দিল্লি পুলিশ আর অমিত মালব্যের কথাবার্তার ব্যাখ্যা আর ভিত্তি নিয়ে অনেক বিশেষজ্ঞ মাঠে নেমে পড়েছেন। তাতে ছবিটা একটু গুলিয়ে যাচ্ছে। কাজেই আমি আমার ক্ষুদ্রবুদ্ধিমতো 'ভাষা' সম্বন্ধে ধারণা একটু পরিষ্কার করে দিই, সকলকে অভিবাদন জানিয়ে। এ কথা আমি ছাপার অক্ষরে বিশ-পঁচিশ বছর আগে থেকে লিখছি, আমার 'ভাষাপ্রেম ভাষাবিরোধ', বা 'ভাষা, ব্যাকরণের বাইরে' দেখলেই সেটা মালুম হবে। হযতো বাংলায় লেখা বলে সেগুলি বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের চোখে পড়ে না। যাঁদের পড়ে না, তাঁরা আমাকে বলবেন, ইংরেজি বা অন্য ভাষায় তাঁরা ভাষা সম্বন্ধে এই ধারণাটা পেয়েছেন কি না।
আসল কথা হল ভাষা, বিশেষত বড়সড়ো লিখিত ভাষা একটা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট বা অবস্তুক ধারণা। তা কখনোই একটিমাত্র, সংহত, একরূপী (ইউনিফর্ম), অবিমিশ্র, ভূগোলে একস্থানবদ্ধ বস্তু নয়। বাস্তবে তার অনেক ধরনের রূপ আছে।
এক ধরনের রূপ হল স্থানিক। তাকে স্থানীয় উপভাষা বা রিজিয়োনাল ডায়ালেক্ট বলে। বাংলা পাঠ্যবইয়ে তার চারটে বা পাঁচটা রূপ বলেছেন পণ্ডিতেরা। কিন্তু তা বিপুল সরলীকরণ মাত্র। আসলে সেগুলোর মধ্যে লুকিয়ে আছে আরও অজস্র উপভাষা, যেগুলোর সীমানানির্ধারণ করা খুব কঠিন। রাঢ়ীর মধ্যে আছে রাঢ় অঞ্চলের নানা জেলার উপভাষা। কিন্তু একটা জেলার উপভাষাই কি এক ? তাও তো নয়। মেদিনীপুরেই ঝাড়গ্রাম অঞ্চলে এক, ঘাটাল অঞ্চলে এক, কাঁথি দিঘা অঞ্চলে এক, আবার উত্তরাংশে এক। নিশ্চয়ই আরও আছে। এই রকম বর্ধমানে, নদীয়ায়, মুর্শিদাবাদে, অখণ্ড চ্ব্বিশ পরগনায়। নদীয়ায়। অর্থাৎ জেলার উপভাষাও একটা সরলীকরণ।
তারপর তারই মধ্যে আবার নানা স্তর তৈরি করে নারী, পুরুষ, জীবিকা, ধর্ম ইত্যাদির মাত্রা। নদীয়ার ভাষাকে আমরা মান্য বাংলার কাছাকাছি মনে করি, কিন্তু নদীয়ার কোনও কোনও অঞ্চলে আমি জিগাশলুম, (জিজ্ঞেস করলাম) ইত্যাদি শুনি, তা মোটেই মান্য নয়। এইভাবে লিঙ্গ, জীবিকা, ধর্ম ইত্যাদি ভাষার স্থানিক ছাড়া যে আর-একরকম বৈচিত্র্য নির্মাণ করে তাকে বলি শ্রেণিভাষা, ইংরেজি সোশিয়োলেক্ট। তাতে নানা বানানো বৈচিত্র্যও থাকে, যেমন নারীদের, বা ব্যবসায়ীদের গোপন ভাষা, দুই দূরবর্তী ভাষার লোকের আদান-প্রদানে তৈরি পিজিন (pidgin) ভাষা, বা তার খানিকটা স্থায়ী রূপ ক্রেয়োল (creole) ইত্যাদি। পিজিন আর ক্রেয়োলে তফাত হল, পিজিন যেখানে শুধু বাইরের ভাষা থেকে যায়, সেখানে ক্রেয়োল ঘরের ভাষা হয়ে যায়।
এই সমস্থ স্থানিক, সামাজিক আর গোষ্ঠীগত ভাষারূপের ওপর গড়ে ওঠে একটা মান্য ভাষারূপ, যাকে বলা হয় মান্য বা স্ট্যান্ডার্ড বা প্রমিত ডায়ালেক্ট। সেটাও ডায়ালেক্ট, কিন্তু সেটা একটা সুপার ডায়ালেক্ট। কারণ তার ব্যবহারের ব্যাপ্তি যেমন সবচেয়ে বেশি, তার মর্যাদাও সবচেয়ে বেশি। কেন ? কারণ সেটা নানা উপভাষা অঞ্চলের লোকেরা পরস্পরের সঙ্গে কথা বলার সময় ব্যবহার করতে বাধ্য হয়, যদি নিজেদের উপভাষা অন্যে বুঝতে না পারে। এর মুখে ব্যবহার হয় রাজধানীতে (বেশিরভাগ সময়ে রাজধানীতে তৈরিও হয় এটা), ক্লাসঘরে, লেখাপড়ার জগতে, রেডিয়ো-টেলিভিশনের সম্প্রচারে, ওখানে আর বাইরে নানা বক্তৃতায়--তাই যেমন এর মর্যাদা অন্য বৈচিত্র্যের তুলনায় হু হু করে বেড়ে যায়, আবার লেখা আর ছাপায় এর ব্যবহার এর মর্যাদাকে আরও জ্যামিতিক হারে বাড়িয়ে দেয়। সরকারও প্রশাসনিক কাজে এ ভাষা ব্যবহার করতে থাকে, তাই এটা কখনও সরকারি ভাষাও হয়ে ওঠে।
এভাবে এর সম্মান এত বেড়ে যায় যে, এটাই পুরো ভাষাটার পরিচয় দখল করে নেয়, অন্য বৈচিত্র্যগুলোকে আড়াল করে। সেগুলোও কিন্তু ভাষা, বাংলার হলে বাংলা ভাষারই অংশ। সিলেটের বাংলাও বাংলা, পুরুলিয়ার বাংলাও বাংলা, চট্টগ্রামের বাংলাও বাংলা। বৈধ বাংলা। যদি না, রাজনৈতিক বা অন্য কোনও কারণে, ব্যবহারকারীরা তাকে অন্য ভাষা বলে দাবি করে। সেটার ভিত্তি অন্য। এই ভাবে বাংলার আগেকার কামরূপী উপভাষা (অসমিয়ার গোয়ালপাড়িয়া উপভাষাও খানিকটা) এখন সরকারি স্বীকৃতি পেয়ে 'রাজবংশী' ভাষা হয়েছে।
যাই হোক, এই সব ছুটকো উদাহরণ ছাড়া. এখনও সবই বা়ংলা। কাজেই বাংলাভাষা, সব ভাষার মতোই একটা ভাষাবৈচিত্র্যের গুচ্ছ মাত্র, একটা অখণ্ড, শিলীভূত ভাষা নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মান্য বা প্রমিত বাংলাই বাংলা, এই সমীকরণের মূলে আছে ওই ভাষারূপটির ব্যাপক ব্যবহার আর মর্যাদা। বিদেশিরা যখন 'আমি বাংলা শিখছি' বলে তারা ওই মান্য বাংলাই বোঝায়, ইশ্কুল কলেজের বাংলা পাঠ্যক্রমও মূলত মান্য বাংলার।
এই মান্য বাংলাই দুই বাংলায়, ত্রিপুরায়, আসামে আচারিক বা ফর্ম্যাল উপলক্ষ্যে চলে, এমনকি পৃথিবীর নানা জায়গায়, ইংল্যান্ডে, মার্কিনদেশে, অস্ট্রেলিয়ায়, জাপানে--নানা অঞ্চলের বাঙালিরা একত্র হলে এই বাংলায় কথা বলে। কিন্তু সব জায়গার মান্য বাংলা কি হুবহু এক ? একেবারেই না, তা হওয়ার কথাই নয়। ব্যাকরণ মূলত এক, কিন্তু প্রচুর স্থানীয় শব্দ ও পদবন্ধ তাকে কিছুটা 'আঞ্চলিক' করে তোলে। কিন্তু তার 'মান্য' চেহারাটি অস্পষ্ট হয় না। 'প্রমিত' উচ্চারণও একটা আছে। সেটা সবাই মোটামুটি মেনে চলার চেষ্টা করে, টানটোনের তফাত হলেও। এই লেখক জানে যে, বাংলাদেশে প্রমিত উচ্চারণ নিয়ে বেশ মাথাব্যথা আছে। ঢাকায় প্রচুর প্রমিত উচ্চারণের কর্মশালা ও ক্লাস হয়।
লেখা বড় হচ্ছে, আমি সাধারণত এত বড় লিখি না। শেষে যোগ করি যে, ভাষাবিজ্ঞানে সব ভাষা আর উপভাষাকে বৈধ আর সমমর্যাদাসম্পন্ন বলে বলা হয়। তা নিয়ে ঠাট্টাতামাশা করা এক ধরনের অসৌজন্য। অবশ্যই বাস্তব জীবনে সামাজিক ক্ষেত্রে তা বার বার লঙ্ঘিত হয়, কারণ মানুষের ব্যবহার বিজ্ঞানের নির্দেশ মেনে চলে না।
এখন দিল্লির পুলিশের কর্তা বা মালব্যবাবুর এত সব কথা জানবার কথা নয়। তাঁরা তাঁদের অজ্ঞতা বা কূটনীতি নিয়ে খুশি থাকতেই পারেন। 'বাংলা' কোনও ভাষাই নয়' এই কথাটা তিনি কী অর্থে বলেছেন জানি না, কিন্তু বলে তিনি তাঁর দলের উপকার করেছেন তা বলা যাবে না। জানি না, রাজনীতিতে একটু উঁকি দিয়ে বলি, এরও পেছনে কোনও 'সেটিং' আছে কি না। যাই হোক, তিনি ভারতের সংবিধান যদি পড়ে থাকেন তা হলে দেখবেন তার অষ্টম তফশিলে 'বাংলা' ভাষার একটি স্বীকৃতি আছে, নানা অভিধানেও 'বাংলা' কথাটির অর্থ দেখতে পারেন। কিন্তু তাঁকে শিক্ষিত করা আমার কাজ বা জীবন-সাধনা নয়। বাংলা ভাষা বলতে কী বোঝায় তাই আমি একটু বন্ধুদের জানানোর চেষ্টা করলাম। ভুল বা অসম্পূর্ণতা থাকলে নিশ্চয় কেউ আমাকে দেখিয়ে দেবেন।