বুধবার, ২০ এপ্রিল, ২০২২

সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা ও চিকিৎসকের রাজনীতি সচেতনতা ~ বিষাণ বসু

কথাটা হলো, রাজনীতি ব্যাপারটাই খুব খারাপ। রাজনীতির লোকেরা তোয়ালে মুড়ে পয়সা নেন (আরও উচ্চপর্যায়ের লোকেরা তোয়ালে না মুড়েও নেন এবং সামান্য তোয়ালেতে ধরবে না এত বেশি টাকা নেন), পুলিশকে বোম মারতে বলেন, পুলিশকে না মারা হলেও পাব্লিকের উপর তো সে বোম পড়েই, ধর্মের নামে ঘেন্না ছড়িয়ে মানুষকে খুন করান, যতজন খুন হয় তার কয়েক হাজার গুণ মানুষ আতঙ্কে কাঠ হয়ে বাঁচেন- অর্থাৎ কিনা, রাজনীতি একটা নোংরা ব্যাপার, ভদ্রঘরের লেখাপড়া জানা ছেলেমেয়েদের ওদিকে পা না বাড়ানোই ভালো। এমনকি, লেখাপড়া জানা আপাতদৃষ্টিতে ভদ্রঘরের লোকজন যখন রাজনীতি করত, তখনও, আপনি জানেন, বা না জানলেও বারবার একই কথা শুনতে শুনতে আজকাল নিশ্চিত মানেন, সুজলা-সুফলা রাজ্যের শিল্পসম্ভাবনা শেষ করে দিয়েছে ওই পলিটিক্স-ই। আজও যখন মিটিং-মিছিলের কারণে - বনধ হলে তো কথা-ই নেই - আপনাকে রাস্তায় আটকে যেতে হলে দাঁতে দাঁত ঘষটে বলেন, সেই পলিটিক্স করে করে রাজ্যটা শেষ হয়ে গেল, তাতেও শিক্ষা নেই…

অতএব, নিজের সন্তানদের পলিটিক্স থেকে দূরে রাখেন তো বটেই, আপনি নিজেও রাজনীতি যথাসম্ভব এড়িয়ে চলেন। তাছাড়া আপনি চিকিৎসক। মহান পেশা। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে মানুষকে সুস্থ করে তোলার নিরন্তর দায় আপনার 'পরে ন্যস্ত। সেখানে রাজনীতির ক্ষুদ্রতা কি আপনাকে সাজে!!

কিন্তু কী গেরো দেখুন, বহুশ্রুত কমলি-র মতোই, আপনি রাজনীতি এড়িয়ে থাকতে চাইলেও, রাজনীতি কিছুতেই আপনাকে ছাড়তে চায় না। কীভাবে? আপনি হয়ত উত্তরটা ভাবছেন এভাবে - অমুক নেতাকে ম্যানেজ করে ডা. তমুক ঘরের কাছে বহাল তবিয়তে পোস্টিং পেল, কিন্তু আমাকে গত চোদ্দ বছর ধ্যাড়ধেড়ে গোবিন্দপুরে পড়ে থাকতে হচ্ছে! অথবা, তমুক লোকাল নেতা প্রায়শই হাসপাতালে এসে ঝামেলা করেন, কিন্তু হাসপাতালের দরকারের সময় তাঁর টিকির ডগাটি মেলে না। কিংবা… নাহ্, ফর্দ বাড়ানোর দরকার নেই, ব্যাপারটা আপনি জানেন, সুতরাং একগাদা উদাহরণ নিষ্প্রয়োজন।

অথচ, শুধু নিজের কর্মক্ষেত্রটির কথাও যদি ভাবতে চান, তাহলেও ক্ষুদ্র দলীয় রাজনীতি বা তার অপপ্রয়োগের বাড়বাড়ন্তের পিছনে আসল রাজনীতিটা আপনার চিনতে পারা জরুরি। রাজনীতি করুন বা না করুন, রাজনৈতিক সচেতনতা খুব দরকার। আপনি যদি চিকিৎসক হিসেবে গর্ব বোধ করতে চান, রাজনীতি সচেতনতা বাদ দিয়ে তেমন আত্মশ্লাঘা একেবারেই অবান্তর। কিন্তু কেন?

আপনি যদি অনেক বছর ধরে চাকরি করে থাকেন, তাহলে নিশ্চিত লক্ষ করেছেন, অন্তত শহরাঞ্চলে তো বটেই, সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রে কারা পরিষেবা গ্রহণ করেন, সে ব্যাপারে প্রায় মৌলিক শ্রেণীপরিবর্তন ঘটে গিয়েছে। উচ্চমধ্যবিত্ত তো বটেই, মধ্যবিত্তও আর সরকারি হাসপাতালে আসেন না। ইদানীং নিম্ন-মধ্যবিত্তও যথাসাধ্য না আসার চেষ্টা করছেন। সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্র প্রায় পুরোপুরিভাবে নিম্নবিত্ত রোগীদের চিকিৎসা কেন্দ্র। সে হোক গে, তাতে কী-ই বা যায় আসে!! তাই না? না, বিশ্বাস করুন, যায় আসে। আমাদের গরীব দেশে, দেশের অধিকাংশ মানুষই নিম্নবিত্ত, এমনকি হতদরিদ্র। গণতন্ত্রের বিচারে তাঁরা অনিবার্যভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু কণ্ঠের বিচারে যদি বলেন, বা কণ্ঠ শুনতে পাওয়ার বিচারে যদি ভাবেন, তাহলে সবচাইতে উচ্চকিত কণ্ঠ মধ্যবিত্তের। তাতে কী? হ্যাঁ, তাতে অনেক কিছু। ক্রমবর্ধমান আত্মকেন্দ্রিকতার বাজারে নিজের গায়ে আঁচ আসা অব্দি মানুষ কিছুই বলে না। সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যেহেতু মধ্যবিত্ত নিজের চিকিৎসা করান না, তাই সেই ব্যবস্থা ভেঙে পড়লেও মধ্যবিত্তর কিছু যায় আসে না। বরং তাঁরা অনেক বেশি বিচলিত পাঁচতারা কর্পোরেট হাসপাতালের বাড়তি বিল নিয়ে - সরকারের কাছে তাঁদের প্রত্যাশা, সরকার যাতে সেদিকে কড়া নজর রাখেন ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন - সেই প্রত্যাশার ব্যাপারে সরকারও সচেতন, অতএব নিয়মিতভাবে ঘোষণা হয়, কর্পোরেট হাসপাতালে লাগামছাড়া খরচের বিরুদ্ধে সরকার উপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। এই সব হৈ-হুল্লোড়ের মাঝে কেউ প্রশ্নই করে না, সরকারের তো নিজের হাতেই একখানা স্বাস্থ্য-পরিকাঠামো রয়েছে; পড়শির (অর্থাৎ বেসরকারি হাসপাতালের) ঘরের হ্যাপা দেখার পাশাপাশি সরকার বাহাদুর নিজস্ব স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি কেমন সামলাচ্ছেন? হ্যাঁ, আপনার কর্মক্ষেত্র, অর্থাৎ সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি নিয়ে সরকার তো ভাবিত ননই, সেই ব্যবস্থার অব্যবস্থা বা খামতি নিয়ে আজকাল কেউ প্রশ্নই করে না। ভয়টা সেখানেই। বিশ্বাস করুন, আপনি রাজনীতিকে যতই ঘেন্না করুন, রাজনীতি না বুঝলে আপনি এই সমস্যার আসল চেহারাটা ধরতে পারবেন না।

তবে কি সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থা নিয়ে কথা একেবারেই হয় না? সরকারের কি এদিকে নজর একেবারেই নেই? না না, বালাই ষাট, অবশ্যই আছে। মধ্যবিত্ত নিজেদের চিকিৎসা করাতে সরকারি হাসপাতালে না আসুক, অন্য কারণে আসে তো। ড্রাইভারের পা ভাঙলে, কাজের মাসি অসুস্থ হয়ে পড়লে, এমন ইতিউতি দরকারে আসতে তো হয়ই। এসে তাঁরা দেখেন, হাসপাতালে নতুন বিল্ডিং হচ্ছে, বিল্ডিং-এ নতুন রঙ পড়েছে, মস্ত উঁচু আলোয় ভরা গেট হয়েছে - দেখেটেখে তাঁরা খুশি, অন্তত অখুশির কারণ তো নেই। অবশ্য চিকিৎসা করাতে গেলে…

হ্যাঁ, চিকিৎসা করাতে গেলে তাঁরা জানতে পারতেন, হাসপাতালে প্রায় সর্বস্তরে নিয়োগ সঙ্কুচিত। গত এক দশকে দন্ত-চিকিৎসক নিয়োগ পুরোপুরি বন্ধ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও রীতিমতো কম। মেডিকেল অফিসার বলতে অনেকাংশে কন্ট্র‍্যাকচুয়াল ডাক্তার, বা সদ্য এমডি/এমএস পাস করে বন্ডে থাকা ডাক্তার। পরিকাঠামোর কথা বলতে, গত এক দশক ধরে সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার ডায়াগনস্টিক সার্ভিস অংশটা প্রায় পুরোপুরিভাবে প্রাইভেট সেন্টারের হাতে - পাব্লিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপ ওরফে পিপিপি মডেলের দৌলতে। বহুলপ্রচারিত 'সব ওষুধ ফ্রি'-ও এখন হাস্যকর কথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এতশত কথা আর কে-ই বা শুনছে!!

বড়লোক থেকে মধ্যবিত্ত শ্রেণী, তাঁদের চিকিৎসার জন্য কর্পোরেট হাসপাতাল - আর গরীবের চিকিৎসা হবে সরকারি হাসপাতালে। ব্যবস্থাটা দিব্যি ছিল। কিন্তু মুশকিল হলো, চিকিৎসা ব্যাপারটা এমনই সেনসিটিভ আর বিজ্ঞাপনের রমরমার সুবাদে পাঁচতারা হাসপাতালে চিকিৎসা করাতে পারাটা এমনই "অ্যাস্পিরেশনাল" হয়ে গিয়েছে, যে, এতখানি অসাম্য দীর্ঘদিন চলতে পারে না। ক্ষোভ অবশ্যম্ভাবী। আপনি যদি দীর্ঘদিন সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত থেকে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই লক্ষ করে থাকবেন, সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থার মুখাপেক্ষী যাঁরা, তাঁদের অধিকাংশের বডি ল্যাঙ্গুয়েজে পরিষ্কার যে তাঁরা নিরুপায় হয়েই এই হাসপাতালে এসেছেন। অর্থাৎ আসাটা "বাই চয়েস" নয়, আসা "বাই কম্পালসান"!! এমতাবস্থায়, আশানুরূপ ফল না পেলেই - কথাটা আরেকবার পড়ুল, আশানুরূপ চিকিৎসা নয়, চিকিৎসায় আশানুরূপ ফল না পেলেই - হাসপাতালে ভাঙচুর বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মারধর অবশ্যম্ভাবী। সেরকম ঘটনা যে ঘটেছে, তা আপনিও জানেন। কিন্তু আপনি তো ঘটনাগুলোকে বৃহত্তর রাজনীতির প্রেক্ষাপটে চিনতে চাননি। চানও না। তাই তো?

তা বেশ। এসবেরই মধ্যে মুখ্যমন্ত্রী খ্যাতিমান গায়িকাকে "বেটার ট্রিটমেন্ট"-এর জন্য রাজ্যের সেরা সরকারি হাসপাতাল থেকে কর্পোরেট হাসপাতালে সরানোর তোড়জোড় করবেন, পাড়ার ছুটকো নেতা থেকে মন্ত্রীসান্ত্রী, সবাই চিকিৎসা করাবেন বেসরকারি হাসপাতালে (ব্যতিক্রম - যদি না তাদের পুলিশ ধরতে আসে), স্বাস্থ্যসাথী কার্ড চালু করার সময় ঘোষণা হবে, এবার থেকে সবাই "বেস্ট ট্রিটমেন্ট" করাতে পারবেন - অর্থাৎ জনসাধারণের চোখে পাঁচতারা হাসপাতাল যে সত্যিই স্বপ্নের মায়াপুরী, সে নিয়ে তিলমাত্র সন্দেহ থাকবে না - আর সরকার আপনাকে বলবেন, সরকারি হাসপাতালে যাতে "স্বাস্থ্যসাথী কেস" বাড়ে, সে দিকটায় নজর দিতে, যদিও সরকারি হাসপাতালে তো সব চিকিৎসাই ফ্রি, সেখানে আবার কার্ডের প্রশ্ন আসছে কেন!!

অতএব, আপনার "রাজনীতি খুব নোংরা ব্যাপার" বুকনির মাঝেই আপনার কর্মক্ষেত্রটির মান - গুণগত ও সম্মান, উভয়ার্থেই - তলানিতে এসে ঠেকেছে। এবং সেই সঙ্গে সরকারি চিকিৎসক হিসেবে আপনার সম্মানও। আমার এক অগ্রজপ্রতিম শিক্ষকের স্কুলপড়ুয়া সন্তান বাবাকে বলেছিল - জানো তো, আগে লোকে বলত, যাদের কোত্থাও যাওয়ার উপায় নেই, তারাই সরকারি হাসপাতালে যায়, এই কথাটা আগে পেশেন্ট নিয়ে বলত, এখন ডাক্তারদের নিয়েও বলে। মানে, যে ডাক্তাররা অন্য কোথাও কাজ পান না, তাঁরাই সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থায় যোগ দেন। তার পর থেকে সেই চিকিৎসক-শিক্ষক কোথায় কর্মরত এই প্রশ্নের জবাবে সরকারি মেডিকেল কলেজের নামটি গোপন রেখে যে প্রাইভেট হাসপাতালে তিনি ভিজিটিং কনসালট্যান্ট, সেই হাসপাতালের নামটি বলে থাকেন।

তবে ঘটনাটা শুধু ওঁর ক্ষেত্রে সত্যি, এমন নয়। আজকাল সবাইকেই বলতে শুনি, আমি চাকরির উপর ডিপেন্ড্যান্ট নই, আমার প্র‍্যাক্টিস আছে। খুবই ভালো কথা। কিন্তু, প্লিজ, অন্যভাবে ভাবতে শুরু করুন। জোর গলায় বলুন, হ্যাঁ, আমি সরকারি চাকরি করি। এই চাকরির মাইনেয় আমার সংসার চলে। এই ব্যবস্থাটার ভালোমন্দের সঙ্গে আমার ব্যক্তিজীবনের ভালোমন্দ জড়িয়ে। অতএব, বৃহত্তর স্বার্থেই বলুন বা ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে - সরকারি স্বাস্থ্যব্যবস্থাটি যেন মজবুত হয়, সে ব্যাপারে গলা তুলুন।

হয়ত আপনিই ঠিক। রাজনীতি হয়ত খুবই নোংরা ব্যাপার। কিন্তু রাজনীতি সচেতন না হলে সঙ্কটের রূপ আপনি বুঝে উঠতে পারবেন না। এও হয়ত ঠিক, যে, আপনি একা সচেতন হয়ে কিছুই করে উঠতে পারবেন না। কিন্তু শিশু যখন প্রথম পা ফেলে, প্রথম ইশকুলে যায় - সে বহুদূর যেতে পারবেই এমন নিশ্চয়তা থাকে না। তবে অনেকেই যায় শেষমেশ। অনেকে পারে না, সেও ঠিক। তবু, পা-টা ফেলতেই হয়। ওটাই শুরু। ওটা না হলে কিছুই হয় না।
একা একা না পারলেও অনেকে মিলে অনেকটাই হয়। অনেক কিছুই করা যায়। তাই বলি, রাজনীতি সচেতন হোন। ব্যক্তিগতভাবে। গোষ্ঠীবদ্ধভাবেও। এটুকু হতে না পারলে কিছুই এগোনো যাবে না।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন