে আমিও মন খুলে গাইতে শুরু করলাম---আরে ও আমারই ক্যাকুইমাসি, মেনকাদিদি, বৌভুলানি, মাথাঠেঙানি, পেছাদুলকি, জটাবগিলা...(ভুল লিখলে ক্ষমা প্রার্থনীয়)। দুরন্ত ছন্দের গানটি গেয়ে শিরা-ধমনি এমন চলকে উঠল, মনে হল, বাল্যকাল ফিরে পেয়েছি। আমার এই এক দুরারোগ্য রোগ। যেখানে ছিটেফোঁটা বাল্যকালের সন্ধান পাই, সেখানেই থানা গেড়ে বসে পড়ি। হেমন্তের শিরশিরে হাওয়াও কোন সুদূর থেকে বাল্যকাল ডেকে আনে। কার্তিকের জ্যোৎস্না, হিমমাখা ভোর আমাকে আছড়ে ফেলে ফসলের খেতে। 
তা যাই হোক, আমরা রোজ খাল, বিল, পুকুর বুজিয়ে ফেলছি। আসলে ঠিক খাল-বিল বুজিয়ে ফেলছি না। আত্মাকে গলা টিপে খুন করছি। আমার বাড়ির অদূরে একটি ইটখোলা ছিল। তাতে ছিল খানতিনেক গভীর পুকুর। সেই পুকুরে মাছ ধরার টিকিট বিক্কিরি হতো। টিকিট কেটে লোকজন মাছ ধরত। মাছের চারের যে কত সম্মোহনী গন্ধ থাকতে পারে, তা পুকুর ধারে না-গেলে বোঝা যেত না। কেউ কেউ উৎকৃষ্ট মানের সুরা মাছের টোপে মাখিয়ে দিতেন। মাছও যে মদ্যপ হয়, সেটা ওই পুকুর ধারে বসে জেনেছি। কয়েক হাত অন্তর ছিপ ফেলে ফাতনার দিকে তাকিয়ে আছে মৎস্যশিকারিরা। উপরে সুনীল আকাশ। অদ্ভুত এক নীরব মেলা। এত মানুষ বসে আছে। কিন্তু কেউ কোনও কথা বলছে না। পাছে মাছ পালিয়ে যায়। মাছ যে গোলযোগ সইতে পারে না। তা সেই পুকুরগুলো আর নেই। সেখানে ফ্ল্যাট উঠেছে। একটি পুকুরকে সুইমিং পুল বানানো হয়েছে। কিন্তু পুকুর আর সুইমিং পুল এক জিনিস নয়। পুকুরে শালুক ফোটে, পুকুরের গভীরে ডুব দিয়ে ছেলেরা মাটি তুলে আনে, পুকুরে ঝিনুক থাকে, পুকুরের জলে সর পড়ে, পুকুরে কার্তিকের চাঁদ জ্যোৎস্না ঢেলে নিজের বাসা খোঁজে। এই পুকুরেই ছিল খোলসে, চাঁদা, পুঁটি মাছের বসত। আমরাই ওদের বাসা কেড়ে নিয়েছি। এখন কেঁদে কী হবে? মাছের বিয়ের গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরে মাছের ঝোলাটা রাখলাম নীচে। দু-একটা মুক্তিকামী মাছের মুখ উঁকি মারছে আমার দিকে। ওগুলো কি সত্যিই মাছের মুখ? নাহ। ওরা বাংলার মুখ। হেমন্তের ভোরে মাছের ঝোলায় খলবল করছে আমার বাংলা।
পৃথিবীর রূপ খোঁজার আর দরকার কী?

শনিবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৫

শ্রম কোড কেন বিপদজনক ~ কুশল দেবনাথ

চারটি শ্রম কোড কেন বাতিল করতে হবে

বিজেপি-পরিচালিত এনডিএ সরকার ২৯টি শ্রম আইনকে চারটি লেবার কোডে পরিণত করে সংসদে পাশ করেছে। এই আইন কার্যকর করা যাচ্ছিল না, তার কারণ বিধি (rules) তৈরি হয়নি। বিধি তৈরি না হলে কোনো আইন লাগু করা যায় না। পশ্চিমবঙ্গ-সহ দেশের তিনটি রাজ্য বাদ দিয়ে সব রাজ্যই ইতিমধ্যে বিধি তৈরি করেছে। এ বছরের গোড়ায় কেন্দ্রীয় শ্রম দপ্তর ঘোষণা করেছিল, পয়লা এপ্রিল ২০২৫ থেকে সারা দেশে শ্রম কোড লাগু করা হবে। শেষ অবধি তা হয়নি। কিন্তু প্রশ্ন হল, সারা ভারতে যখন শ্রম কোড চালু হবে, তখন পশ্চিমবঙ্গেও কি আইন লাগু হবে? হ্যাঁ হবে, কারণ শ্রম যে হেতু যুগ্ম তালিকাভুক্ত, তাই কেন্দ্রীয় সরকার নোটিফিকেশন জারি করতে পারে যে, যে রাজ্যগুলি বিধি তৈরি করেনি, সেগুলিতেও কেন্দ্রীয় বিধি লাগু হবে।
২০২০ সালে তিনটি কৃষি আইন ও চারটি শ্রম কোড লোক সভায় বিল আকারে পেশ করা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বার কৃষক আন্দোলনের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। শ্রম কোডের বিরুদ্ধে গোটা দেশে বিভিন্ন ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন যে প্রতিবাদ করেনি, এমনটা নয়। কিন্তু সেই প্রতিবাদের ধার অনেক কম ছিল। শ্রমিক আন্দোলনের দুর্বলতার জন্যই আজ গোটা দেশে শ্রম কোড লাগু হতে চলেছে।
প্রশ্ন আসে, বিভিন্ন সময় আমাদের দেশে যে শ্রম আইন এসেছিল, তার সাথে এই চারটি শ্রম কোডের পার্থক্যটা কী? এ যাবৎ কালে যে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে শ্রম আইন এসেছিল, তার প্রত্যেকটিরই আলাদা আলাদা উদ্দেশ্য ছিল। কিন্তু এই চারটি শ্রম কোড ভিন্ন ভিন্ন আইনকে একটা সূত্রে গেঁথে দিয়েছে। তাই প্রতিটা আইনের যে আলাদা আলাদা উদ্দেশ্যগুলি ছিল, সেগুলি তুলে নেওয়া হয়েছে। একটু উদাহরণ দিয়ে বোঝানো যাক। ১৯৭০ সালে যখন 'কন্ট্র্যাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন)' আইন আসে, তার উদ্দেশ্য ছিল ঠিকা শ্রমিকদের কাজের নিয়মাবলী নির্দিষ্ট করা, ও ঠিকা প্রথার অবসান ঘটানো। যদিও ঐ আইনে ঠিকা শ্রম নির্মূল করা বা 'অ্যাবোলিশন'-এর কোনো কথা লেখা হয়নি, তবু এই উদ্দেশ্যে আইনটি তৈরি হয়েছিল। এ বারে 'অক্যুপেশনাল সেফটি, হেল্থ এবং ওয়ার্কিং কনডিশন' ২০২০ নামক শ্রম কোডটিতে ঠিকা শ্রমিকের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত করা হোলো। ফলে ঠিকা শ্রমিকদের জন্য ১৯৭০ সালে প্রণীত মূল আইনটির তাৎপর্যই হারিয়ে গেল। আমরা দেখি, এই কোডের বিষয়টির 'উদ্দেশ্য' হিসেবে লেখা রয়েছে, পেশাগত নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য ও কাজের অবস্থা। সুতরাং দেখা যাচ্ছে ঠিকা শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার যে মূল উদ্দেশ্য ছিল, যার জন্য আইনে ঠিকাদারদের লাইসেন্স নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছিল, প্রধান নিয়োগকারীকে সময়মতো মজুরি মেটাতে, এবং অন্যান্য সুবিধা ঠিকা শ্রমিকদের দিতে বাধ্য করা হয়েছিল — সে সব কিছুই আর নতুন আইনে নেই।
আমরা যদি চারটি শ্রম কোড খুঁটিয়ে পড়ি, তা হলে দেখব যে এই কোডগুলির উদ্দেশ্য হচ্ছে শ্রমিক শ্রেণিকে টুকরো টুকরো মানুষে পরিবর্তিত করা। পুঁজিবাদের শুরুর পর্যায়ে শ্রমিক ছিল 'ক্লাস ইন ইটসেল্ফ' — 'শ্রমিক' একটি শ্রেণি-পরিচয়। কিন্তু ধারাবাহিক লড়াইয়ের মাধ্যমে শ্রমিকরা 'ক্লাস ফর ইট সেল্ফ' (নিজেদের জন্য নির্মিত শ্রেণি, স্বরচিত পরিচয়) অবস্থানে পৌঁছয়। লেবার কোডে এমন অনেক বিষয় যুক্ত করা হয়েছে যেখানে শ্রমিকরা সেই 'শ্রেণি' সত্বা হারিয়ে ফেলবে, কেবল 'ব্যক্তি' সত্বায় পরিণত হবে। অর্থাৎ পুঁজির হামলার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ভাবে শ্রমিক শ্রেণির প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবে না। 
দ্বিতীয়ত, শ্রম কোড এমন ভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে বেশির ভাগ শ্রমিকই শ্রম আইনের আওতার বাইরে চলে যাবে। উদাহরণ দিয়ে বলা যাক- ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট লেবার (রেগুলেশন ও অ্যাবোলিশন) অ্যাক্টে ২০জন শ্রমিক ঠিকাদারের অধীনে কাজ করলে আইনি অধিকার পেতো। শ্রম কোডে সংখ্যাটা ৫০ করে দেওয়া হয়েছে।ফলে একজন কন্ট্রাকটর ৪৯জন শ্রমিককে নিয়ে কাজ করলে আইন তাকে ছুঁতেও পারবে না। আর বিভিন্ন কোম্পানিতে ঠিকা শ্রমিকরা একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ায় নিযুক্ত হয় এবং কাজ করে, সেই সংখ্যাটা মাত্রাতিরিক্ত হয় না। উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিভিন্ন ধাপে নানান ধরনের ঠিকাদারকে নানা কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একজনই ঠিকাদার সব ধরনের কাজ করেন, এমন নয়। কাজ এমন টুকরো টুকরো করে দেওয়ার ফলে, একজন ঠিকাদার ৫০জনের বেশি ঠিকা শ্রমিককে নিয়োগ করবেন, সে সম্ভাবনা কতটুকু? সুতরাং নতুন লেবার কোডে বেশির ভাগ ঠিকা কর্মীকে শ্রম আইনের বাইরেও নিয়ে আসা হলো। ফলত কন্ট্রাকটর কিংবা মূল কর্তৃপক্ষ শ্রমিকদের ওপর যথেষ্ট আক্রমণের চেষ্টা করবে।
এই শ্রম কোডগুলিতে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন করার, অর্থাৎ ধর্মঘট করার অধিকার সুকৌশলে কেড়ে নেবার চেষ্টা হয়েছে। কেড়ে নেওয়া হয়েছে ছাঁটাই শ্রমিকদের পুনর্বহালের বিষয়টিও। কারখানায় স্থায়ী ভাবে নিযুক্ত হওয়ার যে অধিকার শ্রমিকের ছিল, তা তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে। শুধু ঠিকা শ্রমিক নয়, অন্য একটা বিরাট অংশের শ্রমিককেও লেবার আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। উদাহরণ স্বরূপ বলা যায়, এই শ্রমকোডে 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞাও পাল্টে দেওয়া হয়েছে। এত দিন আইনি সংজ্ঞা ছিল, 'যে প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ-সংযোগ থাকলে অন্তত ১০জন শ্রমিক কাজ করে, অথবা বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করে, তা 'ফ্যাক্টরি' বা কারখানার মর্যাদা পাবে। এবং এই আইনের সুবিধা পাবে। কিন্তু শ্রম কোডে শ্রমিক সংখ্যা পূর্বের আইনের দ্বিগুণ করা হয়েছে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ-সংযোগ আছে, এমন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ২০জন শ্রমিক কাজ করলে তারা শ্রমিকের মর্যাদা পাবে। আর বিদ্যুৎহীন প্রতিষ্ঠানে অন্তত ৪০জন শ্রমিক কাজ করতে হবে। যে হেতু ভারতে অধিকাংশ কারখানা খুব কম শ্রমিক নিয়ে কাজ করে, তাই আইনে পরিবর্তনের ফলে বিপুল সংখ্যক শ্রমিকদের কোনো আইনি সুবিধা থাকবে না। তাদের শ্রম আইনের সুরক্ষার বাইরে নিয়ে যাবে শ্রম কোড। এই কোড শ্রমিকদের একটি ঐক্যবদ্ধ শ্রেণির পরিবর্তে অগুনতি টুকরো টুকরো মানুষে পরিণত করবে। এ হল সংগ্রাম ও সংগঠন করার অধিকার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা। এই কোড বাতিলের লড়াই ছাড়া, অন্য কোনো রাস্তা খোলা নেই এ দেশের শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
যে চারটি শ্রমিক কোড আইনে রূপান্তরিত হয়েছে তার মধ্যে অন্যতম হল 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০' — শিল্পে শ্রমিক নিযুক্তি, ট্রেড ইউনিয়ন, নিয়োগকারী ও শ্রমিকের মধ্যে বিবাদ সম্পর্কিত আইন। এ বিষয়ে তিনটি পূর্বতন আইন ছিল 'দ্য ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট, ১৯২৬', 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল এমপ্লয়মেন্ট (স্ট্যান্ডিং অর্ডার্স' অ্যাক্ট, ১৯৪৬', এবং 'দ্য ইন্ডায়স্ট্রিয়াল ডিসপিউটস, ১৯৪৭।' এই কোডে একটি শব্দ সংযোজিত হয়েছে, 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট।' এতে লেখা হয়েছে, একজন শ্রমিক তার মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করবে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য। নির্দিষ্ট সময়ের পরে (সেটা কয়েক মাস বা কয়েক বছর হতে পারে) তাকে আবার চুক্তি করতে হবে। অর্থাৎ ধারাবাহিক ভাবে কাজের সুযোগকে খর্ব করা হল, চুক্তিভিত্তিক, স্বল্পমেয়াদী নিয়োগকে আইনত বৈধ করা হল।
নরেন্দ্র মোদি সরকার ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর মরসুমি শ্রমিকদের ক্ষেত্রে এই বিষয়টি ঢোকায়, সরকারি বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে। ২০১৮ সালে বস্ত্রশিল্পের জন্য এর 'গেজেট নোটিফিকেশন' জারি হয়। লেবার কোডে শিল্পের সমস্ত বিভাগে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' বিষয়টি যুক্ত করা হয়েছে। এটা করতে এই সরকার এতটাই বদ্ধপরিকর যে গ্র্যাচুয়িটি আইনেরও পরিবর্তন করেছে। ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্টের চুক্তি করলে এক বছরে গ্র্যাচুইটি পাবেন শ্রমিক। সরকারি ভাবে গ্র্যাচুইটি পাবার নিয়ম হল, অন্তত পাঁচ বছর কাজ করলে গ্র্যাচুইটি পাওয়া যায়। কিন্তু সময়সীমা কমিয়ে এক বছর করা হল। আমাদের দীর্ঘ দিনের দাবি ছিল গ্র্যাচুইটি আইনের সংশোধন করে পাঁচ বছরের জায়গায় এক বছর কাজ করলেই গ্র্যাচুইটি দেওয়া হোক। সরকার মানেনি। এখন শ্রম কোডে এই সুবিধা দেওয়া হল কেন? এটা শ্রমিককে প্রলোভিত করার জন্য, যাতে 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর নিয়মে শ্রমিক মালিকের সঙ্গে লিখিত চুক্তি করে৷ কিন্তু স্বল্পমেয়াদী এই চুক্তি যদি মালিক পুনরায় নবীকরণ না করে, তা হলে তো গ্র্যাচুইটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সব পাওনার শেষ হবে। 
অর্থাৎ 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' চুক্তিতে একবার ঢুকলে স্থায়ী চাকরির সম্ভাবনা, শ্রমিকের বিভিন্ন অধিকার, সব বাতিল হয়ে যাবে। এমনকি শ্রমিকের সংগঠিত হয়ে ইউনিয়ন করার বিষয়টি আর থাকবে না। ফিক্সড টার্মে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহোরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায় তাহলে তা লিখিত চুক্তির বিরুদ্ধে হবে৷ সুপরিকল্পিত ভাবে ফিক্সড টার্ম ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। কারণ, ফিক্সড টার্ম চুক্তিতে যে শ্রমিক কাজ করছে তার মধ্যে অহরহ এই ভয় থাকবে যে যদি সে মালিক বা কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে যায়, তা হলে তা লিখিত চুক্তির শর্ত ভঙ্গ করবে। সুপরিকল্পিত ভাবে নিয়োগের ক্ষেত্রে 'ফিক্সড টার্ম' চুক্তির ব্যাপারটা আনা হয়েছে যার ফলে স্থায়ী শ্রমিক থাকবে না, শ্রমিকের কোনো সুরক্ষা পাবে না, শ্রমিকরা ইউনিয়নভুক্ত হবে না বা সংগঠিত প্রতিবাদ করবে না। আর এখানে সরকার বা লেবার দপ্তরের কোনো দায়ও থাকবে না। কারণ মালিকের সাথে লিখিত চুক্তি করেই ব্যক্তি শ্রমিক কাজ পেয়েছে৷ সরকার বা শ্রম দপ্তরের এখানে কিছু করার নেই৷ এমনকি শ্রমিক কোনো আইনি সুরক্ষাও পাবে না। কারণ আদালতে যুক্তি আসবে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ লিখিত চুক্তি করে স্বল্পমেয়াদী নিয়োগের শর্তাবলী মেনে নিয়েছে। অর্থাৎ সব দিক থেকেই 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' একটি আদ্যোপান্ত দানবীয় আইন।
একটা প্রশ্ন আসতে পারে— এ দেশে বিভিন্ন শিল্পে চুক্তিভিত্তিক শ্রমিকই বেশি। 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট'-এর সঙ্গে তা হলে তফাতটা কী হল? মূলগত ভাবে তফাত না থাকলেও একটি তফাত আছে৷ তা হল, চুক্তিভিত্তিক বা কনট্র্যাকচুয়াল শ্রমিকের ক্ষেত্রে সব সময় নিয়োগের নির্দিষ্ট মেয়াদ থাকে না, বা লিখিত চুক্তি করতে হয় না। কিন্তু 'ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট' ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সময় উল্লেখ করে লিখিত চুক্তি থাকতে হবে। আরও বড় সমস্যা হল, শ্রম কোডে এটা অন্তর্ভুক্ত হবার ফলে একে আইনত বৈধ করা হল। আরও যে সমস্যা পরবর্তী কালে আসবে তা হল, শ্রমিক-মালিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের বা আদালতের যে একটা ভূমিকা থাকে, তা কার্যত নাকচ হয়ে যাবে।
এরপর এই কোডের আরও দুটি বিষয় নিয়ে আমরা আলোচনা করব — ধর্মঘট এবং ট্রেড ইউনিয়ন আইন বিষয়ে।
ধর্মঘট বিষয়ে আগে বলা ছিল, এক দল শ্রমিকের কাজ বন্ধ করা বা সংঘবদ্ধ ভাবে কাজ করতে না চাওয়াকে 'স্ট্রাইক' বা ধর্মঘট বলা হবে। এ বার তার সঙ্গে আরও একটি বিষয় যুক্ত করা হয়েছে৷ পঞ্চাশ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক যদি ছুটি নেয়, তা হলে সেটাও ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে। শ্রমিক কাজ করতে চায় না, বা কাজ বন্ধ করে তার অধিকার আদায়ের জন্য। কিন্তু ছুটি তো একটা অধিকার৷ ৫০ ভাগের একজন বেশি শ্রমিক ছুটি নিলে সেটা কেন ধর্মঘট হিসাবে গণ্য হবে? এতে ছুটি বা Leave-কে ধর্মঘটের সঙ্গে যুক্ত করা হচ্ছে। এটা একটা অধিকার জোর করে কেড়ে নেওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া আর কিছু নয়। দ্বিতীয়ত, আগে জনপরিষেবার কোনও ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ধর্মঘট করতে চাইলে নোটিস দিতে হত। বাকি শিল্প, যা 'পাবলিক ইউটিলিটি সার্ভিস'-এর মধ্যে পড়ে না সেখানে ধর্মঘটের জন্য আগাম নোটিস দিতে হত না। শ্রম কোডের নিয়ম অনুসারে ধর্মঘট করার বিষয়টি অনির্দিষ্ট কালের জন্য বিলম্বিত হয়ে যাবে — ইউনিয়ন ধর্মঘটের নোটিস দিল, মালিক মানল না, সেটা শ্রম দপ্তরে দু'তরফের বিবাদ বা 'ডিসপ্যুট' হিসেবে গেল। তারপর শুরু হল আলোচনা। আলোচনা চলাকালীন কোনো পক্ষ এক তরফা সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না, বলছে কোড। অর্থাৎ কার্যত ধর্মঘটের বিষয়টা এক অন্তহীন প্রক্রিয়ার মধ্যে চলে গেল। আমরা আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি, কোনো কারখানায় মালিক বা কর্তৃপক্ষ একতরফা কোনো সিদ্ধান্ত নিলে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় শ্রমিক কাজ বন্ধ করে দেয়। অথবা, দুর্ঘটনায় কোনো শ্রমিক মারা গেলে, বা গুরুতর আহত হলে শ্রমিকরা তক্ষুণি কাজ বন্ধ করে দেয়। শ্রমিকদের এই সমবেত প্রত্যাঘাতে মালিকপক্ষ অনেক ক্ষেত্রেই পিছু হটেছে। এ যাবৎ এটা বে-আইনি কাজ হিসেবে গণ্য হত না। কিন্তু বর্তমানে কোনও পরিস্থিতিতেই তাৎক্ষণিক কাজ বন্ধ করা যাবে না। শ্রমিকদের নোটিস দিতে হবে, তারপর ধর্মঘট বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হবে। অর্থাৎ আইনের প্যাঁচে এই ধরনের সমস্ত লড়াই চলে যাবে বিশ বাঁও জলে। এই ভাবে ধর্মঘটের অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে শ্রম কোডে। 
নতুন শ্রমকোডে ট্রেড ইউনিয়ন সংক্রান্ত প্রশ্নে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন রয়েছে। যে কোনো কারখানায় একের অধিক ইউনিয়ন থাকলে, কোনও শ্রমিক সংগঠনকে আইনত স্বীকৃত বা 'রেকগনাইজড' ইউনিয়ন হতে গেলে মোট শ্রমিকদের ৫১% বা তার বেশি নাম মাস্টার রোলে থাকতে হবে। যদি ৫০%-এর বেশি শ্রমিকের সমর্থন কোনো ইউনিয়ন না পায়, তা হলে আনুপাতিক হারে কাউন্সিল তৈরি করতে হবে। সেই কাউন্সিলই মালিকপক্ষের সঙ্গে দর কষাকষি করবে। আপাত ভাবে মনে হয় ৫১% বেশি শ্রমিকের নাম মাস্টার রোলে থাকলে ব্যাপারটা তো মন্দ নয়। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায় — ৫১% শ্রমিকের নাম মাস্টাররোলে রাখার বিষয়ে কোনো নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার কথা বলা হয়নি। ফলে ইউনিয়ন তৈরির ক্ষেত্রে রাজ্যের শাসক দলের, বা কারাখানা মালিকের একটা বড় ভূমিকা থাকবে। তাদের পছন্দের ইউনিয়নের শ্রমিকদের ৫১ শতাংশ বা তার বেশি সদস্যের নাম মাস্টাররোলে ওঠানোর চেষ্টা জারি থাকবে। আর ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা যাই হোক,.... প্রধান এজেন্ট হিসেবে নির্বাচনের কোনো কথা এই আইনে নেই। স্বাভাবিক ভাবেই ইউনিয়নের উপর শাসকদলের বা মালিকের নিয়ন্ত্রণ অনেক বেশি থাকবে।
এর আগে আমরা দেখেছি, 'ফ্যাক্টরি'-র সংজ্ঞা বদলে বহু কারখানা শ্রমিককে আইনের সুরক্ষার বাইরে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আরও একটা উল্লেখযোগ্য বিষয় 'স্ট্যান্ডিং অর্ডার'— যার উল্লেখ 'দ্য ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিলেশনস কোড, ২০২০'-তে লেখা আছে। তিনশো বা তার বেশি শ্রমিক যে ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন সেখানে স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে। এখন প্রশ্ন হল, স্ট্যান্ডিং অর্ডারের গুরুত্ব কোথায় ছিল? স্ট্যান্ডিং অর্ডারে কী থাকে? শ্রমিকদের বিভাগ নির্ণয় (ক্লাসিফিকেশন) অর্থাৎ শ্রমিকটি স্থায়ী না ক্যাজুয়াল, নাকি বদলি শ্রমিক, ইত্যাদি। এ ছাড়া কাজের সময় থেকে শুরু করে শিফট কী ভাবে চলবে, টিফিনের সময়, বেতন কখন, কবে দেওয়া হবে, ছাঁটাইয়ের শর্ত, খারাপ ব্যবহারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা— অর্থাৎ উৎপাদনের ক্ষেত্রে শ্রমিক-মালিক সম্পর্কর ব্যাপারটি নীতিভুক্ত হয়। দু'ভাবে স্ট্যান্ডিং অর্ডার হয়। একটা থাকে মডেল স্ট্যান্ডিং অর্ডার, আরেকটা মালিক-শ্রমিক চুক্তি হয় লেবার দপ্তরের উপস্থিতিতে। এখন কিন্তু ৩০০-র চেয়ে কম শ্রমিক কাজ করলে সেখানে কোনো স্ট্যান্ডিং অর্ডার থাকবে না। অর্থাৎ ফ্যাক্টরি চলার অভ্যন্তরীণ রীতি তুলে দেওয়া হল।
অতএব আমরা দেখতে পাচ্ছি, নতুন আইনে নানা সংজ্ঞা এবং বিধি বদল করে লক্ষ লক্ষ শ্রমিককে আইনের বাইরে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। অর্থাৎ সংগঠিত শিল্প-শ্রমিকদের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে৷ কাড়া হয়েছে সংগঠন ও সংগ্রামের অধিকার।
অপর দিকে যে সব শ্রমিকেরা আজ শ্রম আইনের আওতায় নেই, সেই লক্ষ লক্ষ শ্রমিকদের বিষয়ে চারটি শ্রম কোড কী অবস্থান নিয়েছে? বেশি ব্যাখ্যা করার দরকার নেই, কিছু উদাহরণই যথেষ্ট। লাখ লাখ গৃহপরিচারিকাদের সম্পর্কে কোডে কোনো কথা বলা নেই। আর আজকের শ্রম-বাজারে যে শ্রমিকদের নিয়ে সবচেয়ে বেশি চর্চা হয়, সেই গিগ শ্রমিকদের ব্যাপারে লেখা আছে, 'gig workers means a person who performs work or participates in a work arrangement and earn from such activities outside of traditional employer-employee relationship.' মানে প্রথাগত মালিক-শ্রমিক সম্পর্কের বাইরে থাকবে গিগ শ্রমিকরা। তাদের কোনো আইনি অধিকার থাকবে না। শুধু কিছু প্রকল্পের সুযোগ পাবে। এ সব থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে চারটি শ্রম কোড সমস্ত ধরনের শ্রমিকের মৌলিক আইনি অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটি হাতিয়ার। এই চারটি শ্রম কোডকেই বাতিল করার দাবিতে সমস্ত লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।
প্রশ্ন হল, আজ ভারতে কেন এই শ্রম কোড আনা হল? বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যটা কি? এর পিছনের রাজনীতিটা আমরা বুঝব কী ভাবে? রাজনীতি বুঝতে না পারলে সঠিক প্রতিরোধও গড়া যাবে না।
কয়েকটা প্রশ্নে ভাগ করে এর উত্তর খুঁজব।
১) শ্রমকোড বা শ্রম আইন আনার প্রেক্ষিতটা কী?
বিশ্বে পুঁজিবাদী ব্যবস্থা আসার পর শ্রমিক শ্রেণি পুঁজির আক্রমণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অধিকারের দাবিতে সংগঠিত হওয়া শুরু করে। 'মেশিন-ভাঙা' আন্দোলন থেকে বিভিন্ন বিভাগে ঐক্যবদ্ধ হওয়া, পরবর্তীতে বিভিন্ন কারখানায় কিংবা শিল্প-ভিত্তিক সংগঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রক্রিয়া চলতে থাকে। মে দিবসের লড়াই ছিল পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী শ্রমিকদের শ্রেণিগত ভাবে ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের একটি চমৎকার উদাহরণ। ইতিমধ্যে ১৮৭১ সালে প্যারি-কমিউন ঘটে। ১৯১৭ সালে শ্রমিকরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে রাশিয়ার। রাশিয়ার বিপ্লব গোটা পৃথিবীতে শ্রমিক আন্দোলনে নতুন জোয়ার আনে। ঐ সময় বিভিন্ন দেশে শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হয়ে আইনি অধিকার পাবার লড়াই জোরদার করে। অপর দিকে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াইয়েও অংশগ্রহণ করে। অন্য দিকে বুর্জোয়ারাও ক্ষমতা হারানোর ভয়ে শ্রমিকদের কিছু আইনি অধিকার দিতে বাধ্য হয়। এবং নানান ধরনের শ্রম আইন তৈরি হয় নানান দেশে। মানে রাষ্ট্র একটা নিয়ম প্রবর্তন করে যা শ্রমিক, মালিক, রাষ্ট্র সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। এই সব আইনের মাধ্যমে শ্রমিকশ্রেণি কিছু আইনি অধিকার পায়। শ্রমিক বিপ্লব যাতে না হয়, তার জন্য বুর্জোয়ারা এই অধিকার দিতে কিছুটা বাধ্যও হয়। কিন্তু এ কথা স্বীকার করতেই হবে যে, উত্তাল শ্রমিক আন্দোলন না থাকলে শ্রমিকদের এই আইনি অধিকার অর্জন হতো না। শ্রমিকরা যা কিছু আদায় করেছে, সংগঠনের জোরে, ঐক্যবদ্ধ লড়াইয়ের জোরেই করেছে।
আমাদের দেশের সংগঠিত শিল্পও তার ব্যতিক্রম নয়। এ দেশের শ্রমিকরা আন্দোলনের জোরে বেশ কিছু আইনী অধিকার অর্জন করেছে। ভারত রাষ্ট্রে দেশী-বিদেশী একচেটিয়া পুঁজিপতিদের শাসন থাকা সত্ত্বেও অনেক লড়াই করে শ্রমিকরা এই অধিকার অর্জন করেছিল। শ্রমিক আন্দোলন যত দুর্বল হতে থাকে, পুঁজিপতি শ্রেণি ততই শ্রমিকের আইনি অধিকারকে খর্ব করতে তীব্র আক্রমণ নামিয়ে আনে। এর বিরুদ্ধে শ্রমিকরা প্রতিরোধ গড়তে পারেনি। ফলে বহু ক্ষেত্রে পুঁজিপতিরা তাদের ইচ্ছেমতো নিয়ম প্রবর্তন করতে শুরু করে। কাজের ঘন্টা বাড়ানো, স্থায়ী শ্রমিক প্রথা রদ, বেতন সংকোচন, চুক্তি শ্রমিক ও ঠিকা শ্রমিকের সংখ্যায় বৃদ্ধি, ইচ্ছেমতো ছাঁটাই, যখন-তখন কাজ বন্ধ করা, ইত্যাদি চলতে থাকে। এক কথায় শ্রমিকদের ওপর ব্যাপক আক্রমণ নামিয়ে আনে।
২) আর এস এস পরিচালিত বিজেপি সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য কি?
এই প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গেলে আমাদের দু'টো বিষয় নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে :
(ক) গত শতাব্দীর ন'য়ের দশক থেকে এই দেশে নয়া-উদারবাদী অর্থনীতির আগমন ঘটে, কংগ্রেসের নরসীমা রাও ও মনমোহন সিংহের আমলে যার প্রবর্তন হয়। এটি গোটা দেশের অর্থনৈতিক-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে বিপুল বদল আনে।  
(খ) এই পর্যায়েই এ দেশের ফ্যাসিস্ট দল বিজেপির বিপুল শক্তিবৃদ্ধি ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই পরবর্তী কালে ভারতের একচেটিয়া পুঁজিপতিদের সবচেয়ে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক, হিংস্র পুঁজিপতি গোষ্ঠী বিজেপি-কে নিঃশর্ত সমর্থন দেয়। ফ্যাসিবাদ সব সময় প্রধান প্রতিপক্ষ করে শ্রমিকশ্রেণিকে। শ্রমিক শ্রেণি যাতে শ্রেণিবদ্ধ ভাবে সংঘবদ্ধ না হতে পারে, শ্রমিকদের শ্রেণিগত ঐক্য ভেঙে যাতে শ্রমিকরা পরস্পর-বিচ্ছিন্ন হয়, মতাদর্শের দিক দিয়েই ফ্যাসিস্টরা তা নিশ্চিত করতে চায়। ফ্যাসিবাদী শাসন ও স্বৈরাচারী শাসনের মধ্যে তফাৎ হলো, ফ্যাসিবাদী শাসনে স্বৈরাচার থাকবে, কিন্তু স্বৈরাচারী শাসনে ফ্যাসিবাদ থাকবেই— এমনটা নয়। একটু আলোচনা করা যাক। ১৯৭০-১৯৭৬ যখন ইন্দিরা গান্ধীর চরম স্বৈরাচারী শাসন চলছে, সেই সময়েই তিনটি শ্রম আইন তৈরি হয় : ১৯৭০ সালে কন্ট্রাক্ট প্রথা (রেগুলেশন ও এ্যবুলেশন) আইন, ১৯৭২ সালে গ্র্যাচুইটি আইন, ১৯৭৬ সালে সমকাজে সমবেতনের আইন। দেশে স্বৈরশাসন চলাকালীনই এই আইনগুলি পাশ হয়েছিলো, যেগুলি শ্রমিক-স্বার্থ কিছুটা হলেও রক্ষা করেছিলো। কিন্তু ২০১৪-২০২৫, এই এগারো বছরে নরেন্দ্র মোদী সরকার শ্রমিক স্বার্থে একটাও আইন তৈরি করেনি। উপরন্তু ২৯টি শ্রম আইনকে চারটে শ্রম কোডে পরিবর্তিত করে শ্রমিকদের আইনি অধিকার কার্যত কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে। যে চারটি শ্রম কোডের মাধ্যমে কার্যত এই সরকার বেশির ভাগ শ্রমিককে শ্রম-আইনের বাইরে নিয়ে এসে গেছে। অপর দিকে যেটুকু আইন থাকবে, সেটা প্রত্যক্ষ ভাবে মালিকদের স্বার্থরক্ষা করবে। যেমন ধর্মঘট, ট্রেড ইউনিয়ন করা, মজুরির প্রশ্ন, গিগ-প্ল্যাটফর্ম শ্রমিক-সহ অজস্র শ্রমিকদের বিরুদ্ধে আইনকে দাঁড় করানো, ইত্যাদি। এক কথায় একচেটিয়া পুঁজিপতিদের স্বার্থে ফ্যাসিস্ট শক্তি তার সর্বোচ্চ ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়াবে। কোনো মতেই যেন শ্রমিকরা সংঘবদ্ধ হতে না পারে। এটা আরো ভালো ভাবে লক্ষ করা যাবে গুজরাটে। এই পর্যায়ে দুটি রাজ্যে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন তুলনামূলক ভাবে সক্রিয়, গুজরাট ও তামিলনাডু। এ দেশে চারটি শ্রম কোড আইনে রূপ পাওয়ার পরও দেশব্যাপী শ্রমিকদের নানান প্রতিবাদের জন্য আজো শ্রমবিধি তৈরি হয়নি। ফলে চারটি শ্রম কোডকে প্রায়োগিক স্তরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই অন্তত একটি ক্ষেত্রে আট ঘন্টার জায়গায় ১২ ঘন্টা কাজের জন্য অর্ডিন্যান্স গুজরাট সরকার লাগু করেছে। অথচ সপ্তাহে ৪৮ ঘন্টায় কাজের কথাও লেখা আছে। তার মানে এক দিকে দৈনিক ১২ ঘন্টা কাজকে আইনত বৈধ করার চেষ্টা করা হচ্ছে, অপর দিকে সপ্তাহে চার দিন কাজ করতে হবে। এখন, একটা শিল্প তো তিন দিন বন্ধ রাখা যাবে না! ফলে এই অর্ডিন্যান্সের ফলে বাকি দু'দিন বেআইনি প্রক্রিয়াকে আইনি প্রক্রিয়া করে দেওয়া হলো। ফ্যাসিস্ট শক্তির আঁতুড়ঘর গুজরাট। তাই গুজরাটে অর্ডিন্যান্স করে তারা দেখে নিতে চায় ১২ ঘন্টার কাজকে আইনত বৈধ করলে সমাজ জুড়ে তার কি প্রতিক্রিয়া হয়। আর সেই জন্যই এই অর্ডিন্যান্স। এক কথায়, শ্রম কোড আনার পিছনে এটাই বিজেপি-র রাজনৈতিক উদ্দেশ্য। এক দিকে যেমন বেশির ভাগ শ্রমিককে আইনের আওতার বাইরে নিয়ে যাওয়া, অপর দিকে যা কিছু অবশিষ্ট থাকবে তা দিয়ে আরো জোরের সাথে একচেটিয়া বৃহৎ পুঁজিপতিদের স্বার্থরক্ষা করা।
এখন প্রশ্ন হলো, এর বিরুদ্ধে লড়াইটা কিভাবে গড়ে উঠবে? প্রতিরোধ কিভাবে করবে শ্রমিক শ্রেণি? এই আলোচনায় যাবার আগে আমাদের দেশের শ্রমিক শ্রেণির অবস্থা ও শ্রমিক আন্দোলন নিয়ে একটু কথা বলে নিতে হবে।
দীর্ঘ দিন ধরে শ্রমিক আন্দোলন একটা ভাটার পর্বের মধ্য দিয়ে চলছে। এক দিকে পুঁজিপতি শ্রেণির নিত্যনতুন, একচেটিয়া হামলা চলছে, সেই সঙ্গে উৎপাদনের পদ্ধতির পরিবর্তন হচ্ছে, অপর দিকে দীর্ঘ লড়াই করে শ্রমিকশ্রেণি যে অধিকার অর্জন করেছিল সেগুলি আস্তে আস্তে হাতছাড়া হচ্ছে। আজকের শ্রম কোডে যে সব অধিকার ধরে রাখার জন্য লড়াই করা হচ্ছে, বাস্তবে সেগুলো হারানোর প্রক্রিয়া অনেক দিন ধরেই সমাজ জুড়ে চলছে। যেমন স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ প্রথা রদ, চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ ও ঠিকা শ্রমিক বৃদ্ধি, কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি, কাজের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, অবাধ ছাঁটাই-সাসপেন্ড, মজুরি কমানো, ধর্মঘট-সহ যে কোনও শ্রমিকদের লড়াইয়ের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, ইত্যাদি। তথ্যপ্রযুক্তি থেকে শুরু করে যে কোন ম্যানুফ্যাকচারিং শিল্প, পরিষেবা শিল্প সর্বত্র অস্থায়ী শ্রমিক ও কাজের ঘণ্টা বৃদ্ধি করা হয়েছে। নতুন ধরনের শ্রমিক, যেমন গিগ শ্রমিক, প্ল্যাটফর্ম শ্রমিকদের আইনি অধিকার দেওয়া হয়নি। গৃহশ্রমিক থেকে মিড ডে মিল কর্মচারী, এদের জন্য কোনো আইন নেই। এক কথায়, কোটি কোটি মানুষ শ্রম দিচ্ছেন, সম্পদ তৈরি করছেন অথচ তাঁদের সুরক্ষার জন্য কোনো আইন নেই। শ্রমিক আন্দোলনের এই ভাঁটার সময়ে এক দিকে দীর্ঘ দিন আগে অর্জিত অধিকারগুলি হারাচ্ছেন, অপর দিকে অজস্র যে নতুন 'শ্রমিক' যোগ দিচ্ছেন নানা ধরনের কর্মক্ষেত্রে, নানা ধরনের শর্তে, তাঁদের জন্য কোনো আইনি ব্যবস্থা গড়ে ওঠেনি। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের অবস্থা। কোথাও যে লড়াই বা প্রতিরোধ হচ্ছে না তা নয়, কিন্তু তা সামগ্রিক পরিস্থিতিকে স্পর্শ করতে পারছে না। এই হচ্ছে আজকের শ্রমিক আন্দোলনের পরিস্থিতি। একটা প্রশ্ন আসবেই— এই তো কিছু দিন আগে দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট হয়ে গেল। সেখানেও তো প্রতিবাদ-প্রতিরোধের কিছু ছবি পাওয়া গেছে। তা হলে? হ্যাঁ, এটা সত্য যে বিজেপি বাদে প্রায় সমস্ত সংসদীয় রাজনৈতিক দল ও তাদের পরিচালিত ইউনিয়ন, অজস্র ছোট ছোট ট্রেড ইউনিয়ন, নকশালপন্থীদের বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন, নানা ধরনের স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এই ধর্মঘটে অংশগ্রহণ করেছিলেন, তাতে একটা রাজনৈতি

শনিবার, ৮ নভেম্বর, ২০২৫

গ্যাপ ~ সুনৃতা মাইতি

অপর্ণার মন খুব খুব  খারাপ। শরীরও জুতের নেই। দুগ্গা পুজো হয়ে দীপাবলি, এত পরিশ্রম গেছে যে বলার নয়। উৎসবের দিনকাল মানেই বাড়ির মানুষদের বাড়িতে সকাল থেকে রাত্তির পর্যন্ত পায়ে পা তুলে জেঁকে বসে থাকা তো শুধু নয়, আত্মীয়স্বজনদের যাওয়া আসাও  লেগে থাকে। আনতাবড়ি খাটতে খাটতে  অবস্হা কেরোসিন! শরীর এসব সয়ে নেয়, তার অভ্যেস আছে। বাকি রইল মন। সেও অনেক কিছু সইতে সইতে আজকাল শক্তপোক্ত হয়ে গেছে। নারকোলের মত। ভেতরের সারজলটুকুর সন্ধান পেতে বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়। কিন্তু মনের ওই নরম জায়গাটাতে যদি আঘাত লাগে তবে কি আর সহ্য হয়! সে কি সত্যি খারাপ! খারাপ মা? তার মেয়ে তার পিঠপিছে সেটাই বলেছে! মানে ঠিক বলেনি, লিখেছে। সেইটা আবার অপর্ণার গোচরে এসেছে।

লে দে কে অপর্ণার একটিই তো সাফল্য। তার একমাত্র সবেধন নীলমণি মেয়ে শ্রীতমা। বিটস পিলানিতে ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে, পড়াশোনায় যেমন ভাল, তেমনই দুর্দান্ত ফ্যাশানিস্তা। রাস্তায় বেরোলে লোকে হা করে তাকিয়ে থাকে। দীপাবলির ছুটিতে বাড়ি এসেছে। এসেই এমন সব ধুন্ধুমার ড্রেস পড়েছে যে বাড়িতে তার বাবার  সাথে চুলোচুলি হতে বাকি ছিল। অপর্ণা অতি কষ্টে ওই রক্ষনশীল ভদ্রলোক ও মেয়েকে যুগপৎ সামলেছে। মেয়ে পোশাকের ব্যাপারে মঝঝিম পন্থা নিতে বাধ্য হয়েছে মায়ের মধ্যস্থতায়। কিন্তু তাও তার বাপ ব্যাটামানুষের কি রাগ! গজগজ করতে করতে শাশুড়ি মায়ের কাছে কাঁধ মানে পাতি বাংলায় কন্ধা খুঁজতে গিয়েছিল। এদিকে অপর্ণার শাশুড়ি মাও বয়স বাড়ার সাথে সাথে আজকাল হেভি সেয়ানা হয়ে গেছেন। কোন দিকে যাবেন বুঝতে না পারলে বুড়ি আজকাল কানে কম  শোনার একটিং শুরু করেন। সেটাতে কাজ না হলে বলতে থাকেন," হরি বোল! হরি বোল! " যখন ইয়ে বয়স ছিল,সাংঘাতিক সব গা জ্বালানি কমেন্ট করতেন, যাকে বাঙাল ভাষায় বলে, চিমটাইন্যা কথা। আর খুব আস্তে বলতেন ,এত আস্তে যে খুব কাছাকাছি থাকা মানুষরাই শুনতে পেত। অপর্ণার বড় জা মৃদুলা সেই মন্তব্য শুনলেই হাউ হাউ করে দাপাদাপি করে উঠত।  পাড়াশুদ্ধ মানুষ বলত ," আহা! শাশুড়ি মানুষটি কি শান্তিপ্রিয়! গলা পর্যন্ত শোনা যায়না! বড়  বৌ কি দজ্জাল দেখো! "

তারপর তো বড় ভাসুর ও জা আলাদা হয়ে যায় তাদের যৌথ সংসার থেকে। অপর্ণা বরাবরই শান্ত ও ধৈর্যশীল মেয়ে। সবাইকে খুশি করেই চলার চেষ্টা করেছে বরাবর। তাতে অবশ্য ভালই হয়েছে। সকলেরই বিষদাঁত সময়ের সাথে সাথে নড়বড়ে হয়েছে। সব ক্ষত ভুলে সেও একদিন নিজের মত করে জীবনটাকে দেখতে পেরেছে, সাজতে গুজতে পেরেছে, নিজের মত শান্তিনীড় তৈরি করার চেষ্টা করতে পেরেছে। 

কিন্তু মেয়ের ব্যাপারটা ভাবলেই তার চোখ জলে ভিজে উঠছে।রাতে ঘুমোতে গিয়ে সে বার বার তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করছে, 

"হ্যাঁ গো, এটা কি সত্যি ? মেয়ে তার হোয়া স্ট্যাটাসে তাই লিখেছে! সারা দুনিয়াকে জানিয়েছে,তার মা খারাপ! হ্যাঁ গো,আমি এত খারাপ!"

তার স্বামী চোখ ছোট ছোট করে কূটনী ভঙ্গিমায় বলেছে,

" তবে আর বলছি কি! নিজের চোখে দেখেও তোমার বিশ্বাস হলনা! যাগ্গে, বাদ্দাও। কবে বিয়ে হবে, কবে জামাই হবে! ওই নিয়ে ভেবে কাজ নেই।"

আসলে কিনা তার  কলিজার টুকরো মেয়ে  হোয়া স্ট্যাটাসে তার সামাজিক বায়োডাটা দিয়েছে, তাতে নিজের প্রোস আর কোন্স দিয়েছে। মজা করেই দিয়েছে হবে। মানে তাকে যে বিয়ে করবে, কী কী ভাল - মন্দের সম্মুখীন হবে আর কি। ওই আগাম ঘোষণার মত। আজকালকার নতুন জেনারেশনের ছেলেমেয়েরা মানে যাদের জেন জি বলা হয় তারা এইরকম খুল্লামখুল্লা। মেয়ের ভালর মধ্যে লিখেছে, বয়ফ্রেন্ড একটি ফ্যাশন সচেতন মেয়ে পাবে, ভাল মনের মেয়ে পাবে, আবার খারাপের মধ্যে সে খুব এক্সপেনসিভ, মাথা গরম পদী ইত্যাদি। ফেলু গোয়েন্দা বাপ ডজন খানেক ফেক একাউন্ট খুলে সারাক্ষণ মেয়েকে সোস্যাল মিডিয়ায় স্টক করে বেড়ায়। মেয়ে বিপথে যাচ্ছে কিনা তাই নিয়ে বেজায় ভয় লোকটার। ফেসবুক, ইনস্টা, লিংকডিন তো বটেই, হোয়াতেও নজরদারি বাদ নেই। তাই ওই বাপের চোখেই এই স্ট্যাটাস পড়েছে। ওই বায়োডাটার মধ্যে একটা পয়েন্ট ছিল, জামাই একজন খারাপ শাশুড়ি পাবে। ভালয় না মন্দয়? প্রোসে না কোনে? ঠিক মনে নেই! দেখতে দেখতেই চোখটা ঝাপসা হয়ে গিয়েছিল কিনা!এইসব ভাবতে ভাবতেই অপর্ণা পরিষ্কার বুঝতে পারে, তার উপচে পড়া দুই চোখ আর জল ধরে রাখতে পারছে না। চোখ মুছতে মুছতে সে মেয়ের ঘরের দিকে রওনা হয়। না না, রাত বারোটা হোক কিংবা একটা এখনই তার ক্লিয়ার পিকচার চাই। যাকে গোদা বাংলায় ক্ল্যারিটি বলে। কীসে ভুল হল তার! মেয়ের কাছে  খারাপ কেন হল সে! তার এতদিনকার সব শ্রম কি বৃথা!

কিছুক্ষণ পর একজন মেয়ের সামনে গিয়ে একজন মাকে চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে শোনা যায়,

"হ্যাঁ রে, আমি এত খারাপ! এত ব্যাড? তোর বর যে হবে, সে ব্যাড শাশুড়ি পাবে?  ছিঃ!"

"যাব্বাবা! আমি আবার তোমাকে ব্যাড কোথায় বললাম?"মেয়ে ঘুম চোখে আকাশ থেকে পড়ে।

"বলিসনি! ওই যে স্ট্যাটাসে লিখেছিস ,মনে নেই! ইউ ক্যান গেট আ ব্যাডি মাদার ইন ল!বাবা ভাগ্যিস দেখাল,তাই জানলাম!"

মেয়ে বিছানা থেকে অতি কষ্টে বডি তুলে বিরক্ত গলায় বলে, "ফাইন!এতই যখন দেখেছ, ব্যাডের পাশে ডি আর ওয়াই টা  আন্দেখা করছ কেন! ওটা ব্যাডি ছিল।"

"দেখেছি। ব্যাডি। তোর ঠাকুমা হলে বলত, ব্যাডের স্ত্রী লিঙ্গ হবে। আমি যদ্দুর জানি, ওর মানে ক্রিমিনাল গোছের কিছু। " মা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলে।

"বেশ! অনেক বুঝেছ। তাহলে দয়া করো। আমাকে ঘুমোতে দাও। আর পারলে গুগল করে দেখে নিও মানেটা। "বলেই মেয়ে পাচন গেলা মুখে কী সব বিড়বিড় করতে করতে বালিশে মাথা রাখে।

অপর্না নাক টানে, ভাল ভাবে চোখ মোছে আর তড়িঘড়ি ঘরে এসে মোবাইল নিয়ে ভালভাবে গুগল করে বিস্ফারিত নেত্রে দেখে ব্যাডি আদতে স্ল্যাং এবং এর দুটো অর্থ। এর একটি, জেন জি এর ভাষায় ,কনফিডেন্ট, স্টাইলিশ আর অ্যাটরাকটিভ! কি কেলো! উপরে চোখ তুলে সে ভাবে,এ যে ইয়েদের ভাষায়, হ্যারি হে ডিনোবন্ডু কেস! সে কী বুঝতে কী বুঝেছে!

তার মেয়ে মা সম্পর্কে এই ভাবে! বুকে একরাশ প্রজাপতি ওড়াওড়ি করে তার। এই ডানা ঝাপটানো হৃদয় নিয়ে সে মোবাইলে আবার চোখ রাখতেই দেখে পিরিং করে মেসেঞ্জারে গভীর রাতের মেসেজ ঢুকেছে, "বি টি ডাবলু, ইউ লুক গুড ইন শাড়ি।"

হাসি হাসি মুখে সে ভাবে,তাই না তাই! কিন্তু বি টি ডাবলু আবার কী কেস রে বাবা!

পুলিশের ডাক ~ অনিমেষ বৈশ্য

আমাদের পাড়ায় একটি পুলিশ ফাঁড়ি ছিল। ফাঁড়ির উঠোনে একটি কাঁঠালগাছ। পাশে একটি ছোট শিবমন্দির। আমরা সেই মন্দিরের চাতালে বসে দিনরাত তাস পিটতাম। মাঝে-মাঝে দু-একজন পুলিশ উনুনে ভাত চাপিয়ে আমাদের সঙ্গে দু-হাত তাস খেলে নিতেন। এক বিশাল চেহারার পুলিশ থেবড়ে বসে কুটনো কুটতেন। আর একজন পুলিশের নাম মনে নেই। তাঁর বয়স ছিল কম। তিনি হেমন্তের সকালে রোদে পিঠ দিয়ে নিশ্চিন্তে উল বুনতেন। কার জন্য বুনতেন জানি না। তখনও রেডিমেড সোয়েটারের যুগ আসেনি। মা-মাসি-পিসি-দিদিমণি সবার হাতে থাকত উলের কাঁটা। কিন্তু একজন তাগড়াই চেহারার পুলিশ তাঁর কর্মস্থলে উল বুনছেন, এ দৃশ্য আমি কখনও দেখিনি। শীর্ষেন্দু মুখুজ্জে জানতে পারলে ওঁকে নিয়ে একটা দারুণ গল্প লিখে ফেলতেন। আমি লিখতে পারি না বলে পাঠকরা বঞ্চিত হলেন। 
এই পুলিশ ফাঁড়ির পত্তন হয়েছিল সত্তর দশকের মাঝামাঝি সময়ে। জরুরি অবস্থার আশপাশে। আমরা তখন ইস্কুলে পড়ি। নেহাতই কচিকাঁচা।

তখন থেকেই ফাঁড়ির পুলিশের সঙ্গে পাড়ার ছেলেদের নিদারুণ সদ্ভাব। এক পুলিশের নাম ছিল রাখাল। বিশাল চেহারা। তাঁর ছেলে রহড়া রামকৃষ্ণ মিশনে পড়ত। রাখালপুলিশকে আমার এক জেঠামশাই ছোট একটু জায়গা দিয়েছিলেন। তিনি সেখানে পর্ণকুটির তৈরি করে সপুত্র বসবাস করতেন। রাখালপুলিশকে উর্দি পরা অবস্থায় কমই দেখেছি। তিনি কাছে থাকলে চোরেরা স্বস্তি পেত। চোরের মনে হতো, ইনি পুলিশ হবেন কোন দুঃখে? যেন বাড়ির লোক লক-আপে ট্যাংরা মাছ রেঁধে এনেছেন। রাখালপুলিশকে আমরা কাকু বলে ডাকতাম। তাঁর শরীর ও মনে পুলিশের অংশ ছিল সামান্যই। তিনি ছিলেন যাত্রার অভিনেতা। শিবরাত্তিরে ফাঁড়ির সামনের মাঠে হ্যাজাক জ্বেলে যাত্রা হতো। কোনও একটা পালায় দীর্ঘদেহী রাখালকাকুকে শিশুর মতো কাঁদতে দেখেছি। বোধহয় সাবিত্রী-সত্যবান পালায়। তিনি কার ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, মনে নেই। সাবিত্রী হওয়াও বিচিত্র নয়। বসন্তকালে বিরহের পালা দেখে আমাদের তনুমন শিরশির করত। চৌদিকে বাতাসের হু হু আর কোকিলের কুহু। পুলিশ যে বসন্তের দূত হতে পারে, এ কথা পাঁচকান হলে পুলিশেরই চাকরি নিয়ে টানাটানি হবে। কিন্তু গাঁ-গেরামের খবর পুলিশের বড় কর্তারা রাখতেন না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিতে পুলিশকর্মীরা কালাতিপাত করতেন। শিবরাত্রির বহু আগে যাত্রার মহড়ার হু হু হা হা শুনে তস্করেরও বুঝি বুক কেঁপে উঠত। ফাঁড়ির পিছনে ছিল আকন্দের ঝোপ। বনতুলসী, আসশেওড়া, নিসিন্দার ঝোপঝাড়ও ছিল ইতিউতি। সেই সব গহিন ঝোপঝাড়ে একটা লম্বা কালো পাখি রক্তকরবী-র রাজার মতো গম্ভীর গলায় ডেকে যেত। তাকে দেখা যেত কম। আমাদের জীবনে তখন নন্দিনী আসবে-আসবে করছে। একটু উতল হাওয়া দিলেই ঝিমধরা ভালোলাগা চৌদিকে। ফিসফিসিয়ে হাওয়াকে বলতে ইচ্ছে করত, ধীরে বও, ওগো ধীরে বও।

ফাঁড়িতে খান কতক রাইফেলও ছিল। শেষ কবে ওই রাইফেলের গুলির শব্দ শোনা গেছে, তার কোনও হিসেবনিকেশ নেই। আমরা মাঝে-মাঝে সেই রাইফেলের হিমশীতল শরীর স্পর্শ করে নিজের জীবনযৌবন সার্থক করেছি। কিছুদিন পরে দেখলাম একটা রাইফেলও নেই। কালী পুলিশ বলে একজন রাগী পুলিশ ছিলেন। একদিন দিনমানে ফাঁড়ির ভিতর থেকেই তাঁর সাইকেল চুরি যায়। এই চুরির খবর বোধহয় বড় কর্তাদের কানে পৌঁছেছিল। তার পর থেকেই ফাঁড়িতে রাইফেল রাখার আর কোনও দরকার মনে করেননি কর্তারা। রাইফেলের বদলে বাঁশি আর বেহালা হলে পালা বোধহয় আরও জমে উঠত। 

একদিন রাখালকাকুর বাড়ির সামনের মাঠে ঘুরে বেড়াচ্ছি। বাঁশঝাড়ের দিক থেকে হাওয়া বইছে। শীতকাল। ধানের শীষে সোনালি রং লেগেছে। ফড়িং উড়ছে। সদ্য লাঙল দেওয়া মাটি থেকে গন্ধ আসছে ভুরভুর। কোন একটা গানের দু-লাইন গেয়ে উঠেছিলাম, মনে নেই। হঠাৎ দেখি রাখালকাকু একটা নিমের দাঁতন মুখে নিয়ে বললেন, 'কী রে কচি, পালায় গান গাইবি?' আমি তো চমকে উঠলাম। বলে কী? পালায় গান গাইব? বললাম, 'আমি তো গান গাইতে পারি না।' রাখালকাকু বললেন, 'এই যে গাইলি।' গান গাওয়া আর গান গাইতে পারা কি এককথা ? কিন্তু রাখালকাকুকে কে বোঝাবে সে-কথা। আমি দৌড় লাগালাম। রাখালকাকু বলে চলেছেন, 'আরে শোন, পালাচ্ছিস কেন? নিমাই সন্ন্যাস পালা হবে। ওই দেখো।'

আমি ছুটছি। পুলিশকাকুও ডেকে চলেছেন, 'আরে শোন। এই কচি।' আমি ছুটছি। এই প্রথম পুলিশ দেখে ভয় লাগছে। পায়ের নীচে শুকনো বাঁশপাতা। ধানগাছের হাওয়া লাগছে গায়ে। ওই তো সোনাডাঙ্গা মাঠ, ওই যে পদ্মফুলে ভরা মধুখালি বিল, ওই যে বীরু রায়ের বটতলা...।

মূর্খ বালক, পথ তো আমার শেষ হয়নি। চলে...চলে...এগিয়েই চলে। দূরে পুলিশের বীণ শোনা যায়।

বুধবার, ৫ নভেম্বর, ২০২৫

রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

-"রবীন্দ্রনাথ বুর্জোয়া কবি - বামপন্থীদের গালাগালি একটি ফ্যাক্ট চেক"-

বামপন্থীরা (বা কমিউনিস্টরা) রবীন্দ্রনাথকে বুর্জোয়া বলে গালাগালি করেছিল - দক্ষিণপন্থীদের দ্বারা এই বহুল প্রচারিত কুৎসা নিয়ে কিছু বলা প্রয়োজন। আসলে এটি একটি অর্ধ সত্য (যা কিনা মিথ্যার চেয়েও ভয়ানক।  হ্যাঁ, বলা হয়েছিল। কে বলেছিলেন, কোথায় বলেছিলেন দেখে নেওয়া যাক। 

'মার্কসবাদী' নামক পত্রিকায় "বাংলা প্রগতি সাহিত্যের আত্মসমালোচনা" শীর্ষক প্রবন্ধে অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম নেতা (তখনও সিপিআইএম এর জন্ম হয় নি), বুদ্ধিজীবী প্রাবন্ধিক প্রয়াত ভবানী সেন (রবীন্দ্র গুপ্ত ছদ্মনামে ) রবীন্দ্রনাথের যে মূল্যায়ন করেছিলেন তাতে বুর্জোয়া, ভাববাদী ইত্যাদি শব্দ আসে [সূত্র: ধনঞ্জয় দাশ সম্পাদিত 'মার্ক্সবাদী সাহিত্য: বিতর্ক'; প্রথম খন্ড, নতুন পরিবেশ প্রকাশনী]। 

প্রথম কথা ভবানী সেন কবিকে বুর্জোয়া বলার ঢের আগে কবি'র সর্ম্পকে এই মূল্যায়ন চালু ছিল। রবীন্দ্রনাথ নিজে নিজেকে শ্রেনী অবস্থানের দিক থেকে কি ভাবতেন, সেটাও একটু দেখে নেওয়া যাক। ১৭.০৩.১৯৩৯ এর চিঠিতে অমিয় চক্রবর্তীকে তিনি লিখছেন - "যখন ময়মনসিংহগীতিকা হাতে পড়ল, খুব আনন্দ পেয়েছিলুম। শ্রেনীওয়ালাদের মতে এসব কবিতা হয়তো বা প্রোলিটেরিয়েট, কিন্তু আমি তো জাত - বুর্জোয়া, আমার ভালো লাগতে একটুও বাধে নি।" [রবীন্দ্রনাথ, চিঠিপত্র]। 

দ্বিতীয় কথা এই যে কবি সম্পর্কে ভবানী সেনের এই মূল্যায়ন ছিল লেখক হিসেবে সেনের একান্ত একক সিদ্ধান্ত, উনি কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র ছিলেন না বা ওই মূল্যায়ন পার্টির সামগ্রিক সিদ্ধান্তও ছিল না। এর প্রমাণ আমরা পাই অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির আরেক নেতা, পরবর্তীকালে সাংসদ হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় এর লেখা থেকে। 

২২সে জুন ১৯৪১ সালে হিটলার দ্বারা সোভিয়েত ভূমি আক্রান্ত হওয়ার পর পরই তাঁর এবং স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু, গোপাল হালদার চিন্মহণ সেহানবীশ প্রমুখ কমিউনিস্টদের উদ্যোগে গড়ে ওঠে ফ্রেন্ডস অফ সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সোভিয়েত সুহৃৎ সমিতি। ড: ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত, প্রখ্যাত বামপন্থী নেতা এর সভাপতি হন। 

সদ্য স্থাপিত সমিতির পক্ষ থেকে সুরেন গোস্বামী গেলেন শান্তিনিকেতনে - রবীন্দ্রনাথের স্বাস্থ্য তখন ভেঙ্গে পড়েছে, কিন্তু তাঁর আশীর্বাদের বড় প্রয়োজন ছিল সমিতির। কবি রাজি হলেন সমিতির পৃষ্ঠপোষক হ'তে, তবে সাবধান করে দিয়ে বললেন যে, ইংরেজ নিজের স্বার্থে সোভিয়েতকে সাহায্য করবে বলছে বটে, কিন্তু "বিশ্বাস কোরো না ওদের; তোমরা কমিউনিস্টরা ওদের বিরুদ্ধে লড়াইতে গা-ঢিলা দিয়ো না।" কমিউনিস্ট পার্টির ও চিন্তা তখন ঐরূপই ছিল - তাই সুরেন বাবু দেখালেন রবীন্দ্রনাথকে পার্টির সদ্য গৃহীত প্রস্তাব, কবি পুলকিত হলেন। [সূত্র: হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় , তরী হতে তীর, মনীষা গ্রন্থালয়]।

তৃতীয় কথা এই যে, পরবর্তীকালে স্বয়ং ভবানী সেন তাঁর অবস্থান থেকে অনেকটাই সরে আসেন সেটা তার লিখিত "একজন মনস্বী ও একটি শতাব্দী" শীর্ষক প্রবন্ধ পাঠ করলেই জানা যায়। একটু ছোট্ট অংশ উদ্ধৃত করা যাক। "স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে - ভাববাদ যদি জীবন্ত সত্যের বিরোধী ই হবে তাহলে রবীন্দ্রনাথ কেমন করে ভাববাদের আশ্রয় থেকে জীবনের মহাসত্যকেই রূপ দিতে পারলেন, কেমন করে তাঁর পক্ষে সম্ভব হ'লো ভাববাদের ঊর্ধ্বে উঠে, যে সত্য বৈজ্ঞানিক বস্তুবাদের একান্ত নিজস্ব, তাকে উজ্জীবিত করা? এ প্রশ্নের একমাত্র উত্তর এই যে তিনি ছিলেন মহান শিল্পী, এবং মহান শিল্পীর সৃষ্টি প্রতিভার বৈশিষ্ট্যই এই যে সত্য তাঁর মধ্যে প্রতিফলিত হয়। তাই তাঁর মনের মধ্যে ছিল এমন একটি সত্যানুসন্ধানী আবেগ যা তাঁকে তাঁর দার্শনিক বিশ্বাসের ঊর্ধ্বে তুলে ধরছে, অতিক্রম করে নিয়ে গেছে তাঁকে সেই ভাববাদী দর্শনের সীমা থেকে।" [সূত্র: নীলরতন সেন সম্পাদিত রবীন্দ্র বীক্ষা, এশিয়া পাবলিশিং কোম্পানি]

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভবানী সেন আগের অবস্থান থেকে এতটাই সরে এসেছিলেন যে প্রখ্যাত সাহিত্য সমালোচক নারায়ন চৌধুরী সেন মশাইকে বিদ্রূপ করে লিখেছিলেন, "হাওয়ামোরগের মত বায়ুর গতি বুঝে কেবলই যদি দিক বদলাতে হয় তাহলে তার মূল্যায়ন নামক অনুশীলনীর কোন সার্থকতা থাকে না" [সূত্র: সংস্কৃতি'  ৭১]

এই লেখা আর দীর্ঘায়িত না করে এবার শেষ করা যেতে পারে কবি'র জীবনের শেষ দিনগুলিতে গিয়ে। বঙ্গের কমিউনিস্টদের স্নেহের চোখে  দেখলেও কমিউনিজম এর স্বরূপ নিয়ে, সোভিয়েত ইউনিয়ন নিয়ে, সমাজবাদ  নিয়ে কবি'র মনে সংশয় ছিল।  শেষ জীবনে তার অবসান  ঘটে। সোভিয়েত ইউনিয়ন আক্রান্ত হওয়ার পর ছয় সাত সপ্তাহের বেশি তিনি বাঁচেন নি। মৃত্যুশয্যায় শুয়ে কেবল জানতে চাইতেন যুদ্ধের খবর আর যে দেশে তিনি "লক্ষ্মীর কল্যাণী মূর্তি" দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ এর জেতার সামান্য কোনো খবর পেলেও শিশুর মতো খুশি হতেন, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিস এর মতো অন্তরঙ্গ সহচরকে বলে গিয়েছিলেন যে, "সোভিয়েত কখনো হার মানবে না।" এক বিষন্ন শ্রাবণ দিনে কবি চলে গেলেন, ব্যাথাতুর দেশবাসীর মহাগুরু পতনের আঘাত সইল, উপায়ন্তর ছিল না, মৃত্যু তো অবধারিত ঘটনা । তবে কবির ঋষিবাক্য ব্যর্থ হয় নি, যে দেশে তিনি 'লক্ষীর কল্যানী মূর্তি' দেখেছিলেন সেই সোভিয়েত দেশ পরম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে প্রমাণ করলো যে সমাজবাদ অপরাজেয় [সূত্র: চিন্মহণ সেহানবীশ, রবীন্দ্রনাথ ও বিপ্লবী সমাজ, বিশ্বভারতী প্রকাশ]।

 ফ্যাক্ট চেকটি শেষ হল।