শনিবার, ২৫ মার্চ, ২০২৩

দূর্নীতি কমিশন ও ম্যাডাম হীরক রাণী ~ সুশোভন পাত্র

মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা। বছর ঘুরতেই আরও ছটা। এত কমিশন একসঙ্গে জীবনে দেখেনি রাজ্যবাসী। নবান্নের চোদ্দ তলার প্রথম থাকে সে রাখল 'চিরকুটে চাকরি বিলি' কমিশন। দ্বিতীয় থাকে সে রাখল 'জমি বণ্টনে অনিয়মে'র তদন্ত কমিশন'দের। রাজারহাটের কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে সে বলল, তুই আমার 'তুরুপের তাস'। তৃতীয় থাকে রাখল সব 'গণহত্যা' কমিশনদের। ২১শে জুলাই কমিশনটাকে জড়িয়ে ধরে বলল তোর নাম 'বুদ্ধ ভট্টচাজ বধ'।
কিন্তু বছর যেতে না যেতেই ঘটে গেল সেই ঘটনাটা; বার সাতেকের নোটিশের প্যানপ্যানানি, বার তিনেকের জেরার কচকচানির পরেও, জেলে পাঠানো গেল না গৌতম দেবদের, মনীশ গুপ্ত কে বগল দাবা করেও, স্পর্শ করা গেলো না বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যর কেশাগ্র। উল্টে জেলে চলে গেলো মেয়েটার হেভিওয়েট বিধায়ক-নেতা-মন্ত্রীরা। মদন-কুণাল-সুদীপ-তাপসরা জেল ফেরত আসামী। মানিক-কুন্তল-শান্তনু-অয়নরা আপাতত ঘানি টানছে জেলের। বাইরে যারা, জেলে যাবার দিন গুনছে তারা। আর কাটমানির 'রিং মাস্টার' ভাইপোর ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলছে ইডি। মুখ্যমন্ত্রী হয়ে এগারোটা কমিশন গড়েছিল মেয়েটা! বছর ঘুরতেই আরও ছটা!
কমিশনের হাতি পুষতে খরচা রাজ কোষাগারের কোটি কোটি। সিপিএম নেতাদের পিণ্ডি তর্পণের দিবাস্বপ্নে বিগলিত বুদ্ধিজীবীরা কমিশনকে দরাজ সার্টিফিকেট বিলিয়ে বলেছিলেন "এহি হ্যা রাইট চয়েস বেবি"। মিডিয়ার ক্যাকাফনি তে সেদিন চাপা পড়ে গিয়েছিল অজিত লোহার-পূর্ণিমা ঘোড়ুই-জিতেন নন্দীদের লাশের নিস্তব্ধতা। ঠিক যেমন আজ "আঁতুড়ঘর-আলমারি-চিরকুট-ফাইল-অর্পিতা-শ্বেতার" রঙচটা খবরের ডেসিবেলে অবলীলায় অবহেলিত হচ্ছে বাস্তবটা। বাস্তব, তৃণমূল আপাদমস্তক একটা চোর-লুম্পেনদের দল! আর মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই দলের নেত্রী! পিরিয়ড! 
ডিয়ার মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিসের চিরকুট? কি আলমারি? কোন ফাইল? কার কমিশন? সিপিএম কে আপনি ভয় দেখাচ্ছেন কোন অউকাদে? আরে ম্যাডাম আপনি কি বলবেন, আমরাই আপনাকে বলছি ১২ বছরে সিপিএম-র দুর্নীতি খুঁজতে কি কি করেছেন আপনি! 
২০১২-র ৩রা জানুয়ারি, কেতাদুরস্ত রাইটার্সের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে আপনি বলেছিলেন "বামেরা দুর্নীতির আঁতুড়ঘর তৈরি করে গেছে। অডিট করানো হয়েছে। একটু একটু করে প্রকাশ্যে আনব।" 'একটু একটু করে' প্রকাশ্যে আনতে ১২ বছর লেগে গেল ম্যাডাম? ২০২২-র ১৯শে মে, ঝাড়গ্রামে আপনি বললেন, "সিপিএমের ৩৪ বছরে চিরকুট দিয়ে চাকরি হত, বদলি হত। আস্তে আস্তে চ্যাপ্টার ওপেন করব। এত দিন ভদ্রতা করে এসেছি।" এমনিতে ভদ্রতা আপনার অ্যান্টোনিম, কিন্তু 'সিপিএম-র চিরকুট' নিয়ে আপনি আদালতে যাচ্ছেন না কেন? বে-আইনি চাকরিগুলো ঘ্যাচাং ফুঁ করে টার্মিনেট করিয়ে দিচ্ছেন না কেন? ২১শে জুলাইর মঞ্চ কাঁপিয়ে আপনি হুমকি দিলেন, "সিপিএম-র ফাইল গুলো খুলব নাকি?"; আরে ম্যাডাম, পারমিশন নিচ্ছেন কেন? হিম্মত নেই কলজেতে? "বামফ্রন্ট দুর্নীতির আলমারি" ১১ বছরেও খুঁজে পেলেন না? কি অপদার্থ মুখ্যমন্ত্রী মাইরি আপনি! 
সিপিএমকে শায়েস্তা করতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কমিশন গড়েছিলেন, সাঁইবাড়ি নিয়ে। বরানগর-কাশীপুর গণহত্যা নিয়ে। বিজন সেতু, দিনহাটায় গুলি, ২১শে জুলাই, নিউটাউনে ফ্ল্যাট বণ্টন, রাজারহাটের জমি অধিগ্রহণ, গড়বেতায় হুল উৎসবের দুর্ঘটনায় আদিবাসী মৃত্যু, এমপিএস সংস্থার কাজকর্ম নিয়ে। এছাড়াও আছে আমরির অগ্নিকাণ্ড, মগরাহাটের নৈনানে গ্রামবাসীদের নিহত হওয়ার ঘটনা, সারদা কেলেঙ্কারি। বসিরহাটে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, তেহট্টে পুলিশের গুলি, বিধায়ক মোস্তাফা বিন কাশেমের মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে। মোট ১৬টা কমিশন, ১টা তদন্ত কমিটি! 
বন্ধুগণ আপনাদের ধারে পাশে তৃণমূলের কোন মাতব্বর কচিনেতা, উপনেতারা থাকলে জাপটে ধরে অনুরোধ করুন, এই কমিশনগুলোর রিপোর্ট একটু প্রকাশ্যে আনতে! জিজ্ঞেস করুন না, এই কমিশনের তদন্তের যজ্ঞে ৭ মণ ঘি ঢেলে তৃণমূলের দালাল পুলিশ কোন সিপিএম নেতা কে গ্রেপ্তার করল? 
শিক্ষাক্ষেত্রে তৃণমূলের আমলে নিয়োগে দুর্নীতি কমপক্ষে ১০০০ কোটির। স্রেফ দক্ষিণবঙ্গের ৬০টি পৌরসভাতে ৫০০০ পদে নিয়োগ হয়েছে ৫-৮ লক্ষ টাকার বিনিময়ে। মিডল-ম্যান অয়ন শীলের মাধ্যমেই কাটমানি তোলা হয়েছে ৫০ কোটি। এর সঙ্গে যুক্ত করুন বীরভূমের বীর হনুমানের গরু পাচার, বালি চুরি, জমি দখল, একের পর রাইসমিল হাতানোর, লটারি বাগানোর অঙ্ক। যুক্ত করুন ফ্ল্যাট থেকে উদ্ধার হওয়ার টাকার পাহাড়। যুক্ত করুন গ্রাম বাঙলার প্রতিটি কোণায় আবাস যোজনার ব্যাপক ও বিপুল দুর্নীতি। 
আচ্ছা, আপনি খোঁজ নিয়ে দেখুন তো, বাঙলার যেকোনো প্রান্তে, তৃণমূলের নেতা আজ কারা? কি এদের ব্যাকগ্রাউন্ড? চুরি ছাড়া এরা কি করে? তৃণমূলের র‍্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইলস ভদ্র-সভ্যর কেন ব্রাত্য? লুম্পেন বা মস্তান ছাড়া কি তৃণমূলে নেতা হওয়া যায় না? উচ্চ নেতৃত্বের মাথায় হাত ছাড়া দুর্নীতিকে এতটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া যায়? ঘাসে মুখ না দিয়ে চললে তো বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় যে, এই সমস্ত দুর্নীতির 'কিং পিন' আসলে ভাইপো। আর কুইন অফ দা কিংস, মুখ্যমন্ত্রী নিজে!    
তৃণমূলের ভাঁড়, যিনি মুখপাত্র না হয়ে সার্কাসে নাম লেখালে জোকারদের চাকরি চলে যেত, তিনি একসময় প্রকাশ্যে বলেছিলেন "সারদার সবচেয়ে বড় বেনিফিসিয়ারি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়"। ভুল বলেছিলেন? সারদা কর্তা সুদীপ্ত সেন ১৩০ কোটি টাকা দেয়নি তৃণমূলকে? ২০১১-র নির্বাচনে দেদার বিলায়নি সারদার টাকা? প্রার্থী পিছু ১৫ লক্ষ টাকার যৌতুকে ব্যবহার হয়নি গরীব মানুষকে লুটে খাওয়া এই টাকা? 
ম্যাডাম, ভুল পথে হলেও বহুদিন রাজনীতিতে আপনি আছেন। আপনি জানেন, তিনটে বিধানসভা উপ-নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপির যৌথ ভোট ক্ষয় আর বামেদের ব্যাপক ভোট বৃদ্ধি নেহাত কাকতালীয় নয়! পৌরসভা আর কর্পোরেশনে ভোটে বামেদের উত্থান নেহাত কাকতালীয় নয়! দুর্নীতি নিয়ে আপনার বিধায়কদের প্রকাশ্যে ক্ষোভ দেখানো নেহাত কাকতালীয় নয়! বিভিন্ন জায়গায় তৃণমূলের নেতাদের গ্রামে ঢুকতে না দিয়ে খেদিয়ে দেওয়া নেহাত কাকতালীয় নয়! আর তাই, ১-২০ এপ্রিল দুয়ারের সরকারের নামে আপনার পঞ্চায়েত নির্বাচনের জল মাপার চেষ্টা কাকতালীয় নয়। পাঁচ কানে আপনি যে শুনছেন, তৃণমূলে শেষের শুরু হয়ে গেছে, সেটাও আসলে কাকতালীয় নয়। 
ম্যাডাম, বাঙলা থেকে তৃণমূল খেদানোর লড়াই শুরু হয়ে গেছে। আপনি আবার সিপিএম-র ভূত দেখুন। আপনি আবার ধর্না-ধর্না খেলুন। আপনার এরকম ধর্নার ব্লু-প্রিন্ট বাঙলার মানুষ বাখুবি জানেন, আলবাত বোঝেন। আসলে কি জানেন ম্যাডাম, ধর্না বড় সস্তা, রাস্তা, আটকে দিয়েই ছাড়তো/ ছেলে মেয়েরা ভুল করেছে চাকরি পাবে ভেবে/ রেট ছিলো তো ফিক্সই, ঘুষে, কিনে নিলেই পারতো/ বেকার ছেলে, শিল্প হবে, ডিএ আটকে মামলায়/ মাননীয়ার রাজ্যপাটে সব হয়েছে ব্যর্থ/ স্যান্ডুইচে, ক্যাডবেরিতে অনশনে মত্ত/ধর্না বড় সস্তা, শিল্প তাড়িয়ে দিলেই পারতো!

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন