সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২

পাঠশালা কেন বন্ধ ~ ঊর্বা চৌধুরী

কয়েকটা বিষয় নজরে আনতে চাইছি -

১) নানা ছুতোয় স্কুলে লম্বা লম্বা ছুটি দেওয়ার ও বাড়ানোর সিদ্ধান্ত আদ্যন্ত অস্বাভাবিক একটি সরকারি শিক্ষানীতি। শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনো সরকার সাধারণত এসব ক্রুড ঘটনা ঘটিয়ে ফেলার সাহস চট্ করে দেখানোর কথা ভাবতে পারে না। আজকের জমানায় ধনতান্ত্রিক দেশেও না। 

কারণ, স্কুল বন্ধ থাকা কেবল বাচ্চার জীবনযাত্রাকে বদলে দেয় না, অভিভাবকদের জীবনযাত্রাকেও চোখে পড়ার মতো করে বদলে দেয় - সকলে সহজেই বুঝতে পারেন যে, স্কুল বন্ধের সিদ্ধান্ত তাঁদের জীবনকে সম্পূর্ণ তালগোল পাকিয়ে দিচ্ছে। কুরাজনীতির সরকার এতটা বড় গোলমাল সমাজে পাকাতে চায় না।

এটি চরিত্রে কেবল ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর নয়, সম্পূর্ণ "উৎকট" ব্যতিক্রমী রকমের ক্ষতিকর। আড়াই বছর হতে চলল এ রাজ্যে এই "একশ' শতাংশ উৎকট" ঘটনাটাই ঘটে চলেছে। 

অতএব এত বড় অনাচারের পিছনে গূঢ় কোনো বিপজ্জনক পরিকল্পনা, এবং বড়সড় পৃষ্ঠপোষকতা যে আছে - সে কথা নিশ্চিত। যা সরকারকে এ জাতীয় মোটাদাগের অনাচার চালাতে সহায়তা করছে।

২) বিপজ্জনক পরিকল্পনা সম্বন্ধে নিশ্চিত হচ্ছি কারণ, এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ করে রাখা হয়েছে কেবল নয়, বন্ধ হয়ে থাকা সরকারি স্কুলের লাখ লাখ ছাত্রের জন্য ন্যূনতম কার্যকরী কোনো বিকল্প ব্যবস্থা সরকারের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়নি, হচ্ছে না। 

আবারও উল্লেখ করছি - আড়াই বছর ধরে লাখ লাখ বাচ্চাদের সরকারি স্কুলগুলি বন্ধ করে রাখা হয়েছে এমনটাই নয় - বিকল্প কোনো বন্দোবস্ত চালু করা তো দূরের কথা, সরকারি তরফে তা কোনো চর্চার মধ্যেই নেই। 

অর্থাৎ বিদ্যালয় শিক্ষা প্রসঙ্গে এ রাজ্যের সরকার নিজেকে একশ' শতাংশ দায়হীন করে ফেলছে। দেশে রাইট অফ চিলড্রেন টু ফ্রি অ্যান্ড কমপালসারি এডুকেশন অ্যাক্ট ২০০৯ থাকা সত্ত্বেও সে দায়হীন হয়ে থাকতে পারছে। এবং এই আইনটি সংবিধানের মৌলিক অধিকার-এর ভিত্তিতে তৈরি করা। অর্থাৎ রাষ্ট্রের দরাজদিলীর ব্যাপার নয়, এটি সরকারের একটি  বাধ্যতামূলক দায় সংক্রান্ত আইন। 

সংবিধানের নির্দেশমূলক নীতির কারণে কোনো সরকার এই দায় অস্বীকার করার জায়গায় দর্শনগত দিকে থেকে ১৯৫০ সাল থেকেই ছিল না , এবং পরবর্তীকালে আইনতও ২০০৯ সাল থেকে এমন কাজ সরকার করার জায়গায় নাই।

৩) বাচ্চাদের লেখাপড়া, পুষ্টি, শারীরিক, বুদ্ধিগত, প্রাক্ষোভিক, সামাজিক, ভাব প্রকাশগত, ও নৈতিক বিকাশ, যা জড়ো করলে "শিক্ষা", তা সম্পর্কে এমন উৎকট সরকারি নীতির কথা শিক্ষাক্ষেত্রে কর্মরত কর্মীরা, শিক্ষাবিদেরা, শিক্ষা গবেষকেরা আজগুবি কল্পনাতেও আনতে পারেন কি না সন্দেহ! 

৪) যে স্কুলগুলি বন্ধ রাখা হচ্ছে সেগুলি সরকারি, সরকার পোষিত, সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ পরিচালিত - অর্থাৎ কি না এগুলি স্থায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। কোনো সাময়িক প্রতিষ্ঠান বা প্রকল্পের প্রতিষ্ঠান নয় - প্রকল্পের শুরু আর শেষ উদ্বায়ী। মূলস্রোতের প্রতিষ্ঠান কিন্তু তা নয় - এগুলি সাময়িক আপৎকালীন পরিস্থিতিতে তৈরি হওয়া প্রতিষ্ঠান নয়। এই স্কুলগুলি সমাজে কোনো ইভেন্ট ঘটানোর জন্য বা প্রতীকী কাণ্ড ঘটানোর জন্য তৈরি হয়নি। জনগণের ৩৬৫ দিনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকা দরকার মেটানোর জায়গা এই স্কুলগুলি। 

গোটা রাজ্যে আড়াই বছর ধরে বিদ্যুৎ, জল সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়া আর এই আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার মানে যে এক্কেবারে এক - সে কথা কাউকে বোঝাতে হয় না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের প্রশাসনিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন কাছাখোলা প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতেই পারে না।

নজর করাতে চাই এই সিদ্ধান্তের রাজনৈতিক তাৎপর্যটির দিকে - এমন ডেসপারেট রাজনৈতিক সিদ্ধান্তও কোনো স্বাভাবিক মাথা গ্রহণ করতে পারে না...

...যদি না শাসককে কোনো না কোনো শক্তপোক্ত ফোর্স পিছন থেকে মনোবল, কায়িক বল অবিশ্রাম জোগান দিতেই থাকে। 

এছাড়াও যেটি বলার - লক্ষ করবেন জাতীয় শিক্ষানীতি ২০২০ -র "স্কুল ক্লাস্টার/ স্কুল কমপ্লেক্স " অংশটিতে - বোঝা যাবে সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলি বন্ধ করে দেওয়ার বন্দোবস্ত সেখান থেকেই শুরু। নতুন নতুন স্কুল তৈরি করার নীতি গত শতাব্দীর ছয়ের দশক থেকে এ শতাব্দীর প্রথম দশক অবধি বাধ্যতামূলকভাবে নেওয়া হয়েছে। হঠাৎ করে পরিস্থিতির গুণগত তফাত না ঘটা সত্ত্বেও, একাধিক সরকারি স্কুল বন্ধ করে "ক্লাস্টার" করে ফেলার পিছনে কোনো  সৎ উদ্দেশ্য থাকা সম্ভবই না - সরকারি স্কুল কমাতে কমাতে শূন্য করে ফেলাই একমাত্র জাস্টিফিকেশন। 

প্রসঙ্গত, বিরাট বিরাট কর্পোরেট স্কুলের ব্যবসা করে কিন্তু বিশাল মুনাফা করে। সরকারি স্কুলের নথিভুক্ত শিশুরা এখনো তাদের খরিদ্দার নয়। তবে খরিদ্দার যে তাদের বানাতে হবেই - তা নিয়ে ব্যবসাদারের মাথা দৃঢ়নিশ্চয়। কারণ সরকারি স্কুলের বাচ্চাদের সংখ্যা বিশাল। ফলে মুনাফাও অনেক।

কর্পোরেটদের ব্যবসার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হল কর্পোরেট সোশাল রেসপন্সিবিলিটি (সিএসআর)। মুনাফা কামিয়ে না, কর ছাড় পেয়ে। এই সিএসআর-এর আওতাভুক্ত কাজকর্ম করে বিরাট কর ছাড় পাওয়া যায় - শিক্ষাক্ষেত্রও এই কাজকর্মের মধ্যে একটি এবং এদের কাজকর্মের দর্শন, মতাদর্শগত অবস্থান, কার্যপ্রক্রিয়া, লক্ষ্য, উদ্দেশ্য - গোটাটাই নানা প্রকারে গভর্নেন্সের মিনিমাইজেশানকে সুনিশ্চিত করে, যাতে সেই সূত্রে কর্পোরেটদের ব্যবসায়িক আবাদ জমিকে সুবিধাজনক অবস্থায় রাখা যায়। এ কোনো তত্ত্ব চাবানোর ব্যাপার না - ব্যবহারিক ব্যাপার। 

আবারও উল্লেখ করছি - এ রাজ্যে আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখার এ জাতীয় সিদ্ধান্তের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিকটি হল - 

স্কুল বন্ধ রেখে বিকল্প যদি কিছু বন্দোবস্ত হত, তাহলে অন্তত তা নিয়ে চর্চা, তার মানোন্নয়ন করা সম্ভব হত। 

কিন্তু এক্ষেত্রে স্কুল শিক্ষা ক্ষেত্রে এইরকম সিদ্ধান্ত নজিরবিহীন কারণ -

আড়াই বছর ধরে স্কুল বন্ধ রাখা হচ্ছে কেবল নয় - আড়াই বছর ধরে শিক্ষা প্রসঙ্গে কোনোরকম সরকারি বিকল্পের চর্চাই হচ্ছে না। গোটা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাকে একটি "অনালোচ্য" বিষয়বস্তু বানিয়ে ফেলা হচ্ছে। 

সরকারের মুখে শিক্ষা নিয়ে কার্যত তালা চাবি দিয়ে রাখা হয়েছে।

সিদ্ধান্তটি মামুলি বঞ্চনার নয়। অস্বাভাবিক। আনপ্রিসিডেন্টেড।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন