মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর, ২০২৩

ইজরায়েল ~ অভিষেক রয়

একটা ছোট্ট ভূখণ্ড নিয়ে ঝামেলার শেষ নেই। সভ্যতার উষাকাল থেকে যে কাটাকাটি চলছে তার কোনো স্থায়ী সমাধান মনে হয়না সম্ভব। জায়গাটাকে রিজার্ভ ফরেস্ট তৈরি করে মানুষের বদলে জন্তুদের থাকতে দিলে হয়ত এর পরিত্রাণ হতে পারে।

তা মুল ঝামেলা কি নিয়ে? জেরুজালেম (হ্যাঁ শেষের তিনটি অক্ষরই তিনটি গোষ্ঠীর মৌলবাদের পরিচয়), যে ৫৩ বার আক্রান্ত হয়েছে, ৪৪ বার দখলকৃত হয়েছে ২ বার ধ্বংস হয়েছে! 

প্রায় এক হাজার খৃষ্টপূর্ব সময়ে রাজা ডেভিডের সময়ে এটা ইসরায়েল এর রাজধানী ছিল, পরে রাজা সুলেমন এর সময়ে প্রথম মন্দির (যেখানে মসজিদ আল আকসা) তৈরি হয়। এখনকার ইহুদীরা ৯২৫ খৃষ্টপূর্ব সনেই মিশরীয় ফারাও দের দ্বারা বিতাড়িত হয়। এরপর খৃষ্টপূর্ব ৫৮৭ তে ব্যাবিলন সাম্রাজ্য  ও খৃষ্টপূর্ব ১৩৯ এ রোমান সাম্রাজ্যের সময় টেম্পল অফ সুলেমান ভেঙে ফেলা ও বিরাট সংখ্যক ইহুদী বিতাড়ন নথিবদ্ধ আছে।

গোটা ইউরোপ ও মধ্যএশিয়া জুড়ে যে ইহুদী বিদ্বেষ তারাও কিন্তু অন্যদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষভাবই পোষণ করে এসেছে। ওল্ড টেস্টামেন্ট জুড়ে ফিলিস্তিনি দের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও গণহত্যার কথা নথিবদ্ধ: প্রমিসড ল্যান্ডের বাইরের শহর গুলোর সাথে যুদ্ধে ও প্রমিসড ল্যান্ডের ভেতরে যুদ্ধ (Deut 20:10-15) এবং (Deut 20:16-18) জেসুয়া ও মুসা উভয়েই গণহত্যা চালিয়েছেন। যীশুর ক্রুসিফিকেশন এও ইহুদী চক্রান্তর গল্প আছে।

এরপরে এলো খ্রিস্টানরা। নিউ টেস্টামেন্ট জুড়ে অ্যান্টি সেমিটিজম "Cleansing of the Temple" (11:15-19) ও "Parable of the Vineyard" (12:1-12). আবার যীশুর মৃত্যুর পর আমরা পাই বাইবেলের ভার্স:
"তোমরা নিজেদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দাও যে তোমরা তাদেরই বংশধর যারা নবীদের হত্যা করেছে... হে সাপ, সাপের বংশ! জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচবে কিভাবে ?"
- Matthew (23:31-33)
Gospel of John এও ইহুদীদের তুলনা করা হয়েছে অন্ধকার ও শয়তানের সাথে।
এছাড়াও Book of Revelation: (2:9)
"যারা বলে তারা ইহুদী, তারা শয়তানের উপাসনালয়"
লক্ষ্যনীয়, এই ঘৃণার সময়কালে ফিলিস্তিনিরা খ্রিস্টান ছিল, ও ইহুদীদের জেরুজালেমে কোনো প্রবেশাধিকার ছিলনা। লুকিয়ে ঢুকতে গিয়ে ধরা পড়লে মৃত্যু।

সপ্তম শতকে মুসলিম উত্থান হলে দেখা গেল কোরআন ইহুদীদের প্রতি তাৎপর্যপূর্ন বিদ্বেষ পোষণ করে। তারা ঈশ্বরের অবাধ্য (2:93), নিজস্ব চুক্তি প্রত্যাখ্যান করে (2:100), তারা নিজস্ব তোরাহ অনুসরণ করতে ব্যার্থ (5:66) ঈশ্বরের দ্বারা অভিশপ্ত (2:88, 4:51-52) থেকে সূরা আল বাকারা যেখানে সরাসরি খুন ও বিতাড়নের আয়াত।

মোহাম্মদ নিজে বনু কুরাইজা গোষ্ঠীর উপর যে গণহত্যা ও অত্যাচার চালিয়েছেন তার তুলনা ইতিহাসে বিরল। এমনকি মৃত্যু শয্যাতেও ওনার শেষ ইচ্ছে ছিল আরবভূমি হতে ইহুদী বিতাড়ন!
আজ যে হামাস এর অতর্কিত হামলা, যুদ্ধবন্দী নারী ও শিশুদের তুলে নিয়ে যাওয়া তাও কোরআন সমর্থিত বর্বরতা।

আব্রাহামিক ধর্মমানুষদের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব ততক্ষণ শেষ হবেনা যতক্ষন না তারা নিজেদের ধর্মগ্রন্থগুলি ত্যাগ না করে। ইসলামের নামে ভারত ভাগ করে পাকিস্থান তৈরি যতটা ভুল ততটাই ভুল জয়নিজম এর নামে ইসরায়েল তৈরি। ২০০০ বছর আগে পূর্বপুরুষ ছিল বলেই করো অধিকার জন্মায়না যে  নিজেদের ঘরবাড়ি ফেলে অন্যদেশে এসে সেখানকার মানুষকে উৎখাত করে বসা। কাল এন আর আই শ্যামলবাবু আপনার বাড়ি এসে যদি বলেন "৫০ প্রজন্ম আগে আমার পূর্বপুরুষ এই জমিতে থাকতেন, ওই তো পশ্চিমের ভাঙ্গা পাঁচিলটা এখনও আছে, ওখানেই ওরা ইয়ে করতেন, আপনি নিজের বাড়ি থেকে চলে যান" তাহলে আপনি ছেড়ে দিতেন ?
কিন্তু ৭৫ বছর ধরে এটাই চলে আসছে, এর মূল কারণ ইহুদী ধর্মগরন্থ: তোরাহ, যেখানে লেখা আছে হেকেল (বর্তমানে মসজিদ আল আকসা) এর কাছাকাছি থাকা ইহুদীদের জন্য সবচেয়ে পুণ্যের। তাই জেরুজালেম এর এই অংশের প্রপার্টির দাম সবথেকে বেশি। মৌলবাদী ইহুদীরা লক্ষ লক্ষ ডলার খরচ করে   এখানে থাকে। Third Temple গড়ে তোলার জন্য, কল্পিত মাসিহার আগমনের জন্য ইহুদী জনবসতি ইলাস্টিকের মত বাড়ানো হচ্ছে ওয়েস্ট ব্যাংক জুড়ে।

আবার ঠিক তেমনভাবেই দ্ব্যর্থহীন ভাবে বলতে হবে, ভোররাতে ঘুমন্ত জনপদে ৭৫০০ রকেট হামলা করে, নির্বিচারে সাধারণ মানুষকে হত্যা করে নারী শিশুদের গনিমতের মাল বানিয়ে ধর্মীয় স্লোগান দেওয়া শুধুই সন্ত্রাসবাদ কোনো স্বাধীনতা সংগ্রাম নয়। বরং ফিলিস্তিনদের স্বাধীনতা ব্যাহত হওয়ার মুল কালপ্রিট হল হামাস ও হিজবুল্লাহ।

এটাই সংগঠিত ধর্মের সমস্যা। শেষের সেদিন ত্বরান্বিত করার জন্য এরা নিজ নিজ গ্রন্থ অনুযায়ী বদমাইশি করতে থাকে। প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চ গুলোতে প্রতি গুড ফ্রাইডে নিয়মিত টাকা তোলা হয় ও স্টেট অফ ইসরায়েল এর জন্য প্রার্থনা হয় যাতে ইহুদীরা যীশুকে ঈশ্বরপূত্র বলে মেনে নেয় (John XXIII)
সেই যীশু, যিনি বলেছিলেন তিনি ফিরবেন পরেরবার যোদ্ধার মত, শাসকের মত শাস্তি দিতে (অবশ্য মানুষকে দেখলে সত্যি মাথা ঠিক রাখা কঠিন, ৫০০ টাকায় যারা ভোট বিক্রি করে তাদের দেখলে আমারই আগাপাশতলা চাবকাতে ইচ্ছে করে)।

যাইহোক যা বলছিলাম, ভবিষ্যত সম্পর্কে সব ধর্মীয় মৌলবাদের প্রায় একই রকম একটা ধারণা আছে। ঈশ্বরপ্রেরিত দূত আসবেন; ইহুদীদের মসিহা, খৃষ্টানদের খ্রিস্ট ও অ্যান্টি খ্রিস্ট, মুসলিমদের দজ্জাল ও তাকে দমন করতে ইমাম মেহেদী ও যীশু, হিন্দুদের কল্কি অবতার। এলেই একটা বিভৎস মারামারি শুরু হয়ে যাবে। লাশ জমবে পাহাড়ের মত, রক্ত বইবে নদীর মত। তারপর ঠিক আপনার বাপ পিতামোর ধম্মটাই নাকি জিতে যাবে! সেই জিত উপভোগ করার জন্য আপনার বংশের কেউ বেঁচে নাও থাকতে পারে হয়ত সেই জয় ভোগ করবে রাস্তায় আপনার মেয়েকে যে টিজ করেছিল সে বা আপনার জমির ভেতরে যে আল দিয়েছে সে! 

তাই এই ভয়ঙ্কর ফ্যান্টাসি থেকে বেরিয়ে আসুন, মানুষকে শুধু মানুষ হিসেবে দেখুন, শিশুকে ভালোবাসুন শুধু শিশু বলে, পৃথিবীকে কেয়ামতের দিনের মাঠ না ভেবে আজকের পৃথিবীকে বাঁচতে দিন, গাছ লাগান। ধর্মনিরপেক্ষতা ও কল্যাণকামী বিজ্ঞাননস্কতাই একমাত্র শুভপথ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন