শনিবার, ৯ আগস্ট, ২০২৫

রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ ~ চন্দন দাস

১৯২৫।

২৭শে সেপ্টেম্বর দশমী ছিল।

সেদিন তৈরি হয়েছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ।

১৯২৫। ২৬শে সেপ্টেম্বর ছিল নবমী। সেদিন গ্রেপ্তার হয়েছিলেন এক ধার্মিক, হিন্দু ব্রাহ্মণ, সাহাজাহানপুর থেকে। তাঁর নাম রামপ্রসাদ বিসমিল। তাঁর সবচেয়ে ঘনিষ্ট, বিশ্বস্ত, প্রাণের বন্ধু গ্রেপ্তার হয়েছিলেন প্রায় একবছর পর। তাঁরও বাড়ি ছিল উত্তরপ্রদেশের সাহাজাহানাপুরে। তিনিও খুব ধর্মপ্রাণ ছিলেন। তাঁর নাম আশফাকউল্লা খান।

দুজনের একই দিনে ফাঁসি হয়েছিল। ১৯২৭-এর ১২ই ডিসেম্বর। রামপ্রসাদ বিসমিল ফাঁসির আগের রাতে সেলে গীতা পাঠ করেছিলেন। কাবুল হয়ে সোভিয়েতে চলে যাওয়ার পরিকল্পনা করা আশফাকউল্লা ধরা পড়েছিলেন একজনের বিশ্বাসঘাতকতায়। ফাঁসির আগের রাতে তিনি পাঠ করেছিলেন কোরান। দুজনকেই ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ।

কেন?

দুজনেই ছিলেন সাম্রাজ্যবাদকে দেশ থেকে উৎখাত করার সংগ্রামের সেনানী। তৎকালীন 'হিন্দুস্তান রিপাবলিকান আর্মি'র সদস্য। যা পরবর্তীকালে হয়ে ওঠে 'ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মি'। দুজনেই সংগ্রামের জন্য টাকা সংগ্রহের তাগিদে ট্রেন ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিলেন ১৯২৫-এর ৯ই আগস্ট। সেই ট্রেন ডাকাতি ভারতের ইতিহাসে 'কাকোরি ট্রেন ডাকাতি' নামে সুপরিচিত।

তাৎপর্যপূর্ণ হলো, তাঁরা যখন দেশ থেকে ব্রিটিশকে তাড়ানোর জন্য জীবনপণ করছেন, ঠিক তখনই দেশে তৈরি হচ্ছে ব্রিটিশের 'ভাগ করে শাসন করো' চক্রান্তের সংগঠন আরএসএস। রামপ্রসাদ বিসমিল গ্রেপ্তার হচ্ছেন, সূর্য সেন আর রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী উত্তর প্রদেশ ছেড়ে কলকাতায় গা ঢাকা দিচ্ছেন ১৯২৫-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর। আরএসএস তৈরি হচ্ছে ঠিক তার চব্বিশ ঘন্টা পরে।

সমাপতন? ইতিহাসে এমন হয়। 'কাকোরি' তাই পালিত হয় না। উত্তরপ্রদেশের তখতে এখন সাম্প্রদায়িক শক্তি। পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল আর বিজেপি সেই আরএসএস-এরই ছকে রাজ্যে বিভাজন খাড়া করেছে। দেশজুড়ে, কোটি কোটি টাকা খরচ করে পালিত হচ্ছে আরএসএস-এর একশো বছর।

অথচ কাকোরির সেই ঘটনাতেই দেশ জানতে পারে চট্টগ্রাম, কলকাতা, বরানগর থেকে বেনারস, লক্ষ্মৌ— সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে সশস্ত্র সংগ্রামীরা। ৯ই আগস্ট ১৯২৫ উত্তরপ্রদেশের কাকোরিতে ট্রেন ডাকাতি করেছিলেন বিপ্লবীরা। তাঁরা নিয়েছিলেন শুধু সরকারি কোষাগারের টাকা। ট্রেনের কোনও যাত্রী, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান গার্ড—কারোকে আঘাত করেননি বিপ্লবীরা। বৃষ্টির সেই রাতে একটি বস্তায় টাকা ভরে তাঁরা লক্ষ্মৌ থেকে সাহাজাহানপুরগামী ট্রেনটি ছেড়ে চলে গেছিলেন তাঁরা।

কাকোরি ট্রেন ডাকাতির সময় উত্তরপ্রদেশেই ছিলেন সূর্য সেন। তিনি বিপ্লবীদের সেই পরিকল্পনার অংশ ছিলেন। ১৯২৫-এর ২৬শে সেপ্টেম্বর দেশজুড়ে ধরপাকড় শুরু হলে মাস্টারদা চলে আসেন কলকাতায়। পরে আবার ফিরে যান উত্তরপ্রদেশে জেল ভেঙে সহযোদ্ধাদের মুক্তির পরিকল্পনা সফল করতে। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছিল। আর একটি ঘটনা ছিল চমকপ্রদ। কাকোরি ট্রেন ডাকাতির মামলার শুনানির সময় আদালতে নিয়মিত হাজির থাকতে দেখা যায় এক শিখ যুবককে— তিনি ভগৎ সিং। অভিযুক্তদের অন্যতম যোগেশ চ্যাটার্জি তাঁকে চিনতেন। তিনি ভগৎ সিংকে বন্দীদের আদালতে আনার রাস্তার ধারে, শুনানির সময় আদালতে একদম সামনের সারিতে বসে থাকতে দেখেন দিনের পর দিন।

সেই ঘটনায় যাঁদের ফাঁসি হয়েছিল তাঁদের তিনজনের বাড়ি ছিল উত্তরদ্রদেশে। তাঁরা রামপ্রসাদ বিসমিল, আশফাকউল্লা খান এবং ঠাকুর রোশন সিং। একজন ছিলেন বাংলার, জন্ম তাঁর আজকের বাংলাদেশের পাবনায়— তিনি রাজেন্দ্রনাথ লাহিড়ী। এই মানুষটি বিস্ময়কর ছিলেন। গীতা পাঠ করতেন। কিন্তু গোরু, শূকরের মাংস খেতেন। কোনও কুসংস্কার মানতেন না। পৈতে ধারণ করতেন না। দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তার আগেই তিনি কাকোরি ট্রেন ডাকাতিতে অংশ নিয়েছিলেন। আর দক্ষিণেশ্বর বোমার মামলায় তিন বছরের মেয়াদে সেই সময় জেলে ছিলেন বলেই উত্তরপ্রদেশের পুলিশ তাঁর হদিশ পেয়েছিল। তাঁর ফাঁসি হয়েছিল সবার আগে— ১৯২৭-এর ১৭ই ডিসেম্বর।

কাকোরি ট্রেন ডাকাতির ঘটনায় যে পাঁচ জনের আন্দামানে দ্বীপান্তরের সাজা হয়েছিল তাঁদের চার জন উত্তরপ্রদেশের, একজন বাংলার। কিন্তু গোবিন্দচন্দ্র কর, মুকুন্দিলাল গুপ্ত, যোগেশ চ্যাটার্জি, শচীন বক্সি এবং শচীন্দ্রনাথ সান্যাল— প্রত্যেকে ছিলেন বাংলাভাষী। দশ থেকে চোদ্দ বছর সশ্রম কারাদন্ড হয়েছিল পাঁচ জনের। চারজন ছিলেন উত্তরপ্রদেশের বাসিন্দা, একজন ছিলেন মধ্যপ্রদেশের। চার এবং পাঁচ বছর যাঁদের কারাদন্ড হয়েছিল সেই ছয়জনের মধ্যে পাঁচ জন ছিলেন উত্তরপ্রদেশের, একজন মধ্যপ্রদেশের। বেইমানদের কথা বাকি থাকে কেন? রাজসাক্ষী হয়েছিলেন দু'জন—একজন বাংলার, একজন উত্তরপ্রদেশের।

শেষ করবো দুটি প্রসঙ্গ তুলে ধরার চেষ্টা করে। প্রথমত, আশফাকউল্লা খানের সঙ্গে তসাদ্দক হোসেনের কথোপকথন। দ্বিতীয়ত, রামপ্রসাদ বিসমিলের শেষ চিঠি।  

তসাদ্দক হোসেন ছিলেন সিআইডি-র ডেপুটি সুপার। তাকে পাঠানো হয়েছিল জেলে, আসফাকউল্লা খানের সামনে। এক মুসলমান আর এক মুসলমানকে ভাঙতে পারবে—এই ছিল চক্রান্ত।

তসাদ্দক হোসেন আশফাকউল্লাকে বললেন,'আপনি একজন মুসলমান। আমিও সেই একই ধর্মের মানুষ। হিন্দুদের সঙ্গে বিপ্লবের কাজে নেমে কেন আপনার অমূল্য জীবন নষ্ট করবেন। রামপ্রসাদ তো হিন্দু। তার উদ্দেশ্য ব্রিটিশরাজ উৎখাত করে তার বদলে হিন্দুরাজ প্রতিষ্ঠা করা।''

আশফাকউল্লা জবাব দিয়েছিলেন। আর তা ভারতের ভিত্তি। ২২ বছরের সেই যুবক বলেছিলেন,''আপনার শুভেচ্ছার জন্য আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার সঙ্কল্প বদলাবে না। আমার কাছে রামপ্রসাদ শুধু একজন হিন্দু নন। তিনি হিন্দুস্তানের অধিবাসী। তাঁর লক্ষ্য হিন্দুদের স্বাধীনতা নয়, সমগ্র হিন্দুস্তানের স্বাধীনতা। আমার লক্ষ্যও তাই।''

এবার রামপ্রসাদ বিসমিলের শেষ চিঠি। ১৯২৭-এর ১৬ই ডিসেম্বর লেখা তাঁর দীর্ঘ চিঠিতে তিনি লেখেন,''সরকার বলেছে আশফাকুল্লাহ খান রামপ্রসাদের ডান হাত। যদি আশফাকের মতো একজন নিবেদিত মুসলিম রামপ্রসাদের মতো একজন আর্য সমাজীর ডান হাত হতে পারে, তবে কেন অন্য হিন্দু এবং মুসলিমরা তাদের ক্ষুদ্র স্বার্থ ভুলে ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে না? আশফাকই প্রথম এমন মুসলিম, যাকে বাংলার বিপ্লবী দলের সাথে জড়িত থাকার জন্য মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হচ্ছে। ঈশ্বর আমার প্রার্থনা শুনেছেন। আমার কাজ শেষ হয়েছে। একজন মুসলিম যুবককে আত্মত্যাগের জন্য পেয়ে আমি হিন্দুস্তানকে দেখিয়ে দিয়েছি যে মুসলিম যুবকরাও হিন্দু যুবকদের চেয়েও বেশি উদ্দীপনার সাথে দেশের জন্য তাদের জীবন উৎসর্গ করতে পারে এবং সে সমস্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছে। এখন আর কেউ সাহস করে বলতে পারবে না যে মুসলিমদের বিশ্বাস করা উচিত নয়। এটি প্রথম পরীক্ষা ছিল যা সফল হয়েছে।''

সঙ্ঘ সেদিনও হেরেছিল। আবার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন