শনিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

আনিশ খান ও রাজনীতি ~ সুশোভন পাত্র

এক্সিকিউজ মি! মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! আলিয়ার আনিশ থেকে ক্লাসিক্যালের সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হয়ে ডিক্সো ড্যান্সর বাপি লাহিড়ী -রাজনীতি করবেন শুধু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি 'ইনসাফ' চাইবেন, উনিই 'ইনসাফ' দেবেন! উনি রিজওয়ানুর মা কে নিয়ে মিছিল করবেন। রেলের যাত্রী পরিষেবা কমিটিতে হালকা করে গুঁজে দেবেন। রিজওয়ানুরের ভাই রুকবানুর তৃণমূলের বিধায়ক হবেন। 'ইনসাফ' মামলা আদালতে রুকবানুরের সাক্ষ্যের অভাবে ঝুলে থাকবে। লাক্স কোজির কোটিপতি মালিক অশোক টোডি তৃণমূলের মাড়োয়ারি সেলের হর্তা-কর্তা-বিধাতা হবে। 'ইয়ে আন্দর কা মামলা হ্যা'-র ক্যাচলাইন লেপটে, তৃণমূল সরকার রিজওয়ানুর কাণ্ডে অপসারিত অভিযুক্ত পুলিশ অফিসারের জ্ঞানবন্ত সিং-র পদন্নোতি ঘটাবে। আর আনিশ খুনের তদন্তে গঠিত সিটের মাথায় ঐ জ্ঞানবন্ত সিং-ই আলো করে বসবে! 
দার্জিলিংয়ের একচিলতে রোম্যান্টিক গ্রাম সিরুবাড়ির পাহাড়ি বাঁকের পাইন ফরেস্টে পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিক খুন হয়েছিলে বিমল গুরুংর গুণ্ডা বাহিনীর গুলিতে। লাখ টাকায় স্ত্রী বিউটি মালিকের শোক বিহ্বল আর্তনাদ বিক্রি হয়েছিলে মিডিয়ার টিআরপি বাড়াতে। স্বামীর মৃতদেহ জড়িয়ে ধরে বিউটি রাজ্য পুলিশের ডিজিকে বলেছিলেন, "স্যার, আমার সব শেষ! বিমল গুরুং-র মাথায় গুলি করুন!" তারপর বিমল গুরুং পলাতক হলেন!  দিল্লিতে বিজেপি নেতা জেপি নাড্ডার মেয়ের বিয়েতে চেটেপুটে ভোজ খেলেন। আর বিধানসভা নির্বাচনের ঠিক ৬ মাস আগে 'পলাতক' বিমল গুরুং মমতার সাথে গোপন বৈঠক সেরে বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফিরলেন! বিমল গুরুং বললেন স্বাধীন গোর্খাল্যান্ডের ইস্যুতে মমতাই 'আইডল'!
আর আপনি আলিয়ার আনিশ তৃণমূল-বিজেপি বিরোধী ছাত্র আন্দোলন করত বলে রাজনীতি করছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গৃহপালিত মিডিয়া, পুলিশ আর বুদ্ধিজীবীরা! কলকাতা টিভির কর্ণধার কৌস্তুভ রায় মধ্যরাতে আনিশের বাড়িতে যাবেন। 'মুখ্যমন্ত্রীর পিএ' পরিচয় দেবেন। চাকরি, টাকা, পুলিশি নিরাপত্তা -টোপ দিয়ে ভিক্টিম ফ্যামিলিকে কেনার মিডলম্যান হিসেবে ভাড়া খাটবেন। কোন কৌস্তুভ রায়? ব্যবসায়ী আরপি গ্রুপের চেয়ারম্যান কৌস্তুভ রায়! দিল্লির চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে আর্থিক তছরুপের মামলায় অভিযুক্ত জেল ফেরত আসামি কৌস্তুভ রায়! চিট ফান্ড কাণ্ডে কোটি টাকায় মুখ্যমন্ত্রীর ছবি কেনায় ঘটনায় ইডির লুক আউট নোটিস জারি হওয়া শিবাজী পাঁজার 'বুজম ফ্রেন্ড' কৌস্তুভ রায়। মমতা দরদী সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষালের ভাষ্যে 'চোরি চোরি চুপকে চুপকে' 'নো ভোট্টু' বাবুদের গ্লুইং ফ্যাক্টর কৌস্তুভ রায়! 
পুলিশের গাড়ি রাত একটার পরে আনিশের গ্রামে যাবে। চাইলে বাড়িতে ঢুকবে! আনিশ লাশ হয়ে পড়ে আছে জেনেও ৯ ঘণ্টা পর টনক নড়বে। চার জন মার্কা মারা সিভিক পুলিশ বেমালুম ফেরার থাকবে। সিভিক একজন রসপুরের তৃণমূলী পঞ্চায়েতের উপপ্রধানের ছেলে বেরোবে। বাকি তিনজনকে এলাকার লোক সিভিক কম আর তৃণমূলের মস্তান হিসেবেই বেশি চিনবে। লরি, গাড়ি থেকে টাকা আদায় করবে। পুলিশের পোশাক ফাইন করবে, তোলা তুলবে, ভোটের সময় ছাপ্পা মারবে। আর সোনারপুর বিধানসভার তৃণমূল বিধায়ক লাভলি মৈত্র-র স্বামী সৌম্য রায় হাওড়ার গ্রামীণ পুলিশের সুপার সেজে জাস্ট নাকে তেল দিয়ে ঘুমোবে! 
বুদ্ধিজীবীরা কেউ চেয়ার মুছবেন, কেউ পাগলু নাচবেন, কেউ নন্দনে দুলবেন, কেউ আবার কাক আঁকবেন। আর সিলেক্টিভ প্রতিবাদে মাধ্যমিকের বাধ্য মেয়ে হয়ে, "পাগলী, তোমার সঙ্গে সরীসৃপ জীবন কাটাব" বলে কোরাস গাইবেন! এটা কি সিপিএম-র সরকার নাকি যে আলিয়ার আনিশ মরলে 'ইনসাফ' চাইবেন? ফেস্টুনে-ব্যানারে প্রতিরোধের ব্যারিকেড গড়বেন? রাজপথে মিটিং-মিছিল-জনসভা শেষে বিসেলারির মিনারেল ওয়াটারে স্বস্তির চুমুক দেবেন? সন্ধেবেলা রিমলেস চশমা চাপিয়ে টক শো তে সরকারের বাপ-বাপান্ত উদ্ধার করে ডিনারে টেবিলে গোপন বৈঠক সারবেন? রাত্রে দক্ষিণ কলকাতার পশ ফ্ল্যাটে একটা সাউন্ড স্লিপ। কাল আবার ধর্না মঞ্চ? সিঙ্গুরের 'অনিচ্ছুক'রাই তো আসলে 'আইস অন দি কেক'। শিল্পের বদলে মাছের ভেড়ি হলেই কি গৃহপালিত বুদ্ধিজীবীরা মেরুদণ্ড খুঁজে পাবেন?
আর আপনি আলিয়ার আনিশের খুনে মিডিয়ার নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন? পুলিশের ভূমিকায় বিক্ষোভ দেখিয়ে রাস্তা অবরোধ করছেন? বুদ্ধিজীবীদের শিরদাঁড়া হাতড়ে বেড়াচ্ছেন? মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, আনিশ খানের মৃত্যু নিয়ে রাজনীতি করবেন না প্লিজ!
রাজনীতি করবেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়! উনি ভোটের জন্য মুসলমানদের অন্য ক্যামেরা 'দুধেল গরু' বলবেন। সাপের মুখে চুমু খেয়ে, মস্তান মৌলবি তহা সিদ্দিকিদের পুষবেন! ব্যাঙের মুখে চুমু খেয়ে, ফিচেল দাঙ্গাবাজ মোহন ভাগবত কে উস্কানি দিতে কলকাতায় সভা করতে দেবেন। ভোটের জন্য হিজাব পরবেন, CAA-NRC বিরুদ্ধে নিজের সাংসদদের পার্লামেন্টে ভোটদানে বিরত রাখবেন। আর সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে কে লবডঙ্গা দেখিয়ে, আনিশ মরলে 'ফেভারিট' বলে একটা সিট ঠুকে দেবেন! ঐ সিগারেটে ট্যাক্স বসিয়ে চিটফান্ডের টাকা ফেরত দেওয়ার সিট! কুণাল ঘোষ কে চিটফান্ডে কাণ্ডে গ্রেপ্তার করে তৃণমূলের মুখপত্র বানানোর সিট!
খুব বেশি হলে কমিশন! কমিশন গড়তে আবার বড্ড ভালোবাসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশন'দের। রাজারহাটের কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার তুরুপের তাস। দ্বিতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যার' কমিশন'দের। ২১শে জুলাই কমিশন'টাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম বুদ্ধ ভট্টাচাজ বধ। দিনের শেষে সিপিএমের কেশাগ্র স্পর্শ না করা গেলেও কমিশনগুলোর অশ্বডিম্ব প্রসবে খরচা হয়েছিল ৫ কোটি!
রাজ্যের পুলিশ, সিট, কমিশন -সবটাই আইওয়াশ! আসলে চুনোপুঁটিদের সাসপেন্ড-গ্রেপ্তার করে আনিশ কাণ্ডের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার রেসিপি সাজাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। সদ্য সন্তানহারা পরিবারের জেদ দেখে খেই হারাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। আনিশের গ্রামের সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ কে ভয় পাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী। পোষা পুলিশ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীদের নেক্সাসের বিরুদ্ধে বাঙলার যৌবনের প্রতিস্পর্ধা কে রাস্তায় দেখে প্রমাদ গুনছেন মুখ্যমন্ত্রী। এই স্ফুলিঙ্গ যে জঠরে দাবানল হয়ে ওঠার ক্ষমতা ধরছে বিলকুল বুঝতে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। তৃণমূলের শেষের শুরুর দেওয়াল লিখনটা আসলে স্পষ্ট পড়তে পারছেন মুখ্যমন্ত্রী। 
আর তাই মুখ্যমন্ত্রী বলছেন, আনিশ কাণ্ডে বিক্ষোভ-আন্দোলন-রাজনীতি উনি পছন্দ করছেন না! ডিয়ার মুখ্যমন্ত্রী, অকারণ আপনার অপছন্দ নিয়ে চাপ নেবেন না। কারণ আমরাও তো আপনাকে পছন্দ করছি না!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন