'হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউ ? ' কাঁপা কাঁপা গলায় বললেন মা।
খুব অল্প বয়সী একজন আর্মি অফিসার দাঁড়িয়ে আছে, তার পেছনেই বহুজন। অনেকের উর্দু শুনে বোঝা যাচ্ছে তারা বিহারী।
অফিসারটি হাত তুলে একটু সালামের ভঙ্গি করে ইংরেজীতে বলল - আমার নাম ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, আমরা তোমার বাড়িটা একটু সার্চ করব।
- কেন, কী জন্য?
- এমনিই একটু রুটিন সার্চ আর কি। তোমাদের বাড়িতে মানুষ কয়জন? কে কে থাকে? তোমাদের ছেলেদের নাম কি?
রাতটি ছিল ২৯ আগস্ট রবিবার। ১৯৭১ সন। দুই সন্তান সহ স্বামীকে ধরে নিয়ে গেল তারা।
মা সারারাত ঘর বার করেন। ওরা বলেছিল আধা ঘণ্টা পৌণে এক ঘন্টার মাঝেই ফিরবে তারা। কই ফিরল না তো! এইতো কাল ও রুমী ছিল হেসে হেসে বলছিল আম্মা জানো ' সেদিন আসার সময়েও রেডিওতে একটা গান শুনেছি, ' একবার বিদায় দে মা ঘুড়ে আসি' জানি না কপালে কী আছে!
যে সন্তানকে ইঞ্জিনিয়ার বানানোর স্বপ্ন দেখেছিলেন মা 'একদিন নিজেই তাকে বললেন ' যা তোকে দেশের জন্য কোরবানি করলাম। '
সেদিনই অন্য একটা গাড়ি এসে দাঁড়ায় রাস্তায়, দৌঁড়ে গিয়ে মা দেখেন, সে স্বপন। তুমি রুমীর বন্ধু স্বপন না!
এখুনি পালাও রুমী ধরা পড়েছে। এর পরে দরজায় আস্তে টুকটুক এসেছে আরো দুজন ' ফঁতে আর জিয়া। ' ধরে নিয়ে গেছে সামাদকে খবর দিতে এসেছে ওরা। ওদেরকেও দ্রুত চলে যেতে বলেন মা।
দুদিন কাটে আর দুটো বিনিদ্র রাত। এমপি হোস্টেল থানা সবখানে খুঁজে বেড়ান মা তার সন্তানদের আর স্বামীকে। রুমীদের সাথে ভাই সাইফ ইমামকেও ধরে নিয়ে গেছে হানাদারেরা।
ওদিকে টর্চার সেলে চলছে অন্য গল্প, রুমী বাবাকে বলে আপনারা কিছুতেই স্বীকার করবেন না। কোন কিছু, আমার যা হয় হোক।
৩১ আগস্ট ছোট ছেলে জামী সহ ফিরে আসে স্বামী শরিফ । সাথে রুমী নেই। আর্তচিৎকার করে ওঠেন মা।
রুমীকে ছাড়েনি?
স্বামী সন্তানের দিকে চেয়ে দেখেন ওদের মুখে গভীর যন্ত্রণা, দুঃখ আর অপমানের ছাপ। গ্লাস গ্লাস পানি খাইয়েও তাদের তৃষ্ণা মেটানো যায় না।
' যে সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে 'রুমী ' মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। তাদের কাছে সন্তানের প্রাণ ভিক্ষা চেয়ে সন্তানের সম্মানকে নষ্ট করেননি যেই মা যে জননী
তিনিই আমাদের শহিদ জননী ' জাহানারা ইমাম।'
আজীবন সন্তানের জন্য দুঃখ বয়ে বেড়িয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান ' অসামান্য। '
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবীতে ১৯৯২ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন, ' একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। '
ক্যান্সারের সঙ্গে লড়েছেন বহুবছর। তবুও তার আন্দোলন থেমে থাকেনি। তার ডাকেই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে লাখো জনতার উপস্থিতিতে একাত্তরের ঘাতকদের বিরুদ্ধে পরিচালিত হয় গণ আদালত।
পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার সুন্দরপুর গ্রামে একদিন জন্ম হয়েছিল এই মহীয়সী নারীর। কলকাতার লেডি বেব্রোন কলেজ থেকে বি এ, ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে এম এ করেছিলেন তিনি। ঢাকা সিদ্ধেশ্বরী বালিকা বিদ্যালয়ের ছিলেন প্রধান শিক্ষিকা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষা ইন্সটিটিউটে খণ্ডকালীন প্রভাষক ও ছিলেন তিনি।
সবাই তাকে বলতো বাংলার সুচিত্রা সেন। ক্যান্সারের কারণে সেই চুল বিসর্জন দিতে হয় তাকে। কেটে ফেলতে হয় মুখের একপাশের মাড়ি। উনার চুল কাটার খবর পেয়ে সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের বড় কন্যা
'নোভাও তার চুল কেটে ফেলে। '
হুমায়ূন আহমেদ তাকে একথা জানাতেই তিনি বলেন
- আপনার মেয়েকে বলুন ' লম্বা চুল আমার খুব প্রিয়।
তার বয়সে আমার হাঁটুর সমান চুল ছিল। ' এই মহীয়সী নারী সব মানুষের হৃদয় দখল করে নিয়েছিলেন।
জাহানারা ইমাম দুইবার জন্ম নেন না। একবারই তিনি এসেছিলেন আমাদের মাঝে ।
কি পরিমান শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা জমা আছে উনার প্রতি, এই দেশের প্রতিটি মানুষের। সেটা কি তিনি কখনো বুঝতে পেরেছিলেন? হয়তো বুঝতেন তাই আবার তাদের নিয়েই আন্দোলনে নেমেছিলেন। আশার কথা এই যে সেই আন্দোলন থেমে থাকেনি।
১৯৯৪ সালের ২৬ জুন, আজকের এই দিনে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান। ওপাশের জগত থেকে আজ তিনি নিশ্চয়ই আমার বিপুল শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা অনুভব করতে পারছেন। উনি নিজ সন্তান দেশের তরে কোরবানি দিয়েছেন। তিনি তো বঙ্গ-জননী।
বাংলার পবিত্র মাটিতে তার পায়ের চিহ্ন আর পড়বে না এটা ঠিক। তবে বাংলার হৃদয়ে তিনি জ্বেলে দিয়েছেন অনির্বাণ শিখা। ঝড়-ঝাপ্টা যত প্রচন্ডই হোক না কেন সেই শিখা জ্বলতে থাকবে।
' সৌভাগ্য আমাদের, তিনি জন্মেছিলেন এই বাংলায়।'
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন