কপিলাবস্তু। ক'জনই বা গেছে, অথচ, কে না গেছে? প্রাচীন সে শহর মনের চোখে চিরজীবন্ত। এক প্রৌঢ় পিতার তৈরি এমন রমণীয় এক নগরী, যাতে তার তরুণ পুত্র সংসারের প্রতি বীতরাগ না হয়, পিতার সিংহাসনেকে উপেক্ষা করে চলে না যায়। তা-ও সেই পুত্র, মাত্র ২৯ বছর বয়সে, সুন্দরী স্ত্রী আর শিশুপুত্রকে ছেড়ে, স্নেহময়ী বিমাতা প্রজাপতি গোতমীকে ছেড়ে, কপিলাবস্তুর পূর্ব দ্বার দিয়ে বেরিয়ে গিয়েছিলেন। নির্বাণ লাভের পরে পিতার আহ্বানে ফিরেছিলেন বটে, তবে কপিলাবস্তু নগরীতে প্রবেশ করেননি। নগরী থেকে ছ'কিলোমিটার দূরে, বটগাছের বনের ছায়ায় থাকতেন। সেই জায়গার নাম নিগ্রোধারাম। সেখানে সঙ্ঘও তৈরি হয়, সম্ভবত বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই। তার সাক্ষ্য মেলে ধ্বংসাবশেষে। এখানেই নাকি গোতমী বুদ্ধের থেকে সন্ন্যাস প্রার্থনা করেছিলেন, বুদ্ধের ছেলে রাহুল এখানেই দীক্ষিত হয়েছিলেন সন্ন্যাসে।
যে কোনও তীর্থস্থান তার মাহাত্ম্য খুঁজে পায় বহু প্রজন্ম-লালিত কাহিনিতে, সেগুলোকে 'আরও সত্য' বলা চলে। পাশাপাশি চলে আর এক বয়ান — ইতিহাসের, প্রত্নতত্ত্বের। ভারত আর নেপাল মিলিয়ে অন্তত তিনটি স্থান ছিল কপিলাবস্তু হওয়ার দাবিদার। শেষ অবধি লুম্বিনীর অনতিদূরে তিলৌরকোটে খননকার্য চালিয়ে প্রাচীন নগরীর যে নিদর্শন মিলেছে, তাকেই ঐতিহাসিকরা কপিলাবস্তু বলে মোটামুটি স্বীকার করে নিয়েছেন। তা হয়তো আমাদের কল্পিত রাজধানী ছিল না, ছিল ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র। শুদ্ধোধনও মস্ত রাজা ছিলেন না, ছিলেন রাজপুরুষদের প্রধান। কপিলাবস্তুর চাইতে অনেক বড়, অনেক বিলাসবহুল, সুরম্য নগর তখন ভারতে ছিল। হয়তো তরুণ সিদ্ধার্থ সে সব দেখেওছেন। তবে জীবনের প্রথম ভাগ কপিলাবস্তুতেই যে তিনি কাটিয়েছেন, সে বিষয়ে সংশয় নেই।
১৮৯৯ সালে তিলৌরকোটের প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কারকে প্রাচীন কপিলাবস্তু বলে চিহ্নিত করার কৃতিত্ব এক বাঙালির, তাঁর নাম পূর্ণচন্দ্র মুখোপাধ্যায়। সলজ্জে স্বীকার করি, কপিলাবস্তুতে দাঁড়িয়ে সে দেশের সরকারি দফতরের বোর্ডে তাঁর নাম ( পি সি মুখার্জি) দেখে তাঁর কথা প্রথম জানলাম। আমাদের ইতিহাসের সিলেবাস রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়েই ক্ষান্ত দিয়েছিল, আর নিজের পড়াশোনার দৌড় তথৈবচ। নেট সন্ধান করছে দেখছি, বহু সাহেব হর্তাকর্তার ঈর্ষা-বিষ সয়ে পূর্ণচন্দ্রকে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াতে নিজের যোগ্যতার স্বাক্ষর রাখতে হয়েছিল।
আমাদের সঙ্গের গাইডটি নিজেকে 'গভর্নমেন্ট রেজিস্টার্ড' বলে দাবি করলেন, এবং আগাগোড়া কল্পকাহিনী শুনিয়ে গেলেন। ভাগ্যিস, আবছা হয়ে-আসা সরকারি বোর্ডগুলো ছিল। গাইড বললেন, এই পশ্চিমের দরজা দিয়ে শুদ্ধোধন ঢুকতেন কপিলাবস্তুতে, এটাই ছিল নগরের প্রধান রাজপথ। বোর্ড বলল, এই এলাকায় সম্ভবত সব চাইতে গরিবরা থাকত, কারণ এখানকার বাড়িগুলো সব ভাঙা ইটে তৈরি, বেঁটে বেঁটে দেওয়াল। অতঃপর 'এখানেই মায়া দেবী চান করতেন' 'এটাই রাজার শোয়ার ঘর ছিল' ইত্যাদি ব্যাখান চলল। বোর্ড বলল, এ সবই কুশান আর মৌর্য আমলের, বুদ্ধের সময়ের শহর সম্ভবত মাটির অনেক তলায়। তবে এলাকা যে প্রাচীন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই, খ্রিস্টের জন্মের আটশো বছর আগেকার সাক্ষ্যও মিলেছে। বুদ্ধের জন্যই এ নগরীকে সবাই চিনলেও, এর নাম তাঁর চাইতেও অন্তত একশো বছর আগেকার এক ঋষির নামে, তিনি কপিল, সাংখ্য দর্শন যাঁর দান। কপিলের বাস্তু, সেই থেকে কপিলাবস্তু। শাক্যদের মধ্যে সাংখ্যের গভীর প্রভাব ছিল, এবং অনেকে মনে করেন যে বুদ্ধের চিন্তাতেও নিরীশ্বরবাদী সাংখ্য দর্শনের প্রভাব রয়েছে।
সর্বত্র যেমন হয়, এখানেও তাই — এক ধর্মস্থান কালক্রমে দখল করেছে অন্য ধর্ম, তৈরি করেছে নিজের বিকল্প কাহিনি। নিগ্রোধারামের নাম এখন কুদান — 'কুদা' অর্থাৎ লাফানো থেকে। শিব নাকি এখানে লাফ দিয়ে দিয়ে নৃত্য করেছিলেন। এই অঞ্চলে দেখা যায়, প্রায় সব বৌদ্ধস্তূপের কাছাকাছি একটা না একটা শিবলিঙ্গ মিলেছে। এই ইতিহাসের বয়সও ফেলনা নয়, ১৮৯৯ সালে পূর্ণচন্দ্র কপিলাবস্তুর প্রাচীর ঘেরা এলাকার মধ্যে এক দেবী মন্দির দেখেছিলেন, যেখানে মনস্কামনা পূর্ণ করতে হাতি গড়ে রেখে দিয়ে যায় লোকে। এখনও সেখানে নানা রঙের, নানা মাপের হাতি দেখে এলাম। মন্দিরটি নিত্য ব্যবহৃত। কপিলাবস্তুতে বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, পরিব্রাজকরা বিশেষ তিথিতে পুজো করেন, তার ছবি দেখলাম। তবে লুম্বিনীতে মায়া দেবীর মন্দিরে যেমন নিত্য আরাধনা, কপিলাবস্তুতে তেমন ব্যবস্থা আছে বলে মনে হল না।
কপিলাবস্তু বুদ্ধের জীবদ্দশাতেই তছনছ হয়ে যায় কোশল রাজাদের আক্রমণে। সম্ভবত রোহিনী নদীর জল নিয়ে বিবাদ বেধেছিল। অশোক লুম্বিনীতে এসে কপিলাবস্তুতেও এসেছিলেন। চিনা তীর্থযাত্রীরা এখানে ঘুরে গিয়েছেন এবং বিস্তৃত বিবরণ দিয়েছেন। তাদের বিবরণের সূত্রেই ফের কপিলাবস্তুকে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন এক বাঙালি সন্তান।
দুপুরের ঠাঠা রোদে কপিলাবস্তুর সামনে দাঁড়িয়ে কী দেখা যায়? মস্ত এক জমি, সবুজ ঘাসে ঢাকা, নানা জায়গায় আয়তক্ষেত্রের মতো পুরনো ইঁটের গাঁথনি। বুদ্ধের বিচরণক্ষেত্র যদি বা এটাই হয়ে থাকে, তা রয়েছে মাটির নীচে। তাতে কী? ঠিক এখানেই যদি বা না হয়, যদি হয় একটু এ পাশ বা ও পাশে, যদি বা সম্পূর্ণ অন্য রকম হয় ভূগর্ভে প্রোথিত নগরীটির নকশা, তাতে কী আসে যায়? তরুণ সিদ্ধার্থ এই আকাশের নীচেই বিচরণ করেছেন, অকল্পনীয় কষ্টসাধ্য সাধনার পরে ফিরেছেন জ্ঞানপ্রাপ্ত মহামানব হয়ে, করুণাঘন রূপে, বানগঙ্গার তীরে এই জায়গাটি সেই অলৌকিক জীবনের একটি লৌকিক চিহ্ন তো বটে। সেই অচিন্তনীয়কে একটু আপন করে নেওয়ার উপায় — দুপুর রোদে চোখ-মুখ কুঁচকে, গাইডের বকর বকর অগ্রাহ্য করে, সবুজ ঘাস আর ছাতা-পড়া ইটের সারির দিকে তাকিয়ে চিন্তা করা — এই কপিলাবস্তু। এই কপিলাবস্তু।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন