পাশের বাড়ির বৌদি, বিগত যৌবনা হলেও সাজগোজ করতে কিঞ্চিৎ ভালোবাসেন। আপনি আড় চোখে দেখেন আর পাড়ার চায়ের ঠেকের খাপ পঞ্চায়েতে তাকে আখ্যা দেন ঢলানি মেয়েছেলে বলে। অফিসে নতুন কাজে জয়েন করা মেয়েটি স্বচ্ছন্দে সবার সাথে মেলামেশা করছে দেখে আপনি তাকে আখ্যা দেন বেহায়া বলে। বন্ধু'র কনিষ্ঠ কন্যা, সদ্য কলেজ ছাত্রীকে জিন্স পরতে দেখলে, সিগারেট ফুঁকতে দেখলে আপনার স্থির সিদ্ধান্ত হয়, মামনি গোল্লায় গেছে। কাজ সেরে বাড়ি ফেরার সময় মেট্রো রেল কামরায় হাতল ধরা মহিলার শাড়ির আঁচল অবিন্যস্ত দেখলে আপনার ল্যাম্প পোস্টের নিচে দাঁড়ানো মেয়েদের কথা মনে পড়ে। একটা সময় পশ্চিম ইউরোপের ইতালিতে মেয়েদের দেখে আপনার মতো কিছু নীতি পুলিশ সাজা কাকু/ কাকিমা ওই সিদ্ধান্তে আসতেন যে ওদেশের মেয়েগুলি কিঞ্চিৎ বেহায়া, ঢলানী ও বয়ে যাওয়া এম্পটি হেডেড।
অথচ কি আশ্চর্য্য দেখুন ওদেশের সেই মেয়েগুলি দ্বিতীয় বিশ্ব মহাযুদ্ধের সময় কি অবাক কান্ডই না ঘটিয়ে ছিল। আপনার নিশ্চয়ই জানা আছে যে ওই ইতালি দেশটাতেই ফ্যাসি*বাদ নামক কুখ্যাত মতবাদের জন্ম। ইউরোপের আর পাঁচটা দেশেও ফ্যাসি*স্ট আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ওই দেশে ফ্যাসিবাদ বিরোধী সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী, যাদের পার্টিজান বলে, সেটা গঠিত হয়ে ছিল। কিন্তু আপনার কি জানা আছে যে দু লক্ষ পঞ্চাশ হাজার সংগ্রামী মানুষ দ্বারা গঠিত সেই বাহিনীর এক লক্ষ পাঁচ হাজার মানে প্রায় চল্লিশ শতাংশ সদস্য ছিল মহিলা ? যারা পুরুষ কমরেডদের পাশাপাশি স্টেনগান হাতে নিয়ে লড়াই দিয়েছিল ? আজ্ঞে হ্যাঁ যেই "বেহায়া", "ঢলানি" "মেয়েছেলে"র দল। আপনাকে কেউ কি কোনোদিন বলেছে যে ওই মেয়েদের মধ্যে চার হাজার ছশ জন গ্রেপ্তার হয়েছিল, দু হাজার সাতশো পঞ্চাশ জনকে পাঠানো হয়েছিল বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে। ওই মহিলাদের আত্মত্যাগ বিফলে যায়নি কিন্তু। ফ্যাসি*বাদীদের পরাজয় হয়েছিল। আঠাশ এপ্রিল, ১৯৪৫ ফ্যাসিবাদের সবচেয়ে বড় নায়ককে পার্টিজানরা গুলি করে মারে। মেরে ফেলে দিয়ে যায় মিলান এর প্রধান রেল স্টেশনের চত্বরে। যার পরে ক্রুদ্ধ বিক্ষুব্ধ জনতা পাশবিক আক্রোশে সেই একনায়কের মৃতদেহ উল্টো করে ঝুলিয়ে দেয় ল্যাম্পপোস্টে, জনতা জড়ো হয়ে উল্লাস করে সেই ল্যাম্পপোস্টের নিচে। এর পরে সবাই ঘরে ফেরে। মেয়েরা বন্দুক ফেলে ফিরে যায় অভ্যস্ত জীবনে, ঘরকন্নয়, গেরস্থালির কাজে, মাঠে ফসল তোলার কাজে, ফ্যাশন শো এর রেম্পে।
গত কয়েকদিনের মধ্যে চুয়াল্লিশটি দেশের চল্লিশটি নৌযান নিয়ে গঠিত বেসামরিক নৌবহর যার নাম সুমুদ ফ্লোটিলা রওয়ানা দিয়েছিল ইসরায়েলি হানায় বিধ্বস্ত গাজায় ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছিয়ে দিতে। ইসরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সারা পৃথিবী জুড়ে বেসামরিক, বেসরকারি প্রতিবাদ। ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স ওই নৌযান গুলিকে সাগরের বুকেই ইন্টার্সেপ্ট করেছে। অভিযাত্রীদের এই অসম সাহসী অভিযানকে ঘিরে শুরু হয়েছে দক্ষিণপন্থীদের কুৎসা প্রচার। এই প্রচারকারীদের আক্রমণের অন্যতম লক্ষ্য এই আন্দোলনের অন্যতম নেত্রী গ্রেটা থুনবার্গ, রিমা হাসান ও অংশগ্রহণকারী অন্যান্য মহিলারা। তাদের চরিত্রে কালি ছেটানো চলছে। ঠিক যেমনটা হয়েছিল সেই ফ্যাসিস্ট ইতালিতে।
আশার কথা এটাই যে সেই ইতালির মতো আজকের ইতালিতেও খেটে খাওয়া মানুষজন এই অভিযাত্রীদের পাশেই দাঁড়িয়েছে সেই দেশের চরম দক্ষিণপন্থী সরকারের হুশিয়ারি সত্ত্বেও। রাজপথে তাঁদের কন্ঠে ফিরে এসেছে সেই পুরনো ফ্যাসিস্ট বিরোধী "বেলা চাও" গানের সুর ও স্বর। তাদের সাথে সুরে সুর মিলিয়ে কলকাতা সহ পৃথিবীর প্রায় সব শহরের বুকে হচ্ছে মিছিল, জমায়েত। বেলা চাও বারে বারে ফিরে আসছে আমাদের মধ্যে।
ফেরেনি কেবল ফ্যাসিস্ট/ নাৎসি বাহিনীর হাতে শহীদের মৃত্যু বরণ করা ছশো তেইশ জন মহিলা পার্টিজান। কোনো অজানা সবুজ পাহাড়ের কোলে, আরো সবুজ শান্ত গাছের ছায়ায় তারা চিরকালের মতো ঘুমিয়ে আছে। তাদের মিনি স্কার্ট হাই হিলের খুট খুট শব্দে মুখরিত হবে না আর মিলানের পাথর বাঁধানো রাস্তা। যখনই কেউ প্রতিবাদে গর্জে ওঠা মেয়েদের "ঢলানি মেয়েছেলে" বলে অপবাদ দেয়, তাদের শরীর নিয়ে নোংরা কথা বলে তাদের বদনাম করতে চায়, তখনই কেন জানি সেই শহীদ পার্টিজান বাহিনীর মেয়েদের কথা মনে পড়ে যায়। গুডবাই বিউটিফুল। বেলা চাও, বেলা চাও, বেলা চাও চাও চাও।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন