বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২

ভীমরাও রামজি আম্বেদকর ~ অমিতাভ প্রামাণিক

ভারতীয় অর্থনীতিবিদ বা ইকনমিস্ট শুনলেই যে নামগুলো গড়গড় করে মাথায় আসে, তা হচ্ছে অমর্ত্য সেন, অভিজিৎ বিনায়ক ব্যানার্জী, মনমোহন সিং, সুব্রহ্মণ্যম স্বামী, কৌশিক বসু, প্রণব মুখার্জী, অসীম দাশগুপ্ত, অমিত মিত্র প্রমুখ। অথচ মৌলিক ধারণা ও ভারতীয় অর্থনীতিতে তার প্রভাবে সমুজ্জ্বল এক রত্নের জন্মদিন আজ, অর্থনীতিবিদ হিসাবে তাঁর নাম শোনা যায় না বিশেষ। 

তিনি ভারতের সংবিধানের রূপকার – ভীমরাও রামজি আম্বেদকর। 

১৮৯১ সালের ১৪ই এপ্রিল মহারাষ্ট্রের এক অন্ত্যজ (অস্পৃশ্য!) মাহার পরিবারের চোদ্দ নম্বর সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন ভীমরাও। পিতৃপুরুষেরা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নীচুতলার সৈনিক। খুব অল্পবয়সে মাকে হারান তিনি, মানুষ হয়েছিলেন পিসির কাছে। চোদ্দজন ভাইবোনের মাত্র পাঁচজন যৌবনে পদার্পণ করেছিলেন। স্কুলে যেতেন চটের ব্যাগ নিয়ে, তাতেই বসতে হত অন্যদের ছোঁয়া বাঁচিয়ে। জলতেষ্টা পেলে স্কুলের (উচ্চবর্ণের) পিওন দূরত্ব বজায় রেখে জল ঢেলে দিত, সেই জল আঁজলা ভরে পান করতে হত। যেদিন পিওন স্কুলে আসত না, সেদিন জল পাওয়া যেত না। 

পরিবারের পদবি ছিল সকপাল, কিন্তু রত্নগিরির অম্বাদাবে গ্রাম থেকে এসেছিলেন বলে বাবা তাঁকে স্কুলে ভর্তি করেছিলেন অম্বাদাবেকর নামে। ভীমরাওয়ের পড়াশুনা ও আচরণে সন্তুষ্ট শিক্ষক উচ্চবর্ণীয় কৃষ্ণজি কেশব আম্বেদকর স্কুল রেজিস্টারে তাঁর পদবি পরিবর্তন করে আম্বেদকর করে দেন। 

ষোল বছর বয়সে বোম্বে ইউনিভার্সিটির অধীনস্থ এলফিনস্টোন কলেজ থেকে ম্যাট্রিক পাশ করেন তিনি – মাহার কমিউনিটির মধ্যে প্রথম। তার আগের বছরেই তার বিয়ে হয়ে গেছে। ম্যাট্রিকের পাঁচ বছর পরে তিনি অর্থনীতি ও পলিটিক্যাল সায়েন্সে বোম্বে ইউনিভার্সিটি থেকে বিএ পাশ করে বরোদা রাজ্যে চাকরি করতে যান। বরোদারাজ সয়াজিরাও গায়কোয়াড়ের আনুকূল্যে তাঁর কপালে মাসে সাড়ে এগারো পাউন্ডের স্টেট স্কলারশিপ জুটে যায় তিন বছরের জন্যে, উচ্চশিক্ষার জন্যে তিনি চেপে বসেন আমেরিকাগামী জাহাজে। নিউ ইয়র্কের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার জন্যে এই স্কলারশিপ। 

এই তিন বছরে আম্বেদকর কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে ২৯টা, ইতিহাসে ১১টা, সোশিওলজিতে ৬টা, দর্শনে ৫টা, নৃতত্ত্বে ৪টে, রাজনীতিতে ৩টে এবং ফ্রেঞ্চ ও জার্মান ভাষায় ১টা করে কোর্স করেছিলেন। ১৯১৫ সালে তিনি এম এ ডিগ্রি লাভ করেন, তার দু-বছর পরে ঐ বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ডক্টরেট ডিগ্রি পান। অর্থনীতিতে তিনি ভারতের প্রথম ডক্টরেট এবং দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ডবল-ডক্টরেট, একটা ডিগ্রি কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, দ্বিতীয়টা লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে। লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি একটা এম এসসি ডিগ্রিও পেয়েছিলেন! তাঁর সময়ে তাঁর সমতুল্য ডিগ্রিধারী ব্যক্তি ভারতে সম্ভবত আর কেউ ছিলেন না। 

কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সাবমিট করা তাঁর থিসিস ও পেপারগুলো প্রত্যেকটাই মৌলিক ধারণায় এক একটি আকরগ্রন্থ। এগুলোর শীর্ষক – 'Ancient Indian Commerce', 'Castes in India – their Mechanisms, Genesis and Development', 'National Dividend of India - A History and Analytical Study'. 

লন্ডন স্কুল অফ ইকনমিক্স থেকে তিনি এম এসসি পান 'Provincial Decentralization of Imperial finance in British India' শীর্ষক থিসিসের জন্য। ডি এস সি-র থিসিস শীর্ষক 'The Problem of the Rupee – Its Origin and Its Solution'. এর কাজ করার মাঝপথেই ১৯১৭ সালের জুন মাসে বরোদারাজ-প্রদত্ত স্কলারশিপ শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁকে বাড়ি ফেরার জাহাজ ধরতে হয়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দেয় চার বছরের মধ্যে কাজ শেষ করে থিসিস জমা দিতে। আম্বেদকর আমেরিকা ও ইংল্যান্ডে কেনা তাঁর সমস্ত বইপত্র আলাদা এক জাহাজে পাঠিয়ে দেন। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের বাজার তখন, সেই জাহাজ টর্পেডো মেরে ডুবিয়ে দেয় জার্মান সাবমেরিন। 

বরোদারাজের সঙ্গে চুক্তিমতো তাদের 'মিলিটারি সেক্রেটারি'-র চাকরি নিতে বাধ্য হন আম্বেদকর, যদিও ব্যাপারটা সুখকর ছিল না। বরোদায় পৌঁছানোর খরচা তাঁকেই বহন করতে হয়েছিল। জাহাজডুবির জন্যে থমাস কুক তাঁকে যে ক্ষতিপূরণ দিয়েছিল, তা চলে যায় এই খরচা মেটাতে। 

পরে প্রথম সুযোগেই তিনি লন্ডনে ফিরে গবেষণার কাজ শেষ করেন ও ডি এসসি ডিগ্রি পান। রয়্যাল কমিশন অন ইন্ডিয়ান কারেন্সি অ্যান্ড ফিনান্সে (হিল্টন ইয়াং কমিশন) জমা দেওয়া তাঁর থিসিসে তাঁর অনুমোদনসমূহ – যাতে তিনি মুদ্রাস্ফীতি ও ভারতীয় মুদ্রার ক্রমাগত পতন এড়াতে এর 'জেনারেল পার্চেজিং পাওয়ার' নির্দিষ্ট মাত্রায় বেঁধে দেওয়ার ওপর জোর দিয়েছিলেন – থেকে জন্ম নেয় রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অফ ইন্ডিয়া-র ধারণা। 

সমস্ত ভারতবাসীর সমান অধিকার, শ্রমিকের অধিকার, নারীর অধিকার ইত্যাদি সমস্ত বিষয়ে আম্বেদকরের চেয়ে বেশি সরব কেউ ছিলেন না। গান্ধীর প্রকাশ্য সমালোচনা করে তিনি বলেন, ইংরেজদের কাছে নিজেকে প্রোগ্রেসিভ প্রতিপন্ন করতে যে গান্ধী ইংরাজি ভাষায় দলিত হরিজনদের ওপর উচ্চবর্ণের অত্যাচারের কথা বলেন, সেই একই গান্ধী গুজরাতি ভাষায় লেখা তাঁর প্রবন্ধগুলিতে বর্ণভেদের একনিষ্ঠ প্রচারক। ১৯৩০ সালে গান্ধীর প্রবল-প্রচারিত ডান্ডি মার্চের তিন বছর আগে আম্বেদকর মাহার অন্ত্যজদের নিয়ে সত্যাগ্রহ আন্দোলন করেছিলেন চাওদার তালাও থেকে বঞ্চিত তাদের জলপান করিয়ে। ভাইসরয় এগজিকিউটিভ কাউন্সিলের উল্লেখযোগ্য সদস্য (লেবার মিনিস্টার) হিসাবে আম্বেদকরই কারখানার শ্রমিকদের দিনে বারো ঘন্টার বদলে আটঘন্টা কাজের এবং ডি এ, ছুটির অধিকার, বীমা, মেডিক্যাল লীভ, পে-স্কেল ইত্যাদি আধুনিক ব্যবস্থা চালুর সুপারিশ করেন।

দেশের জল ও বিদ্যুৎ নীতি রূপায়ণে (দামোদর ভ্যালি, ভাকরা নাঙ্গাল, হিরাকুদ ইত্যাদি বাঁধ প্রকল্পে এবং সেন্ট্রাল টেকনিক্যাল পাওয়ার বোর্ড, সেন্ট্রাল ইলেকট্রিক্যাল অথরিটি স্থাপনে) তাঁর ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। মধ্যপ্রদেশ ও বিহারের মত বড় রাজ্যকে ভাগ করে দেওয়ার কথা লিখে গেছিলেন তাঁর Thoughts on Linguistic States বইতে, যা রূপায়িত হতে লেগে গেল ৪০-৪৫ বছর। ১৯৫১ সালে তিনিই প্রতিষ্ঠা করেন ভারতীয় ফিনান্স কমিশনের। কাশ্মীর-সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা ৩৭০ এবং রিজার্ভেশন-সংক্রান্ত নীতির প্রবল বিরোধী ছিলেন আম্বেদকর। হিন্দু নারীর অধিকার প্রসঙ্গে তাঁর আনা বিল – যাতে ছিল বিবাহিতা নারীরা পিতার সম্পত্তির অধিকারিণী হবে, ডাইভোর্সে পুরুষ-নারীর সমান অধিকার থাকবে, বিধবা ও ডাইভোর্সিদের পুনর্বিবাহে অধিকার থাকবে, পলিগ্যামি বে-আইনি ঘোষিত হবে, ইত্যাদি – সংসদে গৃহীত না হলে কেন্দ্রীয় আইনমন্ত্রীর পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন।  

মাহার জাতের একমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করার পর তাঁর সম্মানে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়, সেখানে কিশোর ভীমরাওকে দাদা কেলুস্কর নামে একজন লেখক বুদ্ধের জীবনীগ্রন্থ উপহার দিয়েছিলেন। আম্বেদকর সেই বই পড়ে প্রভাবিত হয়ে বুদ্ধের শরণ নিতে বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। ভারতের বর্ণাশ্রম প্রথার উদ্ভব বিষয়ে তাঁর প্রচুর লেখালিখি, যাতে তিনি আর্য-অভিযান তত্ত্বকে নস্যাৎ করে শূদ্রজাতির উদ্ভব বিষয়ে তাঁর মত প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। 

মধুমেহ রোগে হীনস্বাস্থ্য হয়ে ১৯৫৬ সালের ৬ই ডিসেম্বর মৃত্যু হয় এই স্পষ্টবাদী মনীষীর।  

১৪ই এপ্রিল ২০২১

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন