বুধবার, ১ মার্চ, ২০২৩

জাতীয় বিজ্ঞান দিবস ~ অরিজিৎ গুহ

আকাশের রঙ কেন নীল? দূর থেকে লাল রঙকে যত সহজে চিহ্নিত করা যায়, নীল রঙকে আবার অত সহজে চিহ্নিত কেন করা যায় না? অর্থাৎ যে কারণে ট্রাফিক সিগনালের আলো লাল রঙের হয় যাতে করে দূর থেকে গাড়ি সেই সিগনাল দেখেই থেমে যেতে পারে, কিন্তু নীল রঙের সিগনাল হয় না। এদিকে আবার আকাশে রামধনু উঠলে দেখা যায় বিভিন্ন আলো বিভিন্ন জায়গা অধিকার করে রয়েছে। কেন?
এই কেন'র উত্তর খুঁজতে গিয়ে বিজ্ঞানের নানা অবিষ্কার হয়ে এসেছে এখনো অব্দি। মানুষের একটা বেসিক কোশ্চেন এই কেন। খুঁজতে শুরু করলেন বিজ্ঞানীরা। অবশেষে ঊনবিংশ শতাব্দির এক প্রখ্যাত ব্রিটিশ বিজ্ঞানী, রয়াল সোসাইটির ফেলো, লর্ড র্যালে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা দিতে সমর্থ হলেন এই ঘটনার। উনি বললেন যে কোনো ধরণের তরঙ্গ যদি কোনো কণার সাথে সংঘর্ষ হয় তাহলে সেই তরঙ্গ নিজের নিজের ওয়েভলেংথ অনুযায়ী বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
ব্যাপারটাকে একটা সহজ সরল প্রাকৃতিক উদাহরণ দিয়ে বোঝালে কেমন হবে? ধরা যাক একটা কাদামাটির তাল নুড়ি পাথর সহ পাহাড়ের ঢাল দিয়ে নামছে। সেই তালে যেমন ছোট ছোট পাথরের টুকরো রয়েছে, তেমনই আবার বড় পাথরের টুকরোও রয়েছে, আবার তার সাথে বালি, মাটি এসবের সাথে জলের মিশ্রণও রয়েছে।
যখন এই কাদামাটির তালের সামনে কোনো বাধা রাখা হবে, তখন কাদামাটির স্রোত সেই বাধার সামনে ভেঙে যাবে। বড় পাথরের টুকরোগুলো যেখানে স্রোতটা ভাঙবে সেখানেই পড়ে থাকবে, ছোট পাথরের টুকরোগুলো হয়ত আরেকটু দূরে গিয়ে থামবে, আর বালি আর কাদার মিশ্রণটা পুরো ছড়িয়ে গিয়ে বাধাটার আসেপাশে গিয়ে অনেকটা দূরে ছড়িয়ে যাবে।
আলোর ক্ষেত্রে কি হয়, সাদা আলো যেহেতু অনেকগুলো আলোর রঙের মিশ্রণ (আসলে সব কটাই ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ওয়েভ), কাজেই আলোর ক্ষেত্রে বলতে পারি যে ওয়েভ যত লম্বা, মানে যার ওয়েভলেংথ অর্থাৎ একটা সাইকেলে যতটা পথ অতিক্রম করে সেটা যত বেশি, সেই ওয়েভকে তত ভারী বলতে পারি। সেই হিসেবে লাল রঙের ওয়েভলেংথ সব থেকে বেশি, মানে লাল আলো আলোদের মধ্যে ভারী আর নীল আলোর ওয়েভলেংথ সব থেকে কম, মানে সব থেকে হাল্কা।
অর্থাৎ আলো যখন কোনো বায়বীয় মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে অতিক্রম করবে, তখন সেই মাধ্যমের কণার সাথে ধাক্কা খেলে লাল আলো সব থেকে কম ছড়াবে, আর নীল আলো সব থেকে বেশি ছড়িয়ে পড়বে। লর্ড র্যালে শুধু ঘটনার ব্যাখ্যাই দিলেন না। অঙ্ক কষে বেরও করে দিলেন কোন আলো কতটা ছড়িয়ে পড়বে। এই ছড়িয়ে পড়ার ইনটেন্সিটি অর্থাৎ তীব্রতাকে আই(I) বলি আর ওয়েভলেংথ অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্যকে ল্যাম্বডা বলি, তাহলে ইন্টেনসিটি ল্যাম্বডার চতুর্থ বর্গের ব্যাস্তানুপাতিক। অর্থাৎ ইন্টেনসিটি প্রোপোরশোনাল টু ওয়ান বাই ল্যাম্বডা টু দি পাওয়ার ফোর। ঠিক এই কারণে যেহেতু নীল রঙ ছড়িয়ে পড়ে বেশি সেইজন্যই আমরা আকাশকে নীল দেখি। আবার এই একই কারণে লাল আলো যেহেতু ছড়ায় কম সেই জন্য লাল আলোকে অনেক দূর থেকেও দেখা যায়। ট্রাফিক সিগনালে লাল আলো ব্যবহার করার কারণও এটাই।

এতক্ষণ ধরে বিজ্ঞানের শুকনো কচকচি চালালাম। কিন্তু যে লেখার জন্য এর অবতারণা করেছি সেখানে এখনো অব্দি আসিই নি। ১৯০৪ সালে যখন র্যালে নোবেল পুরষ্কার পান 'আর্গন' গ্যাস আবিষ্কার এবং গ্যাস সমূহের ঘনত্ব আবিষ্কারের জন্য, তখন সেই বছরই লর্ড র্যালের দেশের এক উপনিবেশ ভারতের মাদ্রাজে মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক উজ্জ্বল ছাত্র পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক হয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে গোল্ড মেডেল পায়।
সেই ছাত্রের যখন আঠারো বছর বয়স, তখন সে একটা পেপার লিখে তার অধ্যাপকদের দেখায়। ছোটবেলা থেকেই ছেলেটির বিভিন্ন বিষয়ে অনুসন্ধিৎসা ছিল। ছোটবেলায় সে তার ভাই বোনেদের নানারকম চমৎকার চমৎকার সব বৈজ্ঞানিক এক্সপেরিমেন্ট দেখাত।
পেপারটা দেখে তার অধ্যাপকরা খুব একটা পাত্তা দিলেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন হয়ত বাচ্চা ছেলে একটা গোল্ড মেডেল পেয়ে নিজেকে কী না কী ভাবছে। পেপার তো লেখে রিসার্চ স্কলাররা। এ আবার কি পেপার লিখবে।
ছেলেটি তখন পেপারটা সরাসরি পাঠিয়ে দিল ব্রিটিশ জার্নাল 'ফিলজফিকাল ম্যাগাজিন' এ। পেপারটির নাম ছিল Unsymmetrical diffraction-bands due to a rectangular apperture. পেপারটি ছিল আলোর ধর্ম সম্পর্কিত।
এই জায়গায় অপ্রাসঙ্গিক ভাবে একটা ঘটনার কথা বলা যায়। ঠিক যে সময়ে ওই ছাত্রটির পেপার পাবলিশ হচ্ছে, তার আগের বছরই পদার্থবিদ্যার জগতে এক বিস্ময় ঘটে গেছে। সে বছর এক তরুণ জার্মান বিজ্ঞানি একসাথে 'ব্রাউনিয়ান মোশন', 'স্পেশাল থিওরি অফ রিলেটিভিটি' আর 'ফটোইলেক্ট্রিক এফেক্ট' এই তিনটে বিষয়ে তিনটে পেপার পাবলিশ করেন যা আজও পদার্থবিজ্ঞানের দুনিয়ায় এক বিস্ফোরণ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে রয়েছে। ফটো ইলেক্ট্রিক এফেক্টের জন্য পরবর্তীকালে সেই বিজ্ঞানী নোবেল প্রাইজ পান এবং ওই তিনটে বিষয়ের প্রতিটা বিষয়ই পদার্থবিজ্ঞানে এক নতুন দুনিয়ার উন্মোচন ঘটায়। তরুণ বিজ্ঞানীর নাম যে আইনস্টাইন সেটা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। ১৯০৫ সাল যেন ফিজিক্সের দূনিয়ার এক নভেম্বর বিপ্লবের সাল যা ফিজিক্সের অভিমুখ পালটে দিতে সমর্থ হয়েছিল।

ফিরে আসি সেই ছাত্রের কথায়। ফিলজফিকাল ম্যাগাজিনে পেপার পাবলিশ হওয়ার পর বিজ্ঞানী মহলে যথেষ্ঠ প্রশংসিত হয় সেই পেপার। যথারীতি লর্ড র্যালেরও চোখে পড়ে সেই পেপার। তিনি পড়ে অভিভূত হয়ে যান। আঠেরো বছরের ছাত্রটিকে প্রফেসার সম্বোধন করে আস্ত একটা চিঠিই পাঠিয়ে দেন তিনি।
১৯১৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তারকনাথ পালিতের নামে পালিত প্রফেসার বলে একটা চেয়ার তৈরি হল। ছাত্রটি ততদিনে ভারতের বিজ্ঞানের জগতে যথেষ্ঠ নাম ধাম কামিয়েছে। প্রথম পালিত প্রফেসার হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিল সেই ছাত্রটি। বিজ্ঞানী মহলে তিনি তখন পরিচিত সি ভি রমন হিসেবে।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার পাশাপাশি মহেন্দ্রলাল সরকার প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্যা কাল্টিভেশন অফ সাইন্সেও তাঁর গবেষণা চলতে লাগল। মূলত আলোর ধর্ম নিয়েই চলছিল তাঁর গবেষণা।
১৯২১ এ ভারতের প্রতিনিধি হয়ে অক্সফোর্ডে উপনিবেশ সমূহের বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মেলনে যোগ দিতে সি ভি রমন জাহাজে উঠে বসলেন। সেই সময়ে সারাক্ষণ সমুদ্রে থাকার ফলে খুব কাছ থেকে সমুদ্রকে পর্যবেক্ষণ করলেন। সমুদ্রযাত্রায় বন্ধু হিসেবে পেয়েছিলেন বিপ্লবী বিপিনচন্দ্র পালের ছেলে নিরঞ্জন পাল আর হিমাংশু রায়ের অ্যাসিস্ট্যান্ট সুকুমার যিনি পরে মধু বসু নামে বিখ্যাত চিত্র পরিচালক হন। দুজনে চলেছিলেন হিমাংশু রায়ের 'লাইট অফ এশিয়া' ছবির প্রচারে জার্মানিতে।
লর্ড র্যালে যে আকাশের নীল রঙের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন, তার সাথে বলেছিলেন আকাশের এই নীল রঙেরই প্রতিফলন ঘটে সমুদ্রের জলে, তাই সমুদ্রের জলকেও নীল দেখায়। রমন সাধারণ মানের কিছু যন্ত্রপাতি দিয়ে সমুদ্রে পরীক্ষা করে দেখলেন যে র্যালের তত্ত্ব সম্পূর্ণরূপে ঠিক নয়। তিনি দেখলেন সমুদ্রের জল নিজেও scatter করে। সূর্যের আলো পড়লে সেই আলোতে জলের অনুগুলো ঠিক তরঙ্গের মতই ছড়িয়ে পড়ে।

্যালে যখন তাঁর তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন তখন আলো যে একটা তরঙ্গ এই মতই প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু ১৯০৫ সাল আগেই উল্লেখ করেছি পদার্থবিজ্ঞানের বিপ্লবের বছরে আইনস্টাইন যে ফটো ইলেক্ট্রিক এফেক্ট আবিষ্কার করেন, যার জন্য নোবেল প্রাইজ পান, সেই তত্ত্ব দেখিয়ে দিয়েছিল যে আলো শুধু তরঙ্গ নয়। আলোর কণাও হয়। অর্থাৎ আলোর তরঙ্গধর্ম এবং কণা ধর্ম দুইই পাওয়া যায়। একে আলোর দ্বৈত চরিত্র বলা হয়। সমুদ্রের জলের নিজস্ব scattering এর ব্যাখ্যা আলোর এই কণা ধর্মের মধ্যে লুকিয়ে ছিল।
দেশে ফিরে এসে রমন এবার পুরোপুরি light scattering নিয়ে কাজ করতে শুরু করলেন। র্যালের scattering ছিল elastic scattering। অর্থাৎ এই scattering process এ শক্তির কোনো আদান প্রদান হত না। বায়বীয় মাধ্যেম বিভিন্ন আলোর ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে শক্তির কোনো তারতম্য ঘটত না। আলোর কণা ধর্ম দিয়ে যখন সি ভি রমন scattering ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন তখন উনি দেখলেন যে আলোর বিভিন্ন মাধ্যমে বিভিন্ন ভাবে ছড়িয়ে পড়ার মধ্যে আলো যে কণা দিয়ে তৈরি সেই ফোটন কণার শক্তির তারতম্য ঘটে। ফোটন কণা কখনো কখনো যে কণাগুলোর সাথে ধাক্কা লাগছে তাদের থেকে শক্তি গ্রহণ করে আবার কখনো কখনো তাদেরকে শক্তি হস্তান্তর করে। যে কণার সাথে ফোটন কণার সংঘর্ষ হয়, সেই কণাটি তখন কাঁপতে থাকে, অর্থাৎ ভাইব্রেশন হয় আর ফোটন কণার যেহেতু শক্তিক্ষয় বা শক্তির অর্জন ঘটে কাজেই সংঘর্ষের আগে আলোর যে রঙ ছিল, সংঘর্ষের পর আলোর রঙ পরিবর্তিত হয়। এই রঙের পরিবর্তন দিয়ে আমরা আলোকে কোন্ মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে প্রবেশ করানো হয়েছে সেই মাধ্যমটিকে অনায়াসে শনাক্ত করতে পারি। কোনো মাধ্যমের মধ্যে দিয়ে সাদা আলো প্রবেশ করালে যদি নির্গত আলোর রঙ হলুদ হয় তাহলে আমরা বলে দিতে পারব মাধ্যমটি সোডিয়াম।
্যালের স্ক্যাটারিং এর আরো বিস্তৃত তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন সি ভি রমন ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারির আজকের দিনে অর্থাৎ ২৮শে ফেব্রুয়ারি যা আজ রমন এফেক্ট নামে খ্যাত। এই scattering এ যেহেতু শক্তির আদান প্রদান হয়, কাজেই এই scattering কে বলে inelastic scattering. এই রমন এফেক্টের প্রথম প্রতিক্রিয়া হল আলোর কণাধর্ম আরো দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া। ফোটন পার্টিকলকে বিজয়ীর আসনে বসিয়ে দিয়ে গেলেন সি ভি রমন। এছাড়াও স্পেক্ট্রোমেট্রির জগতে এক নতুন দ্বার খুলে গেল রমন এফেক্টের ফলে।
পরপর দু বছর ১৯২৮ আর ১৯২৯ যথাক্রমে ওয়েন রিচার্ডসন আর লুই ডি ব্রগলি পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল প্রাইজ পাওয়ার পর ১৯৩০ সালে সি ভি রমন নিজের পুরষ্কার পাওয়ার ব্যাপারে এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিলেন যে জুলাই মাসেই স্কটল্যান্ডের টিকিট কেটে ফেলেন যদিও পুরষ্কার ঘোষণা হওয়ার কথা নভেম্বরে। প্রতিদিন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে খবরের কাগজে পুরষ্কার ঘোষণার খবর খুঁজতেন। অবশেষে তাঁর নাম ঘোষিত হয় এবং রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় ভারতীয় হিসেবে নোবেল পুরষ্কার জয়ী হন।

১৯৮৭ সাল থেকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি দিনটিকে জাতীয় বিজ্ঞান দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। আজকের দিনের অবৈজ্ঞানিক অবাস্তব বিভিন্ন গল্পগাঁথাকে যখন বিজ্ঞান বলে চালানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, তখন আরো বেশি করে সাধারণ ভারতবাসীকে বিজ্ঞান সম্পর্কে সচেতন করাই হোক আজকের দিনের লক্ষ্য। অপবিজ্ঞান নয়, বিজ্ঞানই হোক আজকের দিনে দেশ গঠনের হাতিয়ার।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন