মঙ্গলবার, ১২ এপ্রিল, ২০২২

মমতার অপসারণ ~ ডাঃ বিষান বসু

অনেকেই দেখছি দীর্ঘশ্বাস ফেলেটেলে বলছেন, অনেক আশা নিয়ে আপনাকে এনেছিলাম। শেষমেশ এই! ঠিক আছে, এনেছিলাম আমরা, ছুঁড়ে ফেলবও আমরাই।

প্রেমে দাগা খাওয়া যৌবনের অনুরূপ ভাষায় অনেকে এমনও বলছেন, এই জন্য, হায়, এই জন্য আপনাকে ক্ষমতায় রেখে দিলাম! ফ্যাসিবাদের বিপদ রুখতে গিয়ে শেষমেশ এই! মনে রাখবেন, আপনার পতনও আসন্ন।

সৎ আবেগ তাঁদের। সম্মান জানানোই উচিত। বিশেষ করে উত্তর মেরুর পেঙ্গুইনের পুনর্বাসন প্রসঙ্গে কমরেড ট্রটস্কি কী বলেছিলেন বা হনলুলুর বিপ্লব সম্ভাবনা প্রসঙ্গে দিমিত্রভের অন্তর্ভেদী মতামত, এসবের কোনোটাই যখন জানা নেই, তখন তাঁদের গভীর চিন্তনের প্রতি শ্রদ্ধাবনত সম্মতিই শ্রেয়।

তবু অশিক্ষিত কাণ্ডজ্ঞানশূন্যতার সুবাদে দুটো কথা বলে বসার লোভ সামলাতে পারছি না।

প্রথমত, "জননেত্রী"-কে ক্ষমতায় বসানো। হ্যাঁ, চৌঁত্রিশ বছরের ক্ষমতার শ্যাওলা এক ভয়ানক অভ্যাস। নিয়মিত ঘষামাজার মাধ্যমে সে শ্যাওলা তুলে না ফেললে পাথরটি যে একসময় লালরঙা ছিল, বুঝে ওঠা মুশকিল। "পরিবর্তন" হতোই - সেদিন না হলে তার পরের দিন। কিন্তু আপনাদের "বিপ্লব" কিছু সস্তা ছিল না - মানে একদম টাকাপয়সার অঙ্কের প্রসঙ্গেই কথাটা বলছি। 

মাননীয়ার ছবি কোটি টাকায় বিক্কিরি হওয়াই বলুন বা "পরিবর্তন"-এর ঠিক মুখেই দশ-বিশটা মিডিয়া একলপ্তে হাতবদল হওয়া - টাকা উড়ছিল বাতাসে। আপনারা টাকা খেয়েছিলেন, এমন অপবাদ দিচ্ছি না - কেননা, আমি সত্যিসত্যিই আপনাদের ব্যক্তিগত সততায় বিশ্বাস করি - কিন্তু বিপ্লবের গনগনে আগুনে কাঠকয়লায় জোগানটি ঠিক কোত্থেকে আসছিল, বিপ্লবের গরমাগরম অতিরঞ্জিত খবরগুলো ঠিক কাদের হাত ধরে "জনগণ"-এর কাছে পৌঁছে যাচ্ছিল, আপনারা বুঝতে পারেননি। বা বিপ্লবের আত্মপ্রসাদের চোটে চিনতেই পারেননি। চিটফাণ্ডের মালিকের চ্যানেল বাম-বিপ্লবের সমর্থক হয়ে বিপ্লবের বার্তা দিকে দিকে ছড়িয়ে দিচ্ছেন - আমি নিশ্চিত, লেনিন কিংবা গ্রামশি এর'ম সম্ভাবনার কথা কোথাও না কোথাও লিখে গিয়েছেন - আমরা যারা অবোধ অজ্ঞান তাদের চোখে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুত ঠেকেছিল অবশ্য, কিন্তু তাতে কী!!!

দ্বিতীয়ত, ফ্যাসিবাদ রুখতে ইয়ে। অর্থাৎ মাননীয়াকে ক্ষমতায় গেঁড়ে বসতে সাহায্য করা। খরচা সেখানেও কম হয়নি। ভাজপা-র ঢালাও টাকা ওড়ানোর তুলনায় অতি নগণ্য হলেও কম নয়। বেশি না, নির্বাচনের আগে মাত্র আটত্রিশ হাজার কোটি টাকা। হ্যাঁ, বাকি সব খরচা বাদই দিন, কিন্তু এই টাকাটা রাজ্য সরকার দিয়েছিলেন বিভিন্ন এনজিও ও "অন্যান্য"-দের। ভোটের আগে। হ্যাঁ, দুস্থ দেনাগস্ত এই রাজ্য সরকারই।

আবারও বলছি, আপনি সেই পয়সার ভাগ পেয়েছিলেন, এমন আমি বলছি না। কেননা আপনার ব্যক্তিগত সততার ব্যাপারে আমি নিঃসংশয়। কিন্তু আপনাদের প্রোগ্রাম ইত্যাদিতে পোস্টার-প্ল্যাকার্ড রঙচঙে ফেস্টুন তার খরচ ঠিক কোন পথে আসছিল, তা জানতে পারেননি। বা ওই যে বললাম, বিপ্লবের আত্মপ্রসাদের চোটে চিনতেই পারেননি। বা ভাবছিলেন, ফ্যাসিবাদের বিপদের সামনে দাঁড়িয়ে মানুষের চেতনা জাগ্রত হয়ে উঠলে এমনই হয়। অথবা, দিমিত্রভ তো বলেইছেন... আসলে দিমিত্রভ তো শুধু পড়ার ব্যাপার নয়, ওসব গীতা-উপনিষদের শ্লোকের মতো উপলব্ধির ব্যাপার - এবং টেক্সটের চাইতে কনটেক্সচুয়াল ইন্টারপ্রেটেনশনটাই অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ, তাই না, বলুন?

সে যাক গে, বলেইছি তো, অশিক্ষিত অবোধ ও অজ্ঞান আমি। ভুল বললে মাফ করে দেবেন, প্লিজ।

মোদ্দা কথাটা হলো, আপনাদের দুই দফার বিপ্লবের পেছনে খরচা কম পড়েনি। সাত মণ তেল পুড়িয়ে রাধা নেচেছেন ঠিকই (এটি প্রবাদবাক্য, লিঙ্গভেদে কৃষ্ণ বাঁশি বাজিয়েছেন বলেও পড়তে পারেন), কিন্তু সেই নাচ শেষমেশ এই। তার পূর্বানুমান আপনারা পাননি, সেটুকু ভ্রান্তি নিয়ে দোষারোপের মানে হয় না।

কিন্তু, সেই সাত মণ তেলের জোগান এলো কোত্থেকে, এটুকু জানতে না চাওয়াটা তো...

প্রথম দফায়, বাকি সব সন্দেহজনক উৎস বাদ দিলেও যে উৎসটি সন্দেহাতীত, তা হল চিটফান্ডের টাকা। অর্থাৎ, হাতবদল হওয়া আমজনতার টাকা, এই রাজ্যেরই সাধারণ মানুষের টাকা।

দ্বিতীয় দফায়, রাজ্য সরকারের টাকা। আইপ্যাকের হাত দিয়ে তৃণমূলের তোলাবাজির টাকাও। অর্থাৎ, আবারও, হাতবদল হওয়া আমজনতার টাকা, এই রাজ্যেরই সাধারণ মানুষের টাকা।

মুশকিল হলো, এই দফায় "রাজ্য জুড়ে অনাচারের প্রতিবাদ"-ই বলুন বা অন্য কিছু - ক্ষমতা থেকে সরানো, বা আপনাদের প্রিয় লব্জ অনুসারে "ছুঁড়ে ফেলা", এবম্বিধ বিপ্লবী কর্মকাণ্ডে স্পনসর পাওয়া চাপ।

প্রথম দফায় কাজটা কঠিন ছিল। শুধু টাকার জোরে করা সম্ভব হয়েছিল, এমন নয়। মানুষের জোর না থাকলে হতো না।

দ্বিতীয় দফায়ও কাজটা কম কঠিন ছিল না। মানুষকে বিভ্রান্ত করার আগে নিজেকেও ভুল বোঝাতে পারা - মানে, ভুলটাকেই সঠিক বলে নিজেকে বোঝাতে পারা - সহজ তো নয়। 

এবার অবশ্য কাজটা সত্যিই কঠিন। প্রতিহিংসাপরায়ণ ও হিংস্র সরকার। বিপদ অনেক। ঝামেলা আরও বেশি। আর, ওই যে বললাম, হাজার চাইলেও প্রয়াসটি যথাযথ প্রচার পাবে না, কেননা স্পনসর নেই। অতএব, পেরে উঠবেন বলে মনে হয় না। তবে বেশি পারার চেষ্টা না করাই ভালো। সেটিই রাজ্যবাসীর পক্ষে সুখকর ও স্বস্তিপ্রদ।

কাজেই বড় বড় বাকতাল্লা ছাড়ুন। আপাতত শুধু এটুকু স্বীকার করে নিন, এই প্রতিটি ধর্ষণ, এই প্রতিটি খুন, এই প্রতিটি অশ্রুবিন্দু, এই সবের পেছনে রইল আপনার অংশীদারি - প্লিজ, এটুকু দায়িত্ব নিন। 

ট্রটস্কি বা দিমিত্রভ এ প্রসঙ্গে কী বলে গেছেন জানি না, কিন্তু মাইরি বলছি, দায়দায়িত্বহীন বিপ্লব যে বড় ভয়ানক জিনিস, সে আমরা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন