[যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় এবং সেই নিয়ে বিভিন্ন ঘটনা এবং লেখা বারবার ফিরে আসে ভাবনায়। যখনই সেখানে কোন অকাজে যাই, সেসব কেজোকথার শেষে বেরোতে বেরোতে সন্ধে। চারপাশে ঝকঝকে পড়ুয়াদের কলতান, পাখির কিচিরমিচির, একটু দূর থেকে ভেসে আসা বাসের হর্নের মধ্যে হঠাৎ করে সময়যানে ফিরতে হয় সাড়ে তিন দশক। অনেক কিছুর মতই চোখের সামনে ভেসে ওঠে এরকম এক পুরনো লেখা, যা হয়তো দু-এক জায়গায় ছাপা হয়েছে আগে, তবে সেভাবে পেশাদারী কোন কাগজে নয়। তাই আর কারও কোন অনুমতি না নিয়েই আপনাদের সামনে আর একবার টুকেই দিলাম পুরনো সেই তথ্য আর কল্পনার মিশেল, দু এক জায়গায় অল্প এদিক ওদিক করে। গবেষণার ক্ষেত্রে হলে নিশ্চিত চাকরি যেত, ওই যাকে বলে কিনা সেল্ফ প্লেজিয়ারিজম। সেকথা থাক। আগে পড়েছেন সে সম্ভাবনা খুবই কম। আর পড়ে থাকলে তো এই অত্যাচারের হাত থেকে মুক্তি পেয়েই গেলেন। লেখাটি আমাদের এক অতিপ্রিয় অঙ্কের মাস্টারমশাই অধ্যাপক তরুণ কুমার মুখার্জীর স্মৃতিতে, সংক্ষেপে যিনি পরিচিত ছিলেন টিকেএম নামে। বহু বছর আগে যখন এই লেখাটা প্রথম লিখি, তখন তিনি সকলের মধ্যেই ছিলেন। আর একটি তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল এ বছরের জুলাই মাসে যখন নতুন করে এই লেখাটি খুঁজে পেতে রিভাইজ করছি, ঠিক তার কদিন আগেই ফ্রান্সের নির্বাচনে তৃতীয় থেকে একলাফে প্রথম স্থানে চলে এসেছে বামপন্থীরা। এই লেখার প্রেক্ষিত সেই ফ্রান্সকে নিয়েই, তবে দু-আড়াই শতক আগে।]
ছিপছিপে লম্বা চেহারার তরুণ-বাবু হেঁটে যাচ্ছেন লাল চেয়ারের পাশ দিয়ে। শিরদাঁড়া সোজা, কাঁধে ঝোলান একটা সপ্তর্ষিমন্ডল আকারের আঁকড়া দেওয়া কাঠের ছাতা। এইট-বি বাস-স্ট্যান্ড এর দিক থেকে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ঢুকে একটু বাঁ দিকে গেলে ছাত্র সংসদের অফিস। রাজ্যে বহু রাজনৈতিক পরিবর্তন সত্ত্বেও অতি বামদের দাপট এই কচি সংসদে কখনও কমে নি। সেখান থেকে সোজা হাঁটলে ডান দিকে খেলার মাঠ আর বাঁদিকে ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া লাল চেয়ার। থুড়ি জায়গাটা আছে, কিন্তু সিমেন্টে বাঁধানো সেই প্লাস্টিকের চেয়ার গুলো আর নেই। সময়টা আশির দশকের শেষ ভাগ, সেপ্টেম্বর মাস প্রায় ফুরিয়ে এসেছে - কলকাতায় পুজোর গন্ধ। স্যার অঙ্কের ক্লাস শেষ করে ফিরছেন। তাঁর হাঁটার গতির সঙ্গে তাল সামলাতে ছাত্রদের রীতিমত ছুটতে হচ্ছে। হাঁপাতে হাঁপাতে তাঁকে ধরে ফেলল প্রণব। সঙ্গে আমরা আরও অনেকে। যাদবপুরের ইলেক্ট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্ররা। কি দুর্ভাগ্য যে প্রযুক্তি বা বিজ্ঞান যাই পড়ো না কেন, অঙ্কের হাত থেকে নিস্তার নেই। ক্লাসে পরীক্ষার খাতা দিয়েছেন তরুণবাবু। আমাদের মত পরীক্ষায় নিয়মিত গাড্ডু খাওয়া ছেলেদের ধান্দা কি করে দু-এক নম্বর বাড়ানো যায়। "স্যার, এখানটা কেন কেটেছেন? আর একটু নম্বর কি এখানে বাড়ত না? আর এক নম্বর বাড়লেই আমার চল্লিশ হয়ে যেত", ইত্যাদি ইত্যাদি। তরুণবাবু রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে কারো নম্বর বাড়িয়ে দিচ্ছেন, কাউকে বা একটা ছোট্ট ধমক। উচ্চমাধ্যমিকে প্রথম হওয়া প্রণবের বক্তব্য অবশ্য অন্য। সে পুরো নম্বর পেয়েছে। কিন্তু তার একটা অঙ্কে সামান্য ভুল আছে, সেখানে স্যার নম্বর কাটেন নি। সে তাই নম্বর কমাতে ছুটেছে। প্রণবের দাবী শুনে চোখ কুঁচকে তাকালেন তরুণবাবু। "বুঝলে হে ছোকরা, অঙ্কের কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল সেটা বোঝার মত বয়স তোমার এখনো হয় নি। যোগ বিয়োগে ভুল হলেই নম্বর কাটা যায় না। ঠিকঠাক বুঝেছ কিনা সেটা দেখতে হয়। তুমি ভেবো না যে আমি মন দিয়ে খাতা দেখি নি। তোমার ভুলটা কোন ভুল-ই নয়। এ বয়েসে মানুষ তো কতরকমের ভুল-ই করে। কিন্তু কোন এক মে মাসের শেষ দিনে তোমাদের বয়সী একটা ছেলে যা ভুল করেছিল সে কথা ভাবলে আমার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়।"
আমাদের চোখ চকচক করে উঠল। তার মানে গল্প আছে। আমাদের বয়সী, অর্থাৎ ঊনিশ-কুড়ি। স্যারের গৌরচন্দ্রিকা মানে তো অঙ্কের কোন এক মস্তান লোকের জীবন নিয়ে জমজমাট আলোচনার সূত্রপাত। কিন্তু এত অল্প বয়েসের কে সেই লোক যার ভুল কিনা স্যারের মন খিঁচড়ে দেয়? সে আবার কি গোলমাল পাকাল? স্যারের গল্প কত বছর আগের কে জানে! ঘটনা সুদূর অতীতে যাই হোক না কেন, ঘটমান বর্তমানে আলগা ঘামে ভেজা বিকেলটা যে অসাধারণ কাটতে চলেছে সেটার একটা ক্ষীণ আভাস পাওয়া গেল। ততক্ষণে আমরা লাইব্রেরির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। ডানদিকে ঘুরেই বউদির ক্যান্টিন। স্যারের পয়সায় হাতে গরম ফিসফ্রাই, বিকেলের শেষ রোদ্দুর আর তার সঙ্গে হাত ধরাধরি করে হেঁটে বেড়াবে অঙ্ক আর ইতিহাস। ফাটা প্লাস্টিকের টেবিলের পাশে গোল করে রাখা চার পাঁচটা চেয়ার। স্যারকে ঘিরে আমরা বসে পড়লাম। প্রণব, সুমিত, অরিন্দম, দেবজ্যোতি আর আমি। অঙ্কের নম্বরের নিরিখে বেশি থেকে কম, একশো থেকে আঠেরো।
"সে ছোকরা জন্মেছিল ১৮১১ সালের ২৫শে অক্টোবর। প্যারিসের দক্ষিণ শহরতলীতে বর্যো-লা-রেইন নামের একটা ছোট্ট জায়গায়। ১৭৯২ সালে ফরাসী বিপ্লবের সময় এই জায়গার নাম বদলে রাখা হয়েছিল বর্যো-লা-এগালিতে, অর্থাৎ সমতার কথা ঢুকে গেছিল নামের মধ্যে। বিপ্লব দীর্ঘজীবি হল, তবে সে ইতিহাস গত হলে পুরনো নামটা আবার ফিরিয়ে আনা হয়েছিল ১৮১২ তে। নাহ, অনেকক্ষণ তোদের ঝুলিয়ে রেখেছি। সে সময়ের গোটা প্রেক্ষাপট ব্যাখ্যা করতে গেলে রাত কাবার হয়ে যাবে। এবার বলেই ফেলা যাক, লোকটার নাম এভারিস্তে গ্যালোয়া। শুনেছিস কেউ?" তুমি থেকে ততক্ষণে আমরা তুই হয়ে গেছি। ফলে বোঝা গেল যে স্যারের মেজাজ দারুণ ফুরফুরে। তার মানে গল্প জমবে এবং কিছুক্ষণ পরে আর একবার চা সিঙ্গারার সম্ভাবনা প্রবল। বাংলা বানানে 'ণ'/'ন' না জানলে আমরা যেমনভাবে মাঝামাঝি লিখি সেরকম একটা মুখের ভাব করছিলাম। কিন্তু প্রণব এখানেও একশো। "হ্যাঁ স্যার জানি। অঙ্কের যাদুকর, মৃত্যু ডুয়েল লড়তে গিয়ে। ৩১শে মে, ১৮৩২, মাত্র ২০ বছর বয়েসে। ইতিহাসে কিছু বিতর্ক আছে, কিন্তু এরকম শোনা যায় যে মৃত্যুর আগের রাতে সে শেষ করে যায় এক অসাধারণ গবেষণা, যেটা গণিতজ্ঞদের মধ্যে গ্যালোয়া ফিল্ড নামে প্রসিদ্ধ।"
— "তাহলে তোরা সবই জানিস। কালকে ক্লাসে ওটাই পড়াব।" স্যার প্রায় উঠে পড়লেন। "না না স্যার, কিচ্ছু জানি না, সত্যি বলছি।" হৈ হৈ করে আমরা লাফিয়ে উঠলাম। আমাদের দৃষ্টির আগুনে দুর্দান্ত ফরসা প্রণব ততক্ষণে ম্লানমুখ লুকোনোর জায়গা খুঁজছে। বারো ক্লাসে পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে এক নম্বরে থেকে শান্তি হয় নি, সঙ্গে কোথাকার কোন ফরাসী গণিতজ্ঞ, সে ব্যাটাকেও গুলে খেয়েছে। আর তার জন্যে কিনা জমজমাট একটা ধারাবিবরণীর সঙ্গে চা সিঙ্গারা ফসকে যেতে বসেছে। যাদবপুরের বিশাল খেলার মাঠের দিক থেকে পথ খুঁজে নেওয়া টুকরো হাওয়া, ঝিল পেরিয়ে পাঁচিলের ওপারে রেল লাইন থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসা ট্রেনের ঘটঘট, সঙ্গে প্যারিসের রাস্তায় মনে মনে হেঁটে বেড়ানো, এতো কিছু একসঙ্গে দফারফা হয়ে যাওয়ার যোগাড়। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন, পাশে প্রণব-ও। প্রণবের কাঁধে হাত রাখলেন স্যার। "তোর হবে। যা চা বলে আয়।" সমান লম্বা দুজন মানুষ। একই রকম ছিপছিপে চেহারা। একজন প্রায় ষাট, অন্যজন তার তিন ভাগের এক ভাগ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম আমরা। আমার অঙ্কে আঠেরো পাওয়া ভাঙ্গা মন ততক্ষণে দুঃখ ভুলে প্যারিসের মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া শ্যেন-এর ঘোলা জলে ছলাত-ছল। (এবার অলিম্পিকে যার ওপর শোভাযাত্রা সহকারে উদ্বোধন, অর্থাৎ যখন এই লেখা রিভাইজ করছি সেই সময়।) অঙ্কে গোল পেলে কি হবে, ভূগোলে আমাকে হারায় কে? আমি তো ইতিমধ্যে হাঁটা লাগিয়েছি প্যারিসের পোড়া ইঁট সাজানো সরু গলিপথে।
— "গ্যালোয়ার বাবা উদারপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। অষ্টাদশ লুই যখন ১৮১৪ সালে ক্ষমতায় ফিরে এলেন তখন তিনি গ্রামের মোড়লও হয়েছিলেন। গ্যালোয়ার মা ছিলেন জজের মেয়ে। ছোটবেলায় ছেলের পড়াশোনা তাঁকেই দেখতে হতো, স্বামী মোড়ল হলে যা হয় আর কি। ঠিক বারো বছরে ইশকুলে ঢোকে গ্যালোয়া। বছর-দুই ল্যাটিন আর পুরনো সাহিত্য নিয়ে পড়াশোনা ভালই চলছিল, কিন্তু এর মধ্যেই অঙ্কের নেশা তাকে পেয়ে বসে। হাতের কাছে পেয়ে যায় আর এক ফরাসী গণিতজ্ঞ অ্যাড্রিয়েন-মেরী লেজেন্ডার-এর (১৮ সেপ্টেম্বর ১৭৫২ — ১০ জানুয়ারী ১৮৩৩) লেখা জ্যামিতির বই। তোরা যেমন করে ফেলুদা পড়িস, সেই গতিতে জ্যামিতির ঐ কঠিন বই এক নিঃশ্বাসে নামিয়ে দিয়েছিল বাচ্ছা ছেলেটা। বছর পনেরো পেরতে না পেরতেই আর এক ফরাসী দিকপাল জোসেফ-লুই ল্যাগ্রাঞ্জের (২৫ জানুয়ারী ১৭৩৬ — ১০ এপ্রিল ১৮১৩) গবেষণার কাজকর্মও হজম করে ফেলেছিল সে।" চায়ে বেশ জোরে একটা চুমুক দিলেন তরুণ-বাবু। স্যারের কথার ফাঁকে অঙ্কের এইসব প্লাতিনি জিদান-দের চেনা নাম শুনে প্রণব মাঝে মাঝেই লাফিয়ে উঠে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু পাশেই সদা সতর্ক সুমিত। কখনো কাঁধ চেপে ধরে, কখনো চিমটি কেটে রুখে যাচ্ছে তাকে। নব্বুই-এর দশকের গোড়ায় ইন্টারনেট ছিল না। ফলে আমাদের কাছে আজকালকার পড়ুয়াদের তুলনায় খবর থাকত অনেক কম। তার ওপর লেজেন্ডার সিম্বল কিম্বা ল্যাগ্রাঞ্জের ইন্টারপোলেশন আমাদের মত ফাঁকিবাজদের সঙ্গে যোগাযোগ করত শুধু পরীক্ষার আগের রাতে। তাই এই নামগুলো স্যারের বর্ণণা থেকে আমার কাছে ভেসে আসছিল আবছা আবিল্যির মত।
— "তোরা যেমন বাবার পয়সায় কোচিং এ পড়ে বারো ক্লাসের পর একবারে যাদবপুরে ঢুকে গেছিস, গ্যালোয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা কিন্তু অত সহজ হয় নি। সেই সময় ফ্রান্সে অঙ্ক শেখার সবচেয়ে ভাল জায়গা ছিল ইকোলে পলিটেকনিক। ইন্টারভিউ-এ ভাল না করায় সে বেচারি সেখানে সুযোগ পেল না। তার বদলে পড়তে হল ইকোলে প্রিপারেটরিতে, যেটা কিনা সেই সময় অনেক কমা একটা জায়গা। তবে এটা মাথায় রাখিস যে সেই জায়গার নাম এখন ইকোলে নরমালে, আজকের দিনে বেশ নামজাদা। এখানকার মাস্টারদের সঙ্গে গ্যালোয়ার দহরম মহরম বেশ ভালই ছিল। ১৮২৮-এ এখানে ভর্তি হওয়ার বছরখানেকের মধ্যেই ভগ্নাংশের ওপর একটা বেশ ভালো কাজও করেছিল গ্যালোয়া। তার জীবনের সবচেয়ে বড় অবদান অবশ্য পলিনোমিয়াল ইকুয়েশন, আর সে সমস্ত অঙ্কও এর মধ্যে শুরু করে দিয়েছিল সে। তার বয়েসটা ভাব একবার। তখন মাত্র আঠারো। হ্যাঁ, হ্যাঁ, অঙ্কের খাতায় তুই আজকে যে নম্বর পেয়েছিস সেটাই।" আমার দিকে কটমট করে তাকালেন স্যার। "পরের পরীক্ষায় সামলে নেব ঠিক।" মিনমিন করে বললাম আমি। এর বেশি আর কি-ই বা বলতে পারি? চোখের সামনে তখন সিনেমার মত চলে বেড়াচ্ছে বিশাল বিশাল গম্বুজ দিয়ে বানানো প্যারিসের এক ইউনিভার্সিটি। ছাইরঙা ইটের রাস্তা শেষ হয়ে শ্বেতপাথরের সিঁড়ি, দুপাশে ফোয়ারা আর সাজানো ফুলগাছের সারি। সেখানে ঢুকে অনেকটা গাড়িবারান্দার মত বিশাল জায়গা আর তার দুপাশে উঁচু উঁচু ক্লাসঘর, জানলার কাঁচগুলো রামধনুর রঙে রাঙানো। আমাদের তরুণবাবুর মতই পড়াচ্ছেন এক ফরাসী অধ্যাপক। গায়ে বকলস লাগান সাদা জামা, পরনে কালো প্যান্ট। আমার চারপাশে বিভিন্ন ডেস্কে বসে ঝলমলে চেহারার সব রাজপুত্তুর রাজকন্যেরা। সামনে বড় বড় তিনটে বোর্ডে একটানা লিখে যাচ্ছেন অধ্যাপক, মাঝে মাঝে বুঝিয়ে দিচ্ছেন। পেন্ডুলামের মত দুলে উঠছে লালচে চুলে মুক্তোর হার ঢেকে যাওয়া ফরাসী রাজকন্যেদের ঘাড়। রাজপুত্রেরা প্রায় স্থির। তাদের চোখ কখনো বোর্ডের দিকে, কখনো বা নিজেদের বাঁধানো খাতায়।
— "এর মধ্যে গ্রামের পুরোহিতের সঙ্গে বিভিন্ন গোলমালে জড়িয়ে পড়ে ১৮২৯ সালে আত্মহত্যা করে বসেন গ্যালোয়ার বাবা। সেই সব ঝামেলার মধ্যে তার কদিন পরেই আবার ইকোলে পলিটেকনিকে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে গ্যালোয়া। কিন্তু ভাগ্যদেবী এবারেও সহায়তা করলেন না। গ্যালোয়া তার নিজের গবেষণার কাজ যেভাবে বোঝানোর চেষ্টা করল সেটা মানতে পারলেন না পরীক্ষকেরা। সেই বছরের একদম শেষের দিকে ইকোলে প্রিপারেটরিতে থেকেই ডিগ্রি পেল সে। যদিও সে পরীক্ষাতেও নাকি গ্যালোয়ার সমস্ত ব্যাখ্যা বুঝতে পারেন নি পরীক্ষকেরা। এর মধ্যে গবেষণা অবশ্য থেমে থাকে নি। দুর্ভাগ্য যে বার বার তার গবেষণাপত্র ফিরিয়ে দিয়েছেন সেই সময়কার বিশেষজ্ঞরা। শেষপর্যন্ত ১৮৩০-এ গ্যালোয়ার তিনখানা গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় যার মধ্যে একটা খুব গুরুত্বপুর্ণ অংশ গ্যালোয়া থিওরী নামে সারা পৃথিবীতে আজ বিখ্যাত।" স্যার বোধহয় আর একটু হলেই সে সব থিওরী বোঝানোর একটা সৎ প্রয়াসে সামিল হতেন। কিন্তু অরিন্দমের ছোট্ট হাই আর দেবজ্যোতির আরামোড়া ভাঙ্গা দেখে বিরত হলেন।
— "একঘেয়ে লাগছে বুঝি? কিন্তু গল্পের আসল জায়গাটাই তো বাকি। তবে তোদের যদি ভাল না লাগে তাহলে আজকে এই পর্যন্তই থাক। পরে না হয় বাকিটা শুনে নিবি। বাড়ি ফেরার সময় তো তো প্রায় হয়েই এলো।" স্যার আবার উঠে দাঁড়ানোর ভঙ্গী করলেন। এবার কিন্তু প্রণবই বাঁচালো। "পাঁচটা কুড়ির ট্রেন চলে গাছে স্যার। এর পরেরটা ছটা পঁয়তাল্লিশ।" আড়চোখে নিজের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম সবে পাঁচটা বেজেছে। স্যার হাতে ঘড়ি পরেন না, আর আশির দশকে কলকাতায় মোবাইলের আবির্ভাব হয় নি। "ঠিক আছে, তাহলে শেষ করে ফেলাই যাক।" স্যার আবার শুরু করলেন। "প্যারিসে তখন চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা। ফরাসী বিপ্লবের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ সময় ১৮৩০-এর জুলাই মাস। রাজা দশম চার্লসকে উল্টে দেওয়া হয় এইসময়ে। ২৬শে জুলাই এই বিদ্রোহ সামাল দেওয়ার জন্যে একগাদা জোরালো দমননীতি জারি করার চেষ্টা করেন রাজা। তার মধ্যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতাও খর্ব করা হয়। কিন্তু এসব করে কি আর বিদ্রোহ রোখা যায়? প্যারিসে সেদিন বেশ গরম ছিল, বুঝলি। সঙ্গে জনগণের মাথাও। ২৭ তারিখ সকাল থেকেই লোকজন পথে নামতে শুরু করে। আর ২৯ তারিখের মধ্যেই রাজার রাজত্বের পতন এবং মূর্ছা। এইসব রাজনৈতিক কর্মকান্ডে গ্যালোয়াও জড়িয়ে পড়েছিল। সারা প্যারিসের মানুষ যখন রাস্তায় নেমেছে, তখন ছাত্ররাও পিছিয়ে ছিল না। ইকোলে পলিটেকনিকের পড়ুয়ারা বিদ্রোহে যোগ দিলেও, ইকোলে প্রিপারেটরিতের অধিকর্তা সেখানকার ছাত্রদের আটকে রেখেছিলেন। এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে খবরের কাগজে চিঠি লেখে গ্যালোয়া এবং এই কারণে পরবর্তীকালে সে বহিষ্কৃত হয় ইউনিভার্সিটি থেকে। যদিও তার আগে সে নিজে থেকেই সেখানকার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছিল।"
— "জুলাই মাসের গোলমালের পরে ক্ষমতা দখল করেন লুই-ফিলিপ। এই সময় রিপাবলিকানদের সশস্ত্র বাহিনীতে যোগ দেয় গ্যালোয়া। সে দলের নাম ছিল ন্যাশনাল গার্ড। বিভিন্ন রাজনৈতিক বিবাদে ঐ সময় এই দলকে বেআইনি ঘোষণা করা হয় আর এদের কিছু লোককে ভরা হয় জেলে। তারা অবশ্য কয়েকমাসের মধ্যেই ছাড়া পেয়ে যায়। সেই উপলক্ষে ১৮৩১-এর ৯-ই মে এক বিপুল পানভোজনের আয়োজন হয়েছিল। সেখানে রাজা লুই-ফিলিপ থেকে আলেক্সান্ডার দ্যুমার মত বিখ্যাত লেখক-ও উপস্থিত ছিলেন। কথিত আছে যে রাজার সামনে মদের গেলাস তুলে উচ্ছ্বাস দেখানোর সময় গ্যালোয়া নাকি একটা ছুরি নিয়ে নাড়াচাড়া করছিল। রাজা অনুমান করেন যে তাঁকে ভয় দেখাচ্ছে গ্যালোয়া এবং সেই অপরাধে তাকে পরের দিনই জেলে ঢোকানো হয়। অবশ্য মাসখানেক বাদেই জেল থেকে মুক্তি পায় সে।" একটানা বলে একটু দম নেওয়ার জন্যে থামলেন তরুণবাবু। তারপর আমাদের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন, "বাস্তিল দূর্গের পতন কবে হয়েছিল?" অঙ্কে টঙ্ক না হলেও, ইতিহাসে আমি মোটেই পাতিহাঁস নই। ফলে গড়গড় করে বলতে শুরু করলাম। "ওটা ফ্রান্সের স্বাধীনতা দিবস স্যার। ১৪-ই জুলাই, ১৭৮৯। বিপ্লবের ধাক্কায় বাস্তিল দূর্গের পতন। দিনটাকে ওরা স্বাধীনতা দিবস হিসেবে পালন করে।"
— "ঠিকই বলেছিস। আমার গল্পের জন্যে এটুকুই যথেষ্ট।" আমাকে চট করে থামিয়ে দিয়ে আবার শুরু করলেন স্যার। "১৮৩১ সালে ওই দিনটা উদযাপনের আনন্দে গ্যালোয়া এক সশস্ত্র মিছিলের নেতৃত্ব দিতে বেরিয়ে পরে। গায়ে পোশাক ছিল ন্যাশনাল গার্ড-দের, যেটা তখন সম্পুর্ণ বেআইনি। এই অপরাধে আবার ৬ মাসের জন্যে জেলে পোরা হয় তাকে। এবার জেলে থাকার সময় গ্যালোয়া ফের গবেষণাতে মন দেয়। ২৯-শে এপ্রিল, ১৮৩২-এ জেল থেকে ছাড়া পায় সে। কিন্তু আবার শুরু হয়ে যায় জোরদার বৈপ্লবিক কর্মকান্ড। যদিও জটিল বীজগণিত নিয়ে কাজ চলতে থাকে একইসঙ্গে। ভাবাই যায় না যে ছেলেটা কি করে একহাতে ঐরকম ঝুঁকির রাজনীতি আর অন্যহাতে গভীর অঙ্ক সমান্তরালভাবে চালিয়ে যাচ্ছিল। তোদের এক একটা ইউনিয়নের নেতা তো অঙ্কের খাতা ফাঁকা রাখাই বেশি পছন্দ করে।" মুখে একরাশ বিরক্তি নিয়ে আমার দিকে তাকালেন স্যার। বোধহয় আমার মনের কথাটা বুঝতে পারছিলেন। আমি তখন ভাবছি যে পরের পরীক্ষাতে মাথায় শিরস্ত্রাণ চাপিয়ে আর হাতে ছুরি নিয়ে যোদ্ধার বেশে মোকাবিলা করব অঙ্ক প্রশ্নের। তাতে যদি কয়েকমাস জেলে যেতে হয় তাও ভাল, কিছুদিন তো অঙ্ক থেকে মুক্তি!
— "গ্যালোয়ার জীবনটা যদি শুধু অঙ্ক আর বিপ্লব এই দুই বিন্দুকে যোগ করা সরলরেখার মধ্যে দিয়ে চলত তাহলে হয়ত গল্পটা এভাবে শেষ হত না। কিন্তু বাধ সাধল এক তৃতীয় বিন্দু। যে মহিলার নাম স্তেফানিয়ে-ফেলিসি পোতেরিন দ্যু মোতেল। সে সময় গ্যালোয়া যে হোস্টেলে থাকত সেখানকার ডাক্তারের মেয়ে ছিল এই দ্যু মোতেল। ত্রিকোণ প্রেমের গল্প নাকি রাজনৈতিক শত্রুতা সে কথা আজও সঠিক জানা যায় নি, কিন্তু এটা জানা যায় যে এই মহিলা সম্পর্কিত কোন এক ঘটনায় ডুয়েল-এর চ্যালেঞ্জ নিয়ে বসে গ্যালোয়া। আলেক্সান্ডার দ্যুমার ভাষ্য অনুযায়ী প্রতিদ্বন্দ্বী যুবকের নাম পেসচেউক্স দ্য'হারবিনভিলে। যাদের মুক্তি উপলক্ষে বিরাট পান ভোজনের আয়োজন হয়েছিল, সে নাকি তাদেরই একজন। অন্য একটা মত বলে সম্ভবত সেই ছেলের নাম আরনেস্ট ডুচাটেলেট, যে গ্যালোয়ার সঙ্গে একইসময়ে জেলে গেছিল সশস্ত্র মিছিলে অংশগ্রহণ করে। ডুয়েল হয়েছিল ৩০-শে মে। লড়তে গিয়ে তলপেটে গুলি লাগে গ্যালোয়ার। পরদিন সকালে সে মারা যায়। মৃত্যুর আগে সে নাকি তার ভাইকে বলে গেছিল - কাঁদিস না আলফ্রেড, কুড়িতে মরার জন্যে আমাকে সমস্ত সাহস একসঙ্গে জড়ো করতে হয়েছে।" আমরা সবাই চুপ। স্যার উঠে দাঁড়িয়েছেন। নজরে আসে নি কখন শরতের সন্ধেটা ঝুপ করে আমাদের কাঁধে চেপে বসেছে।
------
~Saibal
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন