ব্রিটিশ ভারতে ছাত্রাবস্হা থেকেই দেশপ্রেমে অবিচল। এক বিকেলে একটা বাড়ী থেকে গ্রেফতার হয়ে গেল দুই স্কুল ছাত্র। পরের দিনের সকালের ধর্মঘটে তাদের রেলে নাশকতা চালানোর পরিকল্পনা ছিল, সেই উদ্দেশ্যেই উঠেছিল ওখানে। স্যার বললেন, গ্রেফতার হতাম না জানো, যে বাড়ীতে উঠেছিলাম, বন্ধুর বোন পাড়ায় গল্প করেছিল যে বাইরে থেকে দাদার বন্ধুরা এসেছে, ব্যস খবরটা পুলিসের কানে পৌঁছল। সেই ছাত্রই শংকর সেন। স্কুলশিক্ষা শেষে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া, অধ্যাপনায় ঢোকা। ইংল্যান্ডে বিশ্ববিখ্যাত এক অধ্যাপক এম জি সে এর কাছে পিএইচডি।
কলেজে চলছে বার্ষিক পরীক্ষা, তারই অংশ হিসাবেই প্রত্যেককে মৌখিক পরীক্ষা দিতে হচ্ছে। সেই সময়ে করিডোরে ডঃ শংকর সেন দেখলেন একটি ছাত্রকে। 'এই তোমার পরীক্ষা না? এখানে ঘুরছ কেন?' ছাত্রটি বলল, মৌখিক পরীক্ষা দিতে তার প্রথমেই ডাক পড়েছিল, যা প্রশ্ন করেছিল কিছু পারেনি, স্যার ঘর থেকে বার করে দিয়েছেন, বলেছে, একদম শেষে এসো, সবার শেষে তোমায় আবার ধরবো। ছাত্রটিকে বললেন, শিগগিরি তার ঘরে যেতে, ঘরে গিয়ে কী কী প্রশ্ন তাকে করা হয়েছিল শুনলেন, তারপর সেটাই ছাত্রটিকে দীর্ঘক্ষন ধরে বোঝালেন। সবার শেষে ছাত্রটির যখন আবার ডাক পড়লো, সেই একই প্রশ্নে ছাত্রটি সফল, প্রশ্নকর্তা অবাক।
শুধু পড়াশোনা না, যে কোনও ছাত্রকে যে কোনও সাহায্য করার জন্য সবসময় মুখিয়ে থাকতেন স্যার। 'ছাত্র' শব্দটাতেই এক অদ্ভুত দুর্বলতা। কখনো কোনও একটা প্রোগ্রামে হয়তো যেতে চাইছেন না, বকাবকি করছেন, একটা মোক্ষম অস্ত্র ছিল, 'ছাত্রকে আপনি সাহায্য করবেন না?' ব্যস কাত হয়ে যেতেন। তার মৃত্যুর দিনে তাই অগণিত ছাত্রদের ভীড়, সকলেই তার সরাসরি ছাত্র না, কিন্তু তাও প্রত্যেকেই এই সার্বজনীন শিক্ষকের ছাত্রই, কোনও না কোনও ভাবে তার কাছে চলার পথে সাহায্য পেয়েছে, জীবনের উপদেশ পেয়েছে। মেধাবী ছাত্র, গবেষক, অধ্যাপক, উপাচার্য, মন্ত্রী, সব কিছু ছাপিয়েই তার মূল পরিচয় তিনি অগণিত ছাত্রদের স্যার।
মন্ত্রিত্বের পর অবসর জীবনে এক বিখ্যাত তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি তাকে বলেছিল পাওয়ার প্লান্ট পরিচালনার ব্যাপারে একটা সফটওয়্যার বানাতে তাদের সাহায্য করতে। বিজ্ঞান-প্রযুক্তির প্রয়োগের ব্যাপার, সাথে সাথে রাজী হয়েছিলেন, তবে দুটি শর্তে। এক, যেদিন কোম্পানিতে যাবেন তাকে গাড়ী দিতে হবে, আর যতক্ষন থাকবেন, তাকে সামান্য কিছু খেতে দিতে হবে। না, কোনও কনসালটেন্সী ফি তিনি নেবেন না। কোম্পানিটি অবাক। অথচ, তার খুব স্বচ্ছল অবস্হা ছিল না। দীর্ঘদিন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে পড়ানো, তারপর কয়েকবছর যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য, পেনশন পাওয়ার সময়ে যে কোনও কারণেই হোক তার শিবপুর ও যাদবপুরের সার্ভিস পিরিয়ডের সংযোগ না হওয়ায় পেনশন যা পাওয়ার কথা তার থেকে বেশ কম পেতেন। তাই নিয়েই চালাতেন।
চিরকাল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ানো, তা নিয়ে বই লেখা, অথচ স্কুল শিক্ষা উন্নত করার জন্য বিশেষ ভাবিত ছিলেন। কখনো হয়তো কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডাক এসেছে তাকে সমাবর্তনে ভাষণ দেওয়ার জন্য, তিনি রাজী হননি, বলেছেন তিনি এখন স্কুলশিক্ষা নিয়ে বেশী চিন্তিত। সপ্তম বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভায় তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের স্কুলে স্লাইড সহযোগে পড়ানোর উদ্যোগে খুবই সক্রিয় হয়েছিলেন। মন্ত্রিত্বের পরেও বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভার কোনও কোনও দফতরকে সাহায্য করেছেন।
রাজ্য সরকারের তথ্যপ্রযুক্তি দফতরের কাজে একদিন তাকে গাড়ী পাঠানো হয়েছে। যাতায়াতের পথে সেই গাড়ী নিয়ে তিনি ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন। যেহেতু ব্যক্তিগত কাজে সরকারী গাড়ী ব্যবহার করছেন, তাই সরকারী দফতরে হিসেব করে তার জন্য টাকা পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সরকারী অফিসার তো হতবাক, মন্ত্রীকে ধরলেন, এই টাকা কিভাবে নেওয়া হবে? মন্ত্রী বললেন, নিতেই হবে, এই টাকা ফেরত নিতে তার স্যারকে বলার সাহস নেই। উপাচার্য থাকার সময়ও বিশ্ববিদ্যালয়ের গাড়ী নিয়ে বিয়েবাড়িতে গেলে গাড়ীর ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। কলকাতার একটি কেন্দ্রীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একটা কাজে দু-একবার যাওয়ার সময়ে, প্রতিষ্ঠানটি তাকে একটা বড়ো গাড়ী পাঠিয়ে দিত, তাতে তার কি সংকোচ!
পার্টির সদস্য ছিলেন না। কিন্তু শৃঙ্খলা পরায়ণায় ঘাটতি ছিল না। কত রথী-মহারথী তো পার্টির সাথে বিচ্ছিন্ন হওযার পর নানা কথা বলেছেন। তার সাথে কোনও না কোনও মতবিরোধেই তো তিনি বামফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ছেড়েছিলেন, কিন্তু একটা কথা তার মুখ দিয়ে কেউ বার করতে পারেনি। না, শত একান্ত আলোচনাতেও আমরা ছাত্ররাও এ ব্যাপারে কোনদিন কিছু জানতে পারিনি। জ্যোতি বসুর প্রতি ছিল অগাধ আস্হা, বিশ্বাস ও শ্রদ্ধা। মৃত্যুর আগে জ্যোতি বসু যখন দীর্ঘদিন হাসপাতালে ছিলেন, তখন হাসপাতালের চারপাশে বহু লোক রোজ জড়ো হতেন। স্যারও একদিন গিয়েছিলেন, বহু লোকের সাথে বাইরে দাড়িয়ে চলে এসেছিলেন।
মেয়েদের প্রতি দারুন সম্ভ্রম দেখিয়ে গেছেন চিরকাল। মন্ত্রী থাকাকালীনও তার সাথে দেখা করতে আসা ব্যক্তিদের সাথে কোনও মহিলা এলে সাথে সাথে উঠে দাড়াতেন। অবসর জীবনে নানা জায়গায় যেতেন। মানুষের সাথে কথা বলতেন। একবার কোনও এক জায়গায় খুব সাধারণ মহিলারা তাকে একটা প্রশ্ন করেন, মহিলা বিধবা হলে তার মাছ-মাংস খাওয়া বারণ, কিন্তু পুরুষ বিপত্নীক হলে তো সে সব খায়, এটা কেন চলবে? স্যারের তখন কয়েক বছর হল স্ত্রী মারা গেছেন, ট্রেনে ফিরতে ফিরতে তার মনে হল, এদেশের মেয়েদের ভীষন বঞ্চনা করা হচ্ছে, বাড়ী ফিরে মাছ-মাংস খাওয়া বন্ধ করে দিলেন।
জীবনে স্ত্রীর অবদানের কথা সোচ্চারে বলতেন। তাঁর ছাত্র বাৎসল্যকে মদত দিতে তাঁর স্ত্রীও ছিলেন একেবারে উদারহস্ত, আর অসহায় মানুষের প্রতি স্যারের মতোই আন্তরিক। স্যারের কাছেই গল্প শুনেছিলাম, একবার কোন একটা জায়গায় স্যারের সাথে গিয়ে মানুষের দারিদ্র্য দেখে কেঁদে ফেলেছিলেন। একবার একটা প্রোগ্রামে স্যারের যাওয়ার কথা হচ্ছিল, কিন্তু কিছুতেই কেন যেতে চাইছেন না বুঝতে পারছিলাম না। পরে বললেন, ঐদিন তাদের বিবাহবার্ষিকী, ওদিন তিনি একা থাকবেন, কোথাও যাবেন না, তাঁর স্ত্রী তখন ১০-১২ বছর মারা গেছেন।
স্যারের সম্বন্ধে বলতে গেলে নানা গল্প আর শেষ হবে না। গত কয়েক দশকে অনেক বুদ্ধিজীবি তো রাজ্যে দেখা গেল। কেন জানিনা, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির লোকদের কেউ বুদ্ধিজীবির পর্যায়ে ফেলে না। দেশপ্রেম, শিক্ষাঅনুরাগ, সমাজবোধ, সমাজ-সচেতনতা, মূল্যবোধ, প্রগতিশীল চিন্তা, মানুষের প্রতি দরদ, সব কিছুতেই স্যার একবাক্যে অনন্য। আজীবন প্রচারবিমুখ আদর্শের প্রতিমূর্তি মানুষটি নীরবেই চলে গেলেন।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন