হিমাচল প্রদেশে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন। ওডিশাতে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। বিহারে সিপিআই(এম) বিধায়ক তিনজন।
আসামে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন। তামিলনাড়ুতে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। রাজস্থানে সিপিআই(এম) বিধায়ক দুজন। মহারাষ্ট্রে সিপিআই(এম) বিধায়ক একজন।
কেরালায় সিপিআই(এম) বিধায়ক ৬২জন। ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) বিধায়ক ১৬জন।
বাংলায় সিপিআই(এম) বিধায়ক একজনও নেই, শূণ্য।
বাংলায় বিধানসভা নির্বাচনে কমিউনিস্টদের, বামপন্থীদের শোচনীয় পরাজয় নিয়ে নিশ্চিত ভাবেই চুলচেরা বিশ্লেষণ চলবে, তর্ক বিতর্ক চলবে। আগামী দিনের পথ চলার ক্ষেত্রে তা জরুরি, তা আবশ্যক।
কেন 'শূণ্য'? এই কারণের উত্তরের সন্ধান হতে হবে 'ডায়লেক্টিকাল', 'কমন সেন্স' নির্ভর নয়।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর থেকে বামপন্থী কর্মী সমর্থক এমনকি নেতৃত্বের মধ্যেও উঠে এসেছে খানিক যেন 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর। বিগত কয়েকটি নির্বাচনের হারের পর একই ভাবে 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর খোঁজার চেষ্টা চোখে পড়েছে।
যেমন, 'আমরা জনগনকে বোঝাতে পারিনি'। যেমন 'শাসকশ্রেণি বিজেপি ও তৃণমূলের মধ্যে যে বাইনারি তৈরি করেছে তা ভাঙা যায়নি'। যেমন 'আমাদের মানুষ শক্তিশালী নির্ভরযোগ্য বিকল্প হিসাবে গ্রহণযোগ্য মনে করেননি', 'বিভাজনের রাজনীতির আবহে, পোলারাইজেশনের আবহে রুটিরুজির স্লোগান মিলিয়ে গিয়েছে', ইত্যদি ইত্যাদি।
এই 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর সন্ধানের মধ্যে কিছু চটজলদি প্রত্যক্ষ সমাধানের নিদানও আছে। যেমন, 'আমাদের কথা পৌঁছতে পারেনি মানুষের কাছে, আমাদের ডেটা অ্যানালাইসিস দুর্বল', 'সমাজের বিভিন্ন অংশের মানুষকে টার্গেট করে আমাদের কথা পৌঁছতে পারিনি', 'কমরেড ওরা আমাদের কথা বলবে না, আমাদের আগে একটা টিভি চ্যানেল চাই', ইত্যাদি ইত্যাদি। এই প্রবণতাগুলিকে এক কথায় চিহ্নিত করা যায় 'প্রশান্ত কিশোর সিনড্রোম' হিসাবে।
এই 'কমন সেন্স' ভিত্তিক উত্তর বার বার বলা মানে হয় যেন আমাদের সব ঠিকই ছিল শুধু ডেটা অ্যানালাইসিস ঠিক না হওয়ার জন্যই যেন বিপর্যয়! বা আমাদের সব ঠিকই ছিল শুধু একটা টিভি চ্যানেল না থাকায় মানুষ জানতে না পারায় আমাদের কথায় তাই এই বিপর্যয়!
ঠান্ডা মাথায় প্রথমে যেটা মানতে হবে, 'পিপলস রিজেকশন'। জনগণের প্রত্যাখান। যতক্ষণ না এই 'প্রত্যাখান' আমরা স্বীকার করতে না পারবো ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সব সমাধানের উত্তর খোঁজাই হবে 'কমন সেন্স' নির্ভর।
যা সর্বাগ্রে প্রয়োজন 'কমন সেন্স' নির্ভর বিশ্লেষণ ও সমাধানের রাস্তায় না হেঁটে 'ডায়লেক্টিকাল সেন্স'এ উত্তর খোঁজার চেষ্টা, দ্বান্দিক পদ্ধতিতে ভাবনা।
বিজেপি-তৃণমলের বিভাজনের রাজনীতির কথা আমরা বলেছি। বার বার।
এরাজ্যে মেরুকরণের রাজনীতির কথা আমরা বলেছি। বার বার।
ধর্মকে ব্যবহার করে বিভাজনের রাজনীতির কথা আমরা মানুষকে বলেছি । বার বার।
প্রশ্ন হল এই বিভাজনের রাজনীতিকে হারানোর জন্য, এই পোলারাইজেশনকে হারানোর জন্য, এই বাইনারিকে ভাঙার জন্য আমাদের পদক্ষেপ কি ছিল? কি কি আমরা করেছি?
'বিভাজনের রাজনীতি'কে কিভাবে ভাঙতে হয় কিভাবে 'মেরুকরণ'কে ভেঙে এগোতে হয় সারা দেশকে শিখিয়েছে এই বাংলাই।
১৯৪৬'র ভয়াবহ দাঙ্গা, ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ নির্মিত মেরুকরণ, বিভাজনের রাজনীতিকে ভেঙে দিয়েছিল তেভাগার আন্দোলন। ১৯৪৬'র আগস্ট'এ কলকাতা জুড়ে দাঙ্গা। রাস্তায় রাস্তায় লাশ। ধর্মের নামে নারকীয় গণহত্যা। আর ঠিক পাঁচ মাস মাত্র পরেই গ্রাম গ্রামে জ্বলে উঠলো তেভাগার অনির্বাণ আগুণ। দুই বাংলা জুড়েই সশস্ত্র কৃষকরা।
১৯৮৬ সালে এআইকেএস থেকে প্রকাশিত আবদুল্লা রসুলের 'তেভাগা স্ট্রাগল অফ বেঙ্গল'এ রসুল সাহেব লিখছেন, 'ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের ঘৃণ্য মেরুকরণ, বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে মাত্র কয়েকমাসের মধ্যেই তেভাগা আন্দোলন ছিল শক্তিশালী প্রত্যাঘাত। হিন্দু মুসলমান ধর্মের পরিচয় ভুলে কৃষকের পরিচয়ে তেভাগায় ঝাঁপিয়ে পড়েছে'।
১৯৪৬'র দাঙ্গা, সেই সময়ের বিভাজন, মেরুকরণকেও থামিয়ে দিতে পেরেছিল দুর্ধর্ষ কৃষক আন্দোলন। সেই সময়ের কমিউনিস্ট পার্টি বিভাজন ঠেকাতে হাতিয়ার করেছিল 'বেসিক ক্লাশ'কেই, মৌল শ্রেণিকেই।
আজকের মেরুকরণ, আজকের বিভাজন, আজকের পোলারাইজেশনকে রুখে দেওয়া গেল না কি 'বেসিক ক্লাশ'র আন্দোলনের অভাবে? শ্রমিক কৃষক খেতমজুর, গ্রামীণ সর্বহারা যাঁরা জনসংখ্যার শতকরা আশি ভাগ তাঁদের নিয়ে দুর্বার শ্রেণি আন্দোলন গড়ে তোলা গেল না কেন?
অন্য সব রাজনৈতিক দল বা রাজনৈতিক জোট বা রাজনৈতিক সমীকরণের থেকে কমিউনিস্ট পার্টিকে আলাদা করে চেনা যায় একটিই কারণে, কমিউনিস্ট পার্টি যে কাজই করুক না কেন তার মধ্যে একটিই ভাবনা থাকে পুঁজিবাদকে কিভাবে হারানো যায়, পুঁজিবাদ থেকে সমাজতন্ত্রে উত্তোরণের পদ্ধতিতে। জর্জ লুকাচ বলেছেন 'অ্যাকচুয়ালিটি অফ রেভোলিউশন', আমি যাই করি না কেন তা হবে 'বিপ্লবের বাস্তবতা'র সঙ্গে সম্পৃক্ত। এখানে 'অ্যাকচুয়ালিটি অফ রেভোলিউশন' মানে এমনও নয়, যে বিপ্লব আসন্ন।
যদি সাময়িক সঙ্কটের জন্যও এক্ষুনি ও এখনকার জন্য কিছু ব্যবস্থা নেওয়াও হয়ে থাকে তার মধ্যে থাকতে হবে পুঁজিবাদকে উত্তরোণের রসদ, আর পুঁজিবাদকে খতম করার লক্ষ্য বাদ দিয়ে যা কিছুই ব্যবস্থা নেওয়া হোক না কেন তা হবে চটজলদি প্রত্যক্ষ সমাধানবাদ।
কমিউনিস্ট পার্টিতে চটজলদি প্রত্যাক্ষ সমাধানবাদের প্রবণতা বাড়তে থাকলে পার্টির সঙ্গে মৌল শ্রেণির বিচ্ছিন্নতা বাড়তে থাকে, ফলত 'পার্টি স্বার্থ' বড় হয়ে যায় বেসিক ক্লাশের 'শ্রেণি স্বার্থ'র থেকে।
নির্বাচনে কিছু আসন দরকার, লোকসভায় প্রতিনিধি দরকার, বিধানসভায় কিছু বিধায়ক দরকার, এই ধরণের 'পার্টি স্বার্থ' রক্ষার জন্য চটজলদি সমাধান কিছু নেওয়া হলে সেখানে থাকে না 'বেসিক ক্লাশ'র শ্রেণি স্বার্থ। চটজলদি সমাধানবাদকে এখনই যদি রোখা না যায় তাহলে 'পার্টি স্বার্থ' রক্ষা করতে গিয়ে আগামীতে পার্টি যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করে সেই শ্রেণির স্বার্থ ক্রমশ মিলিয়ে যেতে থাকে। চটজলদি সমাধানবাদ কমিউনিস্ট পার্টিকে তখন অন্য চার পাঁচটা রাজনৈতিক দলের থেকে আলাদা করতে পারে না জনগণের কাছে।
কোন পথে ঘুরে দাঁড়াবে কমিউনিস্ট পার্টি? এই নিয়েও চর্চা চলবে, তর্ক বিতর্ক চলবে। কিছু ওপিনিয়ান পেজ লেখক মূলত কয়েকটি সমাধান হাজির করেন বামপন্থীদের ভালো চেয়ে! যেমন কমিউনিস্ট পার্টি সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটিক পার্টি হয়ে উঠুক তারা সাম্রাজ্যবাদের 'পুরোন বস্তাপচা ধারণা'কে ছেড়ে দিক।
আবার কেউ কেউ বলেন কমিউনিস্ট পার্টির ভালোর জন্যই এই ধরনের 'সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক' টাইপ স্লোগান ছেড়ে সব অংশের কাছে অ্যাপিলিং হয়ে উঠতে পারে। যাঁ তাঁরা বলেন না কমিউনিস্ট পার্টি যাঁদের স্বার্থ রক্ষা করে 'বেসিক ক্লাশ', শ্রমিক কৃষক ক্ষেতমজুর যাঁরা জনসংখ্যার আশি শতাংশ, যাঁরা নয়া উদারবাদী আক্রমনের প্রতিনিয়ত শিকার, যে নয়া উদারবাদের নিয়ন্ত্রক আন্তর্জাতিক ফিনান্স পুঁজি যা আজকের সমসাময়িক সাম্রাজ্যবাদের মূল আকর।
আজকের এই কঠিন পরিস্থিতি থেকে উত্তরোণের জন্য শুধু রাস্তায় থাকতে হবে বা রাস্তাই একমাত্র রাস্তা বলার থেকেও জরুরি কোন রাস্তায় থাকবো? কোনটা ঠিক রাস্তা? সঠিক রাস্তার সন্ধান না পেলে একই রাস্তায় বার বার ঘুরে ঘুরে থাকার বিভ্রান্তি আরও চটজলদি সমাধানবাদ হাজির করতে পারে।
ইতিহাস দেখিয়েছে বারে বারে কমিউনস্টদের হারানো গণভিত্তি ফিরে পেতে এলে চটজলদি সমাধানবাদ কাজে লাগে না, একটাই সমাধান তখন ফিরে যাও 'বেসিক ক্লাশ'র কাছে। মৌল শ্রেণির কাছে ফিরে যাও।
এইরকম সঙ্কটের সময়ে পার্টি নেতৃত্বের ভূমিকা হবে সব থেকে কার্যকরি। লেনিন বার বার জোর দিয়েছোন 'ক্লাশ লিডারশিপ'র কথা, সঙ্কট থেকে মুক্তি পেতে হলে পার্টি কমিটি ভরিয়ে দাও 'বেসিক ক্লাশ' কে নিয়ে এসে, কমিটি ভরিয়ে দাও মজুর, কৃষক, খেতমজুরদের দিয়ে।
১৯২২ সালে রুশ পার্টির পার্টি কংগ্রেসে চিঠি লিখে লেনিন প্রস্তাব দিয়েছেন 'কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যের সংখ্যা বাড়াতে হবে। আমার মনে হয় পার্টির অধিকার আছে দাবি করার যে সিসি'তে ওয়ার্কিং ক্লাশের প্রতিনিধি ৫০ থেকে বাড়িয়ে ১০০জন করতে হবে। এই ধরণের ব্যবস্থা পার্টিকে আরও সুসংহত করতে কবে লড়াইতে। পার্টি নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণির প্রতিনিধি বাড়ালে পার্টি হাজারগুণ বেশি সুসংহত হবে'।
বারে বারেই শিখিয়ে যান ভ্লাদিমির।
অনেক সুন্দর লিখেছেন আপনাকে অনেক ধন্যবাদ
উত্তরমুছুন