রবিবার, ১৫ অক্টোবর, ২০২৩

পুজোয় চাই নতুন শাড়ি ~ সৌম্য চট্টোপাধ্যায়

কি কঠিন সব শাড়ির নাম হয়ে গ্যাছে আজকাল। বৌয়ের সাথে পুজোয় কেনাকাটা করতে গেছিলাম। একজন বলছে, আপনাকে একটা ফ্লোরাল জরি, জুট-কটন বালুচরি দেখাই! আর একজন বলছে, না, না!আপনি বরং প্রথমে একটা হাতে বোনা এথনিক-মোটিফ জুট সিল্ক দেখুন। শাড়ির নাম না ধামালের ভেনুগোপাল মুতথুস্বামী আইয়ারের পুরো নাম বলা শক্ত। শাড়ির দোকানে গেলে আমি কতগুলো বেসিক্স মাথায় রাখি। যদি দুটো শাড়ির রঙ একদম এক মনে হয়, তাহলে অবশ্যই তাদের রঙ পুরোপুরি আলাদা। প্রথম আধঘণ্টায় দেখানো কোন শাড়ি কখনো ভালো হয় না। এবং কোন শাড়ির কত দাম হতে পারে, পাড়ের নীচে স্টেপল করা কাগজে নিজে না দেখে বোঝা অসম্ভব। শাড়ি আর সৌরভ গাঙ্গুলী শেষ অবধি কত টাকায় বিক্রি হবে কেউ আগে থেকে জানতে পারে না।  

বউ, দুটো শাড়ি অনেকক্ষণ ধরে দেখছে, আমি জানি শেষ অবধি দুটোই নেওয়া হবে, কিন্তু সেটা এখন বললে মানবে না, আমি বলছিও না। দুটো একইরকম শাড়ি কেনার একটা প্রাথমিক শর্ত হল ডিসিশান-মেকিংটাকে প্রথম একঘণ্টা একটা ডিনায়ালের মধ্যে দিয়ে যেতে দিতে হবে। সে হোক, আমার তাড়া নেই, আমি ইউটিউবে ভিডিয়ো দেখছি, ইজরায়েল-প্যালেস্টাইন দিয়ে শুরু করেছিলাম, এখন জিরাফের গলা কি করে এতো লম্বা হলো দেখছি। হঠাত দেখি বৌ বলছে, এর মধ্যে কোনটা নেবো বলতো? এগুলো ট্রিক কোয়েশ্চেন, সত্যি করে উত্তর দিতে নেই। এরকম আমরা স্কুলে জিজ্ঞাসা করতাম, তুই কি এখনও আগের মত শেয়ালদা স্টেশানে পকেট মারিস? সে যাই হোক, এরকম প্রশ্নের উত্তর দেবার একটা টেম্পলেট আছে।দেখবেন মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল ডার্বির দিন হয়তো স্কুল গ্রুপে উদমা খিস্তিখাস্তা চলছে, হঠাত কোন এক শান্তিগোপাল লিখল, কিন্তু শেষ অবধি জিতে গেলো ফুটবল।

আমি বউকে বললাম, কোনটা নেবে সেটা বড়কথা না, দুটো শাড়িতেই কি সুন্দর হাতে বুনে কাজ করেছে। যেটাই নাও, শেষ অবধি জিতে যাবে শিল্পটা। বউ খুশি হয়েছে, বুটিকের মহিলা, যে কিনা রাত্তিরবেলাতেও অপর্ণা সেনের মত একটা বাদামী গগলস পরে বসে ছিলো, সে অবধি আমাকে গগলস খুলে মাপছে। সে মাপুক, আমি আবার মোবাইলে ফিরে গেছি। ফেসবুকে একজন ভদ্রমহিলা কবিতা লেখেন বলে ফলো করেছিলাম, দেখছি রিলসে কামার্ত দৃষ্টিতে ঠোঁট চিপে তাকিয়ে আছেন। নীচে বাপ্পা সমাদ্দার লিখেছে, দিদি খুব স্নিগ্ধ লাগছে। ভাগ্যিস রবীন্দ্রনাথের সময় রিলস ছিলো না, নইলে আমি স্পষ্ট দেখতে পারছি, রাশিয়ার চিঠিতে মস্কোর বারান্দা থেকে রবিবাবু নবাব গেঞ্জি-জাঙ্গিয়া পরে পাউট করছেন আর রঞ্জন বন্দোপাধ্যায় লিখেছেন, দাদা, খুব স্নিগ্ধ লাগছে।  

বুটিকের মহিলা বউকে বলছে, আপনাকে একটু সুদীপার কালেকশান দেখাই, আমি কলকাতা থেকে আনিয়েছি।এটা শুনে একটু নড়েচড়ে বসলাম, সাবধান হওয়ার দরকার আছে। কোন শাড়ি দেখানোর আগেই মনে হচ্ছে সুদীপার হাতে আমার একটা কাটা কিডনি দেখতে পাচ্ছি।  সুদীপা রান্নাঘরে বলছে, প্রথমেই আমরা সৌম্যর একটা কিডনি, ছাঁকা তেলে মুচমুচে করে ভেজে নেবো। অপর্ণা সেন বৌকে একটা সাদা ন্যাতার মত শাড়ি দেখাচ্ছে, এরকম শাড়ি পরে জেনেরালি জয়া এহসান বিধবা সেজে ঘোরে কৌশিক গাঙ্গুলীর সিনেমায়। বলছে, একদম সিম্পলের মধ্যে, নাম আঙুরলতা, দামও রিজনেবেল, সত্তর হাজারের রেঞ্জে এইগুলো। আমি মানসচক্ষে দেখতে পারছি, সুদীপা আমাকে বলছে, শুধু কিডনি না, পুরো শরীরটাই চাই সৌম্য, নইলে আঙুরলতা হবে না। আমি দেখতে পাচ্ছি সুদীপার বাড়িতে একটা পুতুল সাজানো আছে, মুখটা একদম আমার মত দেখতে। বাড়িতে কেউ গেস্ট এলেই পুতুলটা ঠক করে নীচে পরে যায়। 

আমি উশখুশ করে বলছি, না না, এইগুলো থাক, অন্য কোন কালেকশান আছে নাকি! বুটিকের অপর্ণা সেন বলছেন, তাহলে একটু সব্যসাচী দেখাবো নাকি? আসলে সকলে দেখতে চায় না! সুদীপার মত সব্যসাচী চক্রবর্তী যে শাড়ির ব্যবসায় নেমেছেন এটা জানতাম না। চিরদিন বামপন্থী মানুষ, গণআন্দোলনে থেকেছেন। নিশ্চয়ই মাস-সেগমেন্ট টার্গেট করেছেন। আমাদের প্রোডাক্ট প্লেসমেন্টে শেখানো হত, Sensodyne এর কাস্টমার আলাদা, আবার বাবুল টুথপেস্টের কাস্টমার আলাদা, একদম ডিফারেন্ট প্রোডাক্ট প্লেসমেন্ট, আলাদা ক্যাচমেন্ট এরিয়া। ভালোই করেছেন, ছেলে দুটো তেমন দাঁড়াতে পারে নি। মাস-সেগমেন্টের, মেহনতি মানুষের প্রোডাক্ট যে এই বুটিকে কেউ দেখতে চাইবে না, এতে আর অবাক হওয়ার কি আছে।

এতক্ষণে বেশ কনফিডেন্ট ফিল করছি, শাড়ীর রঙগুলো ও বেশ ফ্যানাভাত, দুধভাত টাইপের, খেটে খাওয়া মানুষের শাড়ির রঙ যাকে বলে আরকি। বৌকে বললাম, নাহ এবারে তাহলে একটা সব্যসাচী নাও বুঝলে। বউ খুব অবাক, বলছে, এই না না, এইসবের একদম দরকার নেই, এইগুলো কেউ কেনে নাকি, পাগল হয়েছো! শাড়ির দাম দেখার জন্য, পাড়ের নীচটা উল্টে স্টেপল করা কাগজটা দেখলাম। দেখলাম শুধু আমি না, আমার পুরো গুষ্টি, আমার পুরো পাড়া হাতে কিডনি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। 
 
শাড়ি আর সৌরভ গাঙ্গুলী! শেষ অবধি কত টাকায় বিক্রি হবে কেউ আগে থেকে জানতে পারে না মাইরি।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন