সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

আবার ব্যোমকেশ ~ কৌশিক মজুমদার

বড় মুশকিলে পড়িয়াছি। ১৯৭০ সালে আজিকার দিনে শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পর হইতে আজ অবধি কলম ধরি নাই। অনভ্যাসে বিদ্যা কিঞ্চিৎ হ্রাস পাইয়াছে। তবু বহুযুগ পরে এই মুখপুস্তিকাখানি পাইয়া কিছু লিখিতে সাধ জাগিল। খোকার পুত্র এখন বড় হইয়াছে। সেই আমাকে এই অ্যাকাউন্টখানি খুলিয়া দিয়া কহিল মনের সকল কথা ইহাতে লিপিবদ্ধ করিতে।


কিন্তু কী লিখি? জানি পাঠকদিগের আমার প্রতি এক চরম ক্ষোভ রহিয়াছে। কেন বিশুপাল বধের কাহিনি সম্পূর্ণ করিলাম না? কেন শরদিন্দু বাবুর মৃত্যুর পরেই লেখনী সংবরণ করিলাম? এতদিন এই কথা প্রকাশ করি নাই। আজ জানাই, উহাই ব্যোমকেশের শেষ কেস ছিল এবং উহাতে তাহার সম্পূর্ণ পরাজয় হয়। আমি চাহিয়াছিলাম পাঠকদের নিকট যে ব্যোমকেশ বীরের আসনে আসীন, তাহা যেন বিন্দুমাত্র লাঘব না হয়।

এই অবধি লিখিয়াছি, আচমকা ঘরে ব্যোমকেশ প্রবেশ করিল। মুচকি হাসিয়া কহিল "কি হে, আজ শরদিন্দুবাবুর উপরে ফেসবুকে কিছু লিখছ নাকি?" আমি চমকিত হইয়া কহিলাম "বুঝলে কি করে?" একখানি সিগারেট ধরাইয়া আরামকেদারায় বসিয়া পা নাচাইতে নাচাইতে ব্যোমকেশ কহিল "এ বুঝতে বুদ্ধি লাগে না। গতকাল থেকেই তোমার মধ্যে কেমন একটা অস্থির ভাব দেখছি। তাক থেকে শরদিন্দু বাবুর লাল লাল বইগুলো টেনে বার করছ। কাল অনেক রাত অবধি খোকার থেকে বাংলায় টাইপ করা শিখলে। আজ ওঁর মৃত্যুদিন। এটুকু আমি কেন পুঁটিরাম-ও বুঝতে পারবে"

ভারি রাগ হইল। কহিলাম "প্রিয় চরিত্র" গল্পে উনি তো ঠারেঠোরে তোমাকেই নিজের প্রিয় চরিত্র বলে গেছেন। ভুলে গেলে? তা তুমিই বল ওঁকে নিয়ে কিছু"। ব্যোমকেশের ভ্রুযুগল উত্থিত হইল। খানিক কী যেন ভাবিয়া কহিল "দেখ ভায়া, আমি সত্যান্বেষী। সত্য বই অন্য কিছু জানি না। ফলে কেঠো তথ্য ছাড়া কিছু বলতে পারব না। জন্ম ১৮৯৯ সালে বিহারের পূর্ণিয়াতে। কলকাতায় এসে মেট্রোপলিটন। প্রথম বই কবিতার। নাম যৌবনস্মৃতি। ১৯৩২ সালে পথের কাঁটা। যেটায়…"

"জানি জানি। মূল লেখা আমিই লিখেছিলাম। আমার ভাষা আর বানানের বহর দেখে উনি সেটা শুধরে দেন। এই তো। এই নিয়ে এত বছর বাদে খোঁটা না দিলেও পারতে"
"আরে তোমার লেখার পুরো বিশ্বাস রাখতে পারেন নি বলেই হয়তো বেনীসংহার কাহিনি নিজেই লিখেছেন" বলিয়া ব্যোমকেশ মিটিমিটি হাসিল। "আর তোমার এই সাধু চলিতের গুরুচন্ডালী। বাপ রে!!!"

ভয়ানক ক্ষুব্ধ হইয়া গুম মারিয়া বসিয়া রহিলাম। দেখিলাম অবরুদ্ধ হাসিতে ব্যোমকেশ ফুলিয়া ফুলিয়া  উঠিতেছে। কহিল "আমার সেই ডাক্তার অনুকুল বাবু কিংবা মণিলালের চেয়েও শরদিন্দুবাবু দেখছি তোমার কাছে বড় ভিলেন!" উত্তর না দিয়া উঠিয়া যাইব ভাবিতেছি এমন সময় ব্যোমকেশ সিগারেটে একটা টান দিয়া বলিল "লেখায় আমাদের ভূতান্বেষী বরদার কথাও রেখ। তাঁর আলোচনা তো আজকাল বিশেষ শুনি না"।কথাটা ভুল নয়। গোলগাল আলুর ন্যায় দেখিতে এই ভদ্রলোক যে প্রেতপুরীর সমস্ত খবরাখবর রাখেন তাহা "রক্ত খদ্যোত", "বহুরূপী" র মত কাহিনি পড়িলেই প্রতীয়মান হয়। এই সেদিন খোকার পুত্র সানডে সাসপেন্স নামক এক বেতারকাহিনীতে উহার কীর্তি শুনিয়া শিহরিত হইতেছিল। ব্যোমকেশ যখন তাহাকে জানায় সে স্বয়ং বরদার সঙ্গে মোলাকাত করিয়াছিল, তাহার পৌত্র অবিশ্বাসের হাসি হাসে। এই আজকালকার দিনের ফ্যাশন হইয়াছে। বয়সের মর্যাদা নাই, কিংবা গেঁয়ো যোগী…। যাহা হউক বরদার কথা লিখিতে হইবে। 

দরজায় বেল বাজিল। পুঁটিরাম দরজা খুলিতেই হাসি মুখে পুরন্দর পান্ডের আবির্ভাব। রিটায়ার করিয়া আমাদের পাড়ায় একখানি ফ্ল্যাট লইয়াছেন। প্রত্যহ সকালে একবার করিয়া ঘুরিয়া যান। ব্যোমকেশ আমার এই লেখার কথা জানাইতেই তিনি আনন্দিত হইয়া কহিলেন "এতো খুব ভাল। তবে আমার মতে আপনি ওঁর ঐতিহাসিক কাহিনিগুলো নিয়ে বেশি করে লিখুন। আহা! কি ভাষা! তিনিই প্রথম লেখক যিনি আগের ভুদেব কিংবা রমেশচন্দ্রর মত ইতিহাসের চোঙ দিয়ে গল্পকে বিশ্লেষণ করে নি। ইতিহাস হাতরান নি। ইতিহাস গল্পরসের হানি ঘটায়নি কোথাও। তুমি সন্ধ্যার মেঘ, কালের মন্দিরা, তুঙ্গভদ্রার তীরে, কুমারসম্ভবের কবি-তে তাঁর কল্পনা যেন আকাশ ছুঁয়েছে। আপনাদের একটা গল্প বলি। ফলিত জ্যোতিষের চর্চা করতেন ভদ্রলোক। নাকি মুখ দেখেই ভবিষ্যৎ বলতে পারতেন। একবার যা হয়েছিল তা মারাত্মক। এক বিখ্যাত মানুষের বাড়ি প্রায়ই যেতেন আড্ডা দিতে। একদিন গেছেন, প্রৌঢ় মানুষটি আনন্দের সঙ্গে শরদিন্দুকে জানালেন তাঁর পুত্র পরীক্ষায় দারুন পাশ দিয়েছে। তিনি খুব খুশি। এবার ছেলেকে বিদেশে পাঠাবেন। শরদিন্দুও দারুণ খুশি। 
ভিতর বাড়ি থেকে ছেলেটি এসে তাঁকে প্রনাম করতেই তাঁর চোখমুখ কেমন বদলে গেল। এদিকে তাঁর বাবা বলে চলেছেন, ভাল সম্বন্ধ এসেছে ছেলের বিয়ের। বিয়ে করেই ছেলে বিদেশ যাবে। ছেলেটি চলে যাবার পর শরদিন্দু গম্ভীর হয়ে বসে থাকলেন কিছুক্ষণ। তারপর খুব দৃঢ়ভাবে বললেন, ছেলেকে পারিবারিক ব্যবসার কাজেই লাগান মশাই। বিদেশে পাঠাবেন না। আর হ্যাঁ, বিয়েটা এখনই দেবেন না। প্রৌঢ় অবাক। কেন এমন বলেছেন শরদিন্দু? শরদিন্দু কিছুই ভেঙে বললেন না। উঠে গেলেন।
ভদ্রলোকের মন খচখচ। তবুও বিয়ে হল ঠিক সময়েই। কিন্তু অদ্ভুতভাবে বিয়ের কিছুদন পর থেকেই ছেলেটি খেয়াল করল চোখে ঝাপসা দেখছে। এক বছর ঘুরতে না ঘুরতে পুরো অন্ধ। বিদেশ যাওয়া হল না ছেলেটির। হতে পারে কাকতালীয়। হতে পারে..." 

খেয়াল করি নাই, এর মধ্যেই চায়ের সরঞ্জাম সহ সত্যবতীর প্রবেশ ঘটিয়াছে।পান্ডেজি থামিতেই সে তড়বড় করিয়া কহিল "আমাদের খোকাকেও তো ছেলেবেলায় শরদিন্দুবাবুর লেখা জেনারেল ন্যাপলা, পরীর চুমু, সাপের হাঁচি পড়ে শুনাতাম। আর সদাশিবের গল্পগুলোও দারুণ মজার"

"আমার মোটামুটি লাগে" বলিতেই সত্যবতী এমন কটমট করিয়া আমার দিকে চাহিল, যে পুরাকাল হইলে ভস্ম হইতে কিছুমাত্র সময় লাগিত না। "সে কী ঠাকুরপো! আমার তো তোমার লেখাপড়ার প্রতি বেশ শ্রদ্ধা ছিল। মহারাষ্ট্রের কাহিনিকে বাংলায় এনে অমন দারুণ সব কান্ড আর কে লিখেছেন বল দেখি! আনন্দমেলায় যখন তরুণ মজুমদারের চিত্রনাট্য আর বিমল দাশের ছবিতে প্রকাশ পেত, খোকা যে খোকা, খোকার বাবা, আমি সবাই হামলে পড়তুম, ভুলে গেলে!"
তর্ক বাড়াইলাম না। আমার মুখপুস্তিকার লেখা ঢের বাকি পড়িয়া আছে। অবাক হইয়া বলিলাম "সত্যবতী! তুমিও শরদিন্দু বাবুর ভক্ত!"
"হব নাই বা কেন? কত ভাল রোমান্টিক সব উপন্যাস লিখেছেন ভাব দেখি। দাদার কীর্তি, মেঘদূত, ঝিন্দের বন্দী এমনকি ছোট গল্প ভল্লু সর্দার-ও কত্ সুন্দর। আমার ভারী ভাল লাগে। তোমার লাগে না"
খল হাসিয়া বলিলাম "জানো না বোধহয়, ঝিন্দের বন্দি আসলে প্রিজনার অফ জেন্দার অনুবাদ"
ভীমরুলের চাকে ঢিল পড়িল।"সব জানি ঠাকুরপো। মাকড়সা নিজের পেটের থেকে সুতো তৈরি করে, আর মৌমাছি অন্য ফুল থেকে মধু নিয়ে আসে। কিন্তু তুমি যদি আমায় মধু ছেড়ে মাকড়সার সুতো খেতে বল তা আমার পক্ষে অসম্ভব। তুমি খেলে খাও গে যাও"

অকাট্য যুক্তি। আমাকে চুপ করিয়া থাকিতে দেখিয়া বিজয়িনীর হাসি হাসিয়া সত্যবতী কহিল "তুমি বোধহয় সিনেমা থিয়েটার বিশেষ দেখ না ঠাকুরপো। দেখলে জানতে উত্তমকুমার থেকে আবীর, অনির্বান, সব কালের সব সুপুরুষ নায়কই আমাদের ওঁর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন"। ব্যোমকেশ সলজ্জ হাসি দিল। বুঝিলাম এই বিষয়ে আজ আমার জয়লাভ করা অসম্ভব। 

যে লেখা লিখিতে বসিয়াছিলাম তাহা শেষ হইল না। থাক। এতকাল পরে নূতন করিয়া লেখা শুরু না করাই বুঝি ভাল।মৃত্যুর পর কোন কোন লেখক হারাইয়া যান। কেহ আবার চরম স্রোতস্বতী নদীর মত তীব্রবেগে জনমানসে ফিরিয়া আসেন ।শরদিন্দু এই দ্বিতীয় শ্রেণীর অদ্বিতীয় লেখক।

মৃত্যুদিনে তাঁহাকে প্রণাম জানাই।

শনিবার, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

যতীন দাস ও রক্তঋণ ~ ডাঃ সমুদ্র সেনগুপ্ত

"রক্তঋণ"

কে এই টেরেন্স ম্যাকসুইনি? তদানীন্তন ব্রিটিশ সরকার রাজদ্রোহ এর অভিযোগে এই তরুণ আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামীকে ব্রিকস্টন  কারাগারে বন্দী করে। ব্রিটিশদের অত্যাচারের প্রতিবাদে তিনি ৭৪ দিন অনশনের পর প্রাণ ত্যাগ করেন। আজকের দিনটা তাঁকে নিয়ে নয়, এক "ভেতো" বাঙালিকে নিয়ে। যার নাম যতীন দাস। কে এই যতীন দাস?  হিন্দুস্তান সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান আর্মির সদস্য বিপ্লবী অজয় ঘোষ (পরবর্তীকালে সিপিআই এর সাধারণ সম্পাদক) এর ভাষায়, " কলকাতা থেকে যতীন দাস কে আনা হয়েছিল যাতে তিনি আমাদের বোমা বাঁধতে শেখান।" [সূত্রঃ ১] সেন্ট্রাল লেজিসলেটিভ এসেম্বলি তে ভগৎ সিং যে বোমা ছোঁড়েন সেটি যতীন দাসের বানানো।



আরেক বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোস (তিনি তখনো নেতাজি হননি), তাঁর নিজের ভাষায় তাঁর সাথে বিপ্লবী যতীন দাসের যোগাযোগ ও সম্পর্ক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেছেন,  "At the time of the Calcutta Congress in 1928, and after, he had taken a leading part in organising and training volunteers and in the Bengal Volunteer Corps of which the writer was the Chief officer or G.O.C, he held the rank of Major. ….After the Congress was over, the Volunteer Corps was maintained and branches were opened all over the Province. In this arduous work, Jatin had played an important role. "   [সূত্র ১: ]

লাহোর জেলের বিচারাধীন বন্দীদের উপযুক্ত মর্যাদার দাবিতে ভগত সিং এর সাথে যতীন দাস যোগ দেন অনশনে। ৬৩ দিন অনশন এর শেষে লাহোরে যতীন দাসের মৃত্যু হয় কারণ জেলবন্দী অবস্থায় কর্তৃপক্ষ তাঁকে জোর করে গলায় নল ঢুকিয়ে তরল খাবার খাওয়াতে যায়, যাকে বলা হয় ফোর্স ফিডিং, সেই তরল ভুল করে বুকে ঢুকে নিউমোনিয়া এবং মৃত্যু। কলকাতায় তাঁর শেষ যাত্রার সময় তাঁর বাবা বঙ্কিম বিহারী দাস অকাল মৃত যুবক পুত্রের মুখের দিকে তাকাতে অস্বীকার করলেন। ফোর্স ফিডিং এর চেষ্টায় নিউমোনিয়া আক্রান্ত যন্ত্রনাবিদ্ধ একটা মুখ। বললেন, "ছেলের সেই শেষ মুখটা মনে রাখতে চাই, যেটা লাহোর যাওয়ার আগে দেখেছিলাম।"

যতীন দাসের মরদেহ কলকাতায় (হাওড়ায়) নিয়ে আসার পরে তাঁর মৃতদেহ সারারাত পাহারা দেওয়ার জন্য থাকলেন সুভাষ। পরের দিন কলকাতা জুড়ে বিশাল মিছিল সহকারে অন্তিম যাত্রা কেওড়াতলার ঘাটের উদ্দেশ্যে। সংগঠন ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে মেয়র যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত এর সাথে সেই সুভাষ।  [সূত্র ২:]
পথের ধারে অগণিত মানুষ, মহিলা শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য। মিছিলে পায়ে পা মিলিয়ে হাঁটছে অগণিত ছাত্র যুব। তাদের হাতে প্ল্যাকার্ড। " নবযুগের দধীচি শহীদ বিপ্লবী যতীন দাস লহ প্রণাম"। মুখাগ্নি করলেন দাদা। শেষ অভিবাদন জানালো সুভাষ বসুর নেতৃত্বে বেঙ্গল ভলান্টিয়ারস। [সূত্র: ৩]

সুভাষের নিজের ভাষায়, "So Jatin Das died on September 13. But he died the death of a martyr. After his death the whole country gave him an ovation which few men in the recent history of India has received. As his dead body was removed from Lahore to Calcutta for cremation, people assembled in their thousands or tens of thousands at every station to pay their homage. His martyrdom acted as a profound inspiration to the youths of India and everywhere student and youth organisations began to grow up. " [সূত্র ৪]

স্মরণ সভায় সুভাষ স্মৃতিচারণ করলেন একদা সহকর্মীর। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে আবেগে ভেঙে পড়লো তাঁর গলা। তুলে ধরলেন কিভাবে অনশন-ধর্মঘট চালিয়ে যাওয়ার কিছুদিনের ।মধ্যে  অনশনকারীর মনের মধ্যে আসে এক বৈপ্লবিক রূপান্তর। [সূত্র ১:]

আয়ারল্যান্ড থেকে কলকাতার মেয়রকে পাঠানো টেলিগ্রামে মেরি ম্যাকসুইনি লিখলেন, " Family Terrance Mac Swiney unites patriotic India in grief and pride on death of Jatin Das. Freedom will come"। উত্তরে মেয়র লিখলেন, "India feels grateful for your message. Terrancc Mac Swiney showed the way Ireland Freedom. Jatin Das has followed him" ঠিক এইখানেই দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদীদের সাথে বামপন্থী জাতীয়তাবাদীদের তফাৎ কারণ বামপন্থীরা জাতীয়তাবাদী হওয়ার সাথে আন্তর্জাতিকতাবাদী ও বটে। তাই ম্যাকসুইনি পরিবারের এই সমবেদনা হাজার মাইল দূরের যতীন দাসের পরিবারের প্রতি। 

শুধু ম্যাকসুইনী পরিবার নয়, Eamon De Valera, আইরিশ স্বাধীনতা সংগ্রামের মুর্ত প্রতীক টেলিগ্রামে লিখলেন, "Jatin Das has not died in vain. He is the Indian MacSwiney. Freedom is certain" ভ্যালেরার এই আশা বৃথা যায় নি। ভারত দেশটা স্বাধীন হয়েছিল। [সূত্র: ৩]। 

শাসকের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সেদিনের রাজপথে নামা ছাত্র যুবরা সঠিকভাবেই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান তুলেছিলেন। অত্যাচারী শাসককে পরাস্ত করার মোক্ষম আয়ুধ প্রস্তুত করতে গেলে আত্মত্যাগ লাগে। লাগে দধীচির হাড়। 

আজ ১৩ই সেপ্টেম্বর। শহীদ দিবস। সেই যতীন দাসের মৃতু বরণের দিন, সেই যতীন দাস কারারুদ্ধ হওয়ার আগে প্রকাশ্যে যার শেষ স্লোগান ছিল "ইনকিলাব জিন্দাবাদ"। আজকে গাজা ভূখণ্ডে প্যালেস্তাইন এর নাগরিকদের ওপর সাম্রাজ্যবাদ এর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কলকাতার রাজপথে স্লোগান তোলা বামপন্থী ছাত্র যুবরাই শহীদ যতীন দাসের প্রকৃত উত্তরাধিকারী, মুচলেকা বীরের অনুগামী কোনো দক্ষিণপন্থীরা নয়, তাদের কোনো নৈতিক অধিকারই নেই বামপন্থীদের আন্তর্জাতিকতাবাদ নিয়ে, দেশপ্রেম নিয়ে প্রশ্ন তোলার। 

"শহীদ স্মরণে, আপন মরণে রক্তঋণ ....."

তথ্যসূত্রঃ
সূত্র ১: লেনার্ড গর্ডন, ব্রাদার্স এগেইনস্ট দ্যা রাজ
সূত্র ২: সুনীতি ঘোষ, দ্যা ট্র্যাজিক পার্টিশন অফ বেঙ্গল
সূত্র ৩: সি এস ভেনু, যতীন দাস দ্যা মারটার, প্রথম সংস্করণ।
সূত্র ৪: সুভাষ চন্দ্র বোস, দ্যা ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল (১৯২০-১৯৪২)

সোমবার, ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

চন্দ্রগ্রহণ ও কুসংস্কার ~ অনির্বাণ অনীক

ইতিহাসবিদ ব্রায়ান লেভ্যাক এবং অন্যান্য গবেষকরা দেখিয়েছেন যে ১৪৫০ সালের পর থেকে প্রিন্টিং প্রেস ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার পর ডাইনি শিকার বা witch hunt আরও তীব্র হয়ে ওঠে।



এর কারণ, প্রিন্টিং প্রেসের মাধ্যমে ডাইনি ও শয়তান সম্পর্কিত বই, ম্যানুয়াল, প্যামফ্লেট দ্রুত ও সস্তায় ছাপা সম্ভব হয়। উদাহরণ হিসেবে ১৪৮৭ সালে প্রকাশিত  berüchtigte Malleus Maleficarum বইটির কথা বলা যায়। এই বইটি ডাইনি সনাক্ত ও শাস্তি দেওয়ার "গাইডবুক" হয়ে উঠেছিল।

সেদিনের প্রিন্টিং প্রেসের জায়গাটি আজ নিয়েছে ফেসবুক, সমাজ মাধ্যম এবং দুনিয়ার নিকৃষ্টতম সংবাদ মাধ্যম ভারতীয় অনলাইন মিডিয়া।  চন্দ্র গ্রহণের প্রাক্কালে ফেসবুকের গ্রুপগুলো গত দুদিন ধরে কুসংস্কারের আড়ত হয়ে উঠেছে।  আলোচনার বিষয় গ্রহণের সময় কী খেতে নেই, কোনদিকে শুয়ে ঘুমাতে নেই, খাবার বিষাক্ত হয় কিনা -  ইত্যাদি মধ্যযুগীয় বাছ বিচার। তাতে ধুয়ো দিয়ে চলেছে গুচ্ছের অনলাইন মিডিয়া।  

গ্রহণ ঘিরে নানা কুসংস্কার থাকলেও সত্য হলো, এই সময়ে খাওয়া, ঘুমোনো বা গান-নাচ করার মধ্যে কোনো ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। খাবারও তখন স্বাভাবিক থাকে; বিষাক্ত হয় না, অতিরিক্ত জীবাণু জন্মায় না, কিংবা কোনো "রেডিয়েশন"ও মিশে যায় না। কিন্তু যারা সারসত্যটা বোঝেন, ভারতীয় সমাজের নিয়ন্ত্রণ এককালে তাঁদের হাতে যতটুকু ছিল, আজ সেটুকু নিয়ন্ত্রণও তাঁরা হারিয়েছেন। এই পোস্ট ট্রুথের যুগে মানুষকে বোঝানোর সাধ্যি কারো নেই!    

অনেক মুক্তচিন্তক বিশ্বাস করেন বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উন্নতির হাত ধরে কুসংস্কার এবং ধর্মমোহের প্রাচীরে ফাটল ধরবে। এ একেবারেই ভ্রান্ত ধারণা। প্রযুক্তি নিজে নিরপেক্ষ। প্রযুক্তি কার হাতে, কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, তার ওপরই নির্ভর করছে সমাজ বিজ্ঞানের পথে এগোবে নাকি কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হবে। দুনিয়ার আর দশটি বিষয়ের মতো এই বিষয়টিও পুরো দস্তুর রাজনৈতিক।  আজকের বাংলা তথা ভারত তা পদে পদে প্রমাণ করে ছাড়ছে!

শনিবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ভারতীয় সেমিকন্ডাকটর চিপ ~ পবিত্র দাস

এই ছবিটা নিয়ে গত কয়েকদিন অনেক খবর আর আলোচনা  দেখলাম। একটা বোর্ডের চারপাশে অনেকগুলো সেমিকন্ডাক্টর চিপ গাঁথা। তার মধ্যে নয়নের মণি হল Vikram 32bit processor. দেশ উচ্ছ্বসিত এই সাফল্যে। মাস্টারস্ট্রোক। জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ আসন...ইত্যাদি ইত্যাদি। সাধারণত এগুলোর খুব ডিটেইলে যাইনা। এক্ষেত্রে একটু গেলাম। কারণ নিজে সরাসরি এই ইন্ডাস্ট্রিতে, এই একই কাজের সাথে যুক্ত। 
যে চিপগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের ডিজাইন করা। এবং সম্ভবত চন্ডীগড় এর সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরিতে তৈরি করা হয়েছে। এখানে বলা বাহুল্য সেমিকন্ডাক্টর ল্যাবরেটরি ভারতের একমাত্র যায়গা যেখানে সেমিকন্ডাক্টর চিপ তৈরি হয়। প্যাকেজিং নয়, অ্যাসেম্বলি নয়, সরাসরি ওয়েফার তৈরি করা হয়। চিপ তৈরির সবথেকে জটিল, সবথেকে রিস্কি এবং সবথেকে লাভজনক ব্যাবসা। 


কিন্তু এখানে অনেকগুলো কিন্তু আছে। চন্ডীগড় এর এই ল্যাবের টেকনোলজি অন্তত ২৫-৩০ বছর পুরানো। ১৮০ ন্যানোমিটার CMOS নোডের ওপর বেস করে এই প্রসেসর তৈরি হয়েছে। এর নীচে কিছু বানানো সম্ভব নয় সেখানে। প্রযুক্তি বা এক্সপার্টাইজ নেই। কতটা পুরানো এই প্রযুক্তি?  আপনি যে ফোনে এই লেখাটা পড়ছেন, তার প্রসেসর নোড ৩ থেকে ২২ ন্যানোমিটার এর মধ্যে। এবার সেটাকে ১৮০ ন্যানো র সাথে তুলনা করুন। ১ ন্যানোমিটার মানে এক মিটারের ১০ কোটি ভাগের এক ভাগ।
 নোড কি? খুব সহজে বললে নোড মানে একটা চিপের মধ্যে একটা ট্রানজিস্টার এর একটা ছোট্ট অংশের মাপ (গেট বলা হয়)। সেটা যত ছোট হবে ট্রানজিস্টার তত ছোট হবে আর তত একটা চিপের মধ্যে বেশী সং্খ্যায় ট্রানজিস্টার ঠেসে দেওয়া যাবে। অনেক বেশী অপারেশন একসাথে করা যাবে। একটা আধুনিক মোবাইলের প্রসেসর চিপের মধ্যে ১০-২০ কোটি ট্রানজিস্টর থাকতে পারে।
১৮০ ন্যানোমিটার নোড কম্পিউটার, মোবাইল বা খুব উন্নত কোনও প্রসেসরে আজ থেকে ২৫ বছর আগে ব্যবহার হত। এখন এই নোড মূলত গাড়ী বা মেডিক্যাল ডিভাইসে ব্যবহার হয়। 
তার মানে তো ইন্ডিয়া দারুণ ব্যবসা করছে গাড়ি বা মেডিক্যাল ডিভাইসের চিপ বানিয়ে? না। একদমই নয়। কারন চন্ডীগড় এর এই ল্যাবে বানিজ্যিক ভাবে একটাও চিপ তৈরি হয়না। এদের একমাত্র কাস্টমার হল ইসরো বা DRDO. কারন সেখানে সস্তায় দেবার বাধ্যবাধকতা নেই আবার বিশাল পরিমাণে কিছু তৈরিও করতে হয় না।
 কেন বানিজ্যিক চিপ তৈরি হয় না? কারন হল প্রফিটেবিলিটি। একটা চিপ বানাতে যদি এক মিলিয়ন ডলার খরচ হয়, তাহলে পরের ১০০ মিলিয়ন চিপ বানাতে ১ ডলার করে খরচ হবে। মনে করুন কয়েক কোটি ট্রানজিস্টর আছে একটা ৫ মিলিমিটার জায়গায়। সেগুলো আবার একটা আরেকটার সাথে বৈদ্যুতিক ভাবে যুক্ত, মানে বাড়ির অয়ারিং আর কি। এবার তাহলে সেরকম একটা সিস্টেমের ভেতর, অন্তত কয়েকশো কোটি জাংশন আর ইন্টারকানেকশন থাকবে। আর সেই ছোট্ট সার্কিট সিলিকনের ওপর বানানো হবে। একটা প্রফিটেবল প্রসেসে ইল্ড ৯০-৯৯% অব্দি হতে পারে। মানে প্রতি ১০০ টা চিপে ৯৯ টা এই কয়েকশো কোটি জিনিসপত্র ঠিকঠাক তৈরি হয়েছে। কোথাও একটাও ভুল নেই। মাত্র একটা কোথাও কানেকশন খারাপ হলে গোটা চিপ কাজ করবে না। এই লেভেলের প্রযুক্তিগত প্রেসিশন মান্য করা হয়। এবং ইঞ্জিনিয়ার রা সেটা করতে সক্ষম। চিপ ইন্ডাস্ট্রি তে যেসব প্রসেস আছে সেগুলো সম্ভবত মানবজাতির বানানো সবথেকে স্টেবল এবং সবথেকে কন্ট্রোলড প্রসেস। সেগুলোর জন্য দরকার টাকা,প্রচুর স্কিলড ওয়ার্কার আর লাভের কথা না ভেবে প্রচুর প্রাথমিক ইনভেস্টমেন্ট। চন্ডীগড় এর ল্যাবে এগুলোর কোনওটাই নেই। তাই mass প্রোডাকশন হয় না। 
যা দেখছেন এই ছবিতে তার প্রযুক্তি অন্তত ২৫ বছর আগেকার।

মোদী সরকার গুজরাটে একটা ফ্যাবরিকেশন ফেসিলিটি বানানোর চেষ্টা করছে।।এছাড়া অন্য কোনও উদ্যোগ আপাতত নেই। সেট কতটা সফল হবে সময় বলবে।

বৃহস্পতিবার, ৪ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

অমৃতা শাহির ~ অরিজিত গুহ

মহব্বতো কি পরখ কা ইয়েহি তো রাস্তা হ্যায়
তেরি তালাশ মে নিকলু তুঝে না পাউ ম্যায়'



 
সাতের দশকের কোনো এক সময়। হিন্দি সিনেমার প্রখ্যাত গীতিকার শাহির লুধিয়ানভির কোনো গানে সুর দেবেন সুরকার জয়দেব। দুজনে মিলে একটা গানের ব্যাপারে আলোচনা করে চলেছেন। শাহির কিছু লিখছেন আর গুনগুনিয়ে সেই লাইনের সুর ভেজে চলেছেন। হঠাৎ জয়দেবের চোখ পড়ল একটা কাপের দিকে। কফির তলানিটা পড়ে শুকিয়ে রয়েছে। বেশ কয়েকদিন আগের কফি খাওয়া একটা নোংরা কাপ। 'এটা এখানে কী করছে?' বলে নোংরা কাপটা হয়ত তুলে অন্য জায়গায় রাখতে যাবেন জয়দেব, খেঁকিয়ে উঠলেন শাহির। 'হাত মত লাগানা'। একদম ছোঁবে না ওটাকে। সরো, সরো বলছি। ঘাবড়ে গেলেন জয়দেব। কি আছে কফির কাপে বুঝতে পারলেন না। কিছুক্ষণ পর শাহির নিজেই বললেন, 'কাপটায় অমৃতা কফি খেয়ে গেছে শেষ যখন এসেছিল। ওর ছোঁয়া লেগে রয়েছে কাপটায়। ওটাতে হাত লাগিও না।'
    জয়দেব বুঝতে পারলেন সবই। শাহির অমৃতার সম্পর্কের ব্যাপারে জানতে কারো বাকি ছিল না সেই সময়ের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে। সম্পর্কের পরিণতি হয়ত কিছু ছিল না। আর ততদিনে প্রায় কুড়ি পঁচিশ বছরের সম্পর্ক এসে ঠেকেছিল তলানিতে। শাহির তখন গায়ক সুধা মালহোত্রার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন। তাও হয়ত মাঝেমাঝে অমৃতার সাথে দেখা হত। দুজনে বসে থাকতেন ঘন্টার পর ঘন্টা। শাহির একের পর এক সিগারেট টেনে যেতেন আর অমৃতা প্রীতম কাপের পর কাপ কফি। কিন্তু দুজনের কেউই কোনো কথা বলতেন না। নিস্তব্ধতার মধ্যেই লোকানো থাকত অনেককিছু। আসলে নৈঃশব্দেরও বাঙ্ময় প্রকাশ আছে কিনা!

   ৩১ আগস্ট ১৯১৯ এ তৎকালীন পাঞ্জাবের গুজরানওয়ালায় যখন অমৃতার জন্ম হয়েছিল তার কয়েকবছর আগেই ব্রিটিশ ভারতে ঘটে গেছে এক নৃশংস গণহত্যার কাহিনী। ১৯শে এপ্রিলের জালিয়ানওয়ালাবাগের গণহত্যা কাঁপিয়ে দিয়েছিল সারা ভারত সহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টকেও। এক জ্বলন্ত অগ্নিকাণ্ডের সাক্ষী থেকেছিল পাঞ্জাব। তার কয়েকমাস পরে সেই পাঞ্জাবেই জন্ম হয়েছিল অমৃতা নামের আরেক অগ্নিপিণ্ডের। 
   ৪৭ এর দেশভাগ যে দুটো প্রদেশকে সব থেকে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ করেছিল তার নাম পাঞ্জাব আর বাংলা। এই দুটো প্রদেশই দেশভাগের ফলে তৈরি হওয়া ক্ষত আজও বয়ে নিয়ে চলেছে। পাঞ্জাবের প্রখ্যাত কবি হীর রনঝা কাহিনীর সৃষ্টা ওয়ারিস শাহ কে কবর থেকে তুলে এনে যখন অমৃতা প্রীতম বলেছিলেন তাঁর হীর রনঝা কাহিনীর পৃষ্ঠায় আরেকটা অধ্যায় যোগ করতে, যেখানে শুধু ৪৭ এর পাঞ্জাবের মেয়েদের ভাগ্যবিপর্যয় লিপিবদ্ধ থাকবে, তার বেশ কয়েকবছর আগে থেকেই কবিতার জগতে স্থান করে নিয়েছিলেন অমৃতা। এর জন্য অবশ্য বাবা কর্তার সিং এর অবদানও ছিল বেশ ভালোরকম। কর্তার সিং নিজেও ছিলেন একজন কবি। বাবার সেই ধারাই বর্তেছিল তাঁর ওপর। প্রথমদিকে সাধারণ কিছু কবিতা লিখলেও লাহোরের প্রগতিশীল পরিবেশের প্রভাবে পড়ে কালজয়ী কিছু সাহিত্য রচনা করা শুরু করেন। অমৃতার যখন এগারো বছর বয়স, তখন বিপত্নীক কর্তার সিং লাহোরে চলে আসেন। তখন থেকেই প্রোগ্রেসিভ লেখাপত্রের সাথে পরিচয় হতে থাকে। তারই ফলশ্রুতি 'আজ আখখান ওয়ারিস শাহ নু'। 'An Ode to Waris Sha'. এছাড়াও দেশভাগের ওপর আরেকটা বই যা তাঁকে অমর করে রাখবে তা হচ্ছে 'পিঞ্জর'। ভীষ্ম সাহানির 'তমস' আর অমৃতা প্রীতমের 'পিঞ্জর' একই সাথে উচ্চারিত নাম। 
  ষোলো বছর বয়সে বাড়ি থেকে ঠিক করে দেওয়া ছেলে প্রীতম সিং এর সাথে বিয়ের পর অমৃতা কউর থেকে অমৃতা প্রীতম বলে পরিচিত হতে থাকেন। তবে ছোটবেলার ওই বিয়েটা কোনোদিনই তাঁকে সুখ বা শান্তি কোনোটাই দেয় নি। ১৯৪৪ সাল নাগাদ লাহোরের এক মুশায়রাতে শাহির লুধিয়ানভির সাথে যখন দেখা হয় তখন শাহির মজেছিলেন অমৃতার রূপে আর অমৃতা মজেছিলেন 'কলম কা জাদুগর' শাহিরের কবিতায়। 
    দেশভাগের পর লাহোর থেকে প্রীতম সিং সস্ত্রীক দিল্লিতে চলে এলে শাহিরের সাথে সম্পর্কে আরো জড়িয়ে পড়তে থাকেন। তাঁদের দুজনের আদানপ্রদান হওয়া কিছু প্রেমপত্র সাহিত্যের এক ক্লাসিক নিদর্শন হয়ে রয়েছে। অমৃতা নিজের বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসতে চেয়েছিলেন শাহিরের হাত ধরে, কিন্তু শাহিরের আদর্শবাদী মূল্যবোধ আর তার থেকেও বড় কথা দায়িত্ব থেকে পালিয়ে বেরানোর মানসিকতা শাহিরকে বাধা দিয়েছিল সম্পর্ককে পূর্ণতা দিতে। অমৃতার কথায়, 

'ম্যায়নে টুটকে প্যেয়ার কিয়া তুমসে
কেয়া তুম ভি উতনা কিয়া মুঝসে

     অমৃতা জানতেন শাহির সম্পর্ককে পূর্ণতা দেবেন না। তাও বারেবারে ছুটে এসেছেন কোনো এক অজানা টানে। এমনকি শাহির যখন জড়িয়ে পড়েছেন সুধা মালহোত্রার সাথে তখনো শাহির ছাড়া আর কারো কথাই ভাবেন নি। প্রীতম সিং এর সাথে বিয়েটা হয়ত ভাঙতই। শাহির সেখানে অনুঘটকের কাজ করেছিলেন। 

'ম্যায় চুপ শান্ত অওর আদৌল খাড়ি থি
সির্ফ পাস ব্যয়ঠে সমুন্দ্র মে তুফান থা।
ফির সমু্ন্দ্র কো খুদা না জানে কেয়া খয়াল আয়া
উসনে তুফান কি এক পোটলি বান্ধি
মেরে হাথো মে থামাই
ঔর হাস কর কুছ দূর হো গয়া'

বারেবারে অমৃতার কবিতায় ঘুরে ফিরে এসেছেন শাহির। শুধু শাহির শাহির আর শাহির। জীবনে আর অন্য কেউ যেন ছিল না। ১৯৬০ এ বিয়ে ভেঙে বেরিয়ে আসার পর শাহিরের কাছে আশ্রয় চান নি। ততদিনে সাহিত্যের জগতে অমৃতা প্রীতম এক বিশিষ্ট নাম। ইতিমধ্যে পুরষ্কারও পেয়ে গেছেন কয়েকটা। তাঁর লেখায় বারেবারে ফিরে আসে মেয়েদের লড়াই আর মেয়েদের আত্মপরিচয়ের কথা। শুরু করেন পাঞ্জাবী কাগজ 'নাগমনি' পার্টনার ইমরোজকে সাথে নিয়ে। এই ইমরোজই শেষ অব্দি জীবনে থেকে গেছিলেন, যদিও কোনোদিনও বিয়ে করেন নি আর ইমরোজকে। লাইফ পার্টনার হিসেবেই থেকে গেছেন উনি।

   অনেকের অভিযোগ ছিল অবশ্য শাহিরের মা'র জন্য নাকি শাহির আর অমৃতার সম্পর্ক পরিণতি পায় নি। কারণ সিঙ্গল মাদার হিসেবে শাহিরকে মানুষ করার পর শাহিরের একটা আলাদা টান ছিল নিজের মায়ের প্রতি। 'ও আপকি বহু বন সকথি থি' অনেক অভিমানে মা'কে বলেছিলেন এই কথাগুলো। কিন্তু ততদিনে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়। সত্যিই কি শেষ হয়? তা নাহলে শাহিরই বা লিখবেন কেন 'মেহফিল সে উঠ যানে বালো/ তুম লোগো পার কেয়া ইলজাম/ তুম আবাদ ঘরো কে বাসি/ ম্যায় আওয়ারা ঔর বদনাম।' লেখার সময়ে হয়ত অমৃতাই এসেছিল চোখের সামনে। ঘর করতে না পারার যন্ত্রণা কুড়ে কুড়ে খেয়েছে সবসময়।

    শেষবার যখন ফিরে আসেন শাহিরের কাছ থেকে, তখন লিখে গেছিলেন 'তুমহারে দরখতি কি তহানি কা যো আসরা মিলা/ মেরে টুটে হুয়ে দিল কা পারিন্দা ঔহি রুক গয়া। যখন তোমার গাছের শাখা খুঁজে পেলাম/ সেখানেই মরে গেল আমার ভাঙা এ মনের পাখি। আর তার সাথে বায়রনের একটা কোট "In her first love, woman loves her lover/ In all the others, all she loves is love."। শাহির বলেছিলেন 'আপ জানে সে পেহলে ইসকা তার্জুমা কর দেঙ্গি?' শাহির অমৃতাকে নিয়ে মনোকষ্টে ভুগলে তাঁকে 'তুম' বলার বদলে 'আপ' বলে ডাকতেন। শাহির লিখেছিলেন তুম চলি যাওগি, পারছাইয়া রহ জায়েঙ্গি/ কুছ না কুছ ইশক কা রানাঈয়া রহ জায়েঙ্গি। 'শাগুন' সিনেমায় মহঃ রফি গানটা গাওয়ার পর শাহির লুধিয়ানভি রফিকে অনুরোধ করেন গানটা আবার রিটেক করার জন্য। ইশক শব্দটা হুস্ন দিয়ে পরিবর্তন করেন। বলেছিলেন অমৃতার জন্য এই লাইনটা লিখেছিলাম। আপনাকে কষ্ট দিচ্ছি জানি, কিন্তু এটাকে যতটা পারা যায় আমার হৃদয় দিয়ে প্রকাশ করব। মহঃ রফি খুশির সাথে গ্রহণ করেছিলেন অনুরোধ। একদম শেষে শাহিরের কথাতেই বলা যায়

'মহব্বত যো আনজাম তক পহুঁছি নেহি
ওয়াহি মহব্বত হ্যায়, বাকি কুছ নেহি'।

আজ ৩১শে অগাস্ট অমৃতা প্রীতমের জন্মদিন। অমৃতা প্রীতম এলে অবধারিতভাবেই চলে আসে শাহির লুধিয়ানভির নাম। দুজনের এই নিরুচ্চারিত ভালোবাসাকে ধরা কারো পক্ষেই হয়ত সম্ভব নয়।


সিনেমার ধারাবিবরণী ~ সুচেতনা দত্ত

জি বাংলায় সিনেমায় একটা বাংলা সিনেমা হচ্ছে।

মুনমুন সেন ফুলশয্যার খাট থেকে জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
জর্জ বেকারকে তাড়িয়ে দিয়ে মুনমুন সেন তার পোষা ডোবারম্যানকে নিয়ে শুয়েছে।
জর্জ বেকার মনের দুঃখে এমন একটা ঘরে গিয়ে ঘুমিয়েছে, যে ঘরে একটা কালী মূর্তি, আর তিন দেওয়ালে তিনটে বন্ধ জানলা।
মুনমুন সেন ফুলশয্যার ঘরে চাদরমুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে।
 জর্জ বেকার তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে বিনা চাদরে ঘুমোচ্ছে বলে বেজায় শীত করছে। কারণ বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে প্রবল ঝড় উঠেছে।
মুনমুন সেনের পাশে শোয়া ডোবারম্যানটা টেলিপ্যাথি করে টের পেয়েছে বন্ধ জানলার ঘরটার ভিতরে সোঁ সোঁ করে ঝড় হচ্ছে বলে জর্জ বেকারের ভীষণ শীত করছে।
নিজের টেলিপ্যাথি ক্ষমতার উপর বিশ্বাস না রেখে ডোবারম্যান নিজের চোখে জর্জ বেকারকে দেখতে যায়।
জর্জ বেকারকে টিউনিং ফর্কের মতো কাঁপতে দেখে ডোবারম্যান মুনমুন সেনের ঘরে ফিরে আসে এবং ঘুমন্ত মুনমুনের গায়ের থেকে চাদরটা মুখে করে খুলে নিয়ে গিয়ে জর্জ বেকারের গায়ে সেই চাদরটা চাপিয়ে দিয়ে এসে ভাল পোষা কুকুরের মতো মুনমুন সেনের পাশে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ে।
মুনমুন সেন ভোর বেলায় ঘুম থেকে উঠে ডোবারম্যানকে জিজ্ঞেস করে "আমার চাদরটা কোথায় গেল রে?"
সেই সময় গদগদ মুখে জর্জ বেকার চাদরটা ফেরত দিতে আসে।
এই চরম ক্লাইম্যাক্সের মুহূর্তে বদমাইশ ডোবারম্যান খাট থেকে নেমে পড়ে কোথায় একটা চলে যায় জর্জ বেকারকে কেস খাইয়ে দিয়ে।
জর্জ বেকারের হাতে চাদরটা দেখে মুনমুন সেন ভাবে রাতে জর্জ বেকার এসে মুনমুনের চাদর খুলে নিয়ে গেছে।
তারপর মুনমুন বেজায় গালাগালি করে রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে চলে গেছে।
তাই মুনমুনের বাবা কালী ব্যানার্জী সব সম্পত্তি জর্জ বেকারকে লিখে দিয়েছে।

আমি কি সিনেমাটা এরপরেও দেখব?
পুনশ্চঃ  বন্ধুদের অনুরোধে ধারাবিবরণী দিচ্ছি এর পর থেকে।

জর্জ বেকার শ্বশুরের আদেশ পালন করতে চাবাগানে রঞ্জিত মল্লিকের বাংলো থেকে মুনমুনকে ফিরিয়ে আনতে গেছে।
মুনমুন জিজ্ঞেস করেছে জর্জ বেকার কি ওর ভাল চায়? 
জর্জ বেকার হ্যাঁ বলেছে।
মুনমুন উত্তরে বলেছে, তাহলে যেন জর্জ বেকার নিজেকে মুনমুনের "কেয়ারটেকার" বলে পরিচয় দেয়।
জর্জ বেকার এক গাল হেসে বলেছে, "মা কালী আপনাদের সহায় হোন।"

এখন আবার বিজ্ঞাপন বিরতি।

মুনমুনঃ মা কালী সহায় হলে চলবে না। আপনাকে সহায় হতে হবে। আমার বাবাকে গিয়ে বলুন রঞ্জিত মল্লিকের সঙ্গে আমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে।
জর্জ বেকার (রঞ্জিত মল্লিকের উদ্দেশ্যে) ঃ আই উইশ ইউ অল দা বেস্ট।
জর্জ বেকার (ডোবারম্যানের উদ্দেশ্যে) ঃ চলি রে বিট্টু। আর বোধহয় দেখা হবে না। তোর মায়ের ভাল করে দেখাশোনা করিস।

শয়তান কুকুর কালী ব্যানার্জীর চিঠি রঞ্জিত মল্লিককে দিয়ে দিয়েছে। চিঠিতে লেখা আছে জর্জ বেকার মুনমুনের বর এবং কালী ব্যানার্জীর সব চা বাগানের মালিক।
রঞ্জিত মল্লিক জিপগাড়ি নিয়ে জর্জ বেকারের পিছনে তাড়া করেছে।
রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারকে বলছে, "আপনি মালিক, আমি আপনার কর্মচারী।" 
রঞ্জিত মল্লিক মুনমুনকে জর্জ বেকারের সিঁদুর পরতে বলছে। সিঁথি সাদা রাখতে মানা করছে।

মুনমুন সেন কালী ব্যানার্জীকে থ্রেট দিচ্ছে, "দেখি ওর মা কালী ওকে কী করে বাঁচায়!"
কালী ব্যানার্জী থ্রেট খেয়ে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে মরে গেছে।

জর্জ বেকার মুনমুন সেনের ক্লাবের মেম্বারশিপের রিনিউয়াল ফি দিচ্ছে না। মাধবী মুনমুনের হয়ে জর্জ বেকারকে বলছে টাকা দিয়ে দিতে।

বিজ্ঞাপন বিরতি।

সৌমিত্র ব্যানার্জী ভাড়াটে খুনি নিয়ে এসে যেই বলেছে "এবার দেখি সালাকে কে বাঁচায়?" বিট্টু ডোবারম্যান এসে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা কামড়ে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে একটা গাছের উপর তুলে দিয়েছে সৌমিত্র ব্যানার্জীকে।
তারপর সৌমিত্র ব্যানার্জী ভিতরে সাদা গেঞ্জি পরে আছে দেখে সৌমিত্র ব্যানার্জীর জামা খুলে এনে পাঞ্জাবি পরা জর্জ বেকারের হাতে দিয়ে দিয়েছে।

মুনমুন সেনের বন্ধু শুভ্রার বিয়েতে জর্জ বেকার মুনমুন সেনের হয়ে এক লক্ষ টাকা দিয়ে দিয়েছে। সেই শুভ্রা যে ফুলশয্যার রাতে মুনমুনকে থ্রেট দিয়ে বলেছিল যে মুনমুন যদি জর্জ বেকারকে আর কষ্ট দেয়, তাহলে জর্জ বেকারকে একদিন শুভ্রার ঘরের বিছানায় পাওয়া যাবে।

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে শুভ্রার কন্যাসম্প্রদানের সময় মুনমুন যেন শুভ্রার বাবার পাশে থাকে।

বিজ্ঞাপন বিরতি

শুভ্রার বাবা মুনমুনকে বলছে, "তোর মতো মেয়ে কি স্বামীনিন্দা সহ্য করতে পারে? জর্জ বেকার তোর মতো দেবীকে বৌ হিসেবে পেয়ে ধন্য হয়েছে।"

মুনমুন জর্জকে ঃ তুমি নিজেকে এত ছোট করলে কেন? 
জর্জ ঃ যাকে স্ত্রী হিসেবে পেয়ে আমি ধন্য হয়েছি, তাকে তো আমি বড় করবই।

শুভ্রার বাসরে সৌমিত্র ব্যানার্জী জর্জ বেকারকে গান গাইতে বলেছে বলে মুনমুন রেগে গিয়ে জর্জ বেকারকে নিয়ে বাসর থেকে চলে যেতে চাইছে।

জর্জ বেকার বাসরে "আমি সবার সামনে ছোট হব। মা কালীর নাম করে একটা গান শুনিয়ে দিই" বলে একটা প্রচণ্ড সেল্ফপিটির গান গাইছে। মুনমুন বাসর থেকে বেরিয়ে গিয়ে ডেকোরেটর আর ক্যাটারারের সাইনবোর্ডে মাথা ঠেকিয়ে জর্জ বেকারের সেল্ফপিটির গান শুনছে।

শুভ্রা নিজের বাসি বিয়ের সকালে এসে মুনমুনকে হাজব্যান্ড সোয়াপিংয়ের প্রস্তাব দিয়েছে। 

মুনমুন তাই রাতে কাঁদছে। নিজের খাটের চাদর এনে তিনটে টেবিল জোড়া লাগিয়ে ঘুমন্ত জর্জ বেকারকে চাদরমুড়ি দিয়ে ডোবারম্যান বিট্টুকে খুব বকে দিয়েছে, "আমি নাহয় ওকে ভালবাসি না। কিন্তু তুই তো ওকে ভালবাসিস। কিছু তো করতে পারতিস, দেখছিস না শীতে কষ্ট পাচ্ছে!" বলে। কিন্তু এখন ঘরের ভিতর ঝড় হচ্ছিল না। জর্জ বেকারও এসএইচএমে কাঁপছিল না।

বিজ্ঞাপন বিরতি

রঞ্জিত মল্লিক জর্জ বেকারের সই নিতে এসেছে। জর্জ বেকার রঞ্জিত মল্লিককে বাড়িতে মুনমুনের কাছে পাঠাতে চাইছে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিকের তাড়া আছে, দার্জিলিং মেলে ফিরতে হবে বলছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীকে মুনমুন চড় মেরেছে বলে ওর চ্যালাদের দিয়ে মুনমুনকে মলেস্ট করাচ্ছে। জর্জ বেকার সৌমিত্রকে বলছে মুনমুনকে ছেড়ে দিয়ে জর্জ বেকারকে ধরতে।

সৌমিত্র এই প্রস্তাবে রাজি হয়নি, জর্জ বেকারকে বলেছে চা বাগানগুলো সৌমিত্রকে দিয়ে দিতে। আর যতক্ষণে জর্জ বেকার দলিল আনবে ততক্ষণ মুনমুনকে মাঠে নিয়ে গিয়ে মলেস্ট করা হবে।

জর্জ বেকার কাগজ আনতে যাচ্ছিল রাজি হয়ে। কিন্তু রঞ্জিত মল্লিক খুব রেগে গিয়ে একাই সবাইকে মেরে পাট করে দিয়েছে।

সৌমিত্র ব্যানার্জীর ঘাড় ধরে মুনমুনের পায়ে ফেলে রঞ্জিত মল্লিক বলেছে "মাকে যেমন ভক্তিশ্রদ্ধা করো, তেমন করে পায়ে ধরে মা ডেকে ক্ষমা চাও।"
সৌমিত্র মুনমুনকে ঃ "মা আমাকে ক্ষমা করে দাও।"

মুনমুন মা কালীকে অঞ্জলি দিতে দিতে গান গাইছে, "তোমার চরণ ছুঁয়ে বলছি আমি মা, চাই না সোনাদানা... ওর জীবনের আনন্দতে চাই না আমি বেড়া দিতে...ও যেখানে সুখ খুঁজে পায় ওকে দে সেই ঠিকানা।"

বিজ্ঞাপন  বিরতি

মুনমুন সেনকে জর্জ বেকার জড়িয়ে ধরেছে। তাই দেখে বিট্টু ডোবারম্যান আড়মোড়া ভাঙছে।

জর্জ বেকার আর মুনমুন মাধবীকে প্রণাম করতে গেছে। কিন্তু মাধবী নিজের প্রণাম বুঝে না নিয়ে আগে মরে যাওয়া কালী ব্যানার্জীকে প্রণাম করতে বলেছে। যেই প্রণাম করেছে কালী ব্যানার্জীর ছবিতে অমনি সিনেমা শেষ হয়ে গেছে।

অতএব সিনেমার ধারাবিবরণীও শেষ হল।

বুধবার, ৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

গনেশ পুজোর রমরমা ~ মানস নাথ

অনেকেই আছেন যারা রাজনীতিটা প্রফেশন মনে করেই করেন৷ তাতে দোষের কিছু দেখি না। আমাদের মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী যতই বলুন সমাজসেবা করতে এবং মানুষের জন্য কাজ করতে হলেই রাজনীতিতে আসুন বাস্তবে তা খুব একটা  সম্ভব হয় না৷ কারণ রাজনীতি করতে টাকা লাগে, সমাজসেবা করতেও লাগে। প্লাস নিজের এবং পরিবারের ভরনপোষণ খরচখরচা রয়েছে। তো সারাদিন ধরে অসুস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ালেন, কাঁধে করে মৃতদেহ অন্তেষ্টি করতে নিয়ে গেলেন কিন্তু দিনের শেষে আপনার খরচা আপনাকেই তুলতে হবে। ঠিক কিনা? 



এবার আপনি বলবেন রাজনীতিতে কি পয়সা নাই?  

নেতাদের ফ্ল্যাট ফুঁড়ে কোটি কোটি টাকার বান্ডিল এমনি এমনি বেরোচ্ছে! আহা, সেতো বিগ বিগ নেতা মন্ত্রীদের। থিংক লোকাল৷  আসুন তো হিসাব করি একটা এলাকায় কতজন নেতা থাকতে পারে। সবার উপরে অনুপ্রেরণা আর কালিঘাট, ওটা বাদ দিয়েই হিসাব করছি৷ ধরুন একজন হল এম পি, একজন হল এম এল এ,  একজন হল কাউন্সিলার। পঞ্চায়েত হলে  প্রধান, মেম্বার  এগুলো নির্বাচিত পোস্ট। এছাড়া দলের  সভাপতি বা সেক্রেটারি। দলের ছাত্র যুব শাখার এক দুজন কচি নেতা, যে স্কুল কলেজগুলো দেখবে। এবারে বাদবাকি যারা তারা হল অনুগামী  চ্যালাচামুণ্ডা।

এরা বিভিন্ন নেতার আশেপাশে থাকে, এদের যথেষ্ট কামাই। ইঁট বালুর সাপ্লাই, সিন্ডিকেট, কন্ট্রাকটারি এদেরই হাতে। এখানেই হল আসল ক্ষীর। এর কন্ট্রোল হাতে নেওয়ার জন্যই এত কষ্ট এত ত্যাগ স্বীকার এত সমাজসেবা।

এবার দেখেনি একটা এলাকায় ক্ষমতার ভরকেন্দ্র মানে টাকাপয়সা বিলিবন্টন কার হাতে। এম পি দূরের শুকতারা। এইসব এঁটোকাঁটায় সচারাচর মুখ মারেন না। এম এল এ প্রভাবশালী হলে সুতো তার হাতে থাকে, শিল্পী বুদ্ধিজীবী হলে তার রোল অতিথি শিল্পীর। কর্পোরেশন মিউনিসিপালিটিতে অনেকটাই ক্ষমতা কাউন্সিলারের হাতে। তাই কাউন্সিলর হওয়ার জন্য প্রতিযোগিতাও বেশি।

এক একটা এলাকায় আট দশজন লবি করতে থাকে কাউন্সিলর পদের জন্য। তার উপর আবার মহিলা বা এস সি / এস টি সংরক্ষিত হলে গেলে পারমুটেশন কম্বিনেশন বদলাতে থাকে।

আচ্ছা এই যে একটা ওয়ার্ডে আট দশজন কাউন্সিলর হওয়ার জন্য লড়াইতে থাকে প্রফেশনের শুরুরদিকে  তাদের ইনভেস্টমেন্ট  কেমন?  প্রথম যোগ্যতা ঠিকঠাক ল্যাজ ধরা। এম পি,  এম এল এ বা পার্টির বড় নেতার সাথে সুসম্পর্ক। যাকে বলে দাদা/ দিদি ধরা। পরের কাজ কিছু চামচা পোষা। যারা তার আশেপাশে থাকবে সমাজসেবা করার সময়। একা একা তো আর মড়া কাঁধে করে শ্মশানে কবরস্থানে যাওয়া যায়  না!  পরের স্টেপে ধরতে হবে কোন শাঁসালো ক্লাব। যারা বেশ নামকরা পুজো করে থাকে। একেবারে বড়বড় দুর্গাপূজা কমিটিগুলোতে ঢোকা তো মুখের কথা নয়। একজিস্টিং বিধায়ক বা কাউন্সিলর সেখানে অলরেডি অনুপ্রেরণায় রয়েছেন৷ তাকে সরিয়ে নতুন নেতা হতে চাওয়া মুখটি জায়গা নেবে কেমন করে?  এর উপর আবার রয়েছে নেপোটিজম৷ নেতার ছেলে মেয়েদের ডায়রেক্ট লাইন৷ 

দুর্গা, কালী এরা হল ওপরতলার। আগে থেকেই বড় নেতাদের স্নেহধন্য। বিশ্বকর্মা এখন রিকসাওয়ালা অটোওয়ালাদের হাতে, কারখানা ফারখানা কবেই উঠে গেছে! লক্ষ্মী কার্তিক ঘরোয়া। সরস্বতী ছোটদের। রবিঠাকুরের আর সেই আগের বাজার নেই। শুরুটা তাই রামনবমী, হনুমান বা গনেশপুজো দিয়েই করা ভালো। এলাকায় কচিনেতার ছবিসহ গনেশ পুজোর ফেস্টুনে ছেয়ে দিতে হবে। পাড়ার এমাথা থেকে ওমাথা মাইক আর ননস্টপ মারাঠি গান। 
 এতকিছুর পরেও কপালে সিঁকে নাও ছিঁড়তে পারে। কিন্তু লেগে থাকার তো কোন বিকল্প নেই রাজনীতিতে৷ ভাবলে একটু খারাপই লাগে। একবার ফস্কে গেলে চার চারটি বছরের অপেক্ষা। দেঁতো হাসি মুখে মেখে নতুন কাউন্সিলারের সাথে মিছিলে মিটিংয়ে অনুষ্ঠানে আলাপে হে হে চালিয়ে যেতে হবে কিন্তু স্বপ্ন মরতে দেওয়া যাবে না। বছরে একবার অন্তত ফ্লেক্সে ব্যানারে নিজের নাম তুলে এলাকাবাসীকে পুজো, দেওয়ালি বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাতে হবে।আর ছোট ছোট পুজোতে নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে হবে।  এটুকু ইনভেস্টমেন্ট মাস্ট। 

তাহলে কথা হল হাতেখড়ি করতে গনেশ হল প্রথম পছন্দ। সিদ্ধিদাতা বলে কথা।

মঙ্গলবার, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৫

ফুটলো ছাতিম ~ সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়

কোথাও কিছু ফুটলো ছাতিম, কোথাও কিছু পড়লো ঝরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, বর্ণমালার কোন অক্ষরে
লিখছো ফাঁকি আরাত্রিদিন ঋণ মেটানোর ক্লান্ত আভাস
খাতক আমিই নই মহাজন, ধার করে খাই বারোটা মাস

কিন্তু সে সব কূটকচালি, হিসেব নিকেশ, পাওনা দেনা
ভাবছো যখন অনন্যমন, আর কি তোমায় যাচ্ছে চেনা?
আটপহুরের খোলস ছিঁড়ে তুলছো ধনুক লক্ষ্যবেধী
বিদ্ধ করবে? আপত্তি নেই, বিষ যেন হয় মর্মভেদী

আগুন যখন পোড়াচ্ছে রোজ বলবো কি আর কেমন জ্বালা
রঙ মেখেছি শরীর জুড়ে, জগৎ আমার নাট্যশালা
এই মুহূর্তে বাঁচছি প্রবল এই মুহূর্তে যাচ্ছি মরে
ভাবতে এ সব ভাল্লাগে না, কোথায় ছাতিম পড়লো ঝরে