মঙ্গলবার, ১১ মে, ২০২১

রেড ভলান্টিয়ার্স ~ ডঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

১৯৪২ সালে ঘূর্ণিঝড়ে বিধস্ত মানুষদের ত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে খাদ্য, বস্ত্র, ওষুধ পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে পার্টির ডাকে গড়ে ওঠে পিপলস্‌ সাইক্লোন রিলিফ কমিটি। ১৯৪৩ সালের বন্যা ও দুর্ভিক্ষে ত্রাণ দেওয়ার লক্ষ্যে পার্টির ডাকে আবার গড়ে ওঠে "পিপলস ফ্লাড রিলিফ কমিটি"। প্রথম কমিটিতে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুক্ত হন কৃষকসভা,শ্রমিক সংগঠণ, ছাত্র -শিক্ষকরা, দ্বিতীয়টিতে যুক্ত হন মেডিক্যাল ছাত্ররা। 

১৯৪৫ সালের ১লা মে থেকে পি আর সি দপ্তরের বহির্বিভাগে প্রথমে বিনামূল্যে রোগী দেখা শুরু হলো। পরে ২আনা করে ফি ধার্য হয়। বহু স্বনামধন্য চিকিৎসকরা এই অভিযানে এগিয়ে আসেন। ওই বছরই শুরু হয় অ্যাম্বুল্যান্স বাহিনী। ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে দাঙ্গার কারণে বহু মানুষ ঘরছাড়া হলে তাঁদের পুনর্বাসন দেওয়ার কাজও শুরু হয় পি আর সি-র উদ্যোগে। 

এর পরে বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় সীমান্ত এলাকায় পিআরসি এর উদ্যোগ্যে স্বাস্থ্যশিবির খোলা হয় শরণার্থীদের জন্য। পার্টির ডাকে বহু চিকিৎসক যোগ দেন। দুটি উল্লেখযোগ্য নাম সূর্যকান্ত মিশ্র ও লক্ষ্মী সায়গল।

সারা পৃথিবীর সমস্ত কমিউনিস্ট পার্টি নিজ নিজ দেশে নিজস্ব ঢঙ্গে পথ চলার সময় প্রেরণার উৎস হিসেবে ১৮৭১ সালে পৃথিবীর প্রথম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র, শিশু রাষ্ট্র পারি কমিউনকে স্মরণ করে এসেছে। এই কমিউনকে  প্রতিবিপ্লবী আক্রমণকারী বুর্জোয়াদের (যাদের ঘাঁটি ছিল ভার্সাই) আক্রমণ থেকে বাঁচাতে প্যারিসের অলিগলিতে, পাড়ায় মহল্লায় গড়ে উঠেছিল জনগণের সশস্ত্র বাহিনী। নারী কমুনার্ডরা প্রথমদিকে আহতদের সেবা, এম্বুলেন্স সার্ভিস, কমিউনিটি ক্যান্টিন চালানো এই সব কাজে নিযুক্ত থাকেন,গড়ে ওঠে Union des Femmes pour la Defense de Paris et les Soins aux Blesses (দি ইউনিয়ন অফ উইমেন ফর দ্যা ডিফেন্স অফ প্যারিস এন্ড এইড টু দ্যা উন্ডেড)। 

সেই সময় থেকে পিপলস রিফিল কম্যুনিস্টদের কাছে একটা রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে গণ্য। আর পাঁচটি এনজিও বা এফবিও এর সাথে এই রাজনৈতিক কর্মসূচির তফাৎ কোথায় সেটা বুঝতে গেলে ১৯৪৩ সালের অবিভক্ত কমিউনিস্ট পার্টির একটি পার্টি চিঠির অংশ উদ্ধৃত করা হল। শিরোনাম ছিল - - - "মহামারীর হাত হইতে বাংলাকে বাঁচাও/মেডিক্যাল স্কোয়াড গঠন কর" (বানান অপরিবর্তিত) 

(১) সহরে সহরে সভা ও শোভাযাত্রা করিয়া জনগনের মধ্যে মহামারীর বিরুদ্ধে দাঁড়াইবার বানী প্রচার কর। গভর্নমেন্ট যাহাতে আরও ঔষধ পত্রের ও চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করে তাহার দাবী জানাও এবং গভর্নমেন্ট ও মিলিটারী যেখানে সাহায্য দান করিতেছে তাহার সঙ্গে সহযোগিতা করিবার জন্য জনগনকে উদ্বুদ্ধ কর।
আমলাতন্ত্রের অব্যবস্থাই প্রধানত: দুর্ভিক্ষ ও মহামারী সৃষ্টি করিয়াছে। সেই মহামারী রোধ করিবার জন্য আমলাতন্ত্রই আজ আবার কাজ করিতে বাধ্য হইতেছে। ইহা আমলাতন্ত্রের পরাজয়ের নিদর্শন। সেই জন্য সেই কাজে সহযোগিতা করিলে আমলাতন্ত্রকে সাহায্য করা হয় না। ইহাতে আমলাতন্ত্রের পরাজয়কেই সাহায্য করা হয় এবং জনগনও রক্ষা পায়। 
(২) সমস্ত শ্রেণীর, সমস্ত দলের লোকের নিকট এই কাজে সাহায্যের জন্য আবেদন জানাও।
(এখানে কংগ্রেস, লীগ এবং হিন্দু মহাসভার নেতা, কর্মীদের কী আহ্বান জানাতে হবে, তার বিবরণ ছিল। উল্লেখ করলাম না। বড় হয়ে যাবে বলে।)
আমাদের প্রধান শ্লোগান হইবে মহামারীর হাত হইতে জনগনকে রক্ষা করিবার জন্য সকল দলের ঐক্য চাই। 
(৩) ঔষধের চোরাকারবারীদের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি কর।
(৪) ডাক্তার ও মেডিক্যাল ছাত্রদের মহামারীর বিরুদ্ধে উদ্বুদ্ধ কর।

"মেডিক্যাল স্কোয়াড গঠন কর"
------------------------------------------------
(১) স্থানীয় এক এক জন ডাক্তারকে রাজী করাইতে হইবে যিনি স্কোয়াডের নেতা হইবেন। পার্টির আর তিন চার জন স্বাস্থ্যবান কর্মীকে শিক্ষা দেওয়া হইবে।
(২) স্কোয়াডগুলি পার্টি কর্মীদের চিকিৎসার কাজ প্রথম আরম্ভ করিবে। মনে রাখা দরকার যে, পার্টি কর্মীরাই যদি রোগে ভুগতে থাকে কিংবা মারা যায়, তাহা হইলে মহামারীর বিরুদ্ধে কোন লড়াই হইবে না, বরঞ্চ মহামারীই পার্টিকে গ্রাস করিবে।
(৩) এই সব স্কোয়াডের কর্মীদের অত্যন্ত সংযত ও শৃঙ্খলাবদ্ধ জীবন যাপন করিতে হইবে। স্কোয়াডগুলি রিলিফ কমিটির কাজ করিবে বটে, কিন্তু সবাই বুঝিতে পারিবে যে, এগুলি কম্যুনিস্ট পার্টির স্কোয়াড।

"হুঁশিয়ার! এ-সব কাজ করিও না।"
-------------------------------------------------
(১)অনর্থক রাজনৈতিক বাগ বিতন্ডা সৃষ্টি করিও না।.... আবার স্কোয়াডগুলি যে রাজনৈতিক আলোচনা করিবে না---তাহাও নয়। স্থান, কাল পাত্র বুঝিয়া রাজনৈতিক আলোচনা করিতে হইবে।
(২) কাজে, কর্মে, আলাপে পার্টিগত সংকীর্ণতার পরিচয় দিও না কিংবা পার্টি লইয়া বড়াই করিও না।
(৩) আড্ডা দিয়া সময় নষ্ট করিও না।
(৪)স্থানীয় পার্টি ইউনিটের উপর মাতববরি করিও না।

ভারতের কম্যুনিস্ট পার্টি এই পিপলস রিলিফ কাজের একটি বিরাট ঐতিহ্যবাহী লিগ্যাসি পরম্পরা বহন করে। ১৯৪৩ এর কমিটির স্বেচ্ছাসেবক থেকে আজকের রেড ভলান্টিয়ার - সবাই জনগণের পাশে তাদের সীমিত ক্ষমতা নিয়ে দাঁড়ান ত্রানকাজে এটা জেনেই যে তাদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষমতা অপ্রতুল। তবুও জনগণের বিপদের সময় ঘরে বসে  বিবৃতি না দিয়ে (সেই সময় ফেসবুক ছিল না) তারা জীবন তুচ্ছ করে রাস্তায় নেমেছিলেন এটাই বোঝাতে যে ভূস্বামী-পুঁজিপতিদের পরিচালিত সরকার ও তার আমলাতন্ত্র মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বারবার ব্যর্থ। কারণ তাদের শ্রেণী চরিত্রই এই ব্যর্থতার মূলে। 

তাই আজ ২০২১ সালে অক্সিজেন এর কালোবাজারি হয় দেশ জুড়ে, যার পয়সার জোর আছে সে কিছুটা সেবা কিনতে পায়, যার নেই সে পথে বসে মরে। শত বিজ্ঞানীর সাধনার ফল ভ্যাকসিন শেষ পর্যন্ত মুনাফা কামানোর একটি হাতিয়ার মাত্রে পরিণত হয়। এই সবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার জন্যই রাস্তায় নামা রেড ভলান্টিয়ারদের। পাঁচ বছর বাদে ভোটের সময় কে এই সেবা কাজের কথা মনে রেখে কাস্তে-হাতুড়িতে বোতাম টিপবে সে জন্য "জীবন মৃত্যু পায়ের ভৃত্য" মনোভাব নিয়ে রেড ভলান্টিয়াররা রাস্তায় নামছে না। বামপন্থায় আস্থা রাখা প্রতিটি মানুষের কাছে আবেদন এদের উৎসাহ দিন - এরা আমার আপনার ঘরের ছেলেমেয়ে। এরা পারি কমিউন এর সেই অসীম সাহসী কমুনার্ডদের উত্তরাধিকারী। এদের সবাইকে লাল সেলাম।

[পার্টি চিঠির জন্য কৃতজ্ঞতা: কমরেড ডা: Avijit Dasgupta  ও।সাংবাদিক চন্দন দাস]

#RedVolunteers 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন