বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ভারতীয় অর্থনীতিবিদ বা ইকনমিস্ট শুনলেই যে নামগুলো গড়গড় করে মাথায় আসে, তা হচ্ছে অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, মনমোহন সিং, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, কৌশিক বসু, প্রণব মুখার্জী, অসীম দাশগুপ্ত, অমিত মিত্র প্রমুখ। অথচ মৌলিক ধারণা ও ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাবে সমুজ্জ্বল এক রত্নের জন্মদিন আজ, অর্থনীতিবিদ হিসাবে তাঁর নাম শোনা যায় না বিশেষ। 

তিনি ভারতের সংবিধানের রূপকার – ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। 

১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল মহারাষ্ট্রের এক অন্ত্যজ (অস্পৃশ্য!) মাহার পরিবারের চোদ্দ নম্বর সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভীমরাও। পিতৃপুরুষেরা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীচুতলার সৈনিক। খুব অল্পবয়সে মাকে হারান তিনি, মানুষ হয়েছিলেন পিসির কাছে। চোদ্দজন ভাইবোনের মাত্র পাঁচজন যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন। স্কুলে যেতেন চটের ব্যাগ নিয়ে, তাতেই বসতে হত অন্যদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে। জলতেষ্টা পেলে স্কুলের (উচ্চবর্ণের) পিওন দূরত্ব বজায় রেখে জল ঢেলে দিত, সেই জল আঁজলা ভরে পান করতে হত। যেদিন পিওন স্কুলে আসত না, সেদিন জল পাওয়া যেত না। 

পরিবারের পদবি ছিল সকপাল, কিন্তু রত্নগিরির অম্বাদাবে গ্রাম থেকে এসেছিলেন বলে বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন অম্বাদাবেকর নামে। ভীমরাওয়ের পড়াশুনা ও আচরণে সন্তুষ্ট শিক্ষক উচ্চবর্ণীয় কৃষ্ণজি কেশব আম্বেদকর স্কুল রেজিস্টারে তাঁর পদবি পরিবর্তন করে আম্বেদকর করে দেন। 

ষোল বছর বয়সে বোম্বে ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি – মাহার কমিউনিটির মধ্যে প্রথম। তার আগের বছরেই তার বিয়ে হয়ে গেছে। ম্যাট্রিকের পাঁচ বছর পরে তিনি অর্থনীতি ও পলিটিক্যাল সায়েন্সে বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ পাশ করে বরোদা রাজ্যে চাকরি করতে যান। বরোদারাজ সয়াজিরাও গায়কোয়াড়ের আনুকূল্যে তাঁর কপালে মাসে সাড়ে এগারো পাউন্ডের স্টেট স্কলারশিপ জুটে যায় তিন বছরের জন্যে, উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি চেপে বসেন আমেরিকাগামী জাহাজে। নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্যে এই স্কলারশিপ। 

এই তিন বছরে আম্বেদকর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ২৯টা, ইতিহাসে ১১টা, সোশিওলজিতে ৬টা, দর্শনে ৫টা, নৃতত্ত্বে ৪টে, রাজনীতিতে ৩টে এবং ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ১টা করে কোর্স করেছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি এম এ ডিগ্রি লাভ করেন, তার দু-বছর পরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টরেট ডিগ্রি পান। অর্থনীতিতে তিনি ভারতের প্রথম ডক্টরেট এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ডবল-ডক্টরেট, একটা ডিগ্রি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, দ্বিতীয়টা লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি একটা এম এসসি ডিগ্রিও পেয়েছিলেন! তাঁর সময়ে তাঁর সমতুল্য ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ভারতে সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না। 

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবমিট করা তাঁর থিসিস ও পেপারগুলো প্রত্যেকটাই মৌলিক ধারণায় এক একটি আকরগ্রন্থ। এগুলোর শীর্ষক – 'Ancient Indian Commerce', 'Castes in India – their Mechanisms, Genesis and Development', 'National Dividend of India - A History and Analytical Study'. 

লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে তিনি এম এসসি পান 'Provincial Decentralization of Imperial finance in British India' শীর্ষক থিসিসের জন্য। ডি এস সি-র থিসিস শীর্ষক 'The Problem of the Rupee – Its Origin and Its Solution'. এর কাজ করার মাঝপথেই ১৯১৭ সালের জুন মাসে বরোদারাজ-প্রদত্ত স্কলারশিপ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে বাড়ি ফেরার জাহাজ ধরতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয় চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করে থিসিস জমা দিতে। আম্বেদকর আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে কেনা তাঁর সমস্ত বইপত্র আলাদা এক জাহাজে পাঠিয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজার তখন, সেই জাহাজ টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয় জার্মান সাবমেরিন। 

বরোদারাজের সঙ্গে চুক্তিমতো তাদের 'মিলিটারি সেক্রেটারি'-র চাকরি নিতে বাধ্য হন আম্বেদকর, যদিও ব্যাপারটা সুখকর ছিল না। বরোদায় পৌঁছানোর খরচা তাঁকেই বহন করতে হয়েছিল। জাহাজডুবির জন্যে থমাস কুক তাঁকে যে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল, তা চলে যায় এই খরচা মেটাতে। 

পরে প্রথম সুযোগেই তিনি লন্ডনে ফিরে গবেষণার কাজ শেষ করেন ও ডি এসসি ডিগ্রি পান। রয়্যাল কমিশন অন ইন্ডিয়ান কারেন্সি অ্যান্ড ফিনান্সে (হিল্টন ইয়াং কমিশন) জমা দেওয়া তাঁর থিসিসে তাঁর অনুমোদনসমূহ – যাতে তিনি মুদ্রাস্ফীতি ও ভারতীয় মুদ্রার ক্রমাগত পতন এড়াতে এর 'জেনারেল পার্চেজিং পাওয়ার' নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন – থেকে জন্ম নেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র ধারণা। 

সমস্ত ভারতবাসীর সমান অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, নারীর অধিকার ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে আম্বেদকরের চেয়ে বেশি সরব কেউ ছিলেন না। গান্ধীর প্রকাশ্য সমালোচনা করে তিনি বলেন, ইংরেজদের কাছে নিজেকে প্রোগ্রেসিভ প্রতিপন্ন করতে যে গান্ধী ইংরাজি ভাষায় দলিত হরিজনদের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচারের কথা বলেন, সেই একই গান্ধী গুজরাতি ভাষায় লেখা তাঁর প্রবন্ধগুলিতে বর্ণভেদের একনিষ্ঠ প্রচারক। ১৯৩০ সালে গান্ধীর প্রবল-প্রচারিত ডান্ডি মার্চের তিন বছর আগে আম্বেদকর মাহার অন্ত্যজদের নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন চাওদার তালাও থেকে বঞ্চিত তাদের জলপান করিয়ে। ভাইসরয় এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের উল্লেখযোগ্য সদস্য (লেবার মিনিস্টার) হিসাবে আম্বেদকরই কারখানার শ্রমিকদের দিনে বারো ঘন্টার বদলে আটঘন্টা কাজের এবং ডি এ, ছুটির অধিকার, বীমা, মেডিক্যাল লীভ, পে-স্কেল ইত্যাদি আধুনিক ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেন।

দেশের জল ও বিদ্যুৎ নীতি রূপায়ণে (দামোদর ভ্যালি, ভাকরা নাঙ্গাল, হিরাকুদ ইত্যাদি বাঁধ প্রকল্পে এবং সেন্ট্রাল টেকনিক্যাল পাওয়ার বোর্ড, সেন্ট্রাল ইলেকট্রিক্যাল অথরিটি স্থাপনে) তাঁর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের মত বড় রাজ্যকে ভাগ করে দেওয়ার কথা লিখে গেছিলেন তাঁর Thoughts on Linguistic States বইতে, যা রূপায়িত হতে লেগে গেল ৪০-৪৫ বছর। ১৯৫১ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় ফিনান্স কমিশনের। কাশ্মীর-সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা ৩৭০ এবং রিজার্ভেশন-সংক্রান্ত নীতির প্রবল বিরোধী ছিলেন আম্বেদকর। হিন্দু নারীর অধিকার প্রসঙ্গে তাঁর আনা বিল – যাতে ছিল বিবাহিতা নারীরা পিতার সম্পত্তির অধিকারিণী হবে, ডাইভোর্সে পুরুষ-নারীর সমান অধিকার থাকবে, বিধবা ও ডাইভোর্সিদের পুনর্বিবাহে অধিকার থাকবে, পলিগ্যামি বে-আইনি ঘোষিত হবে, ইত্যাদি – সংসদে গৃহীত না হলে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন।  

মাহার জাতের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর তাঁর সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেখানে কিশোর ভীমরাওকে দাদা কেলুস্কর নামে একজন লেখক বুদ্ধের জীবনীগ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন। আম্বেদকর সেই বই পড়ে প্রভাবিত হয়ে বুদ্ধের শরণ নিতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের বর্ণাশ্রম প্রথার উদ্ভব বিষয়ে তাঁর প্রচুর লেখালিখি, যাতে তিনি আর্য-অভিযান তত্ত্বকে নস্যাৎ করে শূদ্রজাতির উদ্ভব বিষয়ে তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

মধুমেহ রোগে হীনস্বাস্থ্য হয়ে ১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর মৃত্যু হয় এই স্পষ্টবাদী মনীষীর।  

১৪ই এপ্রিল ২০২১

বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২

"রেফার রোগ"~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

রেফার রোগ অর্থাৎ আননেসেসারি রেফারাল এর সর্বজনগ্রাহ্য কারণ খুঁজতে সিস্টেম এনালিসিস করে প্রথমেই যেটা মাথায় আসে তা হল - উপযুক্ত সংখ্যায় উপযুক্ত ডাক্তার ও অন্যান্য কর্মীর অভাব। সংখ্যার বিষয়টা পরে আসছি। আগে এই উপযুক্ত ডাক্তার শব্দটা নিয়ে নাড়াচাড়া করা যাক। বিশেষজ্ঞ ছেড়ে অ বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ ডাক্তারের কথা আগে, সরকারি পরিভাষায় যাদের নাম জেনারেল ডিউটি এম ও। ধরুন একটি ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাতে নিয়ম অনুযায়ী যত জন GDMO থাকার কথা তাই আছে। তাহলে কি অপ্রয়জনীয় রেফারাল আটকানো যাবে ? যাবে না। এক এক করে আসুন। 

নলেজ এর ঘাটতি। সাপের কামড় গত বারের পরীক্ষায় এসেছিল তাই এবারে সেটা না পড়েই পরীক্ষা দিতে যাওয়া ও এমবিবিএস পাশ করে যাওয়া সম্ভব। ফলে সেই ডাক্তার ডিউটিতে থাকলে সাপে কাটা রুগী রেফার হবেই। স্কিল এ ঘাটতি। এপিসিওটমি রিপেয়ার করতে জানে না, নরমাল ডেলিভারি নিজের হাতে কোনোদিন করায় নি এমন জিডিএমও দেখেছি। পোস্টিরিয়ার ন্যাজাল প্যাকিং দিতে পারে না, ছোট বাচ্চাদের ফ্লুইড চালাতে পারে না এমন ডাক্তারও দেখেছি। সেই ডাক্তার ডিউটিতে থাকলে ওই সব কেস রেফার হতে বাধ্য। দোষটা তার নয়, সিস্টেম এর দোষ। সিস্টেম তাকে সুযোগ দিয়েছে এই ভাবে বেড়ে ওঠার। 

এবারে আসুন নেক্সট পয়েন্টে। এক্সপেরিয়েন্স এ ঘাটতি। ডার্মাটোলজি এর ইন্টার্নশিপ এর সময় কোনো কুষ্ঠ রুগী দেখেনি। অগত্যা সাসপেক্ট কেস এলেই রেফার। একজন ডাক্তার কেস ডায়াগনসিস করতে পারছে না অভিজ্ঞতার ঘাটতির জন্য সে জীবনে জলাতঙ্ক রোগীই দেখেনি। কিন্তু তার সহকর্মী দেখেছে। তার সাথে কনসালটেশন এর কোনো চল নেই। জেলাস্তর থেকে তার নিচের হাসপাতালে কোনো ক্লিনিক্যাল মিটিং, ক্লিনিক্যাল অডিট এর চল নেই, প্যাথলজিক্যাল অটপসি এর ব্যবস্থা নেই। বেশ বোঝা যাচ্ছে যে স্রেফ উপযুক্ত সংখ্যায় ডাক্তার দিলেই রেফার আটকানো যাবে না। নলেজ, স্কিল, এক্সপেরিয়েন্স এর ঘাটতি মেটাতে মেডিক্যাল এডুকেশন, ট্রেনিং, পরীক্ষা পাস, পাস করার পরে continuing Medical Education বা CME - এই গোটা সিস্টেমটা নিয়েই ভাবতে হবে। জেলা স্তরে ক্লিনিক্যাল বিষয় যেমন ডেঙ্গু ম্যানেজমেন্ট, বা পয়জনিং এর ট্রেনিং এ ও দেখেছি ২০- ২৫% অনুপস্থিত থাকেন। অতএব মেকানিক্যালি CME কথাটা উচ্চারণ করলেই সমস্যা মিটবে না। সরকারি চাকরিতে ঢোকার পরে উপযুক্ত সময় ধরে সবার ইনডাকশন ট্রেনিং হোক, নিয়ম কানুনের পাশাপাশি এসেন্সিয়াল SOP গুলোও আলোচনা হবে। IAS দের ট্রেনি থাকতে হয় কত দিন ? 

এবার আসুন।  এটিচুড এর ঘাটতি। একই কেস একই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে একজন দেখে দিচ্ছে আর অন্য জন রেফার করছে। দুজনের যোগ্যতা একই এমনটাও দেখেছি। যে রেফার করছে তার দৃষ্টিভংগী কিঞ্চিৎ ভিন্ন। সে হয়তো ঝুঁকি নিতে চায় না, কেস কিছুটা খারাপ , মরে গেলে রুগীর বাড়ির লোকের হাতে মারধর, বা CPA ইত্যাদি। এই দৃষ্টিভঙ্গি কি ভাবে পাল্টানো যাবে সে মস্ত প্রশ্ন। গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রগুলিতে নিরাপত্তার নূন্যতম ব্যবস্থা না করে বা আধা শহরের মহকুমা / জেলা হাসপাতালগুলিতে প্রশিক্ষণ বিহীন নিরাপত্তা কর্মীদের দিয়ে নাম কা ওয়াস্তে ব্যবস্থা করে কি ভাবে ডাক্তার সহ অন্যান্য কর্মীদের মনে নিরাপত্তার ভাব জাগানো যায় সেটা মস্ত চ্যালেঞ্জ। 

ধরা যাক কোনো এক যাদু মন্ত্র বলে ওপরের বর্ণিত ওই ঘাটতি গুলি মেটানো গেল। এবারেও কি রেফার আটকানো যাবে ? ডাক্তার একদম ঠিকথাক, কিন্তু ধরুন যদি উপযুক্ত পরীক্ষা নিরীক্ষার সুবিধে না থাকে ? ছোট গ্রামীণ হাসপাতালের কথা ছেড়েই দিন। কটা জেলা হাসপাতালে ২৪ x ৭ এক্স রে ইসিজি, প্যাথলজি, বায়কেমিস্ট্রি এর ব্যবস্থা থাকে ?  হয় মেশিন নেই, অথবা টেকনিশিয়ান/ টেকনোলজিস্ট নেই অথবা রিয়েজেন্ট নেই, মেশিন আছে, কিন্তু সেটা বিকল। বিকল মেশিনকে তাড়াতাড়ি সচল করার কোনো ফুলপ্রুফ সিস্টেম এদ্দিন এও তৈরি করা গেল না। কেন গেল না ? উপযুক্ত সংখ্যায় ডাক্তার না পাওয়ার একটা যুক্তি আছে। কিন্তু প্যারামেডিকেল বা নার্সিং স্টাফ না পাওয়ার কি যুক্তি আছে। একটিবার খোঁজ করে দেখুন তো শেষ কবে MT lab বা MT opto রিক্রুটমেন্ট হয়েছে ? 

আর এই উপযুক্ত সংখ্যা কথাটাই তো ভীষন গোলমেলে। সরকার এর ম্যানপাওয়ার নর্ম হল ১৯৯১ সালের establishment table নামের একটি বস্তু। তার পরে গঙ্গা তিস্তা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেল, Indian Public health standards, quality assurance কত কি ম্যান পাওয়ার নর্ম এলো গেল কিন্তু সেই ৯১ এর টেবল এর কোনো রিফর্ম হল না। রিফর্ম বাদ দিন। ওই টেবিল অনুযায়ী কটা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে, মহকুমা হাসপাতালে কর্মী নিযুক্ত আছে ? সব ধরনের কর্মীর অপ্রতুলতা। এমন কি কেরানিদের ও। আপনি বলবেন রেফার আটকাতে কেরানীর কি ভূমিকা ? আরে বাবা, একটা চিঠি, ধরুন যন্ত্র খারাপ সেটা লিখতে বা ডাক্তারদের ছুটির হিসেব রাখতেও তো ডিলিং এসিস্ট্যান্ট লাগে। PsC বাদ দিয়ে নিজস্ব হেলথ রিক্রুটমেন্ট বোর্ড তৈরি হয়েছিল এসব এর জন্য। তারা করে টা কি ? ডোম এর পোস্ট ফাঁকা। তাদের জন্য একটা সঠিক TOR তৈরি করা গেল না ? PhD ক্যান্ডিডেট এপ্লাই করছে আর লোকে হাসছে।  

আর অভাবের সংসারে সবচেয়ে বেশি লাগে প্ল্যানিং। আমাদের ম্যানপাওয়ার প্ল্যানিং এর নমুনা ? রুগী মৃত্যুর পরে কাগজ পড়ে জানা গেল যে জেলা হাসপাতালে ছয় জন অর্থোপেডিক সার্জেন ছিল। আর এদিকে অন্য জেলা হাসপাতালে একজন মাত্র। এই posting কে করলো কিভাবে করলো, কেন তাকে শো কজ করা হবে না ? দোষ কেবল ক্লিনিশিয়ানদের ? সেই স্বাস্থ্য প্রশাসকদের নয় ?

সব শেষে আসুন রেফার এর সবচেয়ে বাজে কারণটাতে। ফাঁকিবাজি। আপনি যদি দিনের পর দিন দেখেন যে আপনার ফাঁকিবাজ সহকর্মী আর আর আপনি মাসের শেষে একই মাইনে পান, বছর শেষে একই ইনক্রিমেন্ট তাহলে আপনিই বা "বোকা" এর মতো খাটতে যাবেন কেন। পারফরমেন্স বেসড ইনসেনটিভ বলে কিছু নেই। না মানিটারি, না নন-মানিটারি। এর উল্টো দিকে শাস্তি ? দূরে বদলির ভয় ? অর্ধেক তো চাকরিই ছেড়ে দেয়। আর বদলি হতে হবে জেনে শুনে যারা চাকরিতে আসে তাদের মনে ওই ভয় কতটা কাজ করে বলে আপনার মনে হয় ? আর যাদের ভয় আছে তাদের জন্য তো ইউনিয়ন আছে। 

আর কাজের পরিবেশ ? কষ্ট করে লেখা পড়া শিখে আই এর মাইক্রো সার্জারি শিখে আসা সার্জেনকে দিয়ে মেডিকো লিগ্যাল পোস্ট মর্টেম করিয়ে আত্মপ্রসাদ লাভ করে এই সিস্টেম। নিত্য ঝামেলার জন্য হাসপাতাল সুপার এর পোস্ট এখন স্বাস্থ্য প্রশাসকদের কাছে বিভীষিকা। সবাই প্রোগ্রাম অফিসার হতে চায়। আর ক'জন সুপার এর হসপিটাল ম্যানেজমেন্ট এর ডিগ্রি ডিপ্লোমা আছে ? বড়জোর DPH বা MPH এই তো।  ক'জন সিএমওএইচ এর বড় হাসপাতাল চালানোর অভিজ্ঞতা আছে ? প্রমোশন পলিসিতেও গন্ডগোল। 

আর আমাদের প্ল্যানিং এর নমুনা ? কোটি টাকা ব্যয় করে সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল তৈরি হল তাতে কোনো অফিস কমপ্লেক্স ঘর নেই। সুপার কি রাস্তায় বসে অফিস চালাবে ? তাই সই। আরো আজব ব্যপার হল তাতে ছ টা OT আছে কিন্তু কোনো ফার্মেসি স্টোর নেই। এত ওষুধ পত্র যন্ত্রপাতি, লিনেন রাখবে কোথায়। হেন হাসপাতাল নেই যে খানে প্রায় প্রতিমাসে আদেশ আসে ওপর থেকে অমুক ক্লিনিক খুলতে হবে, তমুক OPD খুলতে হবে। আজ জেরিয়াট্রিক তো কাল টেলিমেডিসিন। সুপার জায়গা বের করবে কি করে সে নিয়ে মাথা ব্যাথা নেই ওপরওয়ালাদের। ফলে সংকুচিত হয় সেই ইনডোর ইনডোর এর করিডোর, বারান্দা। ফলে বেড নেই, ফলে রেফার। এ ভাবে কোনো সভ্য দেশে হসপিটাল সিস্টেম চলে না। 

সবটা মিলিয়ে খুব জটিল অপ্রীতিকর একটা পরিস্থিতির মধ্যে স্বাস্থ্যকর্তারা রেফার রোগের মোকাবিলায় নেমেছেন। দুটো হাসপাতাল সারপ্রাইজ ভিজিট করে (এই তথ্য প্রযুক্তির যুগে ভিজিট করে কেন জানতে হবে কোথায় "বেশি" ডাক্তার সেটা বোধগম্য নয়, ডাটাবেস কি হল তাহলে?) সেই রোগ সারানো যাবে না। হ্যাঁ কিছু লোক খেপিয়ে তোলা যাবে। ইন্দ্ধন যোগানোর জন্য সবজান্তা সংবাদ মাধ্যম তো আছেই। 

রেফার রোগ সারাতে গেলে সঠিক তথ্য সংগ্রহ (তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহার) করা দরকার সবার প্রথমে। তার সাথে সঠিক যুগোপযোগী চিন্তাভাবনা যুক্ত করে সঠিক পরিকল্পনা করার দরকার। প্রচুর খাটতে হবে, সিস্টেম এর খোল নলচে পাল্টে রিফর্ম করতে হবে। দেশ বিদেশের বেস্ট প্রাকটিস মডেলগুলো থেকে শিক্ষা নিতে হবে আর প্রতিপদে সঠিক চেঞ্জ ম্যানেজমেন্ট টেকনিক এর প্রয়োগ করে সব স্টেকহোল্ডারদের এই রিফর্ম এ সামিল করতে হবে। একা কোনো সুপার বা সিএমওএইচ ধমকে চমকে এটা করতে পারবে না। 

সাধারণ মানুষের হয়রানি যাতে কমে (শূন্য করা সম্ভব নয়), গরীব মানুষ যাতে আরও গরীব না হয়ে যায় তার জন্য তার বাড়ির কাছের (ডোর স্টেপ) সরকারি ছোট বড় হাসপাতালে যতটা সম্ভব চিকিৎসা দেয়াটা আমাদের দায়িত্ত্ব কর্তব্য এ নিয়ে কোনো বিতর্কই চলতে পারে না। কিন্তু এই সীমিত বাজেট নিয়ে স্রেফ ধমকে চমকে সেই কর্তব্য পালিত হবে কিভাবে - সেই সুস্থ বিতর্ক চলতে থাকুক যতক্ষণ না বাস্তব সম্মত সমাধান সূত্র বেরিয়ে আসে। স্রেফ ডাক্তার নয়, চিকিৎসাকর্মী নয়, সাধারণ মানুষও এই বিতর্কে অংশ নিন। 

সব শেষে বলবো আমাদের আশাবাদী হতেই হবে। ২০ বছরের বেশি সময় ধরে এই সিস্টেমটা খুব কাছ থেকে দেখার অভিজ্ঞতার নিরিখে বলতে পারি, ডাক্তার সহ অধিকাংশ কর্মচারীরা বেসিক্যালি ফাঁকিবাজ নন, তারা কাজ করতে চান। উপযুক্ত কাজের পরিবেশ চান শুধু, সঙ্গে একটু ঠিকমতো ব্যাকআপ সাপোর্ট সিস্টেম। কোভিড এর সময় এই সহকর্মীদের নিয়ে মিরাকল দেখিয়েছি আমরা। সব্বাই ভয়ে পালিয়ে গেছে। তাবড় দাপুটে নেতা মন্ত্রীসান্ত্রিরা হাসপাতালের ৫০০ মিটারের মধ্যে আসেন নি। স্রেফ ডাক্তার আর স্বাস্থ্যকর্মী - এরাই বুক দিয়ে আগলিয়েছে সরকারি হাসপাতালের সিস্টেম। ধমকে চমকে এ জিনিস হয় নি। আমাদের ওপর ভরসা রাখুন আমাদের পাশে দাঁড়ান সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে। আমরা নিরাশ করবো না।

মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০২২

মমতার অপসারণ ~ ডাঃ বিষান বসু

অনেকেই দেখছি দীর্ঘশ্বাস ফেলেটেলে বলছেন, অনেক আশা নিয়ে আপনাকে এনেছিলাম। শেষমেশ এই! ঠিক আছে, এনেছিলাম আমরা, ছুঁড়ে ফেলবও আমরাই।

প্রেমে দাগা খাওয়া যৌবনের অনুরূপ ভাষায় অনেকে এমনও বলছেন, এই জন্য, হায়, এই জন্য আপনাকে ক্ষমতায় রেখে দিলাম! ফ্যাসিবাদের বিপদ রুখতে গিয়ে শেষমেশ এই! মনে রাখবেন, আপনার পতনও আসন্ন।

সৎ আবেগ তাঁদের। সম্মান জানানোই উচিত। বিশেষ করে উত্তর মেরুর পেঙ্গুইনের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে কমরেড ট্রটস্কি কী বলেছিলেন বা হনলুলুর বিপ্লব সম্ভাবনা প্রসঙ্গে দিমিত্রভের অন্তর্ভেদী মতামত, এসবের কোনোটাই যখন জানা নেই, তখন তাঁদের গভীর চিন্তনের প্রতি শ্রদ্ধাবনত সম্মতিই শ্রেয়।

তবু অশিক্ষিত কাণ্ডজ্ঞানশূন্যতার সুবাদে দুটো কথা বলে বসার লোভ সামলাতে পারছি না।

প্রথমত, "জননেত্রী"-কে ক্ষমতায় বসানো। হ্যাঁ, চৌঁত্রিশ বছরের ক্ষমতার শ্যাওলা এক ভয়ানক অভ্যাস। নিয়মিত ঘষামাজার মাধ্যমে সে শ্যাওলা তুলে না ফেললে পাথরটি যে একসময় লালরঙা ছিল, বুঝে ওঠা মুশকিল। "পরিবর্তন" হতোই - সেদিন না হলে তার পরের দিন। কিন্তু আপনাদের "বিপ্লব" কিছু সস্তা ছিল না - মানে একদম টাকাপয়সার অঙ্কের প্রসঙ্গেই কথাটা বলছি। 

মাননীয়ার ছবি কোটি টাকায় বিক্কিরি হওয়াই বলুন বা "পরিবর্তন"-এর ঠিক মুখেই দশ-বিশটা মিডিয়া একলপ্তে হাতবদল হওয়া - টাকা উড়ছিল বাতাসে। আপনারা টাকা খেয়েছিলেন, এমন অপবাদ দিচ্ছি না - কেননা, আমি সত্যিসত্যিই আপনাদের ব্যক্তিগত সততায় বিশ্বাস করি - কিন্তু বিপ্লবের গনগনে আগুনে কাঠকয়লায় জোগানটি ঠিক কোত্থেকে আসছিল, বিপ্লবের গরমাগরম অতিরঞ্জিত খবরগুলো ঠিক কাদের হাত ধরে "জনগণ"-এর কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল, আপনারা বুঝতে পারেননি। বা বিপ্লবের আত্মপ্রসাদের চোটে চিনতেই পারেননি। চিটফাণ্ডের মালিকের চ্যানেল বাম-বিপ্লবের সমর্থক হয়ে বিপ্লবের বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন - আমি নিশ্চিত, লেনিন কিংবা গ্রামশি এর'ম সম্ভাবনার কথা কোথাও না কোথাও লিখে গিয়েছেন - আমরা যারা অবোধ অজ্ঞান তাদের চোখে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকেছিল অবশ্য, কিন্তু তাতে কী!!!

দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদ রুখতে ইয়ে। অর্থাৎ মাননীয়াকে ক্ষমতায় গেঁড়ে বসতে সাহায্য করা। খরচা সেখানেও কম হয়নি। ভাজপা-র ঢালাও টাকা ওড়ানোর তুলনায় অতি নগণ্য হলেও কম নয়। বেশি না, নির্বাচনের আগে মাত্র আটত্রিশ হাজার কোটি টাকা। হ্যাঁ, বাকি সব খরচা বাদই দিন, কিন্তু এই টাকাটা রাজ্য সরকার দিয়েছিলেন বিভিন্ন এনজিও ও "অন্যান্য"-দের। ভোটের আগে। হ্যাঁ, দুস্থ দেনাগস্ত এই রাজ্য সরকারই।

আবারও বলছি, আপনি সেই পয়সার ভাগ পেয়েছিলেন, এমন আমি বলছি না। কেননা আপনার ব্যক্তিগত সততার ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়। কিন্তু আপনাদের প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড রঙচঙে ফেস্টুন তার খরচ ঠিক কোন পথে আসছিল, তা জানতে পারেননি। বা ওই যে বললাম, বিপ্লবের আত্মপ্রসাদের চোটে চিনতেই পারেননি। বা ভাবছিলেন, ফ্যাসিবাদের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠলে এমনই হয়। অথবা, দিমিত্রভ তো বলেইছেন... আসলে দিমিত্রভ তো শুধু পড়ার ব্যাপার নয়, ওসব গীতা-উপনিষদের শ্লোকের মতো উপলব্ধির ব্যাপার - এবং টেক্সটের চাইতে কনটেক্সচুয়াল ইন্টারপ্রেটেনশনটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, তাই না, বলুন?

সে যাক গে, বলেইছি তো, অশিক্ষিত অবোধ ও অজ্ঞান আমি। ভুল বললে মাফ করে দেবেন, প্লিজ।

মোদ্দা কথাটা হলো, আপনাদের দুই দফার বিপ্লবের পেছনে খরচা কম পড়েনি। সাত মণ তেল পুড়িয়ে রাধা নেচেছেন ঠিকই (এটি প্রবাদবাক্য, লিঙ্গভেদে কৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়েছেন বলেও পড়তে পারেন), কিন্তু সেই নাচ শেষমেশ এই। তার পূর্বানুমান আপনারা পাননি, সেটুকু ভ্রান্তি নিয়ে দোষারোপের মানে হয় না।

কিন্তু, সেই সাত মণ তেলের জোগান এলো কোত্থেকে, এটুকু জানতে না চাওয়াটা তো...

প্রথম দফায়, বাকি সব সন্দেহজনক উৎস বাদ দিলেও যে উৎসটি সন্দেহাতীত, তা হল চিটফান্ডের টাকা। অর্থাৎ, হাতবদল হওয়া আমজনতার টাকা, এই রাজ্যেরই সাধারণ মানুষের টাকা।

দ্বিতীয় দফায়, রাজ্য সরকারের টাকা। আইপ্যাকের হাত দিয়ে তৃণমূলের তোলাবাজির টাকাও। অর্থাৎ, আবারও, হাতবদল হওয়া আমজনতার টাকা, এই রাজ্যেরই সাধারণ মানুষের টাকা।

মুশকিল হলো, এই দফায় "রাজ্য জুড়ে অনাচারের প্রতিবাদ"-ই বলুন বা অন্য কিছু - ক্ষমতা থেকে সরানো, বা আপনাদের প্রিয় লব্জ অনুসারে "ছুঁড়ে ফেলা", এবম্বিধ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্পনসর পাওয়া চাপ।

প্রথম দফায় কাজটা কঠিন ছিল। শুধু টাকার জোরে করা সম্ভব হয়েছিল, এমন নয়। মানুষের জোর না থাকলে হতো না।

দ্বিতীয় দফায়ও কাজটা কম কঠিন ছিল না। মানুষকে বিভ্রান্ত করার আগে নিজেকেও ভুল বোঝাতে পারা - মানে, ভুলটাকেই সঠিক বলে নিজেকে বোঝাতে পারা - সহজ তো নয়। 

এবার অবশ্য কাজটা সত্যিই কঠিন। প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হিংস্র সরকার। বিপদ অনেক। ঝামেলা আরও বেশি। আর, ওই যে বললাম, হাজার চাইলেও প্রয়াসটি যথাযথ প্রচার পাবে না, কেননা স্পনসর নেই। অতএব, পেরে উঠবেন বলে মনে হয় না। তবে বেশি পারার চেষ্টা না করাই ভালো। সেটিই রাজ্যবাসীর পক্ষে সুখকর ও স্বস্তিপ্রদ।

কাজেই বড় বড় বাকতাল্লা ছাড়ুন। আপাতত শুধু এটুকু স্বীকার করে নিন, এই প্রতিটি ধর্ষণ, এই প্রতিটি খুন, এই প্রতিটি অশ্রুবিন্দু, এই সবের পেছনে রইল আপনার অংশীদারি - প্লিজ, এটুকু দায়িত্ব নিন। 

ট্রটস্কি বা দিমিত্রভ এ প্রসঙ্গে কী বলে গেছেন জানি না, কিন্তু মাইরি বলছি, দায়দায়িত্বহীন বিপ্লব যে বড় ভয়ানক জিনিস, সে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

মঙ্গলবার, ৫ এপ্রিল, ২০২২

ইলিয়াস সাহেব ~ নরেশ

এবিপি ও টেলিগ্রাফের প্রাক্তন সাংবাদিক নরেশ বাবু লিখেছেন । এই লেখাটা শেয়ার করা এবং পড়া উচিৎ । 

ইলিয়াস সাহেব, আপনার সঙ্গে আমার দ্বিতীয়বার দেখা হয়েছিল ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের মাঝামাঝি। তখনও আপনি নন্দীগ্রামে থাকতে পারছিলেন। ততদিনে অবশ্য হলদি নদীর এপারে শঙ্কর সামন্তকে পুড়িয়ে মারা হয়ে গেছে আর ওপারে গঙ্গামোড়ে ডিআইবি ইন্সপেক্টর সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের ঘাড় ভাঙা লাশ শেষ অবধি উদ্ধার হয়েছে হলদির গর্ভ থেকে। এক জোড়া পাথর বেঁধে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল লাশটা। নন্দীগ্রামে ততদিনে সিপিএম 'ফিনিস।' ৭ই জানুয়ারির মধ্যেই নন্দীগ্রামের সমস্ত রাস্তা কেটে ফেলা হয়েছে। ৭নম্বর জলপাই গ্রামের ৬৫ বছরের মাখন বাবুকে তাই রিকশা ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেনি ছেলে সুখদেব। বাড়িতে রাখা দু'টো ইনহেলারই শেষ। অতগুলো হাঁদল কাটা রাস্তা পের করতে করতেই রাস্তাতেই মরে গেছেন ৬৫ বছরের মাখন বাবু।  ততক্ষনে পুড়ে গেছে শ'দুয়েক বাড়ি আর লুট হয়েছে শ'পাঁচেক বাড়ি। 'সিপিএম' আর থাকে কোন সাহসে?


তালপাটি খালের ওপারে ভাঙাবেড়ায় সিপিএম আর সিপিআই সমর্থক পরিবারগুলির আশ্রয় শিবির উপচে পড়ছে। শেষ দলটি সোনাচূড়া থেকে পালিয়ে এসেছে দিন চার দিন আগে। এই দলটি মন্ডল পরিবারের। মাওবাদী নেতা তেলেগু দীপক, মধুসূদন মন্ডলরা তাঁদের বেসক্যাম্প পেয়ে গেছে তৃনমূলের অন্দরে। সিদ্দিকুল্লা ততদিনে মহম্মদ ইলিয়াসকে মানে আপনাকে 'হারাম' বলে দেগে দিয়েছেন। খালি কংগ্রেসের সবুজ প্রধান তখনও বুঝে উঠতে পারেননি খেলাটা। ভাবছেন, নিপাট কৃষি জমি রক্ষার আন্দোলন একটা। তিনিও ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটিতে কিন্তু তাঁকে আড়াল করেই নন্দীগ্রামে নীল নকশা বুনে যাচ্ছে শুভেন্দু অধিকারী, সেক সুফিয়ান, তেলেগু দীপক, সিদ্দিকুল্লারা। 'আ্যকশন বাহিনী' গড়ে নিজেদেরই দুটো দল গড়ে খালের এপার ওপার বোমাবর্ষণ আর গুলির মহড়া চলছে। রাতের নন্দীগ্রাম বোমার আওয়াজে কাঁপছে আর হার্মাদ জুজু বোনা হচ্ছে। জুজু এই কারনেই বলা যে সেই 'হার্মাদ' তখনও নন্দীগ্রামে আসেনি। 

সবুজ তো বলেই ফেললেন, ' একটা মারাত্মক ভুল হয়ে গেছে। 'হার্মাদ' মনে করে আমাদের বাহিনীর লোকেরাই গুলি করে মেরে ফেলেছে আমাদেরই কয়েকজনকে।' আসলে খেলাটা বুঝতে পারেননি সবুজ, গ্রামবাসীদের ক্ষেপানোর জন্য আর 'হার্মাদ' গল্প ফাঁদার জন্য মাওবাদীদের লাশের দরকার তাই 'হার্মাদ' ঠেকানোর রাত পাহারায় থাকা ভরত মন্ডল, বিশ্বজিৎ মাইতি আর শেখ সেলিমের লাশের দরকার হয়ে পড়েছিল। সবুজ প্রধানের মত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতারা তখনও বুঝতে পারেননি, কালিচরনপুর হাইস্কুলের পাশেই ডেরা বেঁধে আছে প্রশিক্ষিত মাওবাদীদের একটি দল। রাতে এরাই নিশিকান্ত মন্ডলের জিম্মায় থাকা অস্ত্র নিয়ে লড়াই লড়াই খেলে আর চমকে ওঠে নন্দীগ্রাম। ৭তারিখ মধ্যরাতে মাওবাদীদের গুলিতে মরলেন ভরত, সেলিম, বিশ্বজিৎ আর সেটাকেই হার্মাদ বলে চালিয়ে দিয়ে শঙ্কর সামন্তর বাড়িতে হামলা চালিয়ে আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে মারা হল শঙ্কর সামন্তকে।

ইলিয়াস সাহেব আপনার সঙ্গে দেখা হল গাঙড়ায়। সাইকেলে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, দেখে মনে হল পদ্মা নদীর মাঝি। হলদিতে বৈঠা বাইতে বাইতে এই মাত্তর উঠে এলেন আমার ডাকে। সবুজ প্রধান বলেছিলেন, মানুষটা বড় ভালো। আমি বলেছিলাম, কিন্তু ওঁর সঙ্গে দেখা করব কী করে? সবুজ বললেন, 'আমি বললেই আসবেন।' আসলে আমার কিছুই করার ছিলনা । ৩রা জানুয়ারি নন্দীগ্রাম ঢুকতে ব্যর্থ হয়েছি। থানার মধ্যেই বসে রয়েছি সারাদিন। যে বাছাই করা কয়েকজন রিপোর্টারের নন্দীগ্রাম ঢোকা বারণ তাদের মধ্যে আমিও একজন। এর আগে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির নেতা সেক সুফিয়ানের কাছে দরবার করেছিলাম, তিনি সোজা হাঁকিয়ে দিয়ে বললেন, 'ভেতরে ঢোকার কী দরকার? নন্দীগ্রাম থানায় বসে থাকুন। বর্তমান, একদিনের রিপোর্টাররা তো খবর আনবে তাদের কাছ থেকেই আপডেট নিয়ে নেবেন। তাছাড়া রাস্তা ফাস্তা সব কাটা আছে।' আমি জানি রানা, দয়াল, পাবকরা ততদিনে খবর খাওয়াচ্ছে, লড়াইয়ের গল্প শোনাচ্ছে, হাড় হিম সন্ত্রাসের।

 সবুজকে বললাম। সবুজ বললেন, আপনাকে সোনাচূড়া অবধি আসতেই হবে, বাকিটা আমরা ম্যানেজ করে নেব। আমি ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির আরেক নেতা আবু তাহেরকে পাকড়াও করলাম। থানার একটু দূরে তাঁর এতিমখানায় দাঁড়ালাম। এসে বললেন, ' আপনার বন্ধুরাই তো বাগড়া দিচ্ছে দাদা। বলছে ওই লোকটাকে কোনও ভাবেই নন্দীগ্রামের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া যাবেনা। সব ফাঁস করে দেবে।' আমি বললাম, কিন্তু ফাঁস করার আছেটা কী?' আবু বললেন, না, তেমন কিছুই নেই। আচ্ছা দাঁড়ান। কাউকে একটা ফোন করলেন। তারপর বললেন, 'বাইকে করে একজন আপনাকে সোনাচূড়া বাজার অবধি নিয়ে যাবে কিন্তু ওই পর্যন্ত। আর ওপাশে যাবেননা পরের জায়গাটা হার্মাদদের দখলে! আর তেলের দামটা দিয়ে দেবেন। ' আমি বললাম, তাই সই। আবু যে ছেলেটিকে দিয়েছিলেন, তার ফোন নম্বর নিয়েছিলাম। এরপর তাকেই ফোন করে নিতাম। দিনটা সম্ভবতঃ ১২ই ফেব্রুয়ারি, দুদিন আগেই হলদির গর্ভ থেকে ডিআইবি ইন্সপেক্টর সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়ের লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ। মাত্র কয়েকমাস ছিল অবসর নিতে। ঈশ্বরদহ উত্তরপল্লীতে ভাবনীপুর থানার পুলিশের সঙ্গে একটা তদন্তে এসে নিখোঁজ হয়ে গেছিলেন সাধু। 

যাইহোক সবুজকে ফোন লাগলাম, 'সোনাচূড়ায় যাচ্ছি।' ততদিনে চৌরঙ্গী বাজার, হাজরাকাটা, গড়চক্রবেড়িয়া থেকে সোনাচূড়া অবধি সাত আটটা জায়গায় রাস্তাকাটা হয়ে গেছে। বাকি রাস্তায় কাঠের মিল থেকে নিয়ে আসা লম্বা লম্বা লগ ফেলে রাস্তা সঙ্কীর্ণ করে দেওয়া হয়েছে। পুলিশের গাড়ি যাতে না ঢুকতে পারে। প্রতিটি রাস্তা কাটা জায়গায় চার পাঁচজন দাঁড়িয়ে থাকে। ওই বাইক চালকের ইশারায় তারা কাটা রাস্তার ওপর মোটা তক্তা বিছিয়ে দেয়। বাইক পেরুতে পেরুতে সোনাচূড়া বাজার। বেলা দেড়টা। সবুজ এলেন। সবুজই কথা বলে রেখেছিলেন, এলেন নিশিকান্ত মন্ডল। ছিপছিপে লুঙ্গি পরা মানুষটিই তখন সোনাচূড়ার নেতা। রাতে এঁর বাড়ি থেকেই পরিচালনা হয় 'আ্যকশন বাহিনী'। তেলেগু দীপক, মধুসূদন মন্ডলরা নাকি এর বাড়িতেই ডেরা গাড়েন। অনেক পরে খুন হয়েছিলেন নিশিকান্ত মন্ডল। মাওবাদীরাই গুলি করে মেরেছিল তাঁকে। এক মাওবাদী নেতা পরে আমার কাছে আফসোস করে বলেছিলেন, নিশিকান্ত মন্ডলকে মারা ভুল হয়েছিল। ওনার কাছে আমাদের যে অস্ত্রগুলি ছিল তা উনি ফেরৎ দিতে অস্বীকার করেছিলেন বলেই ওনাকে মারা হয়। কিন্তু পরে আমরা জানতে পারি এটা উনি ওনার এক শীর্ষ নেতার নির্দেশেই করেছিলেন। মাওবাদী সেই নেতাতো সরাসরি  অধিকারী বাবুর নাম নিয়েছিলেন।

সোনাচূড়া বাজারের একটা চায়ের দোকানে বসে কথা হল নিশিকান্ত মন্ডল, সবুজ প্রধান, খোকন শীটের সঙ্গে। এরইমধ্যে সবুজ কথা বলে নিয়েছিলেন মহম্মদ ইলিয়াসের সাথে। আমাকে বললেন, উনি গাঙড়া পর্যন্ত আসতে পারবেন। কিন্তু আপনি যাবেন কী করে? আমি বললাম, কেন বাইকে? সবুজ বললেন, মাথা খারাপ ওরা আমাদের বাহিনীর ছেলে। নন্দীগ্রামের বাম বিধায়কের কাছে আপনি বাহিনীর বাইকে যাবেন? এদিকে বাইক চালকও ততক্ষনে অধৈর্য্য হয়ে উঠছে আর উশখুশ করছে। ওকে বললাম, ভাই আপনি চলে যান। তেলের টাকা দিয়ে দিলাম। ছেলেটি খুশি মনে চলে গেল। সোনাচূড়া থেকে গাঙড়া প্রায় তিন কিলোমিটার। চড়া রোদ, মাথা ঝিমঝিম করছে। পরনের হাফ সোয়েটার খুলে মাথায় চাপালাম। সবুজের কথায় খোকন আমাকে গাঙড়ার মুখে নামিয়ে দিয়ে বললেন, বাকিটা হেঁটে চলে যান। বাকিটা হেঁটেই আপনার কাছে গেলাম। রাস্তার ওপর একটা কার্লভাটে বসলাম দু'জন। কার্লভাটটার তলা দিয়ে তখন কুলকুল করে জল ঢুকছে পূর্ব থেকে পশ্চিমে। আমি সেদিকে তাকাতেই আপনি বললেন, হলদিতে জোয়ারের জল ঢুকছে।

দিনটা আমার এই কারনেই মনে আছে যে, নন্দীগ্রামের এই অংশ থেকে শেষ সিপিএম সমর্থক পরিবার চলে গেছে কয়েকদিন আগেই ঠিক যেদিন নদীর ওপাড়ে গঙ্গামোড়ের কাছে ঈশ্বরদহ থেকে নিখোঁজ হয়েছেন সাধুচরণ চট্টোপাধ্যায়। এপারে সেই দিনই ক্লাশ নাইনের ছাত্রী সুমিতা মন্ডলের লাশ উদ্ধার হয়েছে। অনেক অশান্তির মধ্যেই থেকে গিয়েছিল সুমিতার পরিবার। সুমিতার বাবা নন্দীগ্রামে হলদিয়ার মতই শিল্প চেয়ে মিছিল করেছিলেন। দিনে দুপুরেই ১৬বছরের সুমিতাকে ধর্ষণ করার পর মেরে টাঙিয়ে দেওয়া হয়েছে তার বাড়ির সামনেই একটা গাছে। এরপরও আপনি নন্দীগ্রামে থাকতে পারছেন? প্রশ্ন করেছিলাম। আপনি বললেন, আছি। তবে কতদিন থাকতে পারব জানিনা। পরে বুঝেছি আপনার দলও ততদিনে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর বিরুদ্ধে নরম গরম বক্তব্য রাখছে। অশোক ঘোষ, ক্ষিতি গোস্বামীর মতই মঞ্জুকুমার মজুমদাররাও বলতে শুরু করেছেন, এর পুরো দায় সিপিএমকেই নিতে হবে। আপনাদের সমর্থক পরিবারগুলো ততদিনে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। তাঁদের রুটিন মত মিছিল মিটিংয়ে হাঁটছে। আপনি বললেন, ' মানুষ ভুল বুজছে কিন্তু আশাকরি সত্যটা বুঝতে পারবে। তেরপেখ্যা সেতুটা হলেই....' আপনাকে বড় বিষন্ন লাগছিল। প্রথমবার ৫ই জানুয়ারি আপনার চৌরঙ্গীর বাড়িতে দেখা সেই আপনি তখন মারাত্মক বিষন্ন, হতাশা গ্রাস করেছে আপনাকে।

ওই বছররই ৫ ডিসেম্বর খবরটা ভেসে উঠল টিভিতে। নন্দীগ্রাম বিধায়ক ইলিয়াস মহম্মদ ঘুষ নিতে গিয়ে ধরা পড়েছে! কোন ইলিয়াস? ১৯৯৩ আর ১৯৯৮  নন্দীগ্রাম-১-এর পঞ্চায়েত সমিতির সহকারী সভাপতি? ২০০১ আর ২০০৬ সালে নন্দীগ্রামের বিধায়ক। পলেস্তারা খসে পড়া একতলা বাড়ির মালিক? দলের নির্দেশে সরকারি চাকরি ছেড়ে বিধায়ক হওয়া ইলিয়াস মহম্মদ। দু'টো বেকার ছেলের কোথাও গছাতে না পারা অপদার্থ বাপ  ইলিয়াস মহম্মদ ? আপনি এতটাই ভোলে ভালা যে সংবাদিক রূপী তৃনমূল কর্মীটিকে চিনতে পারলেননা।

ততদিনে আপনার বাড়িতেও হামলা হয়ে গেছে। আপনি এমএলএ হোস্টেলে। সাংবাদিক সাজা তৃনমূল কর্মী শঙ্কুদেব পণ্ডা নন্দীগ্রামের 'উন্নয়নে'র জন্য কাজ করতে চাওয়া এক এনজিওর হয়ে বিধায়কের শংসাপত্র নিতে গেছিল আপনার কাছে। আমার ফোনটা ধরেই কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন, " নন্দীগ্রামে উন্নয়নের কাজ হবে শুনেই শংসাপত্র দিয়েছিলাম। ও আমার পকেটে একটা নোটের বান্ডিল গুঁজে দিল। আমি টাকাটা বের করে ওর হাতে দিয়ে বললাম, ' এইভাবে  দলের ফান্ডে টাকা নেইনা আমরা।' আমি টাকাটা ফেরৎ দিলাম। সেটাই ওরা ছবি করে দেখিয়ে দিল!' আপনার বিরুদ্ধে সেই অভিযোগ শেষ অবধি ধোপে টেকেনি বরং বিধানসভায় চিৎকার করে আপনাকে চোর বলে যিনি স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ এনেছিলেন সেই সৌগত রায়কে নারদ মামলায় ঘুষ নিতে দেখেছে সবাই। আপনার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা শঙ্কুদেবও ধরা পড়েছেন নারদ ঘুষকান্ডে। আপনি নির্দোষ প্রমাণিত কিন্তু তাঁরা এখনও অবধি নন।
 
৪ঠা এপ্রিল ২০২২, আপনার এন্তেকাল! শুনলাম স্ট্রোক হওয়ার পর জমি জায়গা বেচে গত ২বছর আপনার চিকিৎসা হচ্ছিল। আর নন্দীগ্রামে এখন কৃষিজমি খুঁড়ে মাছের ভেড়ি হচ্ছে, সিঙুরের মতই। হলদিয়া শহরের প্রতিটি জনপদে ঝুপড়ির পর ঝুপড়ি বাড়াচ্ছে নন্দীগ্রাম। নন্দীগ্রামের শিক্ষিত যৌবন ছুটেছে বেঙ্গালুরু, আহমেদাবাদ, হায়দ্রাবাদ। আপনার এন্তেকাল হয়েছে আজই, আপনি সব দেখতে পাবেন। দেখে আসুন হলদিয়ার বাবাজীবাসার কোনে যে ছেলেটা সবজি দোকান করে, সে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনীয়ার, আপনারই নন্দীগ্রামে বাড়ি। আর ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধকারী সেই মহান মানুষটির এখন জাহাজ প্রমান বাড়ি!

সোমবার, ৪ এপ্রিল, ২০২২

চলে গেলেন মহম্মদ ইলিয়াস ~ শতদ্রু দাস ও সাহেবুল হক

কমরেড মহম্মদ ইলিয়াস। নন্দীগ্রামের প্রাক্তন বাম বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াস।

কুলাঙ্গার শঙ্কুদেব পান্ডাকে মনে আছে? তৎকালীন তৃণমূল নেতা, দামাল ছেলে৷ নন্দীগ্রামের বাম বিধায়ক কমরেড ইলিয়াসকে ঘুষের অভিযোগে ফাঁসিয়ে দেয়। যদিও পরবর্তী সময়ে ইলিয়াস নির্দোষ প্রমাণিত হন। কিন্তু নির্দোষ প্রমাণ হতে হতে ইলিয়াসের জীবনে চলে আসে বড়সড় পরিবর্তন।

পরিকল্পনা করে বিধায়কের পকেটে ১০ হাজার টাকা গুঁজে দেয় শঙ্কু। সেই অবস্থায় ছবি তুলে নেয়৷ যদিও ছবিতে দেখা গিয়েছিল প্রথমে ইলিয়াস বাধা দিয়েছিলেন। বিধানসভায় স্বাধিকার ভঙ্গের অভিযোগ তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। বিধায়ক পদ, এমনকী দলের সদস্য পদও ছেড়ে দিতে হয় ইলিয়াস মহম্মদকে।

'ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।' ইলিয়াসকে যারা চক্রান্ত করে ফাঁসাতে চেয়েছিল সেই মূল মাথা শঙ্কুদেব পাণ্ডা চিটফান্ড মামলায় গ্রেফতার হয়৷ নারদা স্টিং অপারেশনে তাকে ক্যামেরার সামনে টাকা নিতে দেখা যায়। শেষপর্যন্ত জেল খাটার ভয়ে বিজেপিতে ভিড়ে যেতে বাধ্য হয় শঙ্কু। সেই গোয়ালঘরই এখন তার বর্তমান ঠিকানা৷

নন্দীগ্রামের বাসিন্দা ইলিয়াস মেধাবি ছাত্র ছিলেন। গণিতে অনার্স নিয়ে স্নাতক পাশ করেন। সমাজসেবার ইচ্ছে থেকেই রাজনীতিতে পা দেন। মেদিনীপুরের মানুষের জনসমর্থন পেয়ে বাম জমানায় ২০০১ সালে এবং ২০০৬ সালে নন্দীগ্রাম বিধানসভা কেন্দ্র থেকে বিধায়ক হন।

অনেক অভিমান নিয়ে কমরেড ইলিয়াস চলে গেলেন৷ চলে গেল একটা সংগ্রামী জীবন৷ তৃণমূলের একদা প্রভাবশালী নেতা নন্দীগ্রামের আবু সুফিয়ানদের প্রাসাদের মতো বাড়িঘর৷ ইলিয়াস সেই ফুলে ফেঁপে ওঠা জীবন চাননি। শঙ্কুদেবের টাকার প্রলোভন তাঁকে ভোলাতে পারেনি৷ ক্যামেরার সামনে তোয়ালে মুড়ে টাকা নেওয়া নেতাদের মতো ছিলেন না ইলিয়াস৷ আমৃত্যু সরল-সাধারণ জীবন অতিবাহিত করেছেন৷ এমন মানুষ উন্নয়নের জমানায় বিরল।

চলে যাওয়ার দিনে লোকটার কথা তেমন কাউকে লিখতে দেখলাম না। শোকজ্ঞাপনের তেমন তোড়জোড় চোখে পড়ল না৷ মনে হল লেখা উচিত।

***********************

মহম্মদ ইলিয়াসের ওপর হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো তথাকথিত "সংখ্যালঘুদের মসিহা", কোনো "সাবল্টার্ন"-এর প্রতিনিধি, কোনো "দলিত অ্যাক্টিভিস্ট"-কে বলতে শুনেছেন? 

সব উপাদান কিন্তু ছিল। ইলিয়াসবাবু গরিব খেটে খাওয়া সংখ্যালঘু, যারা তাকে ফাঁসিয়েছিল এবং তার বিরুদ্ধে বিধানসভায় প্রস্তাব এনেছিল সেই শঙ্কু পণ্ডা, সৌগত রায়, বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার, অধিকারী পরিবার – সবাই উচ্চবর্ণ হিন্দু। যারা চোরকে চোর বললে আজকাল চোরের ধর্ম আর বর্ণ টেনে এনে "উচ্চবর্ণের ষড়যন্ত্র" দেখে, তাদের কাউকে দেখেছেন কখনো কিছু বলতে? যারা ফাঁসিয়েছিল তাদের প্রত্যেককে টিভির পর্দায় এক্সপার্টের মত ঘুষ খেতে দেখেছেন, সৌগতবাবু ঠোঁটের গোড়ায় সিগারেট ঝুলিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ নিয়ে ঘুষদাতাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ঘুষদাতার সংস্থার নামটা। মনে পড়ে? 

কেউ কোর্টে দোষী সাব্যস্ত হয়নি। বিজেপি এ টিম এবং বিজেপি বি টিম করে দিব্য সকলেই আজ রাজনীতিতে করে কম্মে খাচ্ছে, কোনো লজ্জা শরম তাদের বা তাদের দলের কারুর নেই। কিন্তু কোনো সংখ্যালঘুদের মসিহা, কোনো "রিকশাচালক সাহিত্যিক দলিত নেতা", কোনো "ছোট প্রকাশনা" কাউকে দেখিনি বলতে যে মহাম্মদ ইলিয়াস এক দল বরাহ শাবকের ঘৃণ্য চক্রান্তের শিকার হয়েছিলেন।

[ সেখ সাহেবুল হক ] [ Purandar Bhat ]

রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২

উব্যর ও মার্ক্স ~ অর্ক রাজপন্ডিত

মার্কস কি কখনো লন্ডনের রাস্তায় উবের চেপেছেন? বা মার্কস চুরুট আনিয়েছেন ফ্লিপকার্টে অর্ডার করে, অথবা এঙ্গেলসকে কোন বই উপহার দিয়েছেন অ্যামাজনে অর্ডার করে? 

তাহলে কিভাবে লিখে ফেলতে পারলেন পিস ওয়েজ (টুকরো মজুরি,  নির্দিষ্ট একটিই কাজের ভিত্তিতে মজুরি)  হল টাইম ওয়েজ (সময় মজুরি)র ই পরিবর্তিত রূপ। আর সময় মজুরি হল শ্রম শক্তির মূল্যের পরিবর্তিত রূপ।

দেড়শো বছরেরও বেশি সময় আগে লেখা ক্যাপিটাল এর প্রথম ভলিউম এর  ২১ নম্বর চ্যাপ্টারে মার্কস ঠিক এই লেখা দিয়েই শুরু করেছেন! পিস ওয়েজ থিওরিতে মার্কস লিখেছেন একই শিল্পে পিস ওয়েজ অর্থাৎ টুকরো মজুরি আর টাইম ওয়েজ বা সময় মজুরি, এই দুই ধরনের মজুরিই মজুরি একই সঙ্গে সমান্তরালে চলতে পারে।


মার্কস উদাহরণ দিয়েছেন লণ্ডনের একটি ঘোড়ার জিনের সরঞ্জাম এর দোকানে দেখা যাবে ব্রিটিশ মজুরদের পিস ওয়েজ দেওয়া হচ্ছে আবার ফরাসি মজুরদের টাইম ওয়েজ দেওয়া হচ্ছে।

'পিস ওয়েজ '  থিওরি নির্মাণে দেড়শো বছর আগে মার্কস লিখে গেছেন ক্যাপিটালে ' পিস ওয়েজ সিস্টেম শ্রমিক শ্রেণীর জন্য নতুন যুগ চিত্রিত করেছে '।

কলকাতার রাস্তায় ধরা যাক নবমীর রাতে উবের এর চড়া চাহিদা,ভাড়া বেশি। উবের চালক ধরা যাক, তাঁর মালিক এর থেকে ভাড়া নেওয়া গাড়ি,  তিনি দেখলেন যে এই বর্ধিত উবের রাইড এর চাহিদা ও বর্ধিত ভাড়ার কারনে তিনি কমিশন ও খানিক বাড়তি পাবেন, টানা সারা রাত গাড়ি চালালেন বাড়তি আয় এর জন্য।

এই প্রবনতা নতুন নয়, আজ যা দেখছি দেড়শো বছরেরও বেশি আগে লিখে গেছেন মার্কস "পিস ওয়েজ" থিওরিতে। মার্কস লিখছেন, পিস ওয়েজ ওয়ার্কারদের প্রবনতা হল অতিরিক্ত কাজ করা, অতিরিক্ত সময় কাজ করা, যাতে তারা বাড়তি মজুরি পেতে পারে।

উবের, আমাজন, ফ্লিপকার্ট এর মত ড্রাইভার,ডেলিভারি বয় নির্দিষ্ট ভাবে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম এ গিগ ওয়ার্ক অর্থাৎ নির্দিষ্ট কাজের জন্য নির্দিষ্ট মজুরির যে অর্থনীতি,গিগ ইকোনমি বুঝতে হলে, অ্যাপ শ্রমিকদের দুর্দশা,বঞ্চনা বুঝতে হলে মার্কস এর " পিস ওয়েজ থিওরি" র আলোয় বুঝতে হবে।

গিগ অর্থনীতির মূলত তিনটি বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। প্রথমত, শ্রমিকরা যে টুকরো মজুরি " পিস ওয়েজ" পান, তা ঠিক হয় তাঁর কাজের সংখ্যার ওপরে, যেমন একজন উবের চালক দিনে কতবার রাইড চালালেন। দ্বিতীয়ত, গ্রাহকদের কাছে থাকে পণ্য ও পরিষেবা কেনার নানান সুযোগ, বিভিন্ন ধরনের ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম থেকে তিনি পছন্দ করতে পারেন। তৃতীয়ত, পণ্য বা পরিষেবার উৎপাদনের সঙ্গে এই ধরনের অ্যাপ কোম্পানিগুলো যুক্ত নয়, তারা শুধু মাত্র বাংলা ভাষায় দালালির কাজ করে।

যেমন আমাজন ময়দা তৈরি করে না বা বই ছাপায় না বা মোগলাই পরোটা তৈরি করে না, সে শুধু মাত্র মোগলাই বা বই বা ময়দা গ্রাহকের কাছে পৌঁছনোর জন্য একজন মজুর নিয়োগ করে দালালির কাজ করে।

ক্যাপিটালিজম সব সময়ই শ্রমিককে বাড়তি খাটিয়ে তার অতিরিক্ত মুনাফা অর্জন করে। গিগ এর ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম নয়, ধরা যাক উবের চালককে রাইড পিছু উবের ৫০ শতাংশ কমিশন দেয়, এর অর্থ হল বাকি ৫০ শতাংশ এর কোন মজুরি ই সে পায় না। কেউ যদি দিনে বারো ঘণ্টা গাড়ি চালায় কমিশন বাবদ তার মোট শ্রম সময়ের অর্ধেক সে পায়, তাই দিয়েই সে জ্বালানি ভরে, গাড়ি সারায়,এসির গ্যাস ভরে, পরিবারের যাবতীয় খরচ চালায় ইত্যাদি ইত্যাদি।

এবার একটা অদ্ভুত মজা মানে একেবারে সাংঘাতিক বিভৎস মজা আছে! 

আপনি একজন আদপে শ্রমিক, একটু ভালো মাইনের শ্রমিক, হয়তো আপনি গাড়ি ফ্ল্যাট ও হাঁকাতে পারেন এবারে আপনি ভাবতে শুরু করলেন আপনি 'মিডল ক্লাশ' বরং আপনার নিজেকে ভাবা উচিত ছিল, দেখা উচিত ছিল ' মিডল ইনকাম ওয়ার্কিং ক্লাশ' হিসেবে। 

আপনি একজন ঘোষিত বামপন্থী, লেবার - ক্যাপিটাল দ্বন্দ্বে আপনি বিশ্বাস রাখেন, আপনি চান মজুরি দাসত্বের অবসান হোক। কি মজা দেখুন সেই আপনি উবরে এসি চলেনি, ড্রাইভার ফোন ধরেনি,গাড়িতে সিগারেট খেতে দেয়নি, জোমাটোর ছেলেটা চিকেন রোল দেরিতে এনেছে এসব নানাবিধ কারণে দিলেন নেগেটিভ রিভিউ।

এবার মজাটা কোথায়? আপনার রিভিউ এর ওপর তার মজুরিতে, তার আয় এ আক্রমন হচ্ছে। যেটা " পিস ওয়েজ" এ অনিবার্য। মার্কস লিখেছেন " পিস ওয়েজে শ্রমের মান ও মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে সে যে কাজটা করছে সেটা,  সেটা তখনই ভালো হতে পারে যখন পিস প্রাইস অর্থাৎ টুকরো কাজের জন্য পুরো মজুরি দেওয়া হচ্ছে '।

এবার আপনার মত বামপন্থী গ্রাহকের বা ' মিডল ইনকাম ওয়ার্কিং ক্লাশ ' গ্রাহকের  নেগেটিভ রিভিউ কি করলো? উবের চালককে কাজ দিল না, এমন কি তার আই ডি পর্যন্ত ব্লক করে দিল!  মার্কস লিখেছেন " পিস ওয়েজ মজুরি ছাঁটাই বাড়িয়ে তোলেএবং ক্যাপিটালিষ্টদের আরো প্রতারণার  শক্তি যোগায়"।

গিগ এর মত " পিস ওয়েজ" কাজে শ্রমিকদের স্বাভাবিক প্রবনতা থাকে বাড়তি মজুরির জন্য বাড়তি শ্রম দেওয়া। টানা হয়তো কুড়ি ঘণ্টা উবের চালানো, বা সকাল থেকে সন্ধ্যা টানা ডেলিভারি করে যাওয়া। পুঁজিপতিরাও এই সব পিস ওয়ার্ক এর জন্য পিস মজুরি দেওয়ার আগে সারা ক্ষণ মজুরদের তদারকিতে রাখে। কে কখন গাড়ি চালাচ্ছে, কে কটা ডেলিভারী দিল, রাস্তায় বাইকের টায়ার হয়তো পাংচার হল তাই ডেলিভারী দিতে দেরি হল, সবই দেখা যায়, নিয়ন্ত্রণ করা যায় অ্যাপ এর মাধ্যমে, টায়ার পাংচার এর জন্য সারাই ও করতে হবে শ্রমিক কে আবার দেরির জন্য মজুরিতেও কোপ বসবে!

মার্কস লিখেছেন " যেহেতু এই ধরনের কাজ এর মান ও মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে এহেন পিস ওয়েজ এর টুকরো কাজ, পুঁজিপতিদের শ্রম এর ওপর তদারকি এমন পর্যায়ে পৌঁছায় যা অতিরিক্ত অবাঞ্ছিত"।

একই সঙ্গে গিগ অর্থনীতি জন্ম দিচ্ছে পুঁজিবাদের অনিবার্যতায় পরজীবী মুনাফাখোরদের। উৎপাদক আর গ্রাহকদের মধ্যে যেমন পরজীবী দালাল আমাজন ওলা উবের, তেমনি উবের আর চালক এর মধ্যেও জন্ম নিচ্ছে দালালরা যারা উবের চালানোর গাড়ি বা বাইক পর্যন্ত ভাড়ায় ধার দেয়! মার্কস লিখেছেন " পুঁজিপতি ও শ্রমিকদের মাঝে প্যারাসাইটদের প্রবেশ আরো সহজ করে দেয় পিস ওয়েজ, ফলত পুঁজিপতিদের যেমন মুনাফা আরো বাড়ে, শ্রমিকের শোষণ আরও বাড়ে"।

পরজীবী অর্থনীতির গর্ভে জন্ম নেয় পরজীবী ফাঁপা দর্শন, যা আমাদের অবলীলায় শত্রু ভাবতে শেখায় কখনো কখনো উবের ওলা চালকদের, ডেলিভারি বয়দের। 

আমি আপনি শ্রমজীবীদের দার্শনিক অভিধার অংশ, তাই আমাকে আপনাকেই দায়িত্ব নিতে হবে অনিশ্চিত জীবনের এই গিগ ওয়ার্কারদের শোষন চিনিয়ে দেওয়ার, আমিও আপনিও যাতে বুঝতে ভুল না করি আমার আপনার অভিন্ন লড়াইতে কে শত্রু,কে মিত্র। আমাদের একাজ পারতেই হবে, আমি আপনি ইতিহাসের প্রশ্রয় পাওয়া মানুষ।

এনজিও দের এক লক্ষ কোটি টাকা ~ শতদ্রু দাস

সেদিন একটা খুব অদ্ভুত তথ্য পড়লাম। কম্পট্রলার অডিটর জেনারেল (সিএজি) আমাদের রাজ্যের বাজেটের অডিট করতে গিয়ে পেয়েছে যে ২০১৬-২০২০ এই পাঁচ বছরে, রাজ্য সরকার মোট ১ লক্ষ কোটি টাকা নিজেদের বাজেট থেকে এনজিও দের বরাদ্দ করেছে। সবই আপনার আমার কষ্টার্জিত রোজগারের টাকা, এবং গরিব মানুষের হকের টাকা কারণ টাকাগুলো আমরা কর হিসেবে দি গরিব মানুষের ওপর খরচ হবে ভেবেই, চার আনার কবি সাহিত্যিকের মেয়ের চালানো এনজিও বা ঘুরপথে ৬ আনার প্রকাশনার পেছনে খরচ হবে জানলে এই কর কেউই দিতে চাইবে না। কিন্তু তথ্যটা চমকপ্রদ শুধুই টাকার অংকের জন্য না, অন্য কারণে। সেটা হলো এই যে এই খরচের পরিমাণ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে পঞ্চায়েতগুলো এবং পৌরসভাগুলোকে দেয় অর্থের চেয়ে বেশি। ২০২০ সালে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলোকে রাজ্য সরকার দিয়েছে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ এনজিওগুলোকে দিয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই বছর রাজ্য সরকার যদি এনজিওকে টাকা না দিয়ে সবাইকে হাতে হাতে টাকা দিয়ে দিত, তাহলে রাজ্যের প্রতিটা মানুষ প্রায় ২৬০০ টাকা করে পেতেন। পাঁচ জনের পরিবার ধরলে পরিবার পিছু ১২ হাজার টাকা করে পেত। হকের ১২ হাজার টাকা, আমাদের টাকা। সিএজি তাদের রিপোর্টে বিষ্ময় প্রকাশ করেছে যে কেন এত টাকা এনজিওদের দেওয়া হচ্ছে, এনজিওরা সরকারের অংশ নয়, তাদের খরচাপাতির হিসেব সরকারি সংস্থা করতে পারে না, তারা বাধ্যও নয় সরকারকে খরচের হিসেব দিতে, তাহলে কেন এত টাকা তাদের দেওয়া হলো? অন্তত পঞ্চায়েত বা পৌরসভার হাতে টাকা গেলে সেই খরচাপাতির হিসেব চাওয়া যায় আইনত, আরটিআই করলে সেই হিসেব দিতে বাধ্য। তাহলে তাদের মাধ্যমে খরচ না করে এনজিওদের মাধ্যমে কেন? এই প্রশ্নটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর উত্তরের ভেতরেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং বগটুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত আছে বলে আমার ধারণা। যদি এই অবধি পড়ে আপনাদের মনে হয় যে  এ সবই কল্পনা তাহলে পুরোটা পড়ার অনুরোধ করবো।


আমার ধারণা যে পুরসভা পঞ্চায়েতের মত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে, এনজিওর মাধ্যমে এত টাকা খরচ করবার উদ্দেশ্য হলো দুটো। প্রথমত, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের নিজেদেরর দলের নিচু তলার নেতা কর্মীদের ওপর বিশেষ ভরসা নেই। তাঁরা জানেন যে পঞ্চায়েত পুরসভায় আসা টাকা নিয়ে কিরকম কামড়াকামড়ি মারামারি হয়, কিরকম চুরি হয়। এই চুরি এবং তাকে কেন্দ্র করে হওয়া গোষ্ঠীদ্বন্দ কমাতে সরকার পঞ্চায়েত পুরসভাগুলোর ওপর ভরসা না করে, করেছে এনজিওগুলোর ওপর। তাদের মনে হয়েছে যে এনজিওর মাধ্যমে উন্নয়নের কাজ করলে অন্তত কিছু টাকা আসল জায়গায় পৌঁছবে, নিজেদের নির্বাচিত পঞ্চায়েত বা পুরসভার হাতে দিলে সেটুকুও মানুষের কাছে পৌঁছবে না। তাই পঞ্চায়েত পুরসভার টাকা কমাও, এনজিওদের দাও। দ্বিতীয়ত, এইসব এনজিওগুলোর মাধ্যমে সুশীল সমাজকে হাতে রাখা যাবে। এসব এনজিওর অনেকগুলোরই মাথায় বসে আছে কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডিএম, ডিএসপি, উকিল জজদের ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রীরা। শুধুই তারা নন, নানা প্রকাশনা, থিয়েটার, অভিনেতা অভিনেত্রীরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এরকম হাজারো এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত।  তাই এসব এনজিওদের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলে অন্তত তার কিছু প্রসাদ এদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এমন কিন্তু নয় যে সবাইকে সরাসরি টাকা দিচ্ছে, এটা একটা ইকোসিস্টেম। আপনাকে একটা কাল্পনিক উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক এক প্রখ্যাত সরকারি কবির মেয়ের কোনো একটা এনজিও আছে। সরকার সেই এনজিওকে কোনো একটা বরাত দিলো। সেই কবি খুশ। সেই কবি এবার কিছু কবিতা লিখে একটা ছোট প্রকাশকের মাধ্যমে ছাপালেন, বড় প্রকাশকের মাধ্যমে ছাপাতেই পারতেন কিন্তু সরকারি দলের কেউ হয়ত বলে দিল যে "ওদেরও কিছু মালকড়ির ব্যবস্থা করে দিন, কত আর কামাবেন?" বড় কবির মেয়ে এনজিওর মাধ্যমে অলরেডি কামিয়েছে, তাই তিনি এই 'অনুরোধ" শুনবেন বই কি। এবার সেই ছোট প্রকাশকও বড় কবির বই পেয়ে দু পয়সা রোজগার করলো। এভাবেই এই টাকা ক্রমশ রিসার্চ সেমিনার, কবিতা পাঠ, রিসার্চ কনফারেন্স ইত্যাদিতে নিজের উদ্দেশ্য খুঁজে পেল। আমাদের টাকায়। আর পশ্চিমবঙ্গ যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেল।

এর একটা অন্য দিক হলো যে পঞ্চায়েত পুরসভায় টাকা কমে যাওয়ায় অনারুল লালন ভাদুদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হলো। পঞ্চায়েতে কমে যাওয়া টাকাকে কম্পেনসেট করতে ভেরী, বালি, খাদান, তোলাবাজি বাড়াতে হলো। শুধু নিজের জন্য নয়, এঁদের এক একজনের ওপর কয়েক ডজন পরিবার নির্ভর করে, পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ভাবে গোটা দেশে শেষ সারিতে চলে গেলে কী হবে, এঁরা তৃণমূলের হয়ে খুন জখম ভোট লুঠ করেছে, তার বদলে তো এদের কিছু দিতে হবে। অতএব ক্রমশ ছোট হতে থাকে টাকার থলি নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি। ক্রমশ বগটুই। ক্রমশ শিশু মহিলাদের পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া। 

একটা রাজনৈতিক  দল তৈরিই হয়েছে অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভের ওপর, যে দল করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সেই দল রাজ্যকে যে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ এই ব্যবস্থায় বিরাট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এবং রাজ্যের একটা বড় অংশ তাদের দেখে ভাবছে যে তারাও যদি তৃণমূলের নেক নজরে থাকতে পারে তারাও ওই ক্ষুদ্র অংশে জায়গা পাবে, বাকি রাজ্য *** যাক।

বৃহস্পতিবার, ২৪ মার্চ, ২০২২

লুম্পেন পুঁজি ~ অবীন দত্তগুপ্ত

সহজ টিকা - লুম্পেন পুঁজি বলতে বেআইনি অর্থ লগ্নি কারবারের টাকাকে বোঝায়, অর্থাৎ সারদা-নারদা, ঘুষ, ১০০ দিনের কাজের টাকা মারা ,চালচুরি , বালি খাদান - পাথর খাদানের উপর কাটমানি , তোলাবাজি ইত্যাদি। সনাতন পুঁজি উৎপাদনের মাধ্যমে উদ্বৃত্তমূল্য আহরণ করে ক্রমে স্ফীত হয়ে ভার্টিকাল বা উল্লম্ব বৃদ্ধি ঘটায়, লুম্পেন পুঁজির ক্ষেত্রে উৎপাদনের গল্প নেই, প্রতারণা বা জবরদস্তির ক্ষেত্র বাড়িয়ে তা আহৃত হয়। এর বিস্তার হরাইজন্টাল বা অনুভূমিক, মেলা-খেলা-উৎসব-মোচ্ছবেই এর উপযোগ।

এই উপরের টিকাটা দেওয়ার কারন ,আমি নিজেও এই শব্দের একটা মোটামুটি আভিধানিক মানে খুজছিলাম ,আমার অন্য কাজের ফাঁকে । এবার পয়েন্টে আসা যাক । 

আজকে রাত ৮টা নাগাদ নদিয়ার এক পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামীর মাথায় গুলি লেগেছে । উনি বোধহয় বাঁচবেন না । এই প্রসঙ্গে দুইটা কথা আমার বলার আছে ।

১। এখন মোটামুটি আপনারা বুঝতে পারছেন রামপুরহাট কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় । ২০১৫র পুরসভা নির্বাচন থেকে যা শুরু , তা ২০১৮-র বিরোধী শূন্য পঞ্চায়েত ভোট দিয়ে পূর্ণতা লাভ করে ।  ২০২১র কোলকাতা সহ সমস্ত মিউনিসিপালিটির সমস্ত ওয়ার্ড জিততে চাওয়া সেই ঝোঁকের-ই আরো জোরালো রূপ । এরপর আসছে পঞ্চায়েতের নির্বাচন । মূল কথা হল , পশ্চিমবঙ্গ এই মুহূর্তে মমতা ব্যানার্জী শাসন করছেন না । শাসন করছে লুম্পেন পুঁজি ( যার টিকা টা উপরে দিলাম ) । এই লুম্পেন পুঁজির Horizontal growth -এর জন্যই , সব কটা ওয়ার্ড ,সব কটা গ্রাম পঞ্চায়েত দরকার । তবেই লুঠ বাড়ানো সম্ভব । কেন বাড়াতে হবে ? কারন কর্মহীন মানুষ বাড়ছে । লুম্পেন প্রলেতরিয়েতের সংখ্যা বাড়ছে । তাদের ভাড়া খাটাতে চাই আরো টাকা । আরো টাকা খাটালে চাই আরো মুনাফা । এই যে দ্বন্দ্ব দেখছি আমরা ,এই যে খুন ওটা এই লুম্পেন পুঁজির অন্তর্দ্বন্দ্ব । যত বেশী এলাকা দখল তত বেশী Horizontal growth । 
এ একটা টাইম বোম্ব । অনেক দিন ধরে সলতে পাকাচ্ছিল । এখন ফাটছে । আরো ভয়ানক বিস্ফোরণ ,এবং ক্রমাগত বিস্ফোরণ হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না । মমতা এ বিষয় কিছুই করতে পারবেন না ,কারন ওনার দলটা তৈরি হয়েছে স্রেফ এর ভিত্তিতেই । এটা ভাঙতে গেলে তৃনমুল ভাঙতে হবে । 

মাঝখান থেকে মরে যাবে অনেক সাধারণ মানুষ । কলেটারেল ড্যামেজ । 

২। এই যে পঞ্চায়েত প্রধানের স্বামী গুলি খেল , পঞ্চায়েত প্রধান গুলি খেল না কেন ? তারও কারন বামফ্রন্ট এর স্বপ্নের পঞ্চায়েতের চরিত্র বদল । পঞ্চায়েত ছিল গ্রামের মানুষের নিজের সরকার । প্রান্তিক মানুষের স্বনির্ভর হওয়ার জায়গা । প্রান্তিক মানুষ মানে শুধুই ক্ষেতমজুর বা জাতি ধর্ম নয় , প্রান্তিক মানুষ মানে নারীও বটে । আমাদের সমাজে ,যে সমাজে পঞ্চায়েত এসেছিল ,সে সমাজে অবশ্যই । একজন মহিলা পঞ্চায়েত প্রধান মানে নারীর ক্ষমতায়ন । এই তো আইডিয়া । 

এখন মহিলা সংরক্ষিত সিটে যিনি বসছেন ,তিনি পুতুল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ,পঞ্চায়েত চালান বাবা,ভাই বা স্বামী । পুরো ইউ পি-বিহার-রাজস্থান হয়ে গেছি এই ফিল্ডে । একেকটা পঞ্চায়েত এ খরচ হচ্ছে ৮-১০ লাখ টাকা । ৫ বছরে তুলতে হবে কয়েক কোটি । এই তো সহজ হিসেব ।

বুধবার, ৯ মার্চ, ২০২২

শিল্পকলা ও বাজার ~ বিষাণ বসু

(বিষয়টা একটু জটিল। একটু নয়, অনেকখানিই। এমন বিষয় সোশ্যাল মিডিয়ায় আলোচনার উপযুক্ত কিনা, জানি না। কিন্তু সবার মতামত পাওয়ার অন্য পথ আমার হাতে এখুনি নেই।

আমার অর্থনীতি বিষয়ে জ্ঞানগম্যি যেহেতু শূন্যের কোঠায়, কথাগুলো মনে এলেও গ্রসলি ভুলভাল ভাবছি কিনা, সে নিয়ে সংশয় ছিলই। অগত্যা অগ্রজসম এক বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদকে ভাবনাগুলো লিখে জানালাম। তিনি জানালেন, বক্তব্যের মধ্যে অর্থনীতির যুক্তিতে বিশেষ ভুল নেই। এ বিষয়ে তাঁর সঙ্গে বাকি যে কথোপকথন, তা বর্তমান আলোচনায় অবান্তর। তাঁর জন্য রইল আমার মুগ্ধতা, শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতা, যেমন থাকে সবসময়ই। অকারণ তাঁকে ট্যাগ করে বিরক্ত করতে চাইছি না। 😊

লেখাটা পড়ে আপনারা সবাই যদি মতামত জানান খুশি হবো। এবং সত্যিই উপকৃত হবো।)

এক ভ্রাতৃসম শিল্পীর সঙ্গে কথোপকথন হচ্ছিল। গুণী শিল্পী। চমৎকার আঁকে। চর্চা জারি রাখে। এই শেষ কথাটা আলাদাভাবে উল্লেখের যোগ্য, কেননা এই কথাটির গুরুত্ব কেন ও কতখানি, তা চারুশিল্পজগতের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানবেন।

তো তাঁকে বলছিলাম, শিল্পজগতে ক্রেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা। বলছিলাম, শিল্পীর ক্ষেত্রে দ্বৈত অস্তিত্ব বজায় রাখার গুরুত্বের কথা। একটি অস্তিত্ব সৃষ্টিশীলতার ও অপরটি বিক্রেতার। এবং তার মধ্যে লজ্জার কিছু নেই, বিশেষত এই বর্তমান সময়ে। দুটি সত্তাকে পৃথক রাখতেই হয়, কেননা বিক্রেতা-সত্তা শিল্পী-সত্তাকে নিয়ন্ত্রণ করলে মুশকিল। (তার উদাহরণ কি কিছু কম নাকি!)

আলোচনার মাঝপথে আচমকা এক তরুণ শিল্পী এসে পড়লেন এবং জানালেন, আমার ভাবনার পথে কিছু 'বেসিক ভুল' আছে। কেননা, শিল্পী কোনও 'মুদিখানার দোকানদার' নন (যদিও তিনি ডিসক্লেইমার দিলেন, তিনি নাকি কাউকেই 'ছোট' করতে চাইছেন না)। শিল্প-সংগ্রাহক ও ক্রেতার মধ্যে নাকি বিস্তর ফারাক আছে। এবং শিল্পবস্তু নাকি 'পণ্য' নয়, পণ্য হতেই পারে না। এইসব কথাবার্তার মধ্যেই মাঝেমধ্যে আমার উদ্দেশ্যে বিস্তর শ্লেষবাক্যও ছিল, আমার তরফে প্রত্যুত্তরও। আপাতত সেসব অগ্রাহ্য করে মোদ্দা কথাটুকুতেই মনোনিবেশ করা যাক।

তরুণ শিল্পীর কথাগুলো নতুন নয়। বিশেষত, ইদানীং সোশ্যাল মিডিয়ার সুবাদে প্রায়শই দেখি, জনগণ কলেজ স্ট্রীটই হোক বা বইমেলা, কখনোই বই কেনেন না - শুধু সংগ্রহ করেন। পয়সা দিয়েই 'সংগ্রহ' করেন।

সত্যিই তো, বাজার কেনাবেচা ইত্যাদি অশ্লীল শব্দের সঙ্গে শিল্পচর্চা সাহিত্যচর্চার মতো মহৎ ক্রিয়াকলাপের যোগাযোগ থাকা নিতান্তই অনুচিত। কেনাবেচা বাজার - এসব হয় মুদিদোকানে, সবজিওয়ালা বা মাছওয়ালার কাছে। যদিও কেউই 'ছোট' নন, তবুও…

তা আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, ভাই, পণ্য মানে ঠিক কী? ছবি যখন কেনাবেচা হয়, তা কেন পণ্য নয়? পণ্য শব্দটিকে এমন নেগেটিভ বা খারাপ অর্থে ধরার যুক্তি কী (যদিও কাছেপিঠের পণ্য বিক্রয়ের কেন্দ্র, যেমন মুদিখানার দোকান ইত্যাদি, উঠে গেলে বিস্তর অসুবিধে হয়)?? শিল্পী শুধুমাত্র বিক্রির উদ্দেশ্যেই শিল্পচর্চা করেন, বা যা বিক্রি হবে তা-ই আঁকেন, এমন কখনোই নয়। কিন্তু তাঁর ছবি যখন কেউ কেনেন, তাঁকে সংগ্রাহকই বলুন বা শিল্পপ্রেমী, আদতে তিনি কি ক্রেতা নন?

তিনি জানালেন, আমি যদি সেটা এতদিনেও না বুঝতে পেরে থাকি, তাহলে নাকি এই বয়সে এসে আর বুঝতে পারব না। শ্লেষের সুরে জানালেন, "সরি কাকু। আলু পটল ছবি সব এক। দিনের শেষে পচে যায়। ভুল হয়ে গেছে আপনার আঁতে ঘা দিয়ে।"

শ্লেষ-বিদ্রূপের ব্যাপারে আমারও এলেম নেহাৎ কম নয়। অতএব, প্রত্যুত্তরে জানানো গেল, না না ভাই, পটল ফ্রিজে রাখলে বেশ কয়েকদিন থাকে। আলু তো ফ্লিজের বাইরেও অনেকদিন। কিন্তু সব ছবির ক্ষেত্রে অতটা বলতে পারা মুশকিল।

কিন্তু আলোচনাটা আবারও পারস্পরিক তর্কাতর্কি কথা চালাচালির গল্পের দিকে চলে যাচ্ছে। তরুণ শিল্পীদের মধ্যে শিল্পকে 'পণ্য' না ভাবার ঔদ্ধত্য স্বাগত - যেকোনও রকম ঔদ্ধত্য, এমনকি হোলিয়ার-দ্যান-দাউ মানসিকতাও স্বাগত - ওটুকু না থাকলে এই মরা গাঙে বসে তাঁরা শিল্পচর্চা চালিয়েই যেতে পারবেন না। আমাদের মধ্যবিত্তপনা অতিক্রম করে আশার ঝলকানি তাঁরাই। অতএব আমার এই লেখাটি সেই তরুণ শিল্পীর প্রতি দ্বেষবশত নয়, বা কোনোরকম খাপ বসানোর মানসিকতা প্রসূতও নয়। আমার উদ্দেশ্য, তাঁর বক্তব্যের যাথার্থ্য বা ভ্যালিডিটি খতিয়ে দেখা।

প্রথমেই বোঝা জরুরি, পণ্য ব্যাপারটা কী? যেহেতু অর্থনীতির ছাত্র হওয়া তো দূরের কথা, সে বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানটুকুনিও আমার নেই, এদিক-ওদিক ঘেঁটে একখানা সংজ্ঞা খুঁজে আনলাম -

"কোনও বস্তুর মধ্যে যদি দৃশ্যমান ও অদৃশ্যমান উপলব্ধিযোগ্য গুণ থাকে ও তা মানুষের অভাব/চাহিদা পূরণ বা সন্তুষ্টি বিধানের সমর্থ হয় এবং বিক্রেতা কর্তৃক বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে তা ক্রেতাদের নিকট বিক্রয়ের নিমিত্তে উপস্থাপন করা যায় তাকে পণ্য বলে।"

কথাগুলো খুব সরল বাংলায় হয়ত বলা নয়, তবে বারকয়েক পড়লে ধরতে অসুবিধে হবে না।

এই সংজ্ঞাকে শিরোধার্য করলে, এবং শিল্পবস্তু মানুষের কোনও না কোনও অভাব/চাহিদা পূরণে সক্ষম (যেমন ধরা যাক, নান্দনিক চাহিদা) ও তা বিক্রির জন্য বাজারে হাজির করা হয় নিয়মিতভাবে, এইটুকু মেনে নিলে, শিল্পবস্তুকে পণ্য না ভাবার যুক্তি নেই।

এখন কেউ তাকে ভোগ্য পণ্য (যে সকল পণ্য চূড়ান্ত ভোক্তা ব্যক্তিগত ভোগের উদ্দেশ্য ক্রয় করে) ভাবতে পারেন, কেউ হয়ত লোভনীয় পণ্য (যে পণ্য দোকানে দেখে ক্রেতা ক্রয়ের প্রয়োজন অনুভব করে), বিরল কেউ কেউ নান্দনিক চাহিদায় বড় গুরুত্ব আরোপ করে শিল্পবস্তুকে আবশ্যক পণ্যও (প্রতিনিয়ত আমাদের বাসা বাড়িতে বা চলতে-ফিরতে প্রয়োজন হয় এমন পণ্য) ভাবতে পারেন। কিন্তু পণ্য শব্দটি নিয়ে খুব বেশি সংশয়ের অবকাশ থাকে কি? বিশেষত তা যখন 'বিক্রয়ের নিমিত্ত উপস্থাপিত' হচ্ছে সবসময়ই?? 

এখন দ্বিতীয় প্রশ্ন, বাজার ঠিক কী? আবারও কিছুক্ষণ খুঁজেপেতে জানা গেল -

"বাজার এমনি একটি লেনদেন পদ্ধতি, সংস্থা, সামাজিক সম্পর্ক অথবা পরিকাঠামো যেখানে মানুষ বস্তু বা অন্য কর্ম-দক্ষতা বিনিময় করে সামগ্রিক অর্থনীতিতে অংশগ্রহণ করে। এটি ক্রেতা এবং বিক্রেতার মধ্যে সরাসরি সংযোগ স্থাপনকারী একটি কর্ম ব্যবস্থা।"

বাজার সম্পর্কে ঘেন্নাপিত্তি বিদ্বেষভাব কাটিয়ে উঠে ঠান্ডা মাথায় ভাবলে স্পষ্ট, বাজার একটি প্ল্যাটফর্ম, যেখানে পণ্যের আদানপ্রদান ঘটে। বিক্রেতা ও ক্রেতা, কিংবা শিল্পী ও সংগ্রাহক - বাজার বিনা এঁদের দেখা হতো কোন অলৌকিক পদ্ধতিতে? ঘরে বসে শিল্পীপ্রবর মাস্টারপিস এঁকে রাখলেও দুনিয়া খবর পেত কী করে, বাজারের উপস্থিতি ছাড়া?

শিল্প ব্যাপারটা প্রথম থেকেই রাজানুগ্রহের উপর নির্ভরশীল। রাজার পছন্দমতো বা বরাত-অনুসারে শিল্পীরা শিল্পসৃষ্টি করতেন - দক্ষ কারিগরের তুলনায় আলাদা করে বাড়তি সম্মান তিনি পেতেন না। শিল্পচর্চার মধ্যে দিয়ে শিল্পীর নিজস্ব বোধ মনন বা একান্ত নিজস্ব শিল্পব্যক্তিত্বের প্রকাশ ইত্যকার ভাবনার শুরু ওই রেনেসাঁস পরবর্তী ইউরোপে। একইসঙ্গে, ঠিক সেই সময়েই শিল্পকলার উপভোক্তার শ্রেণীবিন্যাসও বদলাতে শুরু করেছে। সরাসরি রাজানুগ্রহের 'পরে নির্ভরশীলতা কাটিয়ে ধনাঢ্য বণিক ও অভিজাত শ্রেণীর চাহিদা মেটানোর অভিমুখে যাত্রা শুরু করেছে। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে শিল্পের বাজার - অর্থাৎ শিল্পের ক্রেতা ও শিল্পীর বিনিময়স্থল। শিল্পের সঙ্গে শিল্পীর ব্যক্তিত্বের নিবিড় যোগাযোগের কাহিনীর বাড়বাড়ন্তর শুরুটাও ওই সময়েই - সেটা সুনির্দিষ্ট মার্কেটিং স্ট্র‍্যাটেজি কিনা বলা মুশকিল, তবে সেটিই শিল্প বিষয়ে তৎপরবর্তী ধ্যানধারণাকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। এবং সেই যে নড়বড়ে পায়ে শিল্পের বাজার চলতে শুরু করল, আজ তার দাপাদাপি দেখে গা ছমছম করে। পরবর্তী সময়ে শিল্পী ও ক্রেতার মাঝে মধ্যসত্ত্বভোগীরা এসেছেন - গ্যালারি, আর্ট ডিলার, নীলামঘর ইত্যাদি - এবং ধীরে ধীরে তাঁরাই বাজারের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছেন, ক্ষেত্রবিশেষে শিল্পরুচিরও।

বাজার আজ শিল্পের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে কিনা, বা বাজারই আজকাল শিল্পরুচির নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে কিনা - এ নিয়ে তর্কাতর্কির জায়গা অবশ্যই রয়েছে। এবং যদি সেটি সত্যিই ঘটে থাকে, তা যে শিল্পের পক্ষে নিতান্তই দুর্ভাগ্যজনক, সে নিয়ে তর্কের অবকাশও নেই। তারপরও বলা যায়, এমন কুফলকে কারণ ঠাউরে বাজারকেই বাতিল করতে চাওয়া আর জটিল অসুখে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে ওষুধ খাওয়া থেকে বিরত থাকা একইরকম ভ্রান্তি। যদি ধরেই নেওয়া যায় যে শিল্পীরা বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ছবি আঁকছেন, বাজারের অনুপস্থিতিতে তার বিকল্পটি কেমন হতে পারত? আদর্শ ব্যবস্থা বলতে, যেমন ছিল বাজারের আগে? বাজারের অনুগ্রহের পরিবর্তে রাজানুগ্রহ?? 

শিল্পতাত্ত্বিক জন বার্জার অবশ্য মনে করতেন, শিল্পবস্তু, বিশেষত মহান শিল্পকলার নিদর্শনসমূহ, ক্রয়বিক্রয়ের আওতায় আসা অনুচিত, কেননা সেগুলি মানবসভ্যতার মহোত্তম সম্পদ। গ্রেট আর্ট-কে জাতীয় সম্পদ হিসেবে বিবেচনা করে তা থাকা উচিত রাষ্ট্রের অধিকারে - জনগণের অধিকারে। আমি জন বার্জারের শিল্পভাবনার বাড়াবাড়ি রকমের গুণগ্রাহী। কিন্তু তাঁর এই ভাবনাটি মধ্যে - বা বলা ভালো, ভাবনাটি ভালো হলেও সেটি ঠিক কোন পথে বাস্তবায়িত করা যেতে পারে, তার মধ্যে - অল্পবিস্তর ধোঁয়াশা রয়েছে। ধরুন, মহান শিল্প সবসময় যে সমকালেই মহান শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হয়, এমন তো নয়। ততদিন সেইসব ছবি/ভাস্কর্য থাকবে কার অধিকারে? ব্যক্তি-সংগ্রাহকের কাছে এবং সেখান থেকে মহান শিল্প হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর রাষ্ট্রের কাছে হস্তান্তরিত হবে? সেক্ষেত্রে, বাজারের অনুপস্থিতিতে, হস্তান্তরের মূল্য ধার্য হবে কোন নিক্তিতে? নাকি রাষ্ট্র ভালোমন্দ বিচার না করেই, যাবতীয় শিল্পবস্তু রাখবেন নিজের অধিকারে, বা জনগণের অধিকারের অছি হিসেবে? তা কি আদপেই সম্ভব? আর তা যদি অসম্ভব হয়, রাষ্ট্র যদি বেছে শিল্প সংগ্রহ করতে থাকেন, রাষ্ট্রের পছন্দসই শিল্পই সেক্ষেত্রে একমাত্র চর্চা হয়ে উঠবে না? মানে, রাজা কিংবা চার্চের পছন্দসই শিল্প থেকে আধুনিক রাষ্ট্রশক্তির পছন্দের মাপে মানিয়ে নেওয়া শিল্প? অথচ, প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গি ভাবনাকে অতিক্রম করতে পারা - সেই সুবাদে প্রয়োজনে প্রচলিত ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করতে পারা - মহৎ শিল্পকৃতির অন্যতম গুণ? শিল্পকে যদি শেষমেশ রাষ্ট্রদ্বারা মানবিচারের ভরসায় থাকতে হয়, সে তো নিতান্ত দুর্ভাগ্যজনক। (শিল্পবস্তু, বিশেষত কালজয়ী শিল্পকলা, সন্দেহাতীতভাবে মানবসভ্যতার স্থায়ী সম্পদ। সে সম্পদ ব্যক্তিমালিকানাধীন হলে আমজনতার পক্ষে তা দেখতে পাওয়ার সুযোগটুকুও মেলে না। রাষ্ট্র আর্ট মিউজিয়াম করে তেমন শিল্পকে সবার দেখার জন্য খুলে দিক, এটিই কাম্য। কিন্তু রাষ্ট্রের পক্ষে জনগণের অছি হিসেবে কেমন করে তা করে ওঠা সম্ভব, সে নিয়ে ভাবনাচিন্তার সুযোগ রয়েছে। এবং তা বিস্তারিত আলোচনা ও বিতর্কের বিষয়।)

রাষ্ট্রের পরিবর্তে বর্তমানে চালু শিল্পবাজারই শ্রেষ্ঠ ব্যবস্থা কিনা, সে নিয়ে সংশয় থাকতেই পারে৷ কিন্তু, সঠিকভাবে ব্যবহৃত হলে, দোষগুণ মিলিয়ে, দ্বিতীয়টিই যে কম খারাপ বা অধিকতর সম্ভাবনাময়,  সে কথা অস্বীকার না করা-ই ভালো। আপাতত বাজারের উপস্থিতি মেনে নিয়ে এবং অদূর ভবিষ্যতে শিল্পবাজার ব্যাপারটা উধাও হয়ে যাচ্ছে না ধরে নিয়েই কিছু কথা বলা যাক।

সঙ্গতভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, বাজারের অস্তিত্ব শিরোধার্য করলে ক্রেতার চাহিদা মেনে শিল্পসৃষ্টির প্রবণতাও কি অনিবার্য নয়? এক কথায় উত্তর দেওয়া মুশকিল। তবে বাজারটা সর্বস্তরে প্রসারিত ও বিস্তৃত হতে পারলে, বাজারে বিভিন্ন সামর্থ্য ও রুচির ক্রেতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে এবং বাজার নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না হলে, উত্তরটা, সম্ভবত, না। 

আমার প্রিয় তরুণ শিল্পীদের নরম মনে আঘাত লাগতে পারে ধরে নিয়েও উদাহরণটা দিই - যতদিন বাজারে সবধরনের রুচির ক্রেতার আনাগোনা চালু থাকবে, ততদিন বাজারে সব্জিওয়ালা মাছওয়ালা মাংসের দোকান সবই চালু থাকবে। কিন্তু আচমকা পাড়ার সবাই উদ্বুদ্ধ হয়ে ভেগান হয়ে গেলে সব্জিওয়ালা বাদে কারও ব্যবসা চলতে পারবে না। এতে মাছওয়ালা সপরিবারে না খেতে পেয়ে পথে বসবেন, নাকি তিনি মাছের পরিবর্তে সব্জির ঝুড়ি নিয়ে ওই বাজারেই বসবেন, তা আগাম অনুমান করা মুশকিল। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হলো, বাজারকে গালি না দিয়ে বাজারে সর্বস্তরের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাটাই লক্ষ্য হওয়া উচিত। শিল্পবাজারের ক্ষেত্রে, সবধরনের রুচির সবরকম পকেটের ক্রেতার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়া জরুরি। আবার শিল্পের বাজারে অংশগ্রহণের জন্যে বিক্রেতাদের জন্য ধার্য যে চড়া প্রবেশমূল্য, প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ মূল্য - এককথায় এন্ট্রি বেরিয়ার - তা দূর করাও সমান জরুরি। বর্তমান বাস্তবতায় এসব কীভাবে সম্ভব, বা শিল্পবাজারের খোলনলচে না বদলে আদৌ সম্ভব কিনা, সে অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় হতে পারে। এবং আলোচ্য হিসেবে খুবই ভ্যালিড সে প্রসঙ্গ। এগোনোর জন্য সে নিয়ে ভাবনাচিন্তা আলোচনা এই মুহূর্তে নিতান্ত জরুরি।

কিন্তু যতদিন অব্দি শিল্পীরা বাজার ব্যাপারটিকেই নিচু চোখে দেখছেন এবং নিজেদের শিল্পচর্চার এন্ড-রেজাল্টটিকে শিল্পবাজারে বিক্রয়যোগ্য পণ্য হিসেবে ভাবতে বা দেখতে অস্বীকার করছেন, বা অস্বীকার করার মাধ্যমে ভাবের ঘরে চুরি করছেন - অবশ্যই আমি বাজারের 'রুচি' অনুসারী নির্দিষ্ট উদ্দেশ্য নিয়ে শিল্পচর্চাই পথ বা বাজারের স্বীকৃতিলাভই চূড়ান্ত মোক্ষ হোক, এমনতর কথা বলছি না - ততোদিন অব্দি তো পরিস্থিতির কোনোরকম বদলের সম্ভাবনাই আকাশকুসুম, তাই না?

বৃহস্পতিবার, ৩ মার্চ, ২০২২

সন্ত্রাস ~ অর্ক ভাদুরী

তৃণমূল জিতেছে৷ কিন্তু তাঁর পরিবার তৃণমূল প্রার্থীকে সমর্থন করেনি ভোটপর্বে। সেই অপরাধে বাড়ির দরজার এঁকে দেওয়া হয়েছিল তিন বোনের ঝুলন্ত মৃতদেহের ছবি। বুধবার ভোটের ফল বেরনোর পর বাড়িতে চড়াও হয়ে দেওয়া হচ্ছিল ধর্ষণ করে খুনের হুমকি। সঙ্গে বোমাবাজি, দরজায় লাথি। সম্ভাব্য অত্যাচার থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করলেন ১৯ বছরের তুহিনা খাতুন। তাঁর বাবাও তৃণমূলেরই কর্মী। ফ্যাসিবাদ বিরোধিতার স্বর্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে একটি জেলাসদরের ঘটনা।

বর্ধমান পুরসভার ২৭ নম্বর ওয়ার্ড।   তৃণমূল কংগ্রেসের টিকিটে বসিরুদ্দিন ওরফে বাদসা নামে যে ব্যক্তি নির্বাচনে লড়েছিলেন, তাঁকে মেনে নিতে পারেননি এলাকার তৃণমূল কর্মীদেরই অনেকে। মুক্তার মিঞা নামে স্থানীয় এক তৃণমূল নেতার অনুগামীরা বসির আহমেদের বিরোধিতা করেন। তাঁদের বক্তব্য ছিল, বসির তোলাবাজ, এলাকায় ডন হিসাবে পরিচিত। তাঁকে প্রার্থী করা যাবে না।

স্থানীয় বাসিন্দা জুনাই শেখ। তিনিও তৃণমূলের সমর্থক। মুক্তারের অনুগামী। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে দেখতে চান। কিন্তু জোড়া ফুলের টিকিট পাওয়া 'ডন' বসিরকে মানতে পারেননি। গোটা ভোটপর্ব জুড়ে তাঁকে এই বিরোধিতার মাশুল দিতে হয়েছে।

কেমন মাশুল? জুনাই শেখের তিন মেয়ে। তাদের খুন করে গাছে ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি। বাড়ির বাইরে বোমাবাজি। দরজার লাথি। বাড়ির দেওয়ালে একটা গাছে ঝুলন্ত তিনটি মেয়ের ছবি এঁকে দিয়ে গিয়েছেন জোড়া ফুলের নেতা বসিরের কর্মীরা। তিনটি মেয়ে। নিজেদের লাশের ছবি বাড়ির দেওয়ালে নিয়ে থাকছিল এই গোটা ভোটপর্বে। প্রতিদিন শুনত, শুধু ভোটের ফল বেরনোর অপেক্ষা। তারপর এই ছবিটা সত্যি হবে। ধর্ষণ করে ঝুলিয়ে দেওয়া হবে গাছে।

বুধবার নির্বাচনের ফল বেরল। তৃণমূল প্রার্থী বসির জিতে যাওয়ার পরেই শাসকদলের লোকজন জুনাই শেখের বাড়িতে চড়াও হয়। শুরু হয় বোমাবাজি৷ বাড়িতে তখন ছোট মেয়ে তুহিনা খাতুন একা। দরজায় লাথি মারতে থাকে বসিরের বাহিনী৷ দরজা ভেঙে ফেলার উপক্রম। ১৯ বছরের মেয়েটি আতঙ্কে সিঁটিয়ে যায়। তারপর সম্ভাব্য অত্যাচার থেকে বাঁচতে একটি ঘরে ঢুকে গলায় দড়ি দিয়ে আত্মহত্যা করে। তৃণমূলের ঝঞ্ঝাবাহিনী দেওয়ালে যে ছবি এঁকে গিয়েছিল, তা সত্যি হয়ে ওঠে। ১৯ বছরের মেয়ে তুহিনা খাতুন, বর্ধমান রাজ কলেজে বিএ প্রথম বর্ষের ছাত্রী তুহিনা খাতুন, তৃণমূল কর্মী জুনাই শেখের মেয়ে তুহিনা খাতুন তৃণমূলেরই জয়োৎসবের বলি হয়, তার শরীরটা লাশ হয়ে ঝুলতে থাকে বর্ধমান শহরের মাঝখানে।

মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী দাবি করেছেন ভোটে বড় কোনও গোলমাল হয়নি। তিনি ফ্যাসিবাদ রুখতে উত্তরপ্রদেশে গিয়েছেন। মাননীয়া, যে মেয়েটিকে আপনার দলের কর্মীরা লাশ বানিয়ে দিল, সে কিন্তু আপনাকেই মুখ্যমন্ত্রী দেখতে চাইত। তার বাবা আপনার দলেরই কর্মী। এটা যদি বড় ঘটনা না হয়,তাহলে বড় ঘটনা কোনটা, মাননীয়া? 

এ যদি ফ্যাসিবাদ না হয়, তাহলে কাকে ফ্যাসিবাদ বলে? যাঁরা এখনও এই শাসকের বিরুদ্ধে কথা বলতে পারছেন না, ঝুঁকি নিতে চাইছেন না, আপনাদের আয়নার সামনে দাঁড়াতে অসুবিধা হচ্ছে না?

আনিস খান হত্যার বিচার চাই।
তুহিনা খাতুন হত্যার বিচার চাই।

শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

প্রতিবাদের গান, প্রতিরোধের জীবন ~ দেবাশিস মৈত্র

নীচের ছবিটা খুব পরিষ্কার নয়, তবু একবার দেখুন।
বল হাতে নিয়ে দৌড়ে আসছে এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবক। আশেপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিপক্ষের কয়েকজন শ্বেতাঙ্গ খেলোয়াড়, তারা কেউ এই যুবককে আটকাতে পারেনি।
রাগবি খেলার ছবি, অ্যামেরিকানরা যাকে বলে ফুটবল। রাগবি খেলা আমি বুঝি না, এ-খেলায় আমার কোনো আগ্রহ নেই। আপনাদেরও নেই নিশ্চয়ই। তবু ছবিটা একবার দেখুন। নিছক খেলার ছবি নয়, এক নিপীড়িত জাতিসত্তার মাথা তুলে দাঁড়ানোর ছবি।
ছবিটা তোলা হয়েছিল আজ থেকে একশো পাঁচ বছর আগে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অপেশাদার ফুটবল লিগের একটি ম্যাচে।পেশাদার ফুটবল লিগ সেদেশে তখনও চালু হয়নি, এই অপেশাদার টুর্নামেন্ট ঘিরেই তখন দর্শকদের ছিল অফুরন্ত উৎসাহ। এই প্রতিযোগিতায় অ্যামেরিকার সেরা সব কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের দলগুলি তো অংশ নিতই, পাশাপাশি খেলতে আসত বহু ক্লাব, সংগঠন, এমনকী সেনাদলের রাগবি টিমও।
ছবির এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক ছিল রাটজার্স (Rutgers) কলেজ টিমের সদস্য। সে-ই ছিল দলের একমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়, বাকি সবাই শ্বেতাঙ্গ। সত্যি কথা বলতে কি, দু'বছর আগে সে যখন এই কলেজে ভর্তি হয়, তখন প্রথম বর্ষের ১৮৫ জন ছাত্রের মধ্যে সে-ই ছিল একমাত্র নিগ্রো। এখন সে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র; দলের বেশির ভাগ সদস্যই তার সহপাঠী, বাকিরা দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। দলের একজনও তখনও কুড়ি বছরে পা দেয়নি।
উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের উচ্চতা ছ'ফুট তিন ইঞ্চি, ওজন প্রায় একশো কেজি, অসাধারণ পেশিবহুল শরীর এবং সেই শরীরে দানবের মতো শক্তি। তার জন্য অবশ্য এযুগের সেলিব্রিটিদের মতো এই যুবককে কোনদিন জিমে যেতে হয়নি।নিজের পড়ার খরচ চালানোর জন্য ছুটিছাটায় তাকে নানারকম কাজ করতে হত। বড়লোকদের রিসোর্টে বাসন মাজার কাজই তার বেশি পছন্দ ছিল বটে, কিন্তু সবসময় সে-কাজ জুটত না। অনেক সময় তাকে রাজমিস্ত্রির জোগাড়ের কাজ নিতে হয়েছে, সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বাঁশের ভারা বেয়ে রাশি রাশি ইট তিনতলা-চারতলায় তুলতে হয়েছে। সেটাই ছিল তার ব্যয়াম। তাছাড়া গত দু'বছর ধরে ক্লাসের পড়া অথবা রাগবি দলের ট্রেনিং – কোনোটাতেই সে বিন্দুমাত্র ফাঁকি দেয়নি। ছোটবেলা থেকে সে জানত যে এই দেশের সে এক দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। নিছক শ্বেতাঙ্গদের সমকক্ষ হয়ে উঠলে জীবনের কোনো ক্ষেত্রেই সে পাত্তা পাবে না, প্রতিদ্বন্দ্বীদের টপকে আরো অনেক দূর এগোতে না-পারলে তার ভবিষ্যৎ অন্ধকার। আর এই অনেক দূর এগোনোর সাধনার জোরেই সে কলেজের টিমে সুযোগ পেয়েছে, এবং গত দু'বছর ধরে দলের সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে।
সে-বছর পরপর কয়েকটি লিগ ম্যাচ জিতে, এবং একটি ম্যাচ ড্র করে, রাটজার্স মুখোমুখি হয়েছিল এক ভয়ংকর প্রতিদ্বন্দীর – রোড আইল্যান্ডের "নাভাল রিজার্ভ টিম।" পেশাদার সৈনিকদের এই রাগবি দলে রয়েছে, এক-আধজন নয়, এমন আঠারোজন খেলোয়াড় যারা বিভিন্ন সময়ে অল-অ্যামেরিকান রাগবি দলে নির্বাচিত হয়েছে। তাদের মধ্যে থেকেই এগারোজন সেদিন মাঠে নামবে। খেলা শুরুর আগে ড্রেসিং রুমে প্রতিপক্ষের খেলোয়াড়দের দেখে সৈনিকদের হাসি আর থামতেই চায় না! "এরা তো সব স্কুলের ছানাপোনা, এরা আমাদের পাঙ্গা নিতে এসেছে বুঝি?" সেকথা শুনে কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে তার দু'একজন সহ-খেলোয়াড় চুপি চুপি বলেছিল, "একবার উঠে দাঁড়া তো! তোর স্বাস্থ্যটা ওরা একবার দেখুক!" কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটি ভাবলেশহীন মুখে বসে রইল, যেন প্রতিপক্ষের ব্যঙ্গবিদ্রূপ তার কানেই ঢোকেনি। সে তো তখন জানে যে খেলা শুরু হওয়ার পর প্রতিপক্ষের যাবতীয় আক্রমণ তারই উপর নেমে আসবে।অপরাধ? একটিই অপরাধ তার – চামড়ার রঙ কালো। রাগবির মতো নৃশংস খেলা পৃথিবীতে আর একটিও নেই, মুষ্টিযুদ্ধ এর কাছে শিশু। একশো বছর আগের সেই দিনগুলিতে রাগবির নিয়মকানুনও ছিল অনেক শিথিল। অদূর অতীতে রাগবির মাঠে বেশ কিছু প্রাণহানির ঘটনাও ঘটে গেছে। আর শ্বেতাঙ্গ প্রতিপক্ষের নির্দয় আক্রমণের শিকার তো আমাদের কাহিনির এই ছেলেটিকে বারেবারেই হতে হয়েছে। আজও নিশ্চয়ই তার অন্যথা হবে না। নীরবে বসে রইল সে, আর সময় হওয়ার পর চোয়াল শক্ত করে মাঠে নামল।
তার পরের ঘটনার সাক্ষী ছিল সেদিন মাঠে উপস্থিত পনেরো হাজার দর্শক। এগারো জন বাঘা বাঘা অল-অ্যামেরিকান টিমের অভিজ্ঞ খেলোয়াড় হাজার মারধোর করেও উনিশ বছর বয়সী এই কৃষ্ণাঙ্গ ছেলেটিকে সেদিন কোনোভাবেই আটকে রাখতে পারেনি। অবিশ্বাস্য ফল হল খেলার। একদল শ্বেতাঙ্গ সৈনিক "স্কুলের ছানাপোনা"-দের কাছে ১৪-০ গোলে ম্যাচ হেরে মাথা নীচু করে মাঠ ছাড়ল।
সেদিনের ওই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক পরবর্তী জীবনে তার খেলার মাঠ বদলে নিয়েছিল। রাগবি, বেসবল, বাস্কেটবল অথবা ট্র্যাক অ্যান্ড ফিল্ডের জগৎ ছেড়ে সে পা রেখেছিল সংস্কৃতির আঙ্গিনায়। নাটক, চলচ্চিত্র, সংগীত - সর্বত্রই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়েছিল সে, ঠিক সেদিনের রাগবি ম্যাচের মতোই। সংস্কৃতির জগতে সে হয়ে উঠেছিল বিশ্বের সবচেয়ে খ্যাতিমান শিল্পীদের একজন। বহু নাটক আর চলচ্চিত্রে সে অভিনয় করল, স্বদেশের এবং স্বজাতির গানের ডালি নিয়ে ঘুরে বেড়াল গোটা দুনিয়া। কিন্তু তারপর যখন সে কৃষ্ণাঙ্গদের এবং দরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষার লড়াইয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করে বসল, তখন তার মাতৃভূমির রাষ্ট্রনায়কদের টনক নড়ল -  যেভাবে হোক এই বেয়াদব ছেলেকে আটকাতে হবে!
হ্যাঁ, শেষ পর্যন্ত আটকানো গিয়েছিল তাকে। দেশদ্রোহী হিসাবে তাকে ঘোষণা করে তার গান গাওয়ার এবং অভিনয় করার সমস্ত রাস্তা একে একে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেজন্য বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র হিসাবে পরিচিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকারকে সর্বশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হয়েছিল তার উপর। হ্যাঁ, এই কৃষ্ণাঙ্গ যুবকের কণ্ঠস্বর চিরকালের মতো স্তব্ধ করে দিতে পেরেছিল তারা। আর, অবিশ্বাস্য মনে হলেও একথা সত্যি, যে-কৃষ্ণাঙ্গ সমাজের জন্য তার জীবনভোর লড়াই, শেষের দিনগুলিতে তাদেরও আর তার পাশে দেখা যায়নি।
আজ থেকে ছেচল্লিশ বছর আগে, ১৯৭৬ সালের ২৩শে জানুয়ারি, নিজের প্রিয় শহর থেকে অনেক দূরে তাঁর দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে কয়েক বছর কাটানোর পর শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিলেন নিঃসঙ্গ পল রোবসন।
## দেবাশিস মৈত্র
তথ্যসূত্রঃ
1. Robeson, Paul. "Here I stand." Beacon Press, Boston. (1958)
2. Hamilton, Virginia. "Paul Robeson: the life and times of a free black man." Harper Collins. (1974)
3. Duberman, M. B. "Paul Robeson." Alfred A. Knopf. (1988).
4. Boyle, S. T. and A. Bunie. "Paul Robeson: the years of promise and achievement." University of Massachusetts Press. (2005)
5. Swindall, Lindsay R. "Paul Robeson: A life of activism and art." Rowman & Littlefield, reprinted 2015.
6. Horne, G. "Paul Robeson: the artist as revolutionary." Pluto Press. (2016)
সঙ্গের ছবিটি উপরের তালিকার চতুর্থ বইটি থেকে নেওয়া।
পল রোবসনের কণ্ঠে একটি নিগ্রো স্পিরিচুয়ালের লিংক দিলাম। সঠিক জানি না, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় যে শেষ জীবনে দিদির বাড়িতে স্বেচ্ছা-নির্বাসনে বাস করার সময় এই গানটি পল বারবার শুনতেন।

আনিশ খান ও রাজনীতি ~ সুশোভন পাত্র

এক্সিকিউজ মি! মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! আলিয়ার আনিশ থেকে ক্লাসিক্যালের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হয়ে ডিক্সো ড্যান্সর বাপি লাহিড়ী -রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি 'ইনসাফ' চাইবেন, উনিই 'ইনসাফ' দেবেন! উনি রিজওয়ানুর মা কে নিয়ে মিছিল করবেন। রেলের যাত্রী পরিষেবা কমিটিতে হালকা করে গুঁজে দেবেন। রিজওয়ানুরের ভাই রুকবানুর তৃণমূলের বিধায়ক হবেন। 'ইনসাফ' মামলা আদালতে রুকবানুরের সাক্ষ্যের অভাবে ঝুলে থাকবে। লাক্স কোজির কোটিপতি মালিক অশোক টোডি তৃণমূলের মাড়োয়ারি সেলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হবে। 'ইয়ে আন্দর কা মামলা হ্যা'-র ক্যাচলাইন লেপটে, তৃণমূল সরকার রিজওয়ানুর কাণ্ডে অপসারিত অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের জ্ঞানবন্ত সিং-র পদন্নোতি ঘটাবে। আর আনিশ খুনের তদন্তে গঠিত সিটের মাথায় ঐ জ্ঞানবন্ত সিং-ই আলো করে বসবে! 
দার্জিলিংয়ের একচিলতে রোম্যান্টিক গ্রাম সিরুবাড়ির পাহাড়ি বাঁকের পাইন ফরেস্টে পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক খুন হয়েছিলে বিমল গুরুংর গুণ্ডা বাহিনীর গুলিতে। লাখ টাকায় স্ত্রী বিউটি মালিকের শোক বিহ্বল আর্তনাদ বিক্রি হয়েছিলে মিডিয়ার টিআরপি বাড়াতে। স্বামীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে বিউটি রাজ্য পুলিশের ডিজিকে বলেছিলেন, "স্যার, আমার সব শেষ! বিমল গুরুং-র মাথায় গুলি করুন!" তারপর বিমল গুরুং পলাতক হলেন!  দিল্লিতে বিজেপি নেতা জেপি নাড্ডার মেয়ের বিয়েতে চেটেপুটে ভোজ খেলেন। আর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ৬ মাস আগে 'পলাতক' বিমল গুরুং মমতার সাথে গোপন বৈঠক সেরে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরলেন! বিমল গুরুং বললেন স্বাধীন গোর্খাল্যান্ডের ইস্যুতে মমতাই 'আইডল'!
আর আপনি আলিয়ার আনিশ তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন করত বলে রাজনীতি করছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহপালিত মিডিয়া, পুলিশ আর বুদ্ধিজীবীরা! কলকাতা টিভির কর্ণধার কৌস্তুভ রায় মধ্যরাতে আনিশের বাড়িতে যাবেন। 'মুখ্যমন্ত্রীর পিএ' পরিচয় দেবেন। চাকরি, টাকা, পুলিশি নিরাপত্তা -টোপ দিয়ে ভিক্টিম ফ্যামিলিকে কেনার মিডলম্যান হিসেবে ভাড়া খাটবেন। কোন কৌস্তুভ রায়? ব্যবসায়ী আরপি গ্রুপের চেয়ারম্যান কৌস্তুভ রায়! দিল্লির চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আর্থিক তছরুপের মামলায় অভিযুক্ত জেল ফেরত আসামি কৌস্তুভ রায়! চিট ফান্ড কাণ্ডে কোটি টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কেনায় ঘটনায় ইডির লুক আউট নোটিস জারি হওয়া শিবাজী পাঁজার 'বুজম ফ্রেন্ড' কৌস্তুভ রায়। মমতা দরদী সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের ভাষ্যে 'চোরি চোরি চুপকে চুপকে' 'নো ভোট্টু' বাবুদের গ্লুইং ফ্যাক্টর কৌস্তুভ রায়! 
পুলিশের গাড়ি রাত একটার পরে আনিশের গ্রামে যাবে। চাইলে বাড়িতে ঢুকবে! আনিশ লাশ হয়ে পড়ে আছে জেনেও ৯ ঘণ্টা পর টনক নড়বে। চার জন মার্কা মারা সিভিক পুলিশ বেমালুম ফেরার থাকবে। সিভিক একজন রসপুরের তৃণমূলী পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের ছেলে বেরোবে। বাকি তিনজনকে এলাকার লোক সিভিক কম আর তৃণমূলের মস্তান হিসেবেই বেশি চিনবে। লরি, গাড়ি থেকে টাকা আদায় করবে। পুলিশের পোশাক ফাইন করবে, তোলা তুলবে, ভোটের সময় ছাপ্পা মারবে। আর সোনারপুর বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক লাভলি মৈত্র-র স্বামী সৌম্য রায় হাওড়ার গ্রামীণ পুলিশের সুপার সেজে জাস্ট নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে! 
বুদ্ধিজীবীরা কেউ চেয়ার মুছবেন, কেউ পাগলু নাচবেন, কেউ নন্দনে দুলবেন, কেউ আবার কাক আঁকবেন। আর সিলেক্টিভ প্রতিবাদে মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে হয়ে, "পাগলী, তোমার সঙ্গে সরীসৃপ জীবন কাটাব" বলে কোরাস গাইবেন! এটা কি সিপিএম-র সরকার নাকি যে আলিয়ার আনিশ মরলে 'ইনসাফ' চাইবেন? ফেস্টুনে-ব্যানারে প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়বেন? রাজপথে মিটিং-মিছিল-জনসভা শেষে বিসেলারির মিনারেল ওয়াটারে স্বস্তির চুমুক দেবেন? সন্ধেবেলা রিমলেস চশমা চাপিয়ে টক শো তে সরকারের বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে ডিনারে টেবিলে গোপন বৈঠক সারবেন? রাত্রে দক্ষিণ কলকাতার পশ ফ্ল্যাটে একটা সাউন্ড স্লিপ। কাল আবার ধর্না মঞ্চ? সিঙ্গুরের 'অনিচ্ছুক'রাই তো আসলে 'আইস অন দি কেক'। শিল্পের বদলে মাছের ভেড়ি হলেই কি গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরা মেরুদণ্ড খুঁজে পাবেন?
আর আপনি আলিয়ার আনিশের খুনে মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? পুলিশের ভূমিকায় বিক্ষোভ দেখিয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন? বুদ্ধিজীবীদের শিরদাঁড়া হাতড়ে বেড়াচ্ছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি ভোটের জন্য মুসলমানদের অন্য ক্যামেরা 'দুধেল গরু' বলবেন। সাপের মুখে চুমু খেয়ে, মস্তান মৌলবি তহা সিদ্দিকিদের পুষবেন! ব্যাঙের মুখে চুমু খেয়ে, ফিচেল দাঙ্গাবাজ মোহন ভাগবত কে উস্কানি দিতে কলকাতায় সভা করতে দেবেন। ভোটের জন্য হিজাব পরবেন, CAA-NRC বিরুদ্ধে নিজের সাংসদদের পার্লামেন্টে ভোটদানে বিরত রাখবেন। আর সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে কে লবডঙ্গা দেখিয়ে, আনিশ মরলে 'ফেভারিট' বলে একটা সিট ঠুকে দেবেন! ঐ সিগারেটে ট্যাক্স বসিয়ে চিটফান্ডের টাকা ফেরত দেওয়ার সিট! কুণাল ঘোষ কে চিটফান্ডে কাণ্ডে গ্রেপ্তার করে তৃণমূলের মুখপত্র বানানোর সিট!
খুব বেশি হলে কমিশন! কমিশন গড়তে আবার বড্ড ভালোবাসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশন'দের। রাজারহাটের কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ। দিনের শেষে সিপিএমের কেশাগ্র স্পর্শ না করা গেলেও কমিশনগুলোর অশ্বডিম্ব প্রসবে খরচা হয়েছিল ৫ কোটি!
রাজ্যের পুলিশ, সিট, কমিশন -সবটাই আইওয়াশ! আসলে চুনোপুঁটিদের সাসপেন্ড-গ্রেপ্তার করে আনিশ কাণ্ডের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার রেসিপি সাজাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সদ্য সন্তানহারা পরিবারের জেদ দেখে খেই হারাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আনিশের গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ কে ভয় পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। পোষা পুলিশ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীদের নেক্সাসের বিরুদ্ধে বাঙলার যৌবনের প্রতিস্পর্ধা কে রাস্তায় দেখে প্রমাদ গুনছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই স্ফুলিঙ্গ যে জঠরে দাবানল হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধরছে বিলকুল বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের শেষের শুরুর দেওয়াল লিখনটা আসলে স্পষ্ট পড়তে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। 
আর তাই মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আনিশ কাণ্ডে বিক্ষোভ-আন্দোলন-রাজনীতি উনি পছন্দ করছেন না! ডিয়ার মুখ্যমন্ত্রী, অকারণ আপনার অপছন্দ নিয়ে চাপ নেবেন না। কারণ আমরাও তো আপনাকে পছন্দ করছি না!

সোমবার, ২১ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

ভাষা হোক উন্মুক্ত! ~ সেখ সাহেবুল হক

-'তোর তৈরী সফটওয়্যারের দাম কত রাখবি?'

-'দাম রাখবো কেন? কোনো টাকা পয়সা দিতে হবে না। ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?'

এক সিনিয়রকে এভাবেই বলেছিলেন ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের এক তরুণ। কালক্রমে তাঁর তৈরী সফটওয়্যার ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লেখার পন্থাকে খুব সহজ এবং সরল করেছে। 'ami ekjon bangali' টাইপ করলে খুব সহজেই বাংলায় 'আমি একজন বাঙালি' লেখা হয়ে যায়। এর অবদান বাঙালি সন্তান মেহদী হাসানের। 


একসময় কম্পিউটারে বাংলা লেখা ছিল বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। টাইপ শেখার মতো বাংলা টাইপ শিখতে হতো। আস্তে আস্তে সড়গড় হয়ে তারপর বাংলা লেখা যেতো। মেহেদী হাসানের  সফটওয়ারের দৌলতে বাংলা লেখা খুব সহজ হলো। কম্পিউটার ছাড়াও স্মার্টফোনে বাংলা লেখার কৌশল আজ আমাদের হাতের মুঠোয়। ফেসবুক স্ট্যাটাস-কমেন্ট ছাড়াও হোয়াটসঅ্যাপ বা অন্য যোগাযোগ মাধ্যমে বাংলা লিখে ভাব বিনিময় সহজ হয়েছে। সর্বোপরি, বাঙালি সাধের খিস্তিখেউড় বাংলায় করতে পারে। বাংলা হরফে গালাগালির স্বাদই আলাদা। যিনি খান, তিনি যেমন ঠিকঠাক স্বাদ পান, আবার যিনি দেন, তিনিও যথাযথ সুখ পান।   

 
বইমেলা উপলক্ষে ২০০৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলাদেশের বাংলা অ্যাকাডেমি চত্বর সেজে উঠেছিল বইয়ের স্টলে। সেবার বইমেলায় 'বাংলা ইনভেনশ থ্রু ওপেন সোর্স', সংক্ষেপে 'বায়োস' নামে একটি সংগঠন অংশগ্রহণ করে। এই সংগঠনের সদস্যরা মেলায় সম্পূর্ণ বাংলায় 'লোকালাইজ করা' একটি লিনাক্স ডিস্ট্রোর প্রদর্শনী করেছিলেন। যার পোশাকি নাম ছিল 'বাংলা লিনাক্স'।

'বাংলা লিনাক্স' -র সাহায্যে বাংলা লেখার পাশাপাশি উইন্ডোর টাইটেল, মেনু বা ফাইলের নামকরণ সবই বাংলায় করা যায়। দুর্দান্ত সিস্টেমটি সবার নজর কেড়েছিল। কারণ বাংলা লেখার জন্য প্রচলিত কীবোর্ড গুলিতে সহজে বাংলা লেখা যেত না। অপারেটিং সিস্টেমটিও সম্পূর্ণ বাংলায় ছিল না।

 
'বায়োস' এর প্রদর্শনীতে একটি ছেলে দাঁড়িয়েছিল, প্রোগ্রামিংয়ে যার ভীষণ আগ্রহ ছিল। সে বাড়ি ফিরেছিল প্রদর্শনীর ব্যাপারে ভাবতে ভাবতে। এরপরই কীভাবে এমন একটা কিছু বানানো যায়, যা দিয়ে অতি সহজে সকলে বাংলা লিখতে পারা যাবে, এই স্বপ্ন তাড়িয়ে বেড়ায় তাকে। বইমেলার সেই ছেলেটিই ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজের ছাত্র মেহদী হাসান খান। অভ্র সফটওয়্যার আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে যিনি বাংলা লেখায় নিঃশব্দ বিপ্লব এনেছিলেন। 

 

প্রথমে মেহদী 'বায়োস' এর লিনাক্স নিয়ে চর্চা শুরু করেন। কিন্তু তাঁর কম্পিউটারে উইন্ডোজ থাকায়, বাংলা লিনাক্স দিয়ে কাজ করতে পারছিলেন না। প্রোগ্রামিংয়ে নিবেদিতপ্রাণ ছেলেটির মনে এই ব্যাপারটি নিয়ে তীব্র কৌতুহল ছিলো। সেজন্য বাংলা লিনাক্সের ওই ফন্টটি ইনস্টল করেন। এসময় তার নজরে এলো একটি গুরুত্বপূর্ণ জিনিস। মাইক্রোসফট ওয়ার্ড কীবোর্ডের ইনসার্ট ক্যারেক্টার ব্যবহার করে ওই ফন্টের ক্যরেক্টারগুলো আনা সম্ভব এবং তা বেশ ভালো কাজ করে। তবে এটি বেশ সময়সাপেক্ষ ব্যাপার, বিরক্তির উদ্রেক করে। মেহদী চাইছিলেন বাংলা লেখার এমন একটি সিস্টেম, যার সাহায্যে যে কেউ সহজেই বাংলা লিখতে পারবেন। 

 
ক্রমশ মেহদী উপলব্ধি করলেন, তাঁর একটি কীবোর্ডের প্রয়োজন, যার সাহায্যে ইউনিকোড দিয়ে খুব সহজেই বাংলা লেখা যাবে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পেলেন না তিনি। তিনি বুঝতে পারলেন, এমন কীবোর্ড পেতে হলে তাঁকেই তৈরি করতে হবে।

 
ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজে পড়াশোনার মাঝে তাঁকে সৃষ্টির নেশা গ্রাস করলো। নাওয়া-খাওয়া ভুলে হোস্টেল রুমের দরজা জানালা বন্ধ করে সারাক্ষণ বসে বসে কী যেন করতে লাগলেন! শিক্ষকরা এবং সহপাঠীরা ভাবলেন, ছেলেটা মায়ের ভোগে গেল!
একদিকে পড়াশোনা অন্যদিকে ইউনিকোডভিত্তিক কীবোর্ড বানানোর চেষ্টা। এভাবেই একদিন মেহদী তৈরি করে ফেললেন একটি প্রোটোটাইপ।

 
এই অ্যাপ্লিকেশনটি মেহদী প্রথমে বানিয়েছিলেন মাইক্রোসফটের ডটনেট ফ্রেমওয়ার্ক ব্যবহার করে। কারণ অ্যাপ্লিকেশনটি তিনি বানিয়েছিলেন উইন্ডোজের জন্য। এইসময় ভারতে আয়োজিত বাংলা ফন্ট তৈরির একটি প্রতিযোগীতায় মেহদী নিজের তৈরি প্রোটোটাইপটি বাংলাদেশ থেকে পাঠালেন। মেহদীকে উদ্যোক্তারা জানালেন, তাঁর তৈরি প্রোটোটাইপটি ঘন ঘন ক্র্যাশ হচ্ছে।

 

মেহদী এবার ডটনেট বাদ দিয়ে 'ক্ল্যাসিক ভিজু্য়্যাল' এর ওপর ভিত্তি করে আবার একটি প্রোটোটাইপ তৈরি করলেন। আর ক্র্যাশের সমস্যা রইলো না। আর এভাবেই তৈরি হলো অভ্রর বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক। সফল হলো বইমেলায় 'বায়োস' এর তৈরি ফন্ট দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে শুরু করা মেহেদীর যাত্রা।

মেহদীর তৈরী অভ্রর ওয়েবসাইটটির নাম ওমিক্রন ল্যাব। অভ্রর সঙ্গে ওমিক্রন ল্যাবের জন্ম। অভ্রর এই অফিসিয়াল সাইট 'ওমিক্রন ল্যাব' কে ছড়িয়ে দেওয়াটা ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। সাইটটিকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতেও তাঁকে বেশ পরিশ্রম করতে হয়।

 

পড়াশোনায় অমনোযোগী মেহদীকে কয়েকজন শিক্ষক এবং পরিচালন কমিটির লোকজন একসময় মেডিকেল ছেড়ে দিতে বলেন বলেও শোনা যায়। কিন্তু তিনি তখন সাইটে নিয়মিত আপডেট দিতে, ম্যানুয়াল লিখতে, ভার্সন নম্বর বাড়াতে এবং ব্যবহারকারীদের প্রশ্নের উত্তর দিতেই ব্যস্ত। এভাবেই কালক্রমে অভ্র পৌঁছে যায় ব্যবহারকারীদের কম্পিউটারে। 'কম্পিউটার টু-মরো' নামের একটি মাসিক পত্রিকায় সেই খবর প্রকাশিত হয়।

 

এই কর্মকাণ্ড মেহদী একা শুরু করলেও চলার পথে তিনি সঙ্গে পেয়েছিলেন দেশ বিদেশের বন্ধুদের। অভ্রর ম্যাক ভার্সন প্রস্তুতকারী রিফাত উন নবী, অভ্রর কালপুরুষ ও সিয়াম রুপালী ফন্টের জনক সিয়াম, অভ্রর বর্তমান ওয়েবসাইট ও লিনাক্স ভার্সন প্রস্তুতকারী সারিম এবং মেহদীর স্ত্রী সুমাইয়া নাজমুনসহ আরো অনেকের সহযোগিতা পেয়েছিলেন মেহেদী।   

 

'ভাষার জন্য টাকা নেবো কেন?' বলা তরুণটি শেষ পর্যন্ত সত্যিই তাঁর নিজ মাতৃভাষাকে উন্মুক্ত করে দিয়েছেন সকলের জন্য। অভ্র কীবোর্ড পোর্টালটি বিনামূল্যে উন্মুক্ত করেন তিনি। তথ্য প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষা উন্মুক্ত হতে থাকে। তৈরী হয় ডিজিটাল মাধ্যমে ভাষার নতুন ইতিহাস।

 
স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত সর্বত্রই অভ্র বিনামূল্যে ব্যবহৃত হচ্ছে। বিনামূল্যে বাঙালি ডিজিটাল মাধ্যমে বাংলা লিখতে পারছে, প্রচারবিমুখ মেহদীর স্বপ্ন সফল হচ্ছে প্রতিটি অক্ষর টাইপের মধ্য দিয়ে। তাঁর স্লোগানই ছিল, 'ভাষা হোক উন্মুক্ত'।

মেহদী হাসান খানের সফটওয়্যার অভ্র বাংলা ভাষাকে দিয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে বাংলাভাষায় লেখালিখি করার চটজলদি সুযোগ। বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে স্বীকৃতি না পেলেও মেহদী পেয়েছেন বেশ কিছু সম্মাননা। মাইক্রোসফটের অনলাইন সংগ্রহশালায় ইন্ডিক ভাষাসমূহের সমাধানের তালিকাভুক্ত করা হয়েছে অভ্র কীবোর্ডকে। 
অভ্রকে বাংলা কীবোর্ড রিসোর্স হিসেবে ইউনিকোড সংস্থার ওয়েবসাইটে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এছাড়া বাংলা তথ্য প্রযুক্তিতে বিশেষ অবদানের জন্য 'অভ্র টিম' কে বেসিস বাংলা থেকে দেওয়া হয় 'স্পেশাল কন্ট্রিবিউশন' পুরস্কার। ২০১৬ সালে মেহদী হাসান টপ টেন 'আউটস্ট্যান্ডিং ইয়ং পার্সনস' হিসেবে স্বীকৃতি পান।  

শিক্ষকদের আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণিত করে ভালো ফল নিয়ে উত্তীর্ণ হলেও চিকিৎসাকে পেশা হিসেবে নেননি। তিনি প্রোগ্রামিংয়ের নেশাকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন।

বাংলা ভাষাকে ডিজিটাল মাধ্যমে উন্মুক্তকারী মেহদী হাসান খান একজন 'যথাযথ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি না পাওয়া ভাষা সৈনিক'। সালাম, বরকত, জব্বারদের উত্তরসূরী মেহদী। তিনিও লড়াই করেছেন বাংলা ভাষাকে উন্মুক্ত করার স্বপ্ন নিয়ে। অনেকাংশেই তিনি সফল। 

কিন্তু আজও তাঁর বানানো সফটওয়্যার ব্যবহার করে যখন কেউ লেখেন, 'মোল্লারা কবে বাঙালি হলো?' অথবা 'বাংলাদেশি' শব্দ বিকৃত করে গালাগালি দেওয়া দেখলে মনেহয়, আমাদের আরও লড়ে যেতে হবে, মাতৃভাষার জন্য, বাঙালিয়ানার জন্য। যতদিন বাংলা ভাষা থাকবে, ভাষার ইতিহাস থাকবে, বাঙালি সন্তান মেহদী হাসান থাকবেন! ডিজিটাল মাধ্যমে অভ্র ব্যবহার করে লেখা প্রতিটি বাংলা অক্ষর তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে যাবে অজান্তেই।  

তথ্যসূত্রঃ বিভিন্ন বাংলাদেশি ওয়েবসাইট। লেখার মূল তথ্যগুলো সেখান থেকেই ধার করা।

মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

হিজাব নিয়ে বিতর্ক ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

২০১৪ সালে ফরাসী আদালত সর্বসাধারণের চলাচলের স্থান থেকে ক্রিসমাসের সময়ে যীশুর জন্মের দৃশ্য নিষিদ্ধ করেছিল। ফরাসী আইন অনুসারে, স্কুল, হাসপাতাল এবং স্থানীয় কাউন্সিলের মতো সরকারি স্থানে ধর্মীয় চিহ্ন থাকতে পারে না। যীশুর জন্মের দৃশ্য একটি 'ধর্মীয় প্রতীক' এবং 'পাবলিক স্পেসে ধর্ম নিরপেক্ষতা রাখতে হবে'- এই ফরাসি নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

বলে রাখা ভাল, ২০১৭ সালের পিউ রিসার্চ অনুসারে ফ্রান্সের ৫৪% নিজেদের খ্রিস্টধর্ম অনুসারী বলে দাবি করেছে। তার মধ্যে ৪৭% ক্যাথলিক চার্চের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ তারা যীশু ও মেরির বিভিন্ন প্রতীকচিহ্নকে পূজা করেন। ২০০৪ সালে ওই একই দেশে সরকারি স্কুল এবং হাসপাতালগুলিতে স্পষ্ট ধর্মীয় চিহ্নগুলির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে। সেই সময়ে ওই দেশের শিখ সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

একটা দেশের নীতি-আদর্শ তৈরী হয় বহু ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে। ফ্রান্সের ইতিহাস বড়ই জটিল। একদিকে আছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা; আবার ওই দেশই প্রথম সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা একসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। 

আমাদের দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের তুলনা করা যায় না, উচিতও না। আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার ইতিহাস কণ্টকাকীর্ণ। এখানে শিক্ষায়তনে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহৃত হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৯৫ সালে রুরকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্স গিয়ে অবাক হয়েছিলাম সরস্বতী বন্দনা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনায়। এদিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। 

দেশটা বড়, এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে আছে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে কিছুদিন পড়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি আমাদের সময়ে সেখানে বাঙালি মুসলমান বন্ধুদের হিজাব পরতে দেখিনি। আবার উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের বন্ধুরা কিন্তু পরত। দেশের মুসলিমরাও কোন একশৈলিক চিন্তা ভাবনা করেন না। 

যেদিন সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারব, সেদিন শিক্ষায়তনে হিজাব বা মাথায় ধর্মীয় পাগড়ি বা সরস্বতী বন্দনা সবকিছুরই বিরোধিতা করতে হবে।

যতদিন না তা হচ্ছে, ততদিন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কী করবেন? 

ততদিন হিজাব পরার জন্য কোন নারীকে একদল মনুষ্যেতর তাড়া করলে তাদের দিকে তেড়ে যেতে হবে, মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে মেয়েটির সুরক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্র তা না দিতে পারলে মেয়েদের নিজেদের মত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
 
আর আমরা? ধর্মনিরপেক্ষরা? আমরা কি তবে হিজাব পরাকে সমর্থন করব? আমরা কি আমাদের প্রতিবাদের ভাষা পাল্টে দেব? 

কখনই না।  

হিজাবের সঙ্গে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন যুক্ত। ইরানের  আয়াতোল্লা খোমেইনীর আগমনের পরে নয় বছরের বড় শিশু, কিশোরী, মহিলাদের আবশ্যিকভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। এর প্রতিবাদে হাজার হাজার নারী-পুরুষ একত্রিতভাবে প্রতি বুধবার মিছিল করছেন, প্রকাশ্যে হিজাব খুলে দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের আশংকা থাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে আটকে রাখবে, বিচারের নাম হবে প্রহসন। তবু তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

একসময়ে এই দেশে নারীরা সতী হয়েছেন। তবে আজ আর নারী সতী হবার প্রয়োজন বোধ করেন না, নিরামিষ আহার খাবার কোন ইচ্ছা পোষণ করেন না। হিজাব পরা কোন নারীর স্বাধীন অভিব্যক্তি নয়। এই ইচ্ছা আসলে সামগ্রিক সমাজের ইচ্ছা, এক কঠিন অনুভব। সমূহের বোধ ব্যক্তির ইচ্ছা হয়ে গোপনে চারিয়ে যায় মানুষ থেকে মানুষে। যেমন চারিয়ে গেছে ব্রাহ্মণকে অব্রাহ্মণের প্রণামে।

মেয়েটি তার মত করে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র নগ্নভাবে বিভাজনের রাজনীতি করছে। আমরা কেউ তার পাশে থাকতে পারিনি। আমরা প্রতিবাদী মেয়েটিকে মুখের ভাষা জোগাতে পারিনি। এটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সামগ্রিক ব্যর্থতা। এই ভাষা জোগাতে হবে। নয়তো দশা হবে ইরানের টুদে পার্টির মত। ইসলামিক বিপ্লবের পর ১৯৮২ থেকে এই পার্টি ওই দেশে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ নিহত অথবা কারাগারে। 

একটি ধর্মীয় জিগিরকে বন্ধ করতে অন্য ধর্মীয় জিগির তুলে অসাম্প্রদায়িক উদার চিন্তার বিকাশ সম্ভব নয়। আর যাই হোক, এতে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই করা যায় না। 
নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায় না।

দেশের এই ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির সময়ও সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না, এখনও এমনকি দেশের বাম শক্তি একত্রিত হতে পারল না।
সেই কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল। 

দেশটা বাঁচে। মেয়েটি বাঁচে। আমরা বাঁচি।


08/02/2022

"হিজাব একটি বিতর্ক" ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

হিজাব কি একটি অমানবিক সামাজিক প্রথা? অমানবিক বলতে আমরা সাধারণত বুঝি, যে সামাজিক প্রথা মানলে দেহ ও মনের অপূরণীয় চূড়ান্ত ক্ষতি হয় যেমন সতীদাহ বা সহমরণ প্রথা বা তিন তালাক প্রথা বা মেয়েদের খতনা ইত্যাদি ইত্যাদি। মাথায় সিঁদুর দিলে বা পাগড়ি বাঁধলে বা গলায় পৈতে ঝোলালে বা হিজাব পরলে আপাতদৃষ্টিতে ততটা ক্ষতি হয় বলে আমাদের মনে হয় না। কিন্তু ক্ষতি যে হয় সেটা  অনেকেই মনে করেন এবং তাদের যুক্তিতে সারবত্তা আছে এটা বুঝে নিয়েই আলোচনাটা শুরু করা যেতে পারে।

এ প্রসঙ্গে এটা মনে রাখতে হবে যে হিজাব নিষিদ্ধ করার, বিশেষত বিদ্যায়তনে নিষিদ্ধ করার সপক্ষে যারা আছেন তারা একটা যুক্তি খাড়া করেন যে এর ফলে ছাত্র ছাত্রীদের যে ইউনিফর্ম পরে আসার প্রচলন আছে, সেটা নষ্ট হবে, ডিসিপ্লিন নষ্ট হবে। এর বিরুদ্ধে দুটো কথা বলার। প্রথমত সারা পৃথিবী জুড়ে এমন অসংখ্য স্কুল আছে যেখানে ইউনিফর্মের কোনো বালাই নেই। সে সব ছেলেপুলের লেখাপড়া হচ্ছে না, তাদের ভবিষ্যত ঝরঝরে হয়ে গেছে এমনটা নয়। দ্বিতীয়ত ভারতের সবচেয়ে শৃঙ্খলাবদ্ধ ফোর্সের দিকে তাকানো যাক, ভারতীয় সেনাবাহিনী। তাতে দিব্যি বছরের পর বছর ধরে একদল সৈন্য মাথায় পাগড়ি বেঁধে আসছে। এর জন্য সেনাবাহিনীর ডিসিপ্লিন নষ্ট হয়ে গেছে এমন দাবি অতি বড় পাগলেও করবে না। 

এ প্রসঙ্গে কর্ণাটক সরকার "পাবলিক স্পেস" এর কথা তুলেছে। তাদের যুক্তি স্কুল যেহেতু পাবলিক স্পেস সে জন্য বাড়ি থেকে হিজাব পরে এলেও সেটা খুলে স্কুলে ঢুকতে হবে। ওই একই যুক্তিতে বলা যায় যে তাহলে এবার থেকে নিয়ম করা হোক যে লোকসভা বা বিধানসভায় বা মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে গেরুয়া পরে আসা যাবে না, ওটা খুলে অন্য কাপড় পরে ঢুকতে হবে। 

হিজাব কি চয়েস? এই মানবিক/ অমানবিক  প্রসঙ্গে এই চয়েস বিষয়টিও উঠে আসে বারেবারে। বাড়ি/পরিবার থেকে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, মানা/ না মানার কোনো সুযোগ নেই এমন নিদর্শন এর পাশাপাশি স্বেচ্ছায় হিজাব পরেন তারও কিন্তু নিদর্শন আছে। যারা চয়েস করেছেন তাদের সবার চয়েস যে informed choice এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। যারা মনে করেন যে হিজাব অমানবিক তারা বড়জোর ওই ইনফর্মেশন ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে পারেন, সংবিধান প্রদত্ত বাক স্বাধীনতার অধিকারকে কাজে লাগিয়ে জনমত তৈরির চেষ্টা করতে পারেন যেমনটা হয়েছিল তিন তালাকের সময়। কিন্তু গায়ের জোরে হিজাব পরা বন্ধ করতে পারেন না। 

হিজাব কি একটি পুরুষতান্ত্রিক প্রথা? যারা নিজেদের কিঞ্চিৎ আলোকপ্রাপ্ত শিক্ষিত ইত্যাদি মনে করেন তারা সবাই মিলে রে রে করে তেড়ে আসবেন। এটা কোনো প্রশ্ন হল? সব্বাই জানে যে এটা পুরুষতান্ত্রিক প্রথা, এ নিয়ে আলোচনার কোনো অবকাশই নেই। গোল বেঁধে যায় এইখানেই। প্রথাটি যে পুরুষতান্ত্রিক সেই বক্তব্য মেনে নিয়েই এই অবকাশ থেকে যায় যে এই মতামতটা রাষ্ট্র বা সরকার এর পক্ষ থেকে চাপিয়ে দেওয়া যায় কি না। মানুষকে নিজেকে নিজের মতো করে উপলব্ধি করার সুযোগ না দিয়ে, জনমত গঠন না করে এ ভাবে চাপিয়ে দিলে যেটা হয়, যে আইডেন্টিটি ক্রাইসিস এ ভোগা মানুষ তার এথনিক কালচারাল আইডেন্টিটিকে আরো বেশি করে আঁকড়ে ধরে, সেটা ভালো না খারাপ বিচারে না গিয়ে, বিশেষ করে সেই মানুষজন যারা যেদেশে সংখ্যালঘু। 

আরো মস্ত ফাঁকির জায়গা এখানেই যে হিজাব পুরুষতান্ত্রিক বলে চিল্লানোর দলের একটা বড় অংশ সিঁদুর শাঁখা নিয়ে একেবারেই চুপচাপ। যে রাজনৈতিক দল হিজাব নিষিদ্ধ করতে কোমর বেঁধে লেগেছে, তাদের দিকে তাকালেই এই চরম দ্বিচারিতাটা স্পষ্ট হয়ে যাবে। এই আলোকপ্রাপ্তির ধ্যান ধারণাটা আমরা যে পাশ্চাত্য থেকে পেরেছি তার তথাকথিত আলোকপ্রাপ্ত নারী পুরুষদের একটা বড় অংশ ভিয়েতনাম বা ইরাকে নির্বিচারে তাদের সেনা দ্বারা হত্যালীলা নিয়ে সম্পূর্ন নীরব ছিল। 

হিজাব পরার কী সাংবিধানিক অধিকার আছে? সংবিধানে সরাসরি ভাবে হিজাব পরার কোনো উল্লেখ নেই, থাকার কথাও ছিল না। Article 25(1) এ সুস্পষ্ট ভাবে বলা আছে "Freedom of conscience and the right to freely profess, practise, and propagate religion." সুপ্রীম কোর্ট বিভিন্ন সময়ে নিদান দিয়েছেন যে অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচরণ পালনে বাধা দেওয়া যাবে না। হিজাব নিষিদ্ধ করার গা জোয়ারির বিরুদ্ধে যারা সংবিধান প্রদত্ত ধর্মাচরণ এর মৌলিক অধিকারের কথা তুলছেন তাদের মুখ বন্ধ করার জন্য বলা হচ্ছে যে হিজাব কোনো অত্যাবশ্যক ধর্মীয় আচারের অঙ্গ নয়। উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে যে আমাদের দেশে তো বটেই, পৃথিবীর নানান দেশে ইসলাম অনুরাগীরা হিজাব ব্যবহার করেন না। ধরুন একই যুক্তিতে বলা যায় যে আমিষ খাওয়াটাও হিন্দু ধর্মের অত্যাবশ্যক অঙ্গ নয়। তাই কাল থেকে আমিষ ভক্ষণ নিষিদ্ধ করে দিলে কিছুই কিন্তু বলার থাকবে না। ফাঁকিটা আসলে অন্যখানে। কোন আচার আচরণ অত্যাবশ্যক আর কোনটা নয় এটা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কে কাকে দিল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে না। আমার ধর্মকে আমার মতো করে ব্যক্তিগত পরিসরে ব্যাখ্যা করার সুযোগটাই কেড়ে নেওয়া হল। 

হিজাব পরা নিষিদ্ধ করা নিয়ে আদৌ মাথা ঘামানোর দরকার আছে? যারা মনে করেন দরকার নেই তাদের পক্ষের সবচেয়ে শক্তিশালী যুক্তিটা হল এই যে এসব নিয়ে মাথা ঘামিয়ে সময় নষ্ট করলে "আসল সমস্যা" থেকে নজর সরে যাবে, রুটি রুজির লড়াইটা পেছনে চলে যাবে। এর বিরুদ্ধে এটাই বলা যায় যে রুটিরুজির লড়াইটা ঠিক মতো করতে গেলে একজোট হয়ে থাকাটা খুব জরুরী আর একজোট যাতে না থাকতে পারে লোকজন, সেটা ভেস্তে দেয়ার জন্যই প্রতিক্রিয়ার শক্তিদের এসব আয়োজন। 

হিজাব নিষিদ্ধ করার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ কারা করবেন? যারা বলছেন যে হিজাব পরার পক্ষে হুল্লোড় করে একদল "বাম-ইসলামিক" আসলে মুসলিম সমাজকে পিছিয়ে রাখতে চাইছে, তাদের "অপর" করে রাখতে চাইছে, মেনস্ট্রিম হতে দিচ্ছে না তাদের মনে রাখতে হবে যে এই আলোচনাটা কোনো একটা ভ্যাকুয়াম স্পেসে হচ্ছে না। যে পরিসরে হচ্ছে সেটা ভারত নামের একটা দেশ যার অঙ্গরাজ্য কর্ণাটক যেখানে একটা ফ্যাসিস্ট দল পরিচালিত সরকার হিজাব নিষিদ্ধ করার এই এক্সপেরিমেন্টটা করে দেখছে, সফল হলে গোটা দেশ জুড়ে করবে ভবিষ্যতে। 

সেই এক্সপেরিমেন্টের আঁচ আমার আপনার সবার ব্যক্তিগত জীবনেও আজ বা কাল লাগবে। তখন আর এসব আলোচনা করারই কোনো অবকাশ থাকবে না। শুধু মুসলিমরা নয়, খ্রিস্টান, শিখ এমন কি হিন্দুরাও পার পাবে না। এটা ভাবার কোনো কারণ নেই যে এই অধিকার হরণের খেলাটা কেবল একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়কে নিশানা বানিয়ে খেলা হবে।

জীবনযাত্রার প্রতিটা পদক্ষেপ ওই ফ্যাসিস্ট শক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে। ওদের ইচ্ছে হলে আমিষ খাওয়া নিষিদ্ধ করে দেবে, ভারতীয় সংস্কৃতির দোহাই দিয়ে মহিলাদের জিন্স পরা বন্ধ করবে, পার্কে নারী পুরুষের বসা বন্ধ করবে, রাষ্ট্র বিরোধী দোহাই দিয়ে নানান বইপত্র পড়া নিষিদ্ধ করবে, নাস্তিককে সরস্বতী বন্দনা করতে বাধ্য করবে, হিন্দু বাঙালিকে বাধ্য করবে দ্বিভূজা সরস্বতীর বদলে চতুর্ভুজ সরস্বতীর উপাসনা করতে – ব্যক্তি স্বাধীনতা হরণের এই পিচ্ছিল অবনমনের কোনোই শেষ নেই। ভারতের বহুত্ববাদী সংস্কৃতির বদলে তার জায়গা নেবে সংঘ পরিবারের মনোমত "নাগপুরীয়" সংস্কৃতি। শেষের সেদিন বড় ভয়ংকর। তাই হিন্দু মুসলিম শিখ, নাস্তিক ডান-বাম বাঙালি-অবাঙালি নির্বিশেষে মানুষকে প্রতিবাদ করতে হবে। 

ঠিক কিসের দাবিতে বিক্ষোভ? যারা এতসব জানেন না তাদের কথা বাদ দেওয়া যায়, যারা এসব কিছু জেনেও না জানার ভান করে এই বিতর্কটাকে নিছক একটা একাডেমিক খোলস পরানোর চেষ্টা করেন, একটা "শ্রীনিরপেক্ষ" সাজার চেষ্টা করেন, তাদের অবস্থান সবচেয়ে বিপদজনক। এখনো সময় আছে, সুযোগ আছে, সুবিধাবাদী হাবভাব ছেড়ে স্পষ্ট কথা স্পষ্ট করে বলার, পক্ষ নেওয়ার। হিজাব পরতে দেওয়ার দাবিতে নয়, হিজাব নিষিদ্ধ করার এই ফ্যাসিস্ট কায়দার বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে হবেই। হিজাব পরা বা না পরার অধিকার সবার আছে। কোনোটাই জোর করে চাপিয়ে দেওয়ার তালিবানি কায়দা মেনে নেওয়া যাবে না।