তারপর সেই ভয়ানক দিন আসিয়া পড়িল। চন্দ্রবিন্দু কে তলব করা হইল 'আমার ভিনদেশী তারা' গানটি গাওয়ার অপরাধে। স্পষ্টতই ভিনদেশী বলিয়া কোনও শব্দ যে নাই এবং থাকিলেও তাকে আমার বলিয়া সম্বোধনের অপরাধ যে ক্ষমার অযোগ্য, তাহা বুঝাইয়া দিয়া হইল। চন্দ্রিল তাহার শেষ দু ছক্কা পাঁচ এ লিখিলেন, 'আমরা সক্কলে আ-মোদিত। সরকার চন্দ্রবিন্দু প্রাপ্ত হইয়াছে।' এতে চটিয়া গিয়া এক পাব্লিক চন্দ্রিলকে উদ্দেশ্য করিয়া একটি কড়া চিঠি লিখিল আনন্দবাজারে। তার শুরুটা হইল, 'আপনার মত আঁতেল যে ভিনদেশকে আমার বলিবেন এতে আর আশ্চর্য কী? আপনি এদেশের কলঙ্ক, কোনোদিনই বুঝা যায় নাই আপনি কোনদিকে, তাই আপনি দেশদ্রোহী হইতে বাধ্য। অতএব আপনার মা ও বোনকে...' ইত্যাদি ইত্যাদি
একইভাবে 'পরদেশী পরদেশী যানা নেহি' গানটির লিরিসিস্ট ও সুরকারের তলব পড়িল। তারা সমস্বরে বলিল, 'আমরা কিছু জানি না, আমির জানে'। ব্যাপার স্পষ্ট হইল। আমিরকে আগেও একবার চেতাবনি দিয়া হইয়াছিল, লাস্ট ওয়ার্নিং আর কি। ফলে এবার ঝটিতি 'শালা দেশ ছাড়, পাকিস্তান যা' বলিয়া দেশের লোক ট্যুইটারে লাফাইয়া পড়িল। আমির মুচকি হাসিয়া দেশ ছাড়িলেন- তবে পাকিস্তান নয়, আমেরিকা চলিয়া গেলেন। দু বছর পরে সেখেনে তারান্তিনোর পরবর্তী ছবিতে লিড রোল করিয়া অস্কার তুলিলেন। দেশের লোক ঝটিতি 'আমির আমাদের গর্ব' বলিয়া আবেগমথিত হইয়া কাঁদিয়া কাটিয়া ট্যুইটার ভাসাইয়া দিল। আমির মুচকি হাসিয়া শুধু বলিলেন, 'শালা'
তারপর তো আরেক কান্ড। সমস্ত 'কড়াপাক' মিষ্টি নিষিদ্ধ হইল। লোকে বলিল তাই তো, যে মিষ্টির নামেই 'কড়াপাক' সে ভারতীয় হয় কি করিয়া। বাঙালিরা গোপনে দীর্ঘশ্বাস ফেলিতে লাগিল, তবে মুখে বলিল 'হ্যাঁ, বটেই তো। কেমন ডায়াবিটিস বাধাইয়াছিলাম বাবা, খাইতেই চাইতাম না, তবু টানিত। এ মিষ্টি শত্তুর না হইয়া যায় না'। বাবা রামদেব সক্কলকে আশ্বস্ত করিয়া পতঞ্জলির 'কড়াদেশি মিষ্টি' আনিলেন মার্কেটে, খাইলে সুগার হয় না। একমাসে হু হু সেল-- বাবা আরেকটি আইল্যান্ড কিনিয়া তাতে প্রাচীন ভারতীয় 'কপালভাতি নাচ' করিতে লাগিলেন।
ক্রমে লোকে আয়ুর্বেদিক পদ্ধতিতে চুলকুনি, বাচ্চা উৎপাদন, আয়ুর্বেদিক বিড়ি পান হইতে ট্যাক্স প্রদান- সবই করিতে লাগিল। ট্যাক্সের টাকা গুলি পাব্লিকের দিকে ফিরিয়া মুচকি হাসিয়া বলিল, 'শালা'।
সারাদেশ জুড়িয়া ক্রমে প্রবল আলোড়ন উঠিল। পাব্লিক বাচ্চা পকেটমারকে ধরিয়া আর পিটাইলো না। ল্যাম্পপোস্টে শক্ত করিয়া বাঁধিয়া বন্দেমাতরম ধ্বনিতে আকাশ বাতাস মুখরিত করিয়া দিল। মেট্রোতে জিন্স পরা মেয়ে দেখিয়া জ্যেঠুদের লাল পড়িল না, গেরুয়া পড়িতে লাগিল। প্রসঙ্গত, লাল যে চৈনিক জিনিস এ কথা এখন সবাই জানেন। মোবাইল- টিভি- হেডফোন- সাউন্ড সিস্টেম- জাঙিয়া ঘড়ি জুতো বডি স্প্রে সাবান-- জাস্ট এইকটি ছাড়া দেশের মানুষ আর কোনও চৈনিক প্রোডাক্ট ব্যবহার করেন না। টোটাল অসহযোগ। অরিজিতের 'লাল ইশক' গানটিও ব্যান হইল। কমিউনিজম যে একটি ভয়ানক রোগ- অর্ণবের অনুষ্ঠানে আসিয়া সাধ্বী প্রাচী তা বলিয়া গেলেন। এর বিরুদ্ধে 'দেশভ্যাক- টি' নামের যে ভ্যাকসিনটি আবিষ্কৃত হইয়াছে তাহাও জানাইতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু অর্ণব 'নেশন ওয়ান্টস টু নো, নেশন ওয়ান্টস টু নো' বলিয়া চিৎকার করিয়া উঠিলে উহা আর শুনা গেল না। অর্ণবের বিভূষণ এক বছর পিছাইয়া গেল-- কারা যেন ইহাকে 'ঐতিহাসিক চিৎকার' বলিয়া চিহ্নিত করিল।
অতঃপর 'মা মা' ডাকে স্বর্গ-মর্ত্য-পার্লামেন্ট ভরিয়া উঠিল। ছেলে 'মা, মাগোও' বলিয়া ছলোছলো চক্ষে মাকে বৃদ্ধাশ্রমের গেটে ড্রপ করিয়া গেল। কড়া এক্সটারনাল আসিয়া ভাইভা টেবিলে যখন টুঁটি চাপিয়া ধরিয়াছে তখন ছাত্র চোখ টিপিয়া শুধু বলিল 'মায়ের দিব্যি, আমি সব পড়িয়াছি', সে হায়েস্ট নম্বর পাইয়া সবাইকে চমকাইয়া দিল। দুষ্টু ছেলে পুলিশকে 'মা, মা' বলিলে তারা ভারী খুশি হইয়া তাকে তিনশ বিরানব্বইয়ের চারের এ ধারা অনুসারে একটি গোলাপ ফুল গিফট করিল। পান্নালাল ভট্টাচার্যকে জাতীয় গায়ক এবং চিরঞ্জিত কে জাতীয় নায়কের সম্মান দেওয়া হইল। তৃণমূলের কে একজন নেতা বলিল, আমাদের ক্যাচলাইনে তিনখানা মা-- মা তেও মা, মাটিতেও মা, মানুষেও মা-- আমরা দেশের সবচেয়ে জাতীয়তাবাদী দল। উপরমহল থেকে 'অ্যাই চোওপ, একদম চোপ, আমরা সেকুলার' বলিয়া তাকে খুব কড়কাইয়া দেওয়া হইল আর ব্যাটা ইলেকশানে টিকিট মিস করিল। বেচারা ঘরে আসিয়া ডিকশনারিতে বহু খুঁজিল, কিন্তু সেকুলার শব্দটি খুঁজিয়া পাইল না।
এবং তলে তলে গুটিকত লোক দেশকে পঞ্চাশ- ষাট গ্রামের ছোট ছোট পিস করিয়া দাঁড়িপাল্লায় চাপাইয়া একশ চল্লিশ টাকা কেজিতে বেস্পতিবারের হাটে বিক্রি করিতে লাগিল। সে হাটে পাবলিক যেতে পারে না, খোঁজও নাই কারোর কাছে। সে হাটের খবর, বেচাকেনার খবর যারা রাখিত লোকে তাদের আঁতেল, সিপিয়েম, দেশদ্রোহী ইত্যাদি বলিয়া কিছু জনকে খুন করিয়াছে, কিছুজন কে ভাগাইয়া দিয়াছে দেশ থেকে। আর যারা বাঁচিয়া আছে তারা এমনিতেই চুপ করিয়া গিয়াছে। এমনি করিয়া বেশ কয় বচ্ছর কাটিল। তখন কারো কারো সন্দেহ হইল। আরে চাকরি নাই, খাবার নাই, টাকাকড়ি শান্তিফান্তি নাই শুধু মা ডাকিয়া আর জওয়ানের ছবি শেয়ার করিয়া দিন চলে কেমনে! কেস কী? খোঁজ, খোঁজ। অবশেষে খুঁজিয়া দেখে শুধু বাউন্ডারিখানা পড়িয়া আছে, দেশখানা আর নাই।
শুনা যায়, তখন অনেকে চিৎকার করিতে চাহিয়াছিল। কিন্তু ম্যাট্রিক্সের শুরুতে মিস্টার অ্যান্ডারসন তার হকের দাবী জানাইবার পর নিজের মুখটিকে যেভাবে খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন, তাহারাও নিজের মুখ সেইরকম চামড়া ও মাংস দিয়া আটকানো দেখিতে পাইয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, তখন আর কোথাও মরফিয়াস তার লাল এবং নীল পিল দুটি লইয়া অপেক্ষারত ছিলেন না।
বোবা শান্তিতে সেদিন চরাচর ভরিয়া গিয়াছিল...
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন