ওদের দলটা সেদিন রাতের মতন বিশাল স্তেপভূমির এক কোনে আস্তানা গেড়েছিলো। এখন যেখানে কাজাকস্তানের বেরেল শহর, সেই সময় সেখানে ছিলো এক বিশাল হৃদ আর ধুধু ঘাসজমির প্রান্তর। বেশ কয়েকদিন ধরে এই অঞ্চলটাতেই ঘুরছিলো ওদের গোটা দলটা। এখানে শিকার করবার সুযোগ প্রচুর, হৃদে মাছ ধরা যায়, আর তার সাথে সাথে এদিক ওদিকে মাটির ওপর একধরনের খাটো গাছে একধরনের ফল হয়, যা দিয়ে খিদে মেটে।
ওদের দলের একটাই সমস্যা, এই জায়গাটায় একটা বিশাল খড়্গ-দন্ত বাঘের উৎপাত। ইতিমধ্যেই দুজন তার পেটে গেছে। দিনের আলোতে ওরা খাবার আর শিকারের সন্ধানে দলবদ্ধ হয়ে থাকে, ওদের নিজেদের তৈরি অস্ত্রও সাথে থাকে, কিন্তু অন্ধকার নামতেই ওদের ভয় শুরু হয়। অন্ধকার ওদের শত্রু, আর বাঘের বন্ধু। কখন যে একদম ঘাড়ের ওপর থাবা এসে আছড়ে পড়বে, বোঝা যাবে না, হয়তো অন্তিম মুহুর্তে এক ফালি চাঁদের আলোয় শুধু ঝলসে উঠবে সাদা দুটো দাঁত। আর তাই, সূর্য ডুবলেই একটুকরো আগুনের পাশে জড়সড়ো হয়ে বসে ওরা ঝিমোতে থাকে, আগুনের শিখা যেটুকু জায়গায় আলো দিচ্ছে, সেই সীমানার বাইরেই বিশাল অন্ধকার যেন ওত পেতে থাকে ওদের গ্রাস করতে। আগুনের নাচানাচির সাথে সাথে আগুপিছু করতে থাকে অন্ধকার নামের ভয়ানক দানবটা, যেন ওদের সাথে খেলা করে, আর মাঝেমধ্যেই সেই জমাট কালোর মধ্যে থেকে ভেসে ভেসে আসে বাঘের ডাক। ওদের মধ্যে সবচেয়ে বুড়ো যে, তার চারপাশে তখন জোনাকির মতন ঘুরঘুর করে অনেক গল্প, সে তখন গল্প বলতে চায়, বলতে চায় কিভাবে বহুদিন আগে, যখন ওদের দলটা আরো উত্তর দিকে বরফঢাকা উপত্যকার মধ্যে বিচরণ করতো, সেইসময় ওদের দলের সবচেয়ে শক্তিশালী দুজন মিলে অনেকগুলো গাছের গুড়ির মাথা ঘষে ঘষে ছুচলোঁ বল্লম বানিয়েছিলো, আর তাই দিয়ে একসাথে একটি খড়্গ-দন্ত বাঘকে মেরেছিলো। বুড়োটা ভাবে, এই গল্পটা বলতে পারলেই অন্ধকার ওদের দিকে এগিয়ে আসতে ভয় পাবে। বুড়োটা চায়, সারারাত এরকম অনেক অনেক গল্প বলতে, যাতে কালো ভয়টা দুরেই থাকে। কিন্তু পারে না। কারন ওদের তো ভাষা নেই। শব্দ নেই। ওদের কারুর নামও নেই। বুড়োটা চেষ্টা করে অঙ্গভঙ্গি করে গল্প বলতে, কিন্তু সবাই বোঝে না। এরকম ভাবেই রোজ চেষ্টা করতে করতে কয়েকদিন পর বুড়ো এক নতুন কায়দা আবিষ্কার করে। আগুনের পাশে যেখানে মাটির ওপর আলো পড়েছে, সেখানে আঙুল দিয়ে সে প্রথমে একটা বাঘ আঁকে। সময় নিয়ে তার দাঁতগুলো বড় বড় করে আঁকে। তারপর আঁকে শক্তিশালী দুই মানুষকে। বাকিরা অবাক হয়ে বুড়োকে ঘিরে বসে আঁকা দেখে। মানুষগুলোর হাতে বল্লম আঁকে বুড়ো। শিখার আলো ছবিটার ওপর লাফাতে লাফাতে তাকে জীবন্ত করে তোলে। ওদের সবার চোখ চকচক করে, আর ওদের চারপাশের ভয়মিশ্রিত অন্ধকারটা অনিচ্ছাসত্ত্বেও একটু পিছিয়ে যায়।
এরকমভাবে সারারাত ধরে একের পর এক গল্প আঁকে বুড়ো। কখনও কখনও বাকিরা ঝিমিয়ে পড়ে। কিন্তু বুড়ো এঁকেই চলে। একটা করে গল্প আঁকে, আবার মুছে ফেলে, আবার আঁকে। সারারাত ধরে গল্প আর অন্ধকারের মধ্যে চলে অবিরাম লড়াই। আর ওদের দলটা এরপর যেখানেই যায়, তাদের সাথে বস্তাবন্দি হয়ে সঙ্গী হিসেবে গল্পেরাও থাকে। তারপর কোন একদিন নদী পার হওয়ার সময় চোরাস্রোতে ভেসে যায় নামহীন বুড়োটা।
এরও বহুদিন পরে, যখন ওদের বংশধররা কয়েকটা শব্দ শিখেছে, হয়তো আদিম কিছু আওয়াজকে জীব দিয়ে খেলাতে শিখেছে, যখন ওদের দল সংখ্যায় বেড়েছে, তখনো অন্ধকার হলে ওরা আগুনের চারপাশে গোল হয়ে বসে, আর আবার শুরু হয় গল্প বনাম কালোর লড়াই। ভাঙা ভাঙা শব্দ দিয়ে, হাত পা ছুড়ে, কখনো মাটিতে কিছু অবয়ব এঁকে, কখনো শিকার করা জন্তুর চামড়ার ওপর খোদাই করে, ওরা পালা করে গল্প বলতে থাকে, আর কুস্তি চলতে থাকে অন্ধকারের সাথে। আর তার মধ্যে অতি অবশ্যই থাকে বুড়োর সেই বাঘের গল্প, যা সময়ের সাথে সাথে ফুলেফেঁপে আরো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, আর সেই গল্পটা বললেই অন্ধকার নামের রাক্ষসটা ভয়ে গুটিসুটি মেরে পিছিয়ে যেতে থাকে, আর সেই নিরেট কালোর পেট চিরে নিষ্ফল ক্রোধে গর্জন করতে থাকে ক্ষুদার্ত খড়্গ-দন্ত বাঘ।
হাজার হাজার বছর পরেও, বহু পথ পেরিয়ে এসে যখন ওদেরই কোন বংশধর মাটির ঘরে বাসা বাঁধে নদীর পারে, জঙ্গলের একদম সীমানায়, তখনো রাত হলে বাচ্চাকে জড়িয়ে ধরে সে, আর হাতমুঠো করে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে পাশে রাখা বল্লমকে, আর গাছের পাতা দিয়ে তৈরি পলকা দরজার দিকে মুখ করে বসে। ঘরের এক কোনে জ্বলতে থাকে পুঁচকে একটা আগুন। বাইরে শিকারের আশায় ঠোঁট চাটতে চাটতে পায়চারি শুরু করে ডোরাকাটা বাঘ। আর বাচ্চাটাকে বুকের কাছে এনে কানে কানে সে বলতে থাকে বুড়োর সেই বাঘের গল্প। গল্প আর অন্ধকারের অন্তহীন লড়াই আবার হয় শুরু।
লীলা মজুমদার বলেছিলেন, গল্প মোটে চার রকমের হয়।
ভূতের গল্প।
চোরের গল্প।
প্রেমের গল্প।
বাঘের গল্প।
আর এই চাররকমের গল্প বলতে আমাদের রয়েছে ছয় হাজারেরও বেশি ভাষা। ভাষা দিবসের কসম, আমরা যেন গল্প বলা না থামাই। আমরা যেন অন্ধকারকে জিততে না দিই।
গল্পটি খুবই চমৎকার
উত্তরমুছুন