বেঁচে বর্তে থাকা একদা পূর্ববঙ্গীয় অতি বৃদ্ধ কারও হয়তোবা এখনও জিহ্বায় গোয়ালন্দ স্টিমারঘাটার সুবিখ্যাত মুরগিমাংসর ঝোলের স্বাদ লেগে আছে। পদ্মা ও ব্রহ্মপুত্রের ( যমুনা) সঙ্গম গোয়ালন্দ থেকে নারায়নগঞ্জের স্টিমার পথে মাল্লারা নিজেদের জন্য এই মুরগীর ঝোল রান্না করত। ক্রমে ক্রমে আমজনতার প্রিয় পদ হয়ে ওঠে। কলকাতার লক্ষ্মীবাবুর আসলি সোনাচাঁদি দোকানের মত গোয়ালন্দ স্টিমার ঘাটায় এখন সারি সারি মকবুল চাচার আসলি দোকান।এই মুরগী মাংসের ঝোলের জনপ্রিয়তা একটুও কমেনি।এই বিশিষ্ট স্বাদের রান্না নিয়ে অনেক লোকগাথা তৈরি হয়েছে। রন্ধনপ্রণালীর আদি উদগাতা কে তা নিয়েও বেশ আকচাআকচি আছে।দেশবিদেশের রন্ধন বিশারদরা এই রান্নার রেসিপি জানতে গোপনে হোটেল কর্মচারী সেজে থেকে গেছেন বলে গল্পকথা হাওয়ায় ভাসে। এইসব গল্পকথা নিয়ে একবার এক শারদীয় পত্রিকায় এক উপন্যাস লেখা হয়েছে। দেশভাগের পটভূমিতে খানিকটা রহস্য মিশেল দিয়ে প্রেম ও বন্ধুত্বের টানাপোড়েন। পড়তে মন্দ লাগেনা। হোটেল বা হোটেল জীবন নিয়ে বাংলায় কয়েকটা উপন্যাস আছে। একটা মাত্র রান্নার পদ নিয়ে একটা উপন্যাস এর আগে আমি পড়িনি।
অনেক বছর আগে এই পদের ঘরোয়া রন্ধনপ্রণালী জেনেছিলাম জলপাইগুড়ি হাকিম পাড়ার এক প্রিয় বন্ধুর মায়ের কাছে।মাসীমা প্রয়াত হয়েছেন অনেকদিন। এই সহস্রাব্দের শুরুতে বন্ধুর পাকশালায় হাতেকলমে বার কয়েক রেঁধেছি এই পদ। বেশ ঝকমারি আছে। সে সব লিখে রাখিনি। ভুলেও যাইনি। সেই বন্ধুর গোয়ালন্দে এখনও যাতায়াত আছে। দিন কয়েক আগে ফোনে জলযন্ত্রনায় বিপর্যস্ত বন্ধুর খোঁজ খবর নেওয়ার ফাঁকে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় হল।কথায় কথায় সেই সব পুরানো কথার ঢেউ উঠল।রন্ধনপ্রণালীটাও ঝালিয়ে নিলাম।
প্রস্তুতি, অর্থাৎ কিনা ম্যারিনেট করা।
১) ব্রয়লারে তেমন স্বাদ হবেনা। যাকে বলে দেশী মুরগি কেটে ধুয়ে জল ঝরিয়ে নুন মাখিয়ে মিনিট দশেক ঢাকা থাকবে।
২) কালোজিরে বাটা দিয়ে ভালো করে মেখে আবার ঢাকা দশমিনিট।
৩) আদা জিরে কাঁচালঙ্কা বাটা দিয়ে মেখে মিনিট পাঁচেক ঢাকা।
৪) সরষে তেল দিয়ে মেখে আবার ঢাকা।পাঁচ মিনিট।
** আদা জিরে লঙ্কা কালোজিরে নুন তেল একসাথে মুরগীর সাথে মাখলে হবেনা কিন্তু।
কড়াইয়ে খুব ঢিমে আঁচে গরম করা সরষে তেলে থেতলানো রসুন কোয়া ভেজে , অনেকটা পেয়াজ কুঁচি আধ ভাজা করে আদা কুঁচি দিয়ে আন্দাজমত নুন ছড়িয়ে দিতে হবে।
এরপর
১) ঐ কড়াইয়ে অর্ধেকের বেশি মাংস দিয়ে নেড়েচেড়ে ঢাকা চাপা। চাপা উঠিয়ে নেড়েচেড়ে আবার চাপা।
২) দু-চারটে শুকনো লঙ্কা দিয়ে ঢাকা।
৩) বাকি মাংস কড়াইয়ে দিয়ে হলুদবাটা জলে গুলে ঢেলে দিতে হবে। নেড়েচেড়ে আরও খানিকটা আন্দাজমত জল দিয়ে ঢাকার আগে খোসা ছাড়ানো কয়েক টুকরো আলু দিতে হবে।
৪)ঝোল ফোটা শুরু হলে আঁচ আরও কমিয়ে শুকনো লঙ্কা বাটা ও খুব অল্প সরষে বাটা জলে গুলে কড়াইয়ে দিতে হবে। ফুটুক কয়েক মিনিট।
এইবার রাঁধুনিরা দ্বিমত বা বহুমত।
১) কুঁচো চিংড়ি কড়া করে ভেজে দু'হাতের তালুতে পিষে গুড়ো করে ঝোলে দিয়ে টগবগ করে ফুটিয়ে নামিয়ে নাও।
২) যেকোনো কুঁচো মাছ কড়া ভেজে গুড়ো করে দিতে হবে।
৩) লইট্যা বা হিদল( পুঁটি) শুঁটকি পেয়াজ লঙ্কা রশুন বেশ কড়া ভেজে পেস্ট করে মাংসের সাথে মিলিয়ে দাও।
** আমি চিংড়ি ভাজা গুড়ো দিয়ে করেছি।
নামাবার আগে কয়েকটা কাঁচালঙ্কা চিরে ছড়িয়ে দিতে হবে।সবার পাতেই যেন একটা দুটো পড়ে।
পাতে দেওয়ার আগে সামান্য ঝোল জিভে দিয়ে বুঝে নিতে হবে নুন কমবেশি হয়েছে কিনা।
** গরম না থাকলে এ ঝোলের স্বাদ অর্ধেক কমে যায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন