বৃহস্পতিবার, ১ জুন, ২০২৩

ব্রিজভূষণ ও বিজেপি ~ বিহঙ্গ দত্ত

বিজেপি কেন ব্রিজভূষণকে রেসলিং ফেডারেশনের সভাপতি পদ থেকে সরিয়ে দিচ্ছে না?  

তার নামে যে যে মারাত্মক অভিযোগ এসেছে তাতে প্রতিটা মনুষ্যপদবাচ্য রাজনৈতিক দলেরই উচিত তদন্ত চলাকালীন তাকে সবরকম সাংবিধানিক পদ থেকে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেওয়া। অন্তত গণতন্ত্রের চূড়ান্ত লোকদেখানো ধাঁচাতেও এইটাই দস্তুর। তারপরেও এ কাজ না করার পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। এক এক করে দেখা যাক। 


১) তিনি উত্তরপ্রদেশের কাসরগঞ্জের সাংসদ। টানা ছয়বার জিতেছেন। ২০০৮ সালে স্বয়ং বিজেপিই এনাকে আস্থা ভোটে ক্রস ভোটিং করার জন্য বহিষ্কার করে। তখন তিনি সমাজবাদী পার্টিতে যোগদান করেন। ৯-এ সমাজবাদী পার্টির সাংসদ হন। ১৪-এ আবার ফিরে আসেন ভাজপা-য়। সুতরাং এটুকু বোঝা যায় উত্তরপ্রদেশের রাজনৈতিক সমীকরণে তিনি একজন বিগ ফিশ। 

২) কতটা বিগ ফিশ বুঝতে গেলে তার ট্র্যাক রেকর্ডের দিকে তাকাতে হবে। তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনায় প্রাইম সাসপেক্ট লিস্টে ছিলেন। সঙ্গীরা হলেন লালকৃষ্ণ আদবানী, মুরলি মনোহর যোশী প্রমুখ। শুধু কাসরগঞ্জ নয় উত্তরপ্রদেশের আরও বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে তার রাজনৈতিক দাপট অব্যহত। 

৩) এই রাজনৈতিক দাপট কীভাবে হল? অর্থনৈতিক ও মাসল পাওয়ার দুইয়েরই ভূমিকা আছে। ব্রিজভূষণ একটি প্রতিষ্ঠানও বটে। উত্তরপ্রদেশে অন্তত ৫০টি বেসরকারি স্কুল চলে তার মালিকানায়। বেশ কিছু টেকনো কলেজ ও গমকলের মালিক তিনি। ব্যক্তিগত প্রাসাদোপম বাড়ি, গাড়ি, জমি জায়গার ছড়াছড়ি এমনকি রয়েছে হেলিকপ্টারও। 

৪) এই প্রভাব শুধু রাজ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। গোয়া বিধানসভা নির্বাচনে তিনজন ভিন্ন দলীয় বিধায়ক কেনার ব্যাপারেও তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছিলেন। 

৫) কাহানি মে ছোটাসা টুইস্ট। এহেন ধুঁয়াধার ব্যক্তিত্বের সঙ্গে যোগী আদিত্যনাথের সম্পর্ক মোটেও সুবিধার নয়। দুইয়ের মধ্যে ভালোই ক্যাচাল আছে যা সুবিদিত। তারপরেও ব্রিজভূষণকে টলানো যায়নি। তিনি তার রাজত্ব কায়েম রেখেছেন। তার যোগাযোগ সরাসরি কেন্দ্রীয় দপ্তরের সঙ্গে। এখান থেকেই হয়তো বোঝা যায় কেন তিনি বারবার উল্লেখ করছেন- নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ না বললে তিনি পদ ছাড়বেন না। 

এই চূড়ান্ত পাওয়ারফুল ব্যক্তিত্বকে ২৪-এর আগে চটানো বিজেপির পক্ষে বিপজ্জনক। অযোধ্যার রামমন্দিরের প্রধানতম সৈনিকের সেন্টিমেন্ট জড়িয়ে আছে ওনার নামের সঙ্গে। 

এবার একটু দ্বিতীয় চ্যাপ্টারে আসুন। কুস্তি ফেডারেশন নামেই ভারতীয়। এই ফেডারেশনের সুপারস্টাররা সকলেই উত্তর ভারতের যে অঞ্চল বিজেপির একচ্ছত্র ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু। হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশের শান মান বলে চিহ্নিত করা হয় সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ পুনিয়াদের। কুস্তি ভারতে একেবারে আনপপুলার স্পোর্টস ভাবলে আপনি মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন।  হরিয়ানার ক্ষেতি করা ছেলেপুলে যতটা কোহলি বা ধোনি হতে চায় ঠিক ততটা না হলেও অনেকটাই বজরঙ্গ পুনিয়া, বা সুশীল কুমার হতে চায়। ভীনেশ ভোগট বা সাক্ষী মালিক হতে চায়। 
(সুশীল কুমার নামটি বর্তমানে ভয়াবহভাবে পরিত্যাজ্য। কেন তাও জানেন আপনারা। একাধিক নারী নির্যাতনের অভিযোগে অভিযুক্ত ইনি। অথচ কি অসাধারণ রেস্টলার ছিলেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। শুধুমাত্র এবং শুধুমাত্র ক্রীড়াক্ষেত্রের অবিস্মরণীয় ভূমিকার স্বাপেক্ষেই এই নাম রাখলাম। আজ যখন বজরঙ্গ- সাক্ষী, ভীনেশদের সঙ্গে এক রাস্তায় এক মঞ্চে মার খাচ্ছেন তখন সুশীলকে দেখে ঘেন্না ছাড়া আর কিছু পায় না। )
 সুতরাং নিজেদের ক্ষমতার কেন্দ্রের  সুপারস্টারদের চূড়ান্তভাবে হেয় করার সাহস কীভাবে বিজেপি পাচ্ছে? 

এখানেই বিজেপি ফ্যাসিস্ট। ক্লাসিক অর্থে ফ্যাসিস্ট। সে ফ্যাসিজমের সবকটা শর্ত এক এক করে পূরণ করছে। পপুলার যা সব প্রচার সে গত পাঁচ ছয় বছরে করেছে। ফ্যানবেস তৈরি করেছে। আরএসএসের মাধ্যমে সে সেই মাসের কাছে নিজের মতাদর্শ নিয়ে গেছে। সব মাস এই মতাদর্শের সঙ্গে থাকেনি। তাতে তার কিছু যায় আসেনি। সে এবার দ্বিতীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। 

"এক লাখ মানুষের কাছে জনপ্রিয় হওয়ার থেকে বেশি দরকারি দশ হাজার এমন সৈনিক তৈরি করা যারা দশ লাখকে ঠাণ্ডা রাখতে সক্ষম"। 
বিজেপির হাতে এরকম অযুত নিযুত সৈনিক আছে। তারা রাতদিন সাতদিন চায়ের দোকান থেকে সোশাল মিডিয়ায় খেটে যায়। এই কর্মীদের দেখা পেতে গেলে সাক্ষী মালিকের আজকের টুইটার যান। রিপ্লাইগুলো দেখুন। অত খাটতে না চাইলে ইনস্টাগ্রাম বা ফেসবুকের যে কোনও নিউজ পোর্টালের কমেন্টবক্সে যান। আর অন্য বিশ্ব দেখতে চাইলে পাড়ার চায়ের দোকানে দুটো বিড়ি আর এক কাপ চা নিয়ে বসে পড়ুন। দেখবেন সবকিছু পার করে 'ওদের খুব বাড় বেড়েছে' ধ্বনিই কানে আসবে। 

এই সৈন্যদল দিয়ে সবকিছু সাফ করে দেওয়া যায়। শালা, দু আনার এক বনগাঁর ক্ষেপুড়ে দেখলাম আজ এবিপির কমেন্টবমক্সে গিয়ে লিখেছে- এরা পলিটিকাল প্লেয়ার। যখন উঠেছে ব্রিজভূষণজির ব্যাক আপেই উঠেছে। আমাদের পেছনে পলিটিক্স ছিল না।'
 ওটারে আমি বনগাঁ স্টেডিয়ামে বল বয় ছাড়া কোনওদিন কোনও রোলে দেখিনি। সেও আজ অবলীলায় সাক্ষী মালিক, বজরঙ্গ পুনিয়াদের পলিটিকাল প্লেয়ার ঘোষণা করছে। অবলীলায়। আয়নাও দেখে না সোগো!   

তো দোস্তো! এই হল ব্যাপার। ফ্যাসিজম যখন ফুটে ওঠে এভাবেই ওঠে। ৩০-৪০ বছর পর এই নিয়ে ইতিহাস লেখা হবে। কোন ইতিহাস সেটা এন-ই-পি সমৃদ্ধ বাচ্চারা বলবে। যদি ট্রেণ্ড সেম টু সেম চলতে থাকে তাহলে আপনারা সাক্ষী মালিকের নাম সাক্ষী ইয়াসমিনও পড়তে পারেন ইতিহাস বইতে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন