বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২

কেকের মৃত্যু~ সুশোভন পাত্র

- আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?
রোমান কলজিয়ামে গ্ল্যাডিয়েটর ফাইটে, সশস্ত্র যোদ্ধাদের খুন করে প্রশ্ন করেছিলেন, ট্র্যাজিক হিরো ম্যাক্সিমাস! হয়ত নজরুল মঞ্চের কনসার্ট শেষে গতকালও একই প্রশ্ন করেছিলেন কেকে! 'আর ইউ নট এন্টারটেন্ড?'  
সামাজিক মাধ্যমে ভাসছে হোয়াইট বোর্ডের ছবি। কেকের ২০টি হিট গানের লিস্ট! সম্ভবত লিস্টটা কালকের কনসার্টে কেকের গাওয়া গানের। মোটামুটি একটা সাদামাটা হিসেব, সবমিলিয়ে ১০০ মিনিটের গান। আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্ট! কলকাতার ভ্যাপসা গরম, নজরুল মঞ্চের ক্যাপাসিটির তিন-চার গুণ বেশি ভিড়, বন্ধ এসি, মঞ্চ জুড়ে উদ্যোক্তাদের উদ্ধত দাপাদাপি, বাহারি আলোর তীব্র ঝলকানি, আর অত্যুৎসাহী মাতব্বরদের র‍্যাম্পে উঠে কমপ্রেসড কার্বন ডাই-অক্সাইডের ফায়ার এক্সটিংগুইশার স্প্রে! 
সবকিছু উপেক্ষা করেই কনসার্ট শেষ করেছিলেন কেকে! কেন? কেউ বলছে, প্রফেসেনালিসজম। কেউ বলছে মোটা টাকা। কেউ বলছে উদ্যোক্তাদের চাপ। হয়ত তাই! কিম্বা হয়ত সকালে একজন শিল্পী যেমনটা বলছিলেন তেমনটাই! এত গুলো মানুষের গানের তালে উদ্বেলিত হওয়া, সুর-লয়ের মূর্ছনায় সাইন কার্ভের মত দুলে ওঠা, উচ্ছ্বাসে পাগল হয়ে ফেটে পড়া, ভালোবাসা, মুহূর্তের আনন্দে সমস্ত কষ্ট ভুলে যাওয়া ঐ মায়াবী পরিবেশের মোহময়তা –যে কোন শিল্পীই তো থ্রাইভস ফর দিস!  
সামান্য একটা গুগল সার্চ আপনাকে বলে দেবে কেকের মত প্রথিতযশা একজন প্লে-ব্যাক সিঙ্গারের আড়াই থেকে পৌনে তিন ঘণ্টার কনসার্টের আনুমানিক চার্জ ২৫-৩০ লাখ! সঙ্গে নজরুল মঞ্চের বুকিং। আনুষঙ্গিক খরচা আর পুরো ট্রুপের লজিস্টিক মিলিয়ে, জাস্ট একটা সন্ধ্যার কনসার্টের খরচা প্রায় ৩৫-৪০ লাখ! কলকাতার বহু কলেজের মধ্যে এই গুরুদাস মহাবিদ্যালয়ের একটা ফেস্টের একটা কনসার্টে এই বিপুল খরচা! চোখে লাগে না আপনার? এত টাকা আসছে কোথা থেকে? কিভাবে, কোন নিয়মে খরচা হচ্ছে টাকা? কারা এই ফেস্টের স্পন্সরার? উত্তর কলকাতার গলিতে কান পাতলে যে নাম গুলো উঠে আসবে সেগুলো কোন ছাত্র সংসদের চুনোপুঁটিদের না বরং লাল বাতি নিয়ে ঘুরে বেড়ানো রাঘব বোয়ালদের! 
বাঙলার কলেজে নির্বাচন হয়না বহুদিন। 'শিক্ষায় অনিলায়ন'র থিওরি নামানো কাগুজে বাঘরা খবরই পাননা যে প্রত্যেক কলেজে বকলমে ছাত্র সংসদের নামে লোকাল তৃণমূলে নেতার সিন্ডিকেট চলছে। নিন্দুকে বলে গুরুদাস মহাবিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নাকি প্রয়াত সাধন পাণ্ডের স্নেহধন্য! পেট্রোল-ডিজেলে সেস বেড়েছে, টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে, বাজার আরও অগ্নিমূল্য হয়েছে; তাই মা-মাটি-মানুষের দামাল ভাইরাও কন্যাশ্রীর বোন'দের আর যুবশ্রীর ভাই'দের জন্য ফি-বছরে কলেজে কলেজে অনার্সের 'রেটে' ইনক্রিমেন্ট দিচ্ছে। কোথাও ইংরেজি যাচ্ছে ৬৫হাজার! আবার কোথাও ইতিহাসে লাগছে ৩৫হাজার! 
মেধা-অধ্যবসায়-নিয়ম-নীতি এসব এখন ব্যাকডেটেড, কনটেম্পোরারি ফ্যাশনে টাকা দিলে ইউনিয়ন রুমেই মার্কশিট জমা হয়ে যাবে, পছন্দের অনার্সের রেট ঠিক হয়ে যাবে, ভর্তির জুতো সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠের আনুষ্ঠানিকতা -ইউনিয়নের দাদারা নির্ঝঞ্ঝাটে সব করে দেবে। আর দাদা'দের সাথে 'হাই-হ্যালোর' সম্পর্ক থাকলে তো কেল্লা ফতে; মদের বোতলেই কেরিয়ার একদম 'সেট' হয়ে যাবে।
নির্বাচিত ছাত্র সংসদের অবর্তমানে তৃণমূলের 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' ছাত্র সংসদের হাতে কলেজ কর্তৃপক্ষ ফি বছর ফেস্ট-ফ্রেশারের নামে কত টাকা তুলে দিচ্ছেন? ভর্তির সময়ে সাধারণ গরীব ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে আদায় করা তোলাই কি খরচা হচ্ছে এই মোচ্ছবে? সরকারের কাছে এই আয়-ব্যয়ের অডিট রিপোর্ট আছে? যে কলেজে কোন নির্বাচিত ছাত্র সংসদ নেই তারা টাকা পাচ্ছে কোন আইনি ভিত্তিতে? পাস ছাড়া কালকে কেকের অনুষ্ঠানে তো কেউ ঢুকতে পারারই কথা না। তিনগুণ ভিড় হল কি করে? জাল পাস? দায় কার? কলেজের হোতাদের না 'গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল' তৃণমূল ছাত্র সংসদের? 
হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার মত প্রজন্ম কে বিমোহিত করেছেন কেকে! সারাদিন ধরে সামাজিক মাধ্যমের দেওয়াল ভেসে যাচ্ছে আবেগে। এই মাপের একজন শিল্পীর মৃত্যুর সামাজিকরণ হবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু রাজনীতি কে বাদ দিয়ে তো এই সমাজ নয়, শিল্প কর্মও নয়। বরং সমাজের ও শিল্পের নিয়ন্ত্রক এই রাজনীতি!  আর তাই একজন শিল্পীর মৃত্যু তে বাঙলার এই রাজনীতির স্খলনটা বে-আব্রু হয়ে যাচ্ছে। 'সততা', 'রাজনৈতিক আদর্শ', 'মূল্যবোধ'–সব ক্লিশে হয়ে গিয়ে বাঙলার রাজনীতির পর্যবসিত হচ্ছে লাভ-লোকসানের অঙ্কে! পর্যবসিত হচ্ছে 'করে খাওয়ার' রসায়নে! খেলা হচ্ছে আগুন নিয়ে। খেলা হচ্ছে বাঙলার ভবিষ্যৎ নিয়ে। কেকে থেকে তুহিনা খাতুন, আনিস থেকে বিদ্যুৎ মণ্ডল -খেলা হচ্ছে মানুষের জীবন নিয়ে। 
বাঙলার শিল্পীদের বানানো হচ্ছে রাজনৈতিক বোড়ে! কেউ ভোটে দাঁড়াচ্ছেন, কেউ ২১শে জুলাইয়ের মঞ্চ আলো করছেন, কেউ কমিটি তে জায়গা পাচ্ছেন, কেউ তো সরাসরি তৃণমূলের পদাধিকারী সেজে যাচ্ছেন! সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, চার্লি চ্যাপলিন, জোন বায়েজ, বব ডিলানদের মত সত্যের প্রতি, সমাজের বহমান বঞ্চনা ও শোষণের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের দায়বদ্ধতা, আপোষহীনতা তো দূরের কথা কোদাল কে কোদাল বলার ক্ষমতা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে বাঙলার শিল্পীদের কাছ থেকে! আর যারা আত্মসমর্পণ করছেন না? তাঁদের ভাতে মারার ফন্দি হচ্ছে ১৪ তলা থেকেই! তাই কেকের মৃত্যু ঘিরে সামাজিক আবেগের বাইরে গুরুতর রাজনৈতিক প্রশ্ন গুলো কে যত্ন করে ডজ করছেন বাঙালী শিল্পীরা!
রূপঙ্করের লাইভ, কলকাতার কালচার, বাঙালির চয়েস, জনগণের সচেতনতা -এই সব এন্টিটির ফিলজফির সাবজেক্টিভিজমে কেকের মৃত্যু কে আড়াল করে আদপে লাভ নেই! কেকের মৃত্যুকে ঘিরে প্রশ্নটা অবজেক্টিভ! প্রশ্নটা নিয়ন্ত্রক শক্তির কোয়ালিটির! প্রশ্নটা তৃণমূলের রাজনৈতিক সংস্কৃতির! 
বাঙালি দীর্ঘদিন এই রাজ্যে ছাত্র সংসদের নির্বাচন দেখেছে। নির্বাচিত ছাত্র সংসদের কলেজ পরিচালনা দেখেছে। ফেস্ট দেখেছে, ফ্রেশার দেখেছে, কলেজে ভর্তি প্রক্রিয়াও দেখেছে। ছাত্র সংসদের আয় ব্যয়ের অডিট হয়েছে। হোপ ৮৬-এ বোম্বের তামাম সুপারস্টারদের অনুষ্ঠান দেখেছে। ইন্দিরা গান্ধীর উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর গলায় 'জয় ভারত/জয় বাংলাদেশের' শ্লোগানে এই তিলোত্তমা কল্লোলিত হয়েছে। ৯০'র শীতে দীর্ঘ ২৭ বছর কারাগারে কাটানোর পর ম্যান্ডেলার কলকাতা সফরে ইডেন গার্ডেনস মানবসমুদ্রের উষ্ণতা মেপেছে। দেশ বিদেশের বহু কীর্তিমানদের বাঙালি সমাদর করেছে। আপ্যায়ন করেছে। আপন করেছে। দশকের পর দশক বাঙালি বহু আবেগের সাক্ষী থেকেছে! 
এই আবেগটাই ফাইন লাইন পেরিয়ে বেলাল্লাপনা তে বদলে যায় যখন তৃণমূলের মত একটা লুম্পেন সর্বস্ব দল রাজনীতির নিয়ন্ত্রক শক্তি হয়ে ওঠে! কেকের মৃত্যু আপামর দেশের কাছে যে প্রশ্নটা আবার একবার চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে গেলো, শুধু গান স্যালুটের গর্জনে কি সেই প্রশ্ন ঢেকে রাখা যাবে মাননীয়া?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন