শুক্রবার, ২৮ মে, ২০২১

মনোরঞ্জনবাদ ও তৃণমূল সরকার ~ সংঘমিত্রা ব্যানার্জী

তৃণমূল কংগ্রেসের নীতি-আদর্শ বা মতবাদ বলে কিছু নেই। বামপন্থীরা হামেশাই একথা বলেন। কথাটি কিন্তু ঠিক না। নীতি বা মতবাদ ব্যতীত কোন রাজনৈতিক দল কখন‌ও এই রকম সাফল্য পেতে পারেন না। তৃণমূলে কংগ্রেসেরও নীতি আছে, আছে নির্দিষ্ট মতবাদ। যে রাজনৈতিক মতবাদটি তৃণমূল কংগ্রেস গ্রহণ করেছেন, সেটি নিয়েই সমগ্র বিশ্বে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা এখন চর্চায় ব্যস্ত। রাজনীতির এই ধারাটির নাম 'লোকরঞ্জনবাদ বা পপুলিজম'। 

'লোকরঞ্জনবাদ' কি? এই মতবাদের সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের সম্পর্কই বা কি? আমি এই লেখায় আমার সীমিত ক্ষমতায়, তা আলোচনা করব। পরে আমি লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের পিছনে যে কারণগুলি আছে এবং তার পরিণতি কি --- সেই বিষয়গুলিকে বন্ধুদের সাথে আলোচনার জন্য সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করবো। সমগ্র বিশ্বে লোকরঞ্জনবাদের উত্থানের যুগে তৃণমূল কংগ্রেস কি সুন্দরভাবে এই রাজ্যে সেই মতবাদের প্রয়োগ ঘটিয়ে চলেছেন, তা দেখে আমি নিজেই বিস্মিত। 

বামপন্থীদের জনসমর্থন হ্রাস পাওয়ার এবং তৃণমূল কংগ্রেসের সাফল্যের কারণগুলিকে সঠিকভাবে উপলব্ধি করতে না পারলে, জনগণ এবং সমাজের স্বার্থে বামদের পক্ষে কখনোই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব হবে না। তাই এইসব নিয়ে চর্চার খুবই প্রয়োজন। 

'লোকরঞ্জনবাদ'-র সেই রকম কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। কিন্তু আছে, সাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্য, যা সব দেশের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। আমি যতটুকু পারি, আমার সীমিত জ্ঞানে, তা আলোচনা করব। 

'Oxford Handbook of Populism'-এ  লেখা হয়েছে––
"লোকরঞ্জনবাদ (Populism) হল নির্বাচনে জয়লাভের এবং ক্ষমতায় আরোহনের কিছু কৌশল এবং তার কার্য-পদ্ধতির রূপ"। লোকরঞ্জনবাদী রাজনৈতিক দলগুলির নেতৃত্বে থাকেন, কোন ক্যারিশম্যাটিক নেতা বা নেত্রী। প্রতিষ্ঠিত দলগুলিকে নিয়ে জনগণ যখন ভীষণ হতাশ হয়ে পড়েন, সমাজে ক্রমবর্ধমান দুর্নীতি এবং অসমতা বাসা বাঁধে, তখন জনগণের প্রকৃত ইচ্ছার প্রতিনিধিত্বকারী হিসাবে ঐ নেতা-নেত্রীরা উঠে আসেন। এঁরা ক্ষমতায় এসে, প্রথমেই গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে ভিতর থেকে দুর্বল করে দেন। ডানপন্থীরা যেমন লোকরঞ্জনবাদকে আঁকড়ে ধরতে পারেন, তেমনি বামপন্থী ঘরানায়‌ও লোকরঞ্জনবাদ সম্ভব। 

আমেরিকার ট্রাম্প, ব্রাজিলের বোলসোনারো এবং আমাদের মোদীজী যেমন ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী, তেমনি বলিভিয়ার ইভো মোরালেস এবং ভেনেজুয়েলার হুগো শ্যাভেজ বামপন্থী ঘরানার লোকরঞ্জনবাদী। পূর্ব ইউরোপের যে দেশগুলিতে মার্কসবাদীদের প্রভাব ছিল, বিশেষ করে সেই দেশগুলিতে গত কয়েক বছরে বামপন্থী ঘরানার লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় এসেছেন। এশিয়ার দক্ষিণ কোরিয়াতেও ২০১৭ সালের নির্বাচনে ক্ষমতায় আসেন, আর এক লোকরঞ্জনবাদী নেতা মুন জায়ে ইন। দেশের নির্দিষ্ট প্রেক্ষাপট অনুযায়ী এঁদের উত্থান ঘটে। 

আমাদের দেশের ক্ষেত্রে একই সময়ে সারা ভারতবর্ষে যেমন ডানপন্থী লোকরঞ্জনবাদী নরেন্দ্র মোদীর উত্থান ঘটেছে, তেমনি এই রাজ্যে বামপন্থীদের মোকাবিলায় বাম ঘরানার লোকরঞ্জনবাদী মমতা ব্যানার্জীর উত্থান ঘটেছে। দুই জন পরস্পরের রাজনৈতিক শত্রু হলেও অবিশ্বাস্য রকমের মিল খুঁজে পাবেন দুজনের মধ্যে; কারণ দুজনেই একই ধারার রাজনীতির লোক।

সাধারণভাবে 'লোকরঞ্জনবাদ' হল "To support the interest of mass people." অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ জণগণের স্বার্থ দেখা। এ তো খুব ভালো কথা। বামেরাও তাই বলে। কিন্তু মুশকিল অন্যত্র। আপনার বাচ্চা যদি পুষ্টিকর খাবার না খেয়ে কেবল ফাস্ট ফুড খেতে চায় এবং যদি তার ঐ ফাস্ট ফুড খেতে চাওয়ার ইচ্ছেকে গুরুত্ব দেন, তাহলে তো আপনি তার ফেবারিট বাবা হয়ে যাবেন। কিন্তু তাতে কি আপনার বাচ্চার সত্যিকারের স্বার্থ রক্ষিত হয়? জনগণের কাছে যা জনপ্রিয় তা যদি অন্যায়, অনৈতিক হয়, তা সত্ত্বেও তাকে সমর্থন করাই হল 'লোকরঞ্জনবাদ'।  জণগণের বঞ্চনা এবং হতাশাজনিত আবেগকে কাজে লাগিয়ে লোকরঞ্জনবাদীরা পরিবর্তনের স্বপ্ন দেখায়। বাস্তবে রূপায়ণ সম্ভব না জেনেও, দেয় ঢালাও প্রতিশ্রুতি। চিত্তাকর্ষক বক্তৃতা এবং আচরণের দ্বারা, নির্বাচনে জনগণের হৃদয় জয় করাই এঁদের উদ্দেশ্য। এঁরা কৌশল হিসাবে কোন তথ্য ছাড়াই বিভিন্ন অভিযোগ এনে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা বিদ্বেষ ছড়ায়। এঁরা জনগণের সব দুঃখ-দুর্দশার কারণ হিসাবে কিছু শত্রুকে নির্দিষ্ট করে দেন। লোকরঞ্জনবাদীরা ক্ষমতায় এলে, এঁদের প্রধান কাজ হয় প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাবকে সীমিত করা। তাই সমালোচকরা লোকরঞ্জনবাদকে গণতন্ত্রের পশ্চাদপসরণ এবং কর্তৃত্ববাদী শাসন হিসাবেই চিহ্নিত করেছেন। শেষ অবধি, এই মতবাদ যে রাজনৈতিক আদর্শকে ধারণ করে, তা হল মূলত নির্বাচিত সরকারের কর্তৃত্ববাদ বা একক শাসন। এই মতবাদের সব থেকে মজার বিষয়টি হল, ফলাফল কি হতে পারে, সেটি বিবেচনায় না রেখে, সমস্যার গভীরে না গিয়ে, দেশের জটিল ইস্যুগুলি সমাধানের জন্য সহজ পথ ধরা (এই রাজ্যে অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড)। আরো কতগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য আছে, এই ধারার রাজনীতির। ঘুরপথে নির্বাচন ব্যবস্থাকে দুর্বল করা। জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে দেশের বিচার প্রক্রিয়াকে উপেক্ষা করা। গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে চ্যালেঞ্জ জানানো। আদর্শবাদী প্রধান ধারার রাজনৈতিক দলগুলি সম্পর্কে, 'লোকরঞ্জনবাদ' জনগণের মনে এক ধরণের উদাসীনতা তৈরি করেন। এমন এক ধরণের বিভাজন তৈরি করেন যে, সমাজের মঙ্গলে রাজনৈতিক দলগুলির ঐক্যমতে আসা এক প্রকার অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়। এই মতবাদ সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা বললেও ক্ষুদ্র জাতিসত্ত্বার অধিকার এবং বহুত্ববাদকে চ্যালেঞ্জের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়। 

পরিশেষে বলি, 'লোকরঞ্জনবাদ' হল বর্জনমূলক ধারার রাজনীতি। কোন ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠী কিংবা দলকে বর্জনের কথা বলে।

মমতা ব্যানার্জীর দু-একটি সিদ্ধান্তকে তুলে ধরলেই, বুঝবেন তিনি কি সুচতুর ভাবে এই মতবাদকে প্রয়োগ করছেন।

১। আগে চলচ্চিত্র উৎসব ছিল সমাজের ক্ষুদ্র একটি অংশের জন্য। সেখানে মূলত আর্ট ফিল্ম এবং তার পরিচালক, অভিনেতা, অভিনেত্রীরাই গুরুত্ব পেতেন। মমতা দেবী ক্ষমতায় আসার পর শ্যাম বেনেগাল, মৃণাল সেন, তপন সিনহা ছেড়ে অমিতাভ বচ্চন, শাহরুখ খান, জয়া বচ্চন, .. এবং মূলধারার ছবিকে ধরলেন। চলচ্চিত্র উৎসবকে করে দিলেন সর্বধারণের।

২। সাধারণভাবে পরীক্ষায় ভালো ফল করলে ছাত্র-ছাত্রীরা স্কলারশিপ পায়। উনি ঘোষণা করলেন, যে সমস্ত ছাত্রী পঞ্চাশ শতাংশের নিচে নন্বর পাবে তাদের  স্কলারশিপ দেওয়া হবে। 

৩। সরকারি কর্মীদের বর্ধিত ডি.এ. যা আইন অনুযায়ী সরকার দিতে বাধ্য, তা উনি দিলেন না। বরং তিনি সেই অর্থ থেকে ছয় হাজার টাকা মাইনেতে কিছু প্রান্তিক নারী-পুরুষকে কাজে নিয়োগ করলেন। 

৪। খেলা, মেলা, উৎসব বিশেষ করে দুর্গা পুজো সহ নানা পুজোকে গুরুত্ব দেওয়া।

৫। কখনো সম্ভব না জেনেও নানা প্রকল্প ঘোষণা। রেলমন্ত্রী থাকাকালীন তাঁর ঘোষণাগুলি তিনি নিজেই ভুলে গেছেন। জনগণও অবশ্য ভুলে গেছেন। 

৬। প্রথম দিকে সিপিআই(এম) দলকে বর্জনের রাজনীতি করা। ঘৃণা ছড়ানো। প্রতিদিন একটি করে সিপিআই(এম)-র লাশ কিংবা সিপিআই(এম)-কে বিষাক্ত সাপের সাথে তুলোনা করা। তথ্য ছাড়াই নানা অভিযোগ করে ঘৃণা ছড়ানো। টালা ট্যাঙ্কের জলে বিষ মেশানো, এই রকম নানা অপপ্রচার। সব দোষ সিপিআই(এম)-এর উপর চাপানো। নবজাতকের ওজন কম হলেও দোষ সিপিআই(এম)-এর।
  
৭। গণতন্ত্রের মৌলিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে দুর্বল করে দেওয়া। মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, এই সব তিনি অনেক দিন আগেই পকেটে পুরে নিয়েছেন।

৮। প্রতিদ্বন্দ্বীদের প্রভাব সীমিত করা। নির্বাচিত পৌরসভাগুলিকে (হলদিয়া, হালিশহর, দাঁইহাট সহ অসংখ্য উদাহরণ আছে) গায়ের জোরে কেড়ে নেওয়া।

৯। বিচার প্রক্রিয়াকে পাত্তা না দেওয়া (নারদ নিয়েই দেখুন)। রাজ্য সরকার কোর্টে হলফনামা দিয়েছেন যে, নারদে ঘুষ নেওয়াকে তাঁরা অপরাধ বলেই মনে করছেন না।

১০। ফলাফল না ভেবে সহজ উপায়ে কঠিন সমস্যা সমাধানের চেষ্টা। আগেও উল্লেখ করেছি অসংখ্য উদাহরণের মধ্যে সেরা হল অতি সম্প্রতি স্বাস্থ্যসাথী কার্ড।

মনোরঞ্জনবাদী রাজনীতিবিদদের চরিত্র আন্তর্জাতিকস্তরে রাষ্ট্র বিজ্ঞানীরা যেভাবে বিশ্লেষণ করেছেন তার সাথে তৃণমূল কংগ্রেসের চরিত্রের হুবুহু মিল পাওয়া যায়। রাজনীতির এই ধারাকে সামনে রেখে সচেতন এবং সুপরিকল্পিতভাবে বিশেষজ্ঞদের (পিকে এবং আরো অনেকের) সাহায্য নিয়ে তিনি তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলেছেন। আপাতত সংখ্যাগরিষ্ঠ  মানুষ অবশ্যই খুশি। কিন্তু ভবিষ্যতে এর মূল্য দিতে গিয়ে আমরা শেষ হয়ে যাব। আমাদের সর্বনাশ নিশ্চিত। বিশ্বাস না হলে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে লোকরঞ্জনবাদী রাজনীতির গতিপ্রকৃতির দিকে নজর রাখুন।

আমি তৃনমূল কংগ্রেস ও বিজেপি-র বিরুদ্ধে।

যাঁরা শ্রেণী সংগ্রামের কথা বলেন, তাঁদের আরো‌ গভীরভাবে ভাবনা-চিন্তা করে নতুন পথ খুঁজতে হবে।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন