মঙ্গলবার, ৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২

হিজাব নিয়ে বিতর্ক ~ মধুশ্রী বন্দোপাধ্যায়

২০১৪ সালে ফরাসী আদালত সর্বসাধারণের চলাচলের স্থান থেকে ক্রিসমাসের সময়ে যীশুর জন্মের দৃশ্য নিষিদ্ধ করেছিল। ফরাসী আইন অনুসারে, স্কুল, হাসপাতাল এবং স্থানীয় কাউন্সিলের মতো সরকারি স্থানে ধর্মীয় চিহ্ন থাকতে পারে না। যীশুর জন্মের দৃশ্য একটি 'ধর্মীয় প্রতীক' এবং 'পাবলিক স্পেসে ধর্ম নিরপেক্ষতা রাখতে হবে'- এই ফরাসি নীতির সাথে সঙ্গতিপূর্ণ নয়।

বলে রাখা ভাল, ২০১৭ সালের পিউ রিসার্চ অনুসারে ফ্রান্সের ৫৪% নিজেদের খ্রিস্টধর্ম অনুসারী বলে দাবি করেছে। তার মধ্যে ৪৭% ক্যাথলিক চার্চের সাথে যুক্ত। অর্থাৎ তারা যীশু ও মেরির বিভিন্ন প্রতীকচিহ্নকে পূজা করেন। ২০০৪ সালে ওই একই দেশে সরকারি স্কুল এবং হাসপাতালগুলিতে স্পষ্ট ধর্মীয় চিহ্নগুলির প্রদর্শন নিষিদ্ধ করে। সেই সময়ে ওই দেশের শিখ সম্প্রদায় ক্ষুব্ধ হয়েছিল।

একটা দেশের নীতি-আদর্শ তৈরী হয় বহু ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে। ফ্রান্সের ইতিহাস বড়ই জটিল। একদিকে আছে আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকা; আবার ওই দেশই প্রথম সাম্য-মৈত্রী-স্বাধীনতার ডাক দিয়েছে। ষাটের দশকে ফ্রান্সের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের যে আগুন জ্বলে উঠেছিল তা একসময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিল। 

আমাদের দেশের সঙ্গে ফ্রান্সের তুলনা করা যায় না, উচিতও না। আমাদের ধর্ম নিরপেক্ষতার ইতিহাস কণ্টকাকীর্ণ। এখানে শিক্ষায়তনে ধর্মীয় প্রতীক ব্যবহৃত হওয়া নতুন কিছু নয়। ১৯৯৫ সালে রুরকি বিশ্ববিদ্যালয়ে কনফারেন্স গিয়ে অবাক হয়েছিলাম সরস্বতী বন্দনা দিয়ে অনুষ্ঠানের সূচনায়। এদিকের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। 

দেশটা বড়, এখানে বিভিন্ন অঞ্চলে আছে বিভিন্ন ধরনের সংস্কৃতি। সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুলে কিছুদিন পড়ার অভিজ্ঞতায় বলতে পারি আমাদের সময়ে সেখানে বাঙালি মুসলমান বন্ধুদের হিজাব পরতে দেখিনি। আবার উত্তর প্রদেশ ও অন্যান্য অঞ্চলের বন্ধুরা কিন্তু পরত। দেশের মুসলিমরাও কোন একশৈলিক চিন্তা ভাবনা করেন না। 

যেদিন সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারব, সেদিন শিক্ষায়তনে হিজাব বা মাথায় ধর্মীয় পাগড়ি বা সরস্বতী বন্দনা সবকিছুরই বিরোধিতা করতে হবে।

যতদিন না তা হচ্ছে, ততদিন ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ কী করবেন? 

ততদিন হিজাব পরার জন্য কোন নারীকে একদল মনুষ্যেতর তাড়া করলে তাদের দিকে তেড়ে যেতে হবে, মেয়েটির পাশে দাঁড়াতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রকে মেয়েটির সুরক্ষা দিতে হবে। রাষ্ট্র তা না দিতে পারলে মেয়েদের নিজেদের মত করে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।
 
আর আমরা? ধর্মনিরপেক্ষরা? আমরা কি তবে হিজাব পরাকে সমর্থন করব? আমরা কি আমাদের প্রতিবাদের ভাষা পাল্টে দেব? 

কখনই না।  

হিজাবের সঙ্গে নারী স্বাধীনতার প্রশ্ন যুক্ত। ইরানের  আয়াতোল্লা খোমেইনীর আগমনের পরে নয় বছরের বড় শিশু, কিশোরী, মহিলাদের আবশ্যিকভাবে মাথা ঢেকে রাখতে হয়। এর প্রতিবাদে হাজার হাজার নারী-পুরুষ একত্রিতভাবে প্রতি বুধবার মিছিল করছেন, প্রকাশ্যে হিজাব খুলে দিয়েছেন। প্রতি মুহূর্তে আন্দোলনকারীদের আশংকা থাকে পুলিশ ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে আটকে রাখবে, বিচারের নাম হবে প্রহসন। তবু তারা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন।

একসময়ে এই দেশে নারীরা সতী হয়েছেন। তবে আজ আর নারী সতী হবার প্রয়োজন বোধ করেন না, নিরামিষ আহার খাবার কোন ইচ্ছা পোষণ করেন না। হিজাব পরা কোন নারীর স্বাধীন অভিব্যক্তি নয়। এই ইচ্ছা আসলে সামগ্রিক সমাজের ইচ্ছা, এক কঠিন অনুভব। সমূহের বোধ ব্যক্তির ইচ্ছা হয়ে গোপনে চারিয়ে যায় মানুষ থেকে মানুষে। যেমন চারিয়ে গেছে ব্রাহ্মণকে অব্রাহ্মণের প্রণামে।

মেয়েটি তার মত করে রুখে দাঁড়িয়েছেন। কারণ রাষ্ট্র নগ্নভাবে বিভাজনের রাজনীতি করছে। আমরা কেউ তার পাশে থাকতে পারিনি। আমরা প্রতিবাদী মেয়েটিকে মুখের ভাষা জোগাতে পারিনি। এটা দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সামগ্রিক ব্যর্থতা। এই ভাষা জোগাতে হবে। নয়তো দশা হবে ইরানের টুদে পার্টির মত। ইসলামিক বিপ্লবের পর ১৯৮২ থেকে এই পার্টি ওই দেশে নিষিদ্ধ। অধিকাংশ নেতৃবৃন্দ নিহত অথবা কারাগারে। 

একটি ধর্মীয় জিগিরকে বন্ধ করতে অন্য ধর্মীয় জিগির তুলে অসাম্প্রদায়িক উদার চিন্তার বিকাশ সম্ভব নয়। আর যাই হোক, এতে ধর্মনিরপেক্ষতার লড়াই করা যায় না। 
নিজের কাজ অন্যের ঘাড়ে চাপানো যায় না।

দেশের এই ভয়ঙ্কর বিভাজনের রাজনীতির সময়ও সমস্ত ধর্ম নিরপেক্ষ শক্তি কার্যকরী ভূমিকা নিতে পারে না, এখনও এমনকি দেশের বাম শক্তি একত্রিত হতে পারল না।
সেই কাজ যত তাড়াতাড়ি করা যায় ততই মঙ্গল। 

দেশটা বাঁচে। মেয়েটি বাঁচে। আমরা বাঁচি।


08/02/2022

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন