রবিবার, ৩ এপ্রিল, ২০২২

এনজিও দের এক লক্ষ কোটি টাকা ~ শতদ্রু দাস

সেদিন একটা খুব অদ্ভুত তথ্য পড়লাম। কম্পট্রলার অডিটর জেনারেল (সিএজি) আমাদের রাজ্যের বাজেটের অডিট করতে গিয়ে পেয়েছে যে ২০১৬-২০২০ এই পাঁচ বছরে, রাজ্য সরকার মোট ১ লক্ষ কোটি টাকা নিজেদের বাজেট থেকে এনজিও দের বরাদ্দ করেছে। সবই আপনার আমার কষ্টার্জিত রোজগারের টাকা, এবং গরিব মানুষের হকের টাকা কারণ টাকাগুলো আমরা কর হিসেবে দি গরিব মানুষের ওপর খরচ হবে ভেবেই, চার আনার কবি সাহিত্যিকের মেয়ের চালানো এনজিও বা ঘুরপথে ৬ আনার প্রকাশনার পেছনে খরচ হবে জানলে এই কর কেউই দিতে চাইবে না। কিন্তু তথ্যটা চমকপ্রদ শুধুই টাকার অংকের জন্য না, অন্য কারণে। সেটা হলো এই যে এই খরচের পরিমাণ রাজ্য সরকারের তরফ থেকে পঞ্চায়েতগুলো এবং পৌরসভাগুলোকে দেয় অর্থের চেয়ে বেশি। ২০২০ সালে পঞ্চায়েত এবং পুরসভাগুলোকে রাজ্য সরকার দিয়েছে মোট ১৭ হাজার কোটি টাকা, অথচ এনজিওগুলোকে দিয়েছে ২৬ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ ওই বছর রাজ্য সরকার যদি এনজিওকে টাকা না দিয়ে সবাইকে হাতে হাতে টাকা দিয়ে দিত, তাহলে রাজ্যের প্রতিটা মানুষ প্রায় ২৬০০ টাকা করে পেতেন। পাঁচ জনের পরিবার ধরলে পরিবার পিছু ১২ হাজার টাকা করে পেত। হকের ১২ হাজার টাকা, আমাদের টাকা। সিএজি তাদের রিপোর্টে বিষ্ময় প্রকাশ করেছে যে কেন এত টাকা এনজিওদের দেওয়া হচ্ছে, এনজিওরা সরকারের অংশ নয়, তাদের খরচাপাতির হিসেব সরকারি সংস্থা করতে পারে না, তারা বাধ্যও নয় সরকারকে খরচের হিসেব দিতে, তাহলে কেন এত টাকা তাদের দেওয়া হলো? অন্তত পঞ্চায়েত বা পৌরসভার হাতে টাকা গেলে সেই খরচাপাতির হিসেব চাওয়া যায় আইনত, আরটিআই করলে সেই হিসেব দিতে বাধ্য। তাহলে তাদের মাধ্যমে খরচ না করে এনজিওদের মাধ্যমে কেন? এই প্রশ্নটাই সব চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, এবং এর উত্তরের ভেতরেই পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান আর্থসামাজিক পরিস্থিতি এবং বগটুই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত আছে বলে আমার ধারণা। যদি এই অবধি পড়ে আপনাদের মনে হয় যে  এ সবই কল্পনা তাহলে পুরোটা পড়ার অনুরোধ করবো।


আমার ধারণা যে পুরসভা পঞ্চায়েতের মত গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে এড়িয়ে, এনজিওর মাধ্যমে এত টাকা খরচ করবার উদ্দেশ্য হলো দুটো। প্রথমত, তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বের নিজেদেরর দলের নিচু তলার নেতা কর্মীদের ওপর বিশেষ ভরসা নেই। তাঁরা জানেন যে পঞ্চায়েত পুরসভায় আসা টাকা নিয়ে কিরকম কামড়াকামড়ি মারামারি হয়, কিরকম চুরি হয়। এই চুরি এবং তাকে কেন্দ্র করে হওয়া গোষ্ঠীদ্বন্দ কমাতে সরকার পঞ্চায়েত পুরসভাগুলোর ওপর ভরসা না করে, করেছে এনজিওগুলোর ওপর। তাদের মনে হয়েছে যে এনজিওর মাধ্যমে উন্নয়নের কাজ করলে অন্তত কিছু টাকা আসল জায়গায় পৌঁছবে, নিজেদের নির্বাচিত পঞ্চায়েত বা পুরসভার হাতে দিলে সেটুকুও মানুষের কাছে পৌঁছবে না। তাই পঞ্চায়েত পুরসভার টাকা কমাও, এনজিওদের দাও। দ্বিতীয়ত, এইসব এনজিওগুলোর মাধ্যমে সুশীল সমাজকে হাতে রাখা যাবে। এসব এনজিওর অনেকগুলোরই মাথায় বসে আছে কবি, সাহিত্যিক, অধ্যাপক, সাংবাদিক, ডিএম, ডিএসপি, উকিল জজদের ছেলে, মেয়ে বা স্ত্রীরা। শুধুই তারা নন, নানা প্রকাশনা, থিয়েটার, অভিনেতা অভিনেত্রীরাও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এরকম হাজারো এনজিও সংস্থার সাথে যুক্ত।  তাই এসব এনজিওদের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করলে অন্তত তার কিছু প্রসাদ এদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। এমন কিন্তু নয় যে সবাইকে সরাসরি টাকা দিচ্ছে, এটা একটা ইকোসিস্টেম। আপনাকে একটা কাল্পনিক উদাহরণ দিচ্ছি। ধরা যাক এক প্রখ্যাত সরকারি কবির মেয়ের কোনো একটা এনজিও আছে। সরকার সেই এনজিওকে কোনো একটা বরাত দিলো। সেই কবি খুশ। সেই কবি এবার কিছু কবিতা লিখে একটা ছোট প্রকাশকের মাধ্যমে ছাপালেন, বড় প্রকাশকের মাধ্যমে ছাপাতেই পারতেন কিন্তু সরকারি দলের কেউ হয়ত বলে দিল যে "ওদেরও কিছু মালকড়ির ব্যবস্থা করে দিন, কত আর কামাবেন?" বড় কবির মেয়ে এনজিওর মাধ্যমে অলরেডি কামিয়েছে, তাই তিনি এই 'অনুরোধ" শুনবেন বই কি। এবার সেই ছোট প্রকাশকও বড় কবির বই পেয়ে দু পয়সা রোজগার করলো। এভাবেই এই টাকা ক্রমশ রিসার্চ সেমিনার, কবিতা পাঠ, রিসার্চ কনফারেন্স ইত্যাদিতে নিজের উদ্দেশ্য খুঁজে পেল। আমাদের টাকায়। আর পশ্চিমবঙ্গ যে তিমিরে ছিল সেখানেই রয়ে গেল।

এর একটা অন্য দিক হলো যে পঞ্চায়েত পুরসভায় টাকা কমে যাওয়ায় অনারুল লালন ভাদুদের মধ্যে দ্বন্দ্ব আরো তীব্র হলো। পঞ্চায়েতে কমে যাওয়া টাকাকে কম্পেনসেট করতে ভেরী, বালি, খাদান, তোলাবাজি বাড়াতে হলো। শুধু নিজের জন্য নয়, এঁদের এক একজনের ওপর কয়েক ডজন পরিবার নির্ভর করে, পশ্চিমবঙ্গ অর্থনৈতিক ভাবে গোটা দেশে শেষ সারিতে চলে গেলে কী হবে, এঁরা তৃণমূলের হয়ে খুন জখম ভোট লুঠ করেছে, তার বদলে তো এদের কিছু দিতে হবে। অতএব ক্রমশ ছোট হতে থাকে টাকার থলি নিয়ে মারামারি, খুনোখুনি। ক্রমশ বগটুই। ক্রমশ শিশু মহিলাদের পুড়ে শেষ হয়ে যাওয়া। 

একটা রাজনৈতিক  দল তৈরিই হয়েছে অর্থনৈতিক ইনসেন্টিভের ওপর, যে দল করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো ব্যক্তিগত অর্থনৈতিক অগ্রগতি, সেই দল রাজ্যকে যে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজ্যের একটা ক্ষুদ্র অংশ এই ব্যবস্থায় বিরাট ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এবং রাজ্যের একটা বড় অংশ তাদের দেখে ভাবছে যে তারাও যদি তৃণমূলের নেক নজরে থাকতে পারে তারাও ওই ক্ষুদ্র অংশে জায়গা পাবে, বাকি রাজ্য *** যাক।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন